আগের পর্ব পড়তে: [] [] []

অশ্বমেধের খচ্চর 

বাড়ি বানানো খুব মজার; ওপরে আকাশ নিচে বাজার
হ্যাঁ,  এটুকু সবাই জানে
হতে পারে বাজারও আজকাল ওপরে উঠছে; আকাশের চাতালে গিয়ে বসছে,
কখনওবা আকাশ একটু সময় পেলে উঁকি দিচ্ছে, বাজারের ভেতরে;

–বিজয় দে

লেখালেখি আসলে ভাষাসৌধ নির্মাণের প্রকল্পবিশেষ, কেউ কেউ বলতেন। নিজস্ব ভাষা যার নেই, যার সৃষ্টিতে নিজের বুড়ো আঙুলের ছাপ থাকে না, সে লেখক মৃত– আমরা এসব শুনেছি শুরুর দিনগুলোতে। বিস্ময়ে ভেবেছি, তাহলে প্রথমদিককার বইপত্রগুলো, যেগুলো বিশুদ্ধ আনন্দ দিয়েছে, তাদের কি ক্যান্সেল করতে হবে? কতদুর চলবে এই বর্জনের খেলা, আর তার থেকেও বড় কথা, একই নিয়মে আমরাও বর্জিত হয়ে যাই যদি উত্তরপুরুষের কাছে, হয়তো নতুন নিদান হাঁকবে যারা? তার থেকে নিরাপদ নয় কি, চতুরের আঁকাবাঁকা ঠাঁট? কালবেলা যদি ভাল লাগে তো তার থেকে নেব, আবার রন্ধনশালার আঘ্রাণও চেটেপুটে। তা কি সম্ভব, এই দুটো লিখনভঙ্গীমা একই সঙ্গে কীভাবে ভাল লাগতে পারে? কে জানে, পারে কিনা। কিন্তু যদি তেমনই হয়, ভাললাগা চেপে রাখব কেন? সেরকম হতে পারে না, কারণ যা গল্প আমাদের ছিল সব বলা হয়ে গেছে। এখন দেখার, কীভাবে তুমি স্টাইল বদলাও, ক্রাফট নির্মাণ কর কীভাবে।  তাকাও অমিয়ভূষণ সন্দীপন উদয়নদের দিকে। মুখ ফেরাও, ফেরাও মুখ, তোমার ঔদাসীন্য নিয়ে মরে যাক সংবাদপত্রশাসিত সাহিত্য, তার এলিজি রচনার জন্য অনেক প্রত্যাশীর দল আছে। সবই তো  বুঝলাম, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কাগজে কি ভাল লেখা হয়নি? বিমল কর বা মতি নন্দী কি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে এক নিঃশ্বাসে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব? প্রশ্নটা ব্যক্তিবিশেষের নয়, এঁরা অনেকেই ভাল লেখক, শক্তিশালী কলম এঁদের, কিন্তু প্রশ্নটা রাজনীতির। এস্টাব্লিশমেন্ট যেভাবে লেখালেখিকে পণ্য বানায়, যেভাবে পুজোসংখ্যার অর্ডারি লেখার সাপ্লায়ারে পরিণত করে সেন্সিটিভ লেখককে, লড়াইটা তার বিরুদ্ধে—

এরকম নানাবিধ প্রশ্ন প্রতিপ্রশ্ন সম্ভবত গত পঞ্চাশ বছর ধরে অবাণিজ্যিক লেখালেখিতে চলে আসছে, যাদের মীমাংসা হয় না। হয় না জেনেই এগুলো সজীব থাকে, লেখালেখির অলটারনেটিভ ধারাগুলোকে ক্রমাগত সন্দেহ ও যাচাইয়ের মধ্যে ঝালিয়ে নিতে নিতে বাঁচিয়ে রাখে, মেরেও ফেলে। আর এসবের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে প্রায় সব প্রজন্মের লেখকই নিপুণ গেরস্থালিতে দক্ষ হন, চারিয়ে দেন চতুরালী ঋণপ্রস্তাব। বেড়াল যেভাবে পালায় মাছের টুকরো মুখে নিয়ে, সে ক্ষিপ্রতায় তিনি পেরিয়ে যান বাণিজ্যিক চৌকাঠ, তাঁর মুখে ঝুলতে থাকে অনচ্ছ আলো। তিনি গ্রহণ করেন সমরেশ বসু থেকে তিলোত্তমা মজুমদার পর্যন্ত বিস্তৃত শব্দভাণ্ডার, বর্জনও করেন, তারপর পালিয়ে আসেন নিরাপদ পক্ষপুটে, যেখানে জীবন ক্রমে বীতশোক হয়। রাজ্যজয়ের বাসনা তাঁকে ‘শ্রুড’ বানাতে বাধ্য, যাতে কোনও প্রথার যূপকাষ্ঠেই বলি না হয়ে যান। কারণ, আমরা জানি আজ, প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, পরিণত হয় ফ্যাশনে, এমনকী বড় কাগজেও সযত্নে প্রতিষ্ঠানবিরোধী পত্রিকার স্পেসাল ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়, ঠিক যে নিয়মে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মার্ক্সবাদ এখন জনপ্রিয় বিষয়। তাই নাশকতার নিয়মবিধি পরের ব্যাপার, নিজেকে বাঁচানো সর্বাগ্রে। তার জন্যই দরকার পড়ে অগ্রজের কাছে হাত পাতা। অস্বীকারের রাজনীতি, এখানে অন্তত, চলে না। 

Authors
অস্বীকারের রাজনীতি লেখালিখিতে চলে না। (বাঁ দিক থেকে) অমিয়ভূষণ মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, মতি নন্দী, বিমল কর ও শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দীপেন্দ্রনাথ থেকে দেবেশ রায় তো ছিলেনই, কিন্তু কীভাবে অস্বীকার করব আশি-র দশকে যাঁরা লিখতে এসে বাংলা সাহিত্যের ভুবন পালটে দিলেন, ছোট পত্রিকাগুলো যাঁদের লেখায় স্রোতস্বীনি হয়ে উঠল, সেই তাঁদের? অভিজিৎ সেন, সাধন চট্টোপাধ্যায়, অমর মিত্র, নলিনী বেরা, কিন্নর রায়, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, ভগীরথ মিশ্র, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, অকালপ্রয়াত রাধানাথ মণ্ডল, শিবতোষ ঘোষ, এঁরা কি প্রথাবিরুদ্ধ ছিলেন? হয়তো কিছুটা, কিছুটা নয়ও বা, সেভাবে এঁদের কাউকেই দ্রোহী বলা যায় না, তবু কী সফল এঁদের অঙ্গীকার, এই ২০২২-এ এসেও এঁদের প্রতি লয়ালটি গচ্ছিত রাখতে হয়, সে যতই তারপর সাঁকো পেরবার চেষ্টা হোক না কেন। নব্বইয়ের অলোক গোস্বামী, আনসারউদ্দিন, সুকান্তি দত্ত, নবারুণ ভট্টাচার্য, সোহারাব হোসেন, শরদিন্দু সাহাদের থেকে হাত পেতে নিয়েছি আমরা সবাই, গ্রহণ করেছি লিখনভঙ্গীমা, চাতুর্য ও ইশারা, সবুজাভা এনেছি প্রগলভতায়। আমাদের ওয়াগন উপচে পড়েছে অগ্রজের ঐশ্বর্যে, যেখানে শোক নয়, উজ্জ্বল শস্য ছিল। এঁরা অনেকেই লিটল ম্যাগাজিনের পাশাপাশি বাণিজ্যিক পত্রিকাতেও সমান লিখেছেন, আবার এঁদের কেউ বেশি ভাল লিখেছেন, কারওর লেখা ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ হয়নি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এঁরা একটা প্রবাহের অংশ, যা অবিরাম কারুণ্যের স্রোতে উত্তরপুরুষের মাথা ধুইয়ে দেয়, তার হাতে তুলে দেয় অব্যার্থ আয়ুধ। 

সমস্যা হল, এঁদের বাণিজ্যিক লেখক তো কোনওভাবেই বলা যাবে না, বরং লিটল ম্যাগাজিনের যে সামগ্রিক ধারা ও নিজস্ব রাজনীতি, তারই স্থাপক হিসেবে গণ্য করতে হবে, কিন্তু অন্যদিকে এঁরা যে প্রথা ভেঙেছেন সচেতনভাবে, এমনটাও ছিল না। নিজেদের মতো লিখেছেন শুধু, সেসব লেখাপত্রের অনেকেই বাণিজ্যিক কাগজে স্থান করে নেবার মতো ছিল না চারিত্র্যে, তাই তাদের জন্য নির্মিত হয়েছে আলাদা গৃহ, প্রাসাদ থেকে দূরে, খোলা রাস্তার নৈরাজ্যে স্থিত নয় তবু। আমরা যারা পরে লিখতে এলাম, এই মধ্যবর্তী বিশাল স্রোতকে অস্বীকার করলে শব্দকাঙাল হয়ে যাব, নিজেরাও জানি। অথবা এঁদের তো ছেড়েই দিলাম, বিমল করের মতো অমানুষিক শক্তির গল্পকারের সামনে স্তম্ভিত দাঁড়াব না কি? জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বহু লেখা বাণিজ্যিক কাগজে লিখেছেন, কিন্তু নিজের শর্ত বজায় রেখে, আপস করেননি কখনও। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যেভাবে শান্ততার মধ্যে মারণটান ঘনিয়ে আনেন, সে মাস্টারিকে অস্বীকার করবে কে? অপরদিকে, প্রথা ভাঙার পরেও তো বহু লেখাই হচ্ছে না, দাঁড়াচ্ছে না, ওপরচালাকি হয়ে যাচ্ছে। তাহলে কি সর্পিল গমনের পন্থাই উৎকৃষ্ট– নিজেকে কিছুতেই আহুতি দেওয়া যাবে না?

পুরোপুরি হয়তো না, কারণ বড় কাগজের রাজনীতি, পণ্যায়ণের প্রশ্নটাকে ফেলে দেওয়া যায় না, সে বিষয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, তাই এখানে কচকচি করে লাভ নেই। তবে বড় কাগজে ভাল লেখা বেরয়, এটা সত্যি হলেও মূল প্রসেসটা নিয়েই যদি প্রশ্ন থাকে, তাহলে ব্যক্তির উৎকর্ষ গৌণ হয়ে যায়। কিন্তু আমরা তো এত কিছু ভেবে লিখতে আসিনি, হয়তো কেউই আসে না। আমরা যে যেখানে পেরেছি লিখেছি। এবার লিখতে লিখতেই, দ্বন্দ্বে সংরাগে বিক্ষোভে নিজেদের তত্ত্ববিশ্ব নির্মাণ করেছি, যেমন হয়ে থাকে, আর সে নির্মাণে প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা হোক বা মঝঝিমপন্থা, গা ঘেঁসাঘেঁসি জায়গা করে নিয়েছে একে অন্যের পাশে। কিন্তু সেসব পরে এসেছে। প্রথম থেকে যেটুকু দপদপে, আমাদের লিখতে চাওয়া, ছাপার অক্ষরে নিজেদের নাম দেখার হ্যাংলামি, হ্যাংলামিই বলা যায় তাকে, কারণ আমাদের মধ্যবিত্ত ক্যাবলা যাপনে, ভাড়াবাড়ির জীর্ণতায় ও ফাটাকাপের শস্তা চা-চুমুকে ওটুকুই খুব বেশি চাওয়া ছিল। ফুটবল খেলার শেষে মাঠে সন্ধ্যের আড্ডায় অবহেলায় বলা ‘আজ অমুক পত্রিকায় লেখা বেরল’ এবং বিস্ফারিত বন্ধুদের চোখ ‘তুই লিখিস? পড়াসনি তো’, অথবা পাড়ার অধ্যাপক কাকুর ডেকে বলা, ‘তোর গল্প বেরিয়েছে শুনলাম, পড়াস’, কলেজ-বান্ধবীর প্রশ্রয় মিশ্রিত মনোযোগ বিকল্প প্রস্তাবে, এই মণিকণাগুলোই বড্ড মূল্যবান ছিল। 

এসবের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে প্রায় সব প্রজন্মের লেখকই নিপুণ গেরস্থালিতে দক্ষ হন, চারিয়ে দেন চতুরালী ঋণপ্রস্তাব। বেড়াল যেভাবে পালায় মাছের টুকরো মুখে নিয়ে, সে ক্ষিপ্রতায় তিনি পেরিয়ে যান বাণিজ্যিক চৌকাঠ, তাঁর মুখে ঝুলতে থাকে অনচ্ছ আলো। তিনি গ্রহণ করেন সমরেশ বসু থেকে তিলোত্তমা মজুমদার পর্যন্ত বিস্তৃত শব্দভাণ্ডার, বর্জনও করেন, তারপর পালিয়ে আসেন নিরাপদ পক্ষপুটে, যেখানে জীবন ক্রমে বীতশোক হয়।

তাই হাঁ বসে থাকা, সাদা ফুলস্ক্যাপ কাগজে গোটা গোটা অক্ষরে রাফ ড্রাফট ফ্রেশ করে সযত্নে লিখে ডাকযোগে পাঠানো, দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা যদি ফোন আসে। আসত না বেশিরভাগ সময়েই, উন্মুখ বেড়াল কবে আর ভাঁড়ারের আনুকূল্য পেয়েছে! কিন্তু সেসব অন্য প্রসঙ্গ, মূল কথা যেটা বলছিলাম– দর্শন, বাণিজ্যের বিপরীত পথে হাঁটা, নিজের শব্দবিশ্বকে গড়ে তোলা ঐশ্বর্যময়, এসবের সময় পরে আসে। অত ভেবে কে আর লেখে কাঁচা বয়েসে, এমনকী নিজের কাগজ বার করার সময়েও ভাবে না হয়তো। তখন মূল ভাবনা অনেকেরই থাকে– আমার লেখা, বা বন্ধুদের লেখা যদি অন্যত্র না যায়, তাহলে একটা জায়গা অন্তত রাখার, যেখানে থাকবে। এভাবেই নড়বড়ে, আঁকাবাঁকা অলিগলি বেয়ে, অগোছালো প্রস্থান ও ভিত্তিভূমি তৈরি হয় লেখকের। সে ভাবে, পৃথিবী উলটে দেবে তার গল্প দিয়ে, জয় করবে একটার পর একটা শৃঙ্গ। সে ভাবনায় কারুণ্য নেই, অসাফল্যেও এমনকী, যেমন ধারণা অনেকের। গল্প লিখতাম, কবিতা লিখতাম, কারণ ভাল লাগত, ব্যাস। সেগুলো ভাল হত, বা খারাপ, তাতে কীই বা এল গেল! আবার এই প্রক্রিয়াতেই কিছুটা টিকে গেল যারা, তারাই ওপরে বর্ণিত বেড়ালের মতো চতুর হল। অস্বীকারে নয়, দ্বান্দ্বিকতায় উজ্জ্বল হল, তার নাস্তিক্যে এল তর্পণের বিভা, আস্তিক্য মহিষের শৌর্যে বর্ণময়। 

কমলকুমার লিখেছিলেন ‘পিতার নৌকা ক্রমাগত সাগর অভিমুখে যায়’। পেন্সিলবালকদের ঠোঁটে লবণাক্ত জল লেগেছিল, কিন্তু নৌকার অভিমুখ স্থির ছিল না অনেকের। তাতে সাগর বা পিতৃপক্ষ, কারওর কিছু এসে যায়নি।  (চলবে)

 

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *