শিল্পীর জনপ্রিয়তাকে কি ভাবে দেখব? জনপ্রিয় শিল্প অর্থে সে কি জনতার শিল্প? মানে আমজনতার পছন্দের শিল্পকলা? আরেকটু অন্যভাবে বললে, তাকে কি বাজারের বিনোদনের সঙ্গে জড়িয়ে দেখতে হবে, আভিজাত্যের কোঠায় ফেলতে মানা? আর্টের বিচারে এমন নানান তর্ক উঠে আসে। কারও মতে জনপ্রিয়তা আর উৎকর্ষ…এ দুটো শব্দের অবস্থান খানিকটা বিপরীত মেরুতে। তাহলে কি এটাই বুঝব, উৎকর্ষের দরজা দিয়ে জনপ্রিয়তার প্রবেশ ঘটতে পারে না, দুজনের ঠাঁই ভিন্ন ভিন্ন এলাকায়? জনপ্রিয় শিল্প ও তার রচনাকার কি তবে মাথা হেঁট করে রইবে আলাদা কোঠায়…আভিজাত্যের চৌকাঠের বাইরে! এই ধরনের একটা তর্ক আমাদের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে, জনপ্রিয় শিল্প-সাহিত্যে নিশ্চিত ভাবে বৈদগ্ধ থাকে অনুপস্থিত। সেটাকে অবশ্যম্ভাবী হিসেবে ধরে নেওয়া হয়…যেখানে কেবল মধ্যমেধার কারিকুরি, যা কিনা গভীরতাহীন চপল ও চটুল!
কেবলমাত্র জনতাকে খুশি করার প্রয়াস। এভাবে কি গড়ে নিতে হবে ভাল-মন্দের সংজ্ঞা? আমাদের মন কি এই সরলীকরণে সায় দেবে? অনেকেই বলবেন, শিল্পকলার আখড়ায় এমনতর অবুঝ নিদান ধোপে টেকে না। এ নিয়ে বিপুল বাগাড়ম্বর চলতে থাকবে, থামবে না। আবার আজকে দেখি, তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্যেও তুমুল লড়াই চলেছে। সে কাগজের হেডলাইন হোক বা সংবাদ মাধ্যমের উত্তেজক কথাবার্তায়। এক ধরনের নেগেটিভ পপ্যুলারিটির পিছনেও সকলে যেন ছুটে চলেছে। আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আমাদের সীমানা স্বতন্ত্র, আধুনিক শিল্পকলার পটভূমির দিকে। শিল্প-সাহিত্যের জনপ্রিয়তা আর উৎকর্ষ ঘিরে নিজের মনে এতক্ষণ যে তর্কাতর্কি চলল, তার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে যামিনী রায়ের ছবি।



কিন্তু এসবের পাশাপাশি তাঁর কাজ নিয়ে বয়ে চলে আরেকটা সমান্তরাল স্রোত… যেখানে ছড়ানো আছে কলারসিকদের অদৃশ্য ছাঁকনি। বিশ্লেষণের চাদরে ঢাকা শিল্পালোচনার সে অপর পিঠে লাগানো আছে শিল্পবিচারের নিশ্চল থার্মোমিটার। সে হল আমাদের সহজাত ইমোশনকে সরিয়ে রেখে খোলা মনে ছবি-বিচারের মাপকাঠি। আর সেখান থেকেই উঠে আসে যামিনী রায়ের ছবির অতি-অলঙ্করণের দোষ, ছবিতে প্রাণের উত্তাপকে সরিয়ে রেখে নিপুণতার ঝোঁক দেওয়ার দুর্মর প্রবণতার কথা ইত্যাদি। দীর্ঘদিন আমরা নানাভাবে শুনে আসছি এই বিচিত্র বিতর্ক। একদল তাঁর ছবির পক্ষে প্রবলভাবে সওয়াল করেন, আর স্বভাবতই অন্যদল তা মানতে নারাজ। এক নম্বর দল যদি বলেন, যামিনী রায়ের ছবিতেই প্রথম পূর্ব-পশ্চিমের মিলন সংঘটিত হয়েছে, তিনিই আমাদের প্রথম আধুনিক চিত্রকর… তো বিপরীত দিক থেকে উচ্চারিত হয় ভিন্ন মত। অনেকের মতে যে কোনো মাধ্যমেই শিল্পের একাধিক স্তর থাকে। আর চিত্রকলায় এও একটা বিশেষ দিক, যে তাকে যখন এক লহমায় অনায়াসে কপি করে নেওয়া যায়, তখন সে প্রায় ক্রাফ্টের সামিল।
এই দ্বিতীয় দলের মত, নিঃসন্দেহে তাঁর ভাবনায় অভিনবত্ব ছিল, প্রকৃত অর্থেই তাঁর হাতে জোর ছিল, নিশ্চিতভাবেই তিনি ‘চিত্রকলাদেবী’কে পৌঁছে দিয়েছেন এক বিশেষ উচ্চতায়। কিন্তু খ্যাতির শিখরে পৌঁছানোর পরে শিল্পীকে আর সেভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় না, স্তিমিত হয়ে এসেছে শিল্পীর অন্তরের ক্ষুধা। খেয়াল করলে দেখা যাবে, পরবর্তীকালে জীবনের দীর্ঘ পর্বে একটা নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে তাঁর চিত্রীসত্তার মানস-মুভমেন্ট। শিল্পীর মনের গহনে নিজেকে ভাঙা-গড়ার যে নিরন্তর প্রয়াস সর্বদা সঞ্চারিত হয়, আর্টিস্টের সেই ঝুঁকির সীমা থেকে তিনি সরে এসেছিলেন নিরাপদ দূরত্বের সতর্ক এলাকায়। তাই একদা তাঁর ছবিকে কেন্দ্র করে জনতার যে আগ্রহ বা ক্রেজ তৈরি হয়েছিল… পপ্যুলারিটির সেই আবর্তকে যামিনী রায় আর অতিক্রম করতে চাননি বা পারেননি।

যামিনী রায়ের শিল্পকলা প্রসঙ্গে আলোচনায় এমনতর ভাবনার কথা আজ কলারসিকদের মুখে মুখে ফেরে। কখনওবা অবাঙালী শিল্পীদের মুখে যামিনী রায় প্রসঙ্গে বলতে শোনা যায় ‘তিনি ছিলেন কলকাতার কবিকূলের আদরের গোপাল।’ এ কথার সত্যতা আংশিক হলেও হয়তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিষ্ণু দে বা বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে যামিনীর প্রীতিস্নিগ্ধ সম্পর্কের কথা আমাদের অজানা নয়। তাঁর খ্যাতির নেপথ্যে এই বিশেষ ভালোবাসা নিশ্চয় কিছুটা কাজ করে থাকবে। কিন্তু শুধু এর জেরেই একজন শিল্পী এমন খ্যাতির শিখরে উঠতে পারেন বলে বোধ হয় না।

একটু তলিয়ে দেখলে মনে হয়, এ ব্যাপারে যামিনী রায়ের শিল্পী জীবনের প্রেক্ষাপটটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাঙলার লোকশিল্প, পোড়ামাটির কাজ ইত্যাদিকে ভর করে তিনি যে শিল্পশৈলী গড়ে তুলেছিলেন…তাঁর সঙ্গে আধুনিক বিশ্বশিল্পের একটা দৃশ্যগত সাদৃশ্য ক্রমশ তৈরি হচ্ছিল। খোলা চোখে দেখা শিল্পসাদৃশ্য সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে দেরি হয়নি। মাতিস-পিকাসো-পটচিত্রের দুর্বার সংমিশ্রণে গাঁথা ছবির দৃশ্যগুণের সঙ্গে যামিনী রায়ের ছবিকে সকলেই একাসনে বসিয়ে দেখতে চেয়েছেন। আন্তর্জাতিক চিত্রকলার এই সিনারিয়োর মধ্যে দিয়ে যে তাঁর শিল্পের বিশেষ জনপ্রিয়তা এসেছে…এ কথা বলতে আজ বাধা নেই। তবে এও ঠিক যামিনী রায় বরাবর নিজেকে পোটো হিসেবে প্রচার করেছেন। ছবির মূল্য প্রসঙ্গেও তিনি নিজেকে নামিয়ে এনেছেন প্রায় পটুয়াদের সারিতে। তাদের মতো একটি ছবির একাধিক প্রতিমা রচনাতেও তিনি অবিচল থেকেছেন।এই সবকিছুই তাঁর শিল্পভাবনার অন্যতম দিক। এ যেমন তাঁর ছবির অঙ্গ, তেমনি তাঁর খ্যাতি প্রসিদ্ধি তথা জনপ্রিয়তার অন্যতম চাবিকাঠিও বটে।
বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী সুশোভন অধিকারী একইসঙ্গে শিল্প-ঐতিহাসিক এবং সংরক্ষক। একদা কলাভবনের ছাত্র হিসেবে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। পরে সেখানেই তত্ত্বাবধায়ক পদে কর্মরত ছিলেন দীর্ঘকাল। বর্তমানের রবীন্দ্র-গবেষকদের মধ্যে তাঁর নাম অগ্রগণ্য। রবীন্দ্র চিত্রকলা নিয়ে রয়েছে বিশেষ অধ্যয়ন ও চর্চা। মাস্টারমশাই নন্দলাল নামে তাঁর লেখা বই পাঠকমহলে বহুল সমাদর পেয়েছে।