টুনটুনির বিয়ে হয়েছিল দোজবরে। তখনও টাঙ্গাইলের ভিটেমাটি পুরোপুরি ছাড়তে হয়নি তাকে। কিন্তু বয়স উনিশ পেরিয়েছে বলে বিয়ের খুব তাড়া। বাড়ির লোকে বললে, পাত্তর জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট, উপার্জন দিব্য। কলকাতায় নিজের বাড়ি। থাকুক না ছেলেপুলে! এত বড় মেয়ের জন্য এর চেয়ে ভালো পাত্তর কি এই বাজারে আর পাওয়া যাবে? অতএব সানাই বাজল। কনের সাজে টুনটুনি শ্বশুরবাড়িতে পা রাখল। কালরাত্রির দিনেই কোলে তুলে দেওয়া হল আড়াই বছরের দুধের ছেলে। একগলা ঘোমটার আড়াল থেকে টুনটুনি শুনল, “মা-মরা দুধের শিশু বাছা। নিজের মনে করে মানুষ কোরও।” বাঁ হাতে সদ্যপ্রাপ্ত ছেলেকে জড়িয়ে ধরে লাল চেলির আবডাল ফাঁক করে টুনটুনি ভিড়ের মধ্যে জুলজুল চোখে দাঁড়িয়ে থাকা আরও তিন মেয়ে আর এক ছেলেকে চাক্ষুষ করল। হায় রে, বিয়ে হয়ে আসতে না আসতে পাঁচ পাঁচটা কোলে। দীর্ঘশ্বাসটা সযত্নে লুকিয়ে ফেলল টুনটুনি। আর সেদিন থেকে স্ত্রীয়ের চেয়ে মা হয়ে ওঠাতেই বেশি করে মন দিল।

বছর ঘুরতে থাকে। টুনটুনির নিজের পেটেও সন্তান আসে। দেশভাগ হয়। টাঙ্গাইলের সংসার উচ্ছেদ করে টুনটুনিরা বাসা বাঁধে কলকাতায়। সেখানকার রং-ঢং সবই আলাদা। ভালোই লাগে টুনটুনির। এমন সময় বাড়িতে লাগল এক বিয়ে। শাড়ি-গয়না নিয়ে রোজই আলোচনা, দুপুর-আড্ডা চলে মেয়েমহলে। বিয়ের দিন সন্ধেবেলা বরযাত্রী যাবে বলে ছেলেপুলেকে খাইয়ে দাইয়ে তাড়াতাড়ি করে জা-ননদদের সঙ্গে তৈরি হচ্ছে টুনটুনি। কে যেন কইলে, “এই টুনটুনি, একটু লিপিস্টিক লাগাবি না?” ও মা! কী সব বলছে গো! টুনটুনি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে ছোট্ট কালো গোলাটে জিনিসটাকে। ঠোঁটে মাখার রং! এক রকমের নিষিদ্ধ উত্তজনায় তিরতির করতে থাকে টুনটুনির বুকখানা! কারা ওসব মাখে? কেমন লাগে মাখলে? এদিকে লিপিস্টিক দেখে টুনটুনির বুক-ধুকপুকুনিতে হাসির রোল ওঠে মেয়েমহলে। কে যেন জোর করে ধরে এগিয়ে আনে রংকাঠিখানা। তারপর চলে নির্দেশ, “মুখটা খোল না, গোল কর একটু, ঠোঁটটা একটু ছড়িয়ে দে দেখি। এইত্তো, এ বার ঠোঁটে ঠোঁটে ঘষে নে।” সব হয়ে গেলে পর টুনটুনি আয়নায় নিজের দিকে চায়। ওই টুকটুকে লাল ঠোঁটদুটি কি তার নিজের? এত সুন্দর পাতলা ফিনফিনে ঠোঁট তার? কই কেউ তো কোনওদিন বলেনি! ওই ছোট্ট কাঠির এমন জাদু? এতদিনের আটপৌরে টুনটুনিকে গোলাপবালা করে দিল নিমেষে? বিস্ময়ে, উত্তেজনায়, অজানা ভালোলাগায় শিহরিত হতে থাকে সে।

চটকা ভাঙলো ‘মাআআাআ, ও মাআআআআ’ চিৎকারে। বড় ছেলে খেলতে গিয়েছিল। ফিরল বোধহয়। আহা রে, খিদেয় হাঁকডাক জুড়েছে ছেলেটা। সব ভুলে ছেলেকে খেতে দিতে ছুটল টুনটুনি। মাথায় কাপড় দেওয়ার ফুরসত ছিল না। ছেলের খিদের ডাকে মনেও ছিল না খানিক আগের আয়না দেখার শিরশিরানি। রান্নাঘর থেকে থালা হাতে দৌড়ে বেরিয়ে “এই নে বাবা” বলতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল টুনটুনি। ছেলের চোখ অমন কেন? বিস্ফারিত নেত্রে মুখ হাঁ করে নওলকিশোর চেয়ে আছে ‘মা’ নাম্নী নন্দিনীর পানে! কচি মুখ দিয়ে ছিটকে এল কয়েকটা শব্দ – “মা! তুমি ঠোঁটে রং লাগিয়েছ? ও কী রকম লাগছে তোমাকে? ঠোঁটে লাল রং দিয়েছ তুমি?”

শব্দ নয়, যেন বারুদ! যেন গলানো লোহা ঢেলে দিচ্ছে কেউ টুনটুনির কানে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত থরথর করে কাঁপতে লাগল টুনটুনির। এ কী করেছে সে? এতবড় বড় ছেলেমেয়ের মা হয়ে ঠোঁটে লাল রং মেখে বাহার দেওয়ার শখ? ছি ছি ছি ছি ছি… এ কথা এবার সব ছেলেমেয়ের কানে যাবে! সবাই বলবে “মা ঠোঁটে রংকাঠি মেখেছে!” কত্তার কানে উঠবে তারপর! ও মা গো, এ কী করে করল টুনটুনি? উঁচু ক্লাসে পড়া ছেলের সামনে ঠোঁটে লাল রং মেখে ঘুরছে সে? এমন দৃশ্য চোখে দেখার আগে যে তার মরণও ভালো ছিল! কোনও মতে থালাখানা ছেলের সামনে নামিয়ে হড়াস করে ঘোমটা টেনে মুখ ঢেকে ফেলে টুনটুনি। তারপর অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে ছুটতে থাকে ঘরের দিকে। কোমরে গোঁজা ফুলকাটা রুমাল ততক্ষণে ঘষে ঘষে ছাল তুলে ফেলছে ঠোঁটের। জল লাগবে না। চোখ থেকেই তো নামছে গরম ধারা। লজ্জা-ঘেন্না-অভিমানের নোনা জলে ঠোঁটে লেগে থাকা রঙের পরত চিরতরে ঘষে উঠিয়ে দেয় কালো মেয়ে। সে না ছয় ছেলেমেয়ের মা? মুখে রং মাখা তাকে সাজে না। জীবদ্দশায় আর কোনওদিন রংয়ের কাঠি হাতে তোলেনি সে।

টুনটুনিদের যুগ ফুরল, সন্দে হল আর এক যুগের পার। আরতির ঘরে টিমটিমে বালব জ্বলে উঠল। মনে পড়ে আরতিকে? স্বামী ব্যাঙ্কের চাকুরে। বাংলাদেশ থেকে অনূঢ়া মেয়েকে নিয়ে আরতির কাছে এসে উঠলেন রক্ষণশীল শ্বশুর-শাশুড়ি। স্বামীর একার রোজগারে ছ ছখানা পেট চালাতে তখন হিমশিম অবস্থা। স্বামীই একদিন বন্ধুপত্নীদের চাকরি করার খবর দিল আরতিকে। রাগ-ভয়- অভিমানের পাঁচিল ডিঙিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে আরতি চাকরির দরখাস্ত করতে লাগল গোপনে। একবার শিকে ছিঁড়ল। বাঙালি কোম্পানিতে নিটিং মেশিনের সেলস গার্লের কাজ। শ্বশুরের নিঃশব্দ প্রতিরোধ, শাশুড়ি মায়ের চোখের জল, ছোট্ট ছেলের অভিমানের কান্না বাড়ির চার দেয়ালে বন্ধ রেখে কাজে নামল আরতি। কর্মক্ষেত্রে তার বন্ধু হল ইডিথ নামের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে। প্রথম মাসের মাইনের খাম থেকে কয়েকটা কড়কড়ে নতুন নোট ইডিথের কুঁচকোনো পুরনো নোটের সঙ্গে স্বেচ্ছায় অদলবদল করে ইডিথের কাছ থেকে ভালোবাসার উপহার পায় আরতি। একটা লিপস্টিক।

টুনটুনির মতো আরতির বিয়ের আগে পাঁচ পাঁচটা ছেলেপুলে নেই। বাড়ির বাইরে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে বেরতে পেরেছে সে। তবু ঠোঁটে রং মাখতে পারে না। লেডিজ রুমের আয়নার সামনে ইডিথের লাগিয়ে দেওয়া লিপস্টিক পরে নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখে একটা অপ্রতিভ খুশির হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায় আরতির রং-মাখা ঠোঁটে। ইডিথের কাছ থেকেই টিস্যু নিয়ে রং মুছে ফেলে বাড়ি ফিরে যায় আরতি। রংকাঠিটা অবশ্য রয়েই যায় ভ্যানিটি ব্যাগের অন্দরে। আর ভাগ্যের ফেরে হঠাৎ একদিন স্বামীর চোখে পড়ে যায় বৌয়ের ব্যাগে ঘাপটি মেরে থাকা লিপস্টিক। নিজে-হাতে স্ত্রীর চাকরির ব্যবস্থা করা, বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে স্ত্রীয়ের হয়ে লড়াই করা স্বামীও অফিস বেরুতে যাওয়া স্ত্রীকে সামান্য বাঁকা স্বরে শুধিয়ে ফেলে, “ঠোঁটে রং মাখলে না?” অভিমানে গলা বুজে এলেও ব্যাগ থেকে লিপস্টিক বের করে জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আরতি বলে, “আর যা-ই করো, আমাকে ভুল বুঝো না।”

কেন ভুল বোঝা? কী আছে এই ঠোঁটের রংয়ে, যে যুগে যুগে এই সামান্য অধিকারটুকু পেতে লজ্জার সহস্রডিঙা পার হতে হয় টুনটুনি-আরতিদের? ষাট পেরুনো কারও ঠোঁটে রং দেখলে কেন আজও আমাদের মুখ ঘুরিয়ে ফিসফাস? এখন তো মিলেনিয়ামের সিংদরজাও পেরিয়ে এসেছি আমরা! ভুবনায়ন নিয়ে কেউ আর বিব্রত নয়। সোশ্যাল মিডিয়ার চণ্ডীমণ্ডপে টিকটক ভিডিও থেকে শুরু করে নায়িকাদের বিচওয়্যার ফোটোশ্যুট – আমরা রোজ গিলছি গপগপিয়ে। তবু পাশের বাড়িতে যে মেয়েটি রান্না করে, তাকে গড়িয়াহাটের মোড়ে সেজেগুজে ফুচকা খেতে দেখলে বাড়ি ফিরেই কেন প্রচ্ছন্ন অবজ্ঞায় বলে ফেলি, “মালতীকে দেখলাম গড়িয়াহাটে! কী সেজেছে বাপ রে বাপ! ঠোঁটে কটকটে লাল লিপস্টিক লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!” অফিসের কালো মোটা মেয়েটিকে বিয়েবাড়িতে দেখে হোয়াটস্যাপে বান্ধবীকে লিখি, “পরমাকে দেখলি? ওই তো রূপের ধুচুনী আর তার লিপস্টিকের রং যদি দেখতিস!”

মুখে রং। শুধু মুখে রং মাখার প্রথা দিয়ে আর কতদিন চরিত্রের কড় গুণব আমরা? সৌন্দর্যের দাঁড়িপাল্লায় মুখের রংয়ের উল্টোদিকে গায়ের রংকে আর কতদিন ধরে ওঠাব নামাব? বস্তিবাসী আর ফ্ল্যাটবাসীকে আলাদা করতে মুখের রং আর কতদিন বল্লম উঁচিয়ে দাঁড়াবে আমাদের সামনে? শুনেছি নটী বিনোদিনী নাকি দুর্ধর্ষ মেকাপ করতেন। নাটকের বাইরেও নানারকম সেজে দেখা করতে যেতেন গিরীশ ঘোষ, রামকৃষ্ণের সঙ্গে। তাতে তাঁর নিন্দে হয়েছে বিস্তর। কিন্তু লোকে মেনে নিয়েছে এই বলে, থ্যাটারের মেয়েছেলে, মুখে রং মাখবে না তো কী? তা বলে ভদ্দর ঘরের বৌ-ঝিয়েদের ওসব রং-ঢং কেউ কদাপি মেনে নেয়নি। তার থেকে কতটা এগোলাম আমরা? সনতারিখের হিসেবে, প্রযুক্তির হাঁইহাঁই দৌড়ে, কর্মক্ষেত্রের বিস্তারে নিঃসন্দেহে আলোকবর্ষ পার করেছি! তবু উনিশ শতকের নটী, বিশ শতকের টুনটুনি-আরতি আর একুশ শতকের মালতী-পরমা… মুখে রং মাখলেই সবাই কেন নামহীন, আশ্রয়হীন, স্বকীয় অস্তিত্বহীন কতকগুলো অচেতন মুখ হয়ে যায়, যাদের ঠোঁটের ওপর অদৃশ্য রংকাঠি দিয়ে লেখা আছে, “বাবু, লাগবে?”

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

4 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *