রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর। ইতিহাসের নথিতে যে শহরের নাম লেখা রয়েছে ব্রিটিশপূর্ব ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শহর হিসেবে। এশিয়ার সাতটি সেরা পর্যটনকেন্দ্রের অন্যতম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে জয়পুর। সে শহরের যন্তর-মন্তর আর আদিভূমি আমের দুর্গ, ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট –এর তালিকাভুক্ত হয়েছে। এখন কথা হল, সুদূর অতীত থেকে আজ পর্যন্ত এই যে জয়পুর শহরের এত খ্যাতি, জানেন কি, তার নেপথ্যে এক কৃতী বাঙালির অবদান রয়েছে? আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। বাঙালি। নৈহাটিতে জন্ম নেওয়া এক বঙ্গসন্তান, যাঁর নাম বিদ্যাধর ভট্টাচার্য। ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শহর (Planned city) জয়পুরের স্থপতি তিনি। তবে বহু প্রজন্মের কাছেই তিনি এবং তাঁর অবদান বিস্মৃত, উপেক্ষিত।
এক চৃড়ান্ত আধুনিক শহরের পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিরল কৃতিত্বের জন্য কোনও সম্মানের শিরোপা তাঁকে দেওয়া হয়নি। এমনকী ইতিহাসের পাতাতেও বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের নাম সেভাবে লেখা নেই বললেই চলে। তাঁর জন্মস্থান নৈহাটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতো ভূমিপুত্রদের কথা স্মরণ করলেও, বিদ্যাধর ভট্টাচার্য সেখানে ব্রাত্য। তিনি রয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির অন্তরালে। শুধু তাঁর কর্মভূমি জয়পুরের প্রাচীন সরকারি নথিপত্রের ক্ষয়াটে পাতায় মিশে রয়েছে তাঁর ধূসর স্মৃতি। জয়পুর শহরের কিছু কিছু স্মারকের মধ্যে আজও অদৃশ্য অক্ষরে অক্ষয় হয়ে রয়েছে বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা, শিল্পশৈলীর কল্পনা। আজ আমরা প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এ-ওয়ান সিটি নির্মাণের জন্য বাহবা কুড়োই। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে, শুধুমাত্র দেশজ প্রথায় প্রাকৃতিক উপাদানের ওপর নির্ভর করে নিজের স্থাপত্যভাবনায় এই বিদ্যাধর ভট্টাচার্যই জন্ম দিয়েছিলেন জয়পুর শহরের, শিল্প আর বাস্তুশাস্ত্রের মিল ঘটিয়ে। রাজপুত, মোগল আর ব্রিটিশ স্থাপত্য ঘরানার সমন্বয়ে।
বিদ্যাধর ভট্টাচার্য নৈহাটির লোক ছিলেন সেকথা আগেই বলেছি। তাঁর বাবার নাম ছিল সন্তোষরাম ভট্টাচার্য। তবে কীভাবে নৈহাটি থেকে সুদূর রাজস্থানে গিয়ে পড়েছিলেন বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের পরিবার, সে কথা জানবার আজ আর কোনও উপায় নেই। সম্ভবত তিনি আমের (তৎকালীন অম্বর) শহরের রাজদরবারে জুনিয়র অডিটরের চাকরি পেয়েছিলেন ১৭২৭ সাল নাগাদ। সেই সূত্রেই রাজস্থান যাওয়া। আর সেই সূত্রেই তরুণ বিদ্যাধরের গাণিতিক দক্ষতা, স্থাপত্য, প্রাচীন বাস্তুশাস্ত্রের প্রতি অনুরাগ চোখে পড়ে যায় তৎকালীন আমের-রাজ দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিংয়ের।

আসলে রাজা দ্বিতীয় জয় সিং নিজেও ছিলেন কৃতবিদ্য পুরুষ। শৈশবেই মোগল বাদশাহ ঔরংজেব তাঁর বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ‘সওয়াই’ উপাধি দেন। সওয়াই অর্থে চারগুণ। অর্থাৎ দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিং যে তাঁর পূর্বসূরি এবং সমসাময়িকদের চেয়ে বিদ্যাবুদ্ধিতে অনেক এগিয়ে ছিলেন, তা স্বীকার করেছিলেন খোদ মোগল বাদশা। পরিণত বয়সে জয় সিং হয়ে ওঠেন একদিকে দক্ষ প্রশাসক, অন্যদিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে, পূর্তবিদ্যায়, গণিতে পারদর্শী। অম্বরের সিংহাসনে তাঁর রাজ্যপাট ভালোই চলছিল। কিন্তু একসময় রাজ্যের ওপর ঘনিয়ে এল কালো মেঘ। মুর্শিদকুলি খাঁয়ের মৃত্যুর পর সুজাউদ্দিন খাঁ সিংহাসলে বসলে মোগল সাম্রাজ্যবিস্তারের নিশানা হয়ে উঠতে লাগল করদ রাজপুত রাজাদের শহর, অম্বর। মধ্যভারত থেকে মারাঠাদেরও নজর পড়তে শুরু করল অম্বরের ওপর। এদিকে অম্বরে তখন দুর্ভিক্ষ, জলাভাব, অত্যধিক জনসংখ্যা। অতঃপর দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিং এসব বিপদ থেকে মুক্তি পেতে স্থির করলেন অম্বর থেকে রাজ্যপাট তুলে অন্য কোথাও নিয়ে যাবেন। কোথায়? জায়গা পছন্দ হল আমের থেকে এগারো কিলোমিটার দূরে। কিন্তু সেই ধূধূ প্রান্তরে রাজধানী গড়বে কে? রাজপুতদের মধ্যে অত দক্ষ স্থপতি কোথায়? রাজার মনে পড়ল বিদ্যাধরের কথা। তিনি থাকতে ভাবনা কী? বিদ্যাধরের উপরেই ভার পড়ল জয় সিংয়ের নয়া রাজধানী সাজাবার।

চরম উৎসাহে বিদ্যাধর ভট্টাচার্য পড়াশুনো শুরু করে দিলেন। কখনও টলেমি, ইউক্লিডের জ্যামিতিক নকশার বই, কখনও প্রাচীন শিল্পশাস্ত্র, বাস্তু কিংবা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই। আলাপ আলোচনা চলতে লাগল রাজার সঙ্গে। অবাক হতে হয় একথা জানলে যে, রাজা দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিং সেইসময় ইউক্লিডের জ্যামিতির অনুবাদ করিয়েছিলেন সংস্কৃতে। যাইহোক, বিদ্যাধর ভট্টাচার্য ঠিক করলেন শিল্প, গণিত এবং বাস্তুশাস্ত্রের মূল সূত্রগুলি অনুসরণ করবেন নগরনির্মাণে। যেই কথা সেই কাজ। শুরু হল মহাযজ্ঞষ যা শেষ করতে প্রায় চার বছর সময় লেগেছিল বিদ্যাধরের। প্রথমে রাজার নামানুসারে নতুন রাজধানীর নামকরণ করা হয়েছিল সওয়াই জয়নগর। পরে নামসংক্ষেপে তা হয়ে দাঁড়াল সওয়াই জয়পুর, আরও পরে শুধু জয়পুর। মোটামুটিভাবে ১৭৩১ সাল নাগাদ জয়পুরের নির্মাণকাজ শেষ হল। যে কৌশল, পরিকল্পনা আর নকশায় বিদ্যাধর ভট্টাচার্য জয়পুর শহর তৈরি করেছিলেন, তা এখনকার অত্যাধুনিক বাস্তুকারদের কাছেও বিস্ময়! জায়গার নির্বাচনও অসাধারণ। অম্বরের দুর্গ পাহাড়ি এলাকা থেকে সরিয়ে জয়পুরের সমতলে বানানো হল। যদিও দূরে আরাবল্লি পাহাড়ই শহরের নিরাপত্তা প্রাকার হিসেবে রইল। সমতল বলে শহরে পর্যাপ্ত আলোহাওয়া ছিল। গোটা শহরকে নটা আয়তক্ষেত্রে ভাগ করলেন বিদ্যাধর ভট্টাচার্য, যা সৌরমণ্ডলের নয় অক্ষের প্রতীক হয়ে রইল। এরমধ্যে দুটি ক্ষেত্র রাখা হল রাজারাজড়াদের বাসস্থান ও প্রশাসনিক কার্যালয় হিসেবে। বাকি সাতটি সাধারণ বাসিন্দাদের ব্যবহারের জন্য। বিভিন্ন পেশার জন্য আলাদা আলাদা এলাকা ভাগ করা হল। নিরাপত্তার জন্য গোটা শহর ঘিরে তৈরি হল কুড়ি ফুট উঁচু পাঁচিল। সাতটি বড় বড় প্রবেশপথ বানানো হল রাজপুত স্থাপত্যকীর্তির কারুকার্য অনুসরণে।

বিদ্যাধর ভট্টাচার্যেরই পরিকল্পনায় জয়পুরের অন্যতম স্থাপত্য চন্দ্রমহল নির্মিত হয়েছিল, যার মোগল মিনিয়েচার এবং রাজস্থানী পাথুরে শিল্পকর্মের মিশ্র স্থাপত্যশৈলী আজও পর্যটকদের মুগ্ধ করে। এখনও জয়পুরের রাজপরিবার এখানে বাস করেন। সাতমহলা প্রাসাদের প্রতিটি তলার আলাদা আলাদা নাম: পীতম নিবাস, সুখনিবাস, শোভানিবাস, ছবি নিবাস, রঙ্গমন্দির, মুকুটমহল এবং শ্রীনিবাস। সেই কবে বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের পরিকলপনায় তৈরি হয়েছিল সাতমহলা চন্দ্রমহল! আজও সেই চন্দ্রমহলের মাথা যেন ছুঁয়ে রয়েছে মেঘবাতাসের নরম শরীর। পেছনে আরাবল্লির পাথুরে পাঁচিল। মাঝখানে চন্দ্রমহলের মাথায় উড়ছে জয়পুরের রাজপতাকা। বড় পতাকাটির সঙ্গে এক চতুর্থাংশ সাইজের একটি ছোট পতাকা ওড়ে সওয়াই জয় সিংয়ের স্মৃতিতে। বলা চলে ওটা একরকম সওয়াইয়ের প্রতীক। জয়পুরবাসী মনে করেন রাজা দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিং আজও রয়েছেন জয়পুরের কেন্দ্রবিন্দুতে, তাই তাঁর সম্মানে সেই আঠেরো শতক থেকে বড় পতাকার সঙ্গে ছোট পতাকাও আসীন চন্দ্রমহলের মুকুটে।
জয়পুরের নির্মাণশৈলী নিয়ে কথা বলতে গেলে যে কথার উল্লেখ না-করলেই নয়, তা হল: বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের পরিকল্পনাতেই জয়পুরের রাস্তাঘাট নির্মাণে প্রাচীন বাস্তুশাস্ত্রের ‘গ্রিড মডেল’ অনুসরণের সিদ্ধান্ত। এই মডেল অনুযায়ী, শহরের প্রতিটি রাস্তা একে অন্যের সঙ্গে ৯০ ডিগ্রি দূরত্ব বজায় রেখে একটা জালের মতো নকশা (গ্রিড প্যাটার্ন) তৈরি করে। প্রতিটি রাস্তা উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব–পশ্চিমে খোলা থাকে, যাতে সব রাস্তা দিয়েই যে কোনও দিকে যাওয়া যায়। সিন্ধু সভ্যতার দুই বিখ্যাত নগরী হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োতেও এইভাবে গ্রিড মডেলে রাস্তা বানানোর চল ছিল। প্রাচীন রোমে এবং মিশরেও রাস্তা নির্মাণে এই ধারা প্রচলিত ছিল। জয়পুর শহরের ব্লু-প্রিন্টে প্রধান রাস্তাগুলি ষাট ফুট চওড়া রাখা হয়েছিল। আশপাশের ছোট রাস্তাগুলি প্রধান রাস্তার সঙ্গে মিলছে সমকোণে। এই ছোট রাস্তাগুলি আবার ত্রিশ ফুট লেন এবং পনেরো ফুটের বাইলেন দিয়ে যুক্ত ছিল। বড় গাছ সারি দিয়ে লাগানো ছিল রাস্তায় ছায়া করার জন্য। জলের নালা এবং কুয়োর সাহায্যে শহরের জল সরবরাহ ও নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীকালে বিদেশি পর্যটকরাও মহারাজা দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিংয়ের রাজধানীর নগর পরিকল্পনা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, যার সমস্ত কৃতিত্বটাই পাওনা এক ও একমাত্র বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের।

বিদ্যাধরবাবুর নকশা অনুযায়ী শহরের বাজারহাট, দোকানপাট, বাড়িঘর সব বড় রাস্তার ধারে তৈরি করা হয়েছিল। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতের দাপট থেকে বাঁচাতে সব দোকানের মাথায় থাকত আচ্ছাদন। শহরের প্রধান রাস্তার মাঝখানে জমায়েতের জায়গা, যাকে বলা হত চৌপর। সিঙ্গল এবং মাল্টিকোর্ট সব হাভেলি শহরের শোভাবর্ধন করত। আসলে রাজা দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিংয়ের ইচ্ছে আর বিদ্যাধরের নকশায় জয়পুর সামরিক শহরের খোলনলচে পাল্টে বাণিজ্যিক শহর হয়ে উঠল। কী করে অত অল্প সময়ে শহরের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল, সে-ও কম বিস্ময়ের কথা নয়!
তবে বিদ্যাধর ভট্টাচার্য কি কেবলই স্থপতি ছিলেন? ইতিহাসের তথ্য কিন্তু তেমন বলে না। জানা যায়, তৎকালীন জয়পুর শহরে বাসস্থান এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের জায়গা পেতে প্রয়োজন হত বিদ্যাধরবাবুর অনুমোদনের। বিশেষতঃ জহুরি বাজারে ব্যবসার জন্য জমিবন্টনে প্রশাসনিক সিলমোহর দেবার অধিকারও ছিল বিদ্যাধরবাবুর। তাঁকে রাজা দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিং মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন রাজদরবারের মিনিস্টার অফ প্ল্যানিং! তারপরেও বিদ্যাধরের কথা যতটা জনশ্রুতিতে বেঁচে আছে, পুরাতত্ত্ববিদদের সংরক্ষণে ততটা নেই। জয়পুরের প্রশাসনিক নথিতে তাঁর নাম থাকলেও ইতিহাসে জয়পুরের মুখ্য স্থপতি হিসেবে তাঁর উল্লেখই নেই। আসলে সে যুগে কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতকার, চিত্রকরদের নাম খোদাই করে রাখার প্রথা থাকলেও স্থপতির নাম স্মরণীয় করে রাখার তেমন প্রথা ছিল না। তবে রাশিয়ার এক বিখ্যাত লেখক এ এ ক্রোটোস্কায়া (A A Korotskaya) তাঁর বিখ্যাত বই ‘সিটি অফ ইন্ডিয়া’-তে বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের স্থাপত্যরীতির কথা লিখেছেন বিস্তারিতভাবে।
আর একটি বিষয়েও একটু খটকা থেকে যায়। তা হল, ১৭২৫ সাল নাগাদ মহারাজা দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিং পাঁচটি মানমন্দির তৈরি করান। তার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি ছিল জয়পুর শহরেই। বাকিগুলি দিল্লি, মথুরা, উজ্জয়িনী ও বেনারসে। এখনও পর্যন্ত জয়পুরেই রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাথরের তৈরি সূর্যঘড়ি। এই বড় জ্যোতির্বিজ্ঞান কেন্দ্র তৈরির সময়ে তিনি কি কোনও আলাপ-আলোচনাই করেননি তাঁর গণিতজ্ঞ বাস্তুকার রাজকর্মচারী বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের সঙ্গে? আসলে এমন অনেক প্রশ্নই আছে যার জবাব অজ্ঞাত রয়ে যায়, কালের উত্তরপত্রে তার কোনও সমাধান থাকে না। বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের কীর্তির এমন অনেক অশ্রুত কথা হয়তো এখনও লুকিয়ে রয়েছে ইতিহাসের গুমঘরে। তবে পরবর্তীকালে বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের স্মরণে একটি স্যাটেলাইট টাউন গড়ে তোলা হয় জয়পুরে। ত্রিপোলি বাজারের কাছে বিদ্যাধর সরণিটিও তাঁর নামে। আর রয়েছে বিদ্যাধর বাগান– যা জয়পুরের সংরক্ষিত বাগানগুলির মধ্যে অন্যতম। ১৯৮৮ সালে নির্মিত এই বাগানটি শিল্পশাস্ত্রের প্রাচীন সূত্রের উপর ভিত্তি করেই নকশা করা হয়েছে, ঠিক যেমনটি বিদ্যাধর নিজে করতেন, নগর পরিকল্পনার সময়ে। পাহাড়ি উপত্যকার কোলে এই বাগানে রয়েছে স্ফটিকজল শান্ত হ্রদ, ফুলের গালিচায় মোড়া। হিন্দু ও মোগল শৈলীর মিশ্রণে তৈরি। এখানে রয়েছে ফোয়ারা, শ্রীকৃষ্ণের ম্যুরাল এবং রাজপুত পেন্টিংয়ে সাজানো প্যাভিলিয়ন। এককালে বিদ্যাধর ভট্টাচার্য জয়পুরের স্থাপত্যশৈলীতে মোগল-রাজপুত শিল্পের যুগলবন্দি ঘটিয়েছিলেন। তারই প্রতীকী পরম্পরা হিসেবে গড়ে উঠেছে বিদ্যাধর গার্ডেন, ইতিহাসের ধুলোপড়া কোণে পড়ে থাকা বাঙালি স্থপতির অতুল কীর্তির স্মারক হিসেবে।

আঠেরো শতকে বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের পরিকল্পনায় এবং রাজা দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিংয়ের তত্ত্বাবধানে তৈরি জয়পুর শহর পরবর্তীকালে বিভিন্ন রাজাদের আমলে আরও নানা শিল্পসম্ভারে সমৃদ্ধ হয়েছে। মিউজিয়াম, হাওয়ামহল ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। কিন্ত সেইসব নতুন স্থাপত্য যে প্রাণ পেয়েছে এক বাঙালি বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের পরিকল্পিত নগর-কাঠামোয় ভর করে, সেকথা অনস্বীকার্য হলেও অনুল্লিখিত। ১৮৭৬ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস জয়পুরে এলে তাঁর আতিথেয়তার প্রতীক হিসেবে জয়পুর শহরকে গোলাপি রঙে রাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন থেকে জয়পুর শহরকে ‘পিংক সিটি’ নামে চেনে লোকে। আসুন না, আজকের জয়পুর শহরের এই গোলাপি আভায় মেশানো পথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা না হয় মনে মনে গোলাপের পাপড়ি ছড়াই এ শহরের আদি রূপকার বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের স্মৃতির উদ্দেশে? না হয় বিলাসবহুল চন্দ্রমহলে ঢোকার মুখে মানসপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিই ওই বাঙালির কীর্তিস্মারকের সামনে? না হয় জয়পুরের রাস্তাঘাটে, দেওয়ালে, প্রাচীরের ম্যুরালে হাতড়ে বেড়াই তিনশো বছর আগে প্রাসাদনগরী গড়া এক বাঙালি স্থপতির ভাবনাচিন্তার আঁচ পেতে? না হয় বিদ্যাধর গার্ডেনের হাওয়ায় মিশিয়ে দিই এক বিস্মৃত বাঙালির জন্য দীর্ঘশ্বাস! এতটুকু তো আমরা পারিই, তাই না?
*ছবি সৌজন্য: Alchetron, Outlook Traveller, TalktoIconic
শৈশবের পাঠ শুরু কলকাতায়। মায়ের কর্মসূত্রে মেয়েবেলার পড়াশুনো পূর্ব মেদিনীপুরে, লেখালেখিতে হাত পাকানো। নব্বইয়ের দশকে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক। জীবনের বাঁক বদল করে সাংবাদিকতায় আসা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার ফিচার ও সংবাদ বিভাগে লেখালেখি। কবিতা ও গল্প নিয়ে একটু আধটু চর্চার মুক্ত বাতাস জোগাচ্ছে পেশাতেও।
আমরা জয়পুর বেড়াতে গিয়ে সিটি প্যালেস আম্বের প্যালেস এর জমক বৈভবের, রাজারাজরাদের স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসি,,আত্মবিস্মৃত বাঙ্গালী আমরা,স্থপতি বিদ্যাধর ভট্টাচার্যকে নিয়ে লেখা প্রাতিবেদন টি খুবই তথ্য সমৃদ্ধ,grid based এই শহর যে সমকালীন সেটা লেখিকা সুন্দর ভাবে উপস্থাপনা করেছেন
কিছুদিন আগেই জয়পুর ঘুরে এলাম কিন্তু বহু শতক আগে এর অনন্য শহর পরিকল্পনা যে একজন বাংলার মানুষের অবদান তা জানা ছিল না