অন্নদাশঙ্কর রায়(১৯০৪-২০০২), নানা কারণে আমাদের থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন। কথাসাহিত্যকার অন্নদাশঙ্কর সম্পূর্ণ বিস্মৃত; ‘পথে প্রবাসে’ ও ‘ইউরোপের চিঠি’-র অন্নদাশঙ্কর বিস্মৃত না হলেও, পূর্বের প্রতিতুলনায় অনেকটাই ম্লান। প্রবন্ধকার অন্নদাশঙ্করের ভাবনাচিন্তা নতুন ক’রে বিচার করবার ধৈর্য আমরা বহুদিন হল হারিয়েছি। সজীব অবস্থায় মেঝেতে প’ড়ে রয়েছে কেবল ভাঙা তেলের শিশির ভগ্ন প্রতীকটি।

অথচ, তাঁকে আমরা যতটা দূরের মানুষ মনে করি, ততটা দূরের তিনি নন। কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা সাধারণ নাগরিকদের উপর সহসা চাপিয়ে দেওয়া জরুরি অবস্থার(১৯৭৫-৭৭)বিধিনিষেধের বিরোধিতা করে তিনি কলম ধরেছেন, লিখেছেন শিক্ষার সঙ্কট এবং ধর্মান্ধতা-বিষয়েও। অর্থাৎ বর্তমান সমাজজীবনের এমন একটিও সঙ্কট হয়তো নেই, যা তাঁকে পীড়িত, বিচলিত করেনি।

একটি বিপরীত প্রান্তও আমরা পাই তাঁর লেখায়, ব্রিটিশ ভারত সরকারের অতিউচ্চপদস্থ কর্মচারী হওয়ার সুবাদে তিনি এমন কিছু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, যা, সব দিক থেকেই বিরল:

‘রাজশাহীতে থাকতে হঠাৎ টেলিগ্রাম পেলুম রবীন্দ্রনাথ এসেছেন পতিসরে। আমি যেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি সেইদিনই কলকাতা ফিরবেন। সময় একেবারেই ছিল না। ছুটলুম মোটরে করে নাটোর, তারপর ট্রেন ধরে আত্রাই ঘাট। ট্রেন থেকে নেমে নৌকায় করে যাই রবীন্দ্রনাথের হাউসবোটে। তিনি পতিসর থেকে ফিরছেন। বোট ঘাটে ভিড়লে পরে চেয়ার পেতে প্ল্যাটফর্মে তাঁর পাশে আসন নিলুম। রবীন্দ্রনাথ বললেন, “ওই লোকগুলিকে দেখছ? ওরা সমস্ত পথ পায়ে হেঁটে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। পতিসরে এ সময় আসার কথা ছিল না। ওরাই আমাকে শেষবারের মতো দেখতে চেয়েছিল। কতকাল দেখেনি।”

তা তো চাইবেই। দুনিয়ার লোক দেখল। আর দেখতে পেল না ওরাই। কবি বোধহয় পনেরো বছর ও-মুখো হননি। তাঁর বয়স তখন ছিয়াত্তর। স্বাস্থ্যেও ভাঙন ধরেছে। পতিসরে যাতায়াত তো চারটিখানি কথা নয়। তাঁর সেই হাউসবোটটিরও অন্তিম দশা ঘনিয়ে আসছে। বোধ হয়  আদায়পত্র সুবিধের নয়। “ওরা কী বলছে শুনবে?” রবীন্দ্রনাথ বলতে থাকলেন। “বলছে, পয়গম্বরকে তো স্বচক্ষে দেখিনি। আপনাকে দেখেছি।”

পয়গম্বরকে কি আমিও স্বচক্ষে দেখেছি? কিন্তু গুরুদেবকে তাঁর সেই পরিপক্ক কেশমণ্ডিত পরিণত বয়সে কোনো এক পয়গম্বরের মতোই দেখতে। মর্ত্যের বন্ধন ক্ষয় হয়ে এসেছিল। তিনি আমাদের মধ্যে থাকলেও আমদের একজন নন। ইয়া ইয়া দাড়িওয়ালা বুড়ো বুড়ো মুসলমান। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল শিষ্যজনের মতো। কলকাতাগামী ট্রেন এলো। এক মিনিট কি দু’মিনিট থামল। গুরুদেবকে তুলে দেওয়া হলো ধরাধরি করে। তাঁর প্রজাদের চোখে জল। শেষবারের মতো তাঁকে তারা সালাম করল। তিনি তো কেবল জমিদার নন। তিনি পয়গম্বরের কাছাকাছি যান। সেবার আমি তাঁর একমাত্র সহযাত্রী হয়ে নাটোর পর্যন্ত যাই। প্রধানত সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। কিন্তু আমাকে তিনি সেইজন্যে ডেকে পাঠাননি। ছিল একটা বৈষয়িক অনুরোধ। নাটোরের ট্রেন থেকে নেমে তাঁকে বিদায় দিয়ে রাজশাহী ফিরে যেতেই আমার বৃদ্ধ মুসলমান জমাদার আমাকে ছেঁকে ধরল।“হুজুর বাহাদুরের কোথায় যাওয়া হয়েছিল?”

rabindranath_tagore
ঠাকুরবাবু কী সুন্দর মানুষ! কী সুন্দর গান করেন!

“আমি বললুম। জানতুম না যে সে বুঝবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে। এই লোকটি কালেক্‌টারদের কাছে তরুণ বয়স থেকে চাপরাশিগিরি করে এসেছে। সরকারী কানুন এর জন্যে নয়। এর বয়সের আর সবাই কবে অবসর নিয়ে ভূত হয়ে গেছে। একে ছাড়ানোর সাহস কোনো কালেক্‌টারের হয়নি। আমি তো এর নাতির বয়সী। এ যে দয়া করে বেঁচে আছে এতেই আমার সম্মান। শফি জমাদার আমাকে বকুনির সুরে বলল, “আহা, ঠাকুরবাবু এসেছিলেন! আমাকে কেন নিয়ে গেলেন না, হুজুর! আমি দেখিনি কতকাল। দেখে আসতুম।”

“তুমি তাঁকে দেখেছ?” আমি কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলুম। “কবে?”

“সেই যেবার তিনি এসেছিলেন রাজশাহীতে। পালিত সাহেব তখন এখানকার জজসাহেব। জজসাহেবের কুঠিতে ছিলেন। আহা, ঠাকুরবাবু কী সুন্দর মানুষ! কী সুন্দর গান করেন! আমার এখনো মনে আছে।” তার মন চলে গেল কোন্‌ অতীতে। আমি হিসেব করে দেখলুম সে বলছে চুয়াল্লিশ বছর আগেকার কথা, কবির বয়স যখন বত্রিশ। পদ্মার বুকে হাউসবোটে বাস করতেন। পরে শান্তিনিকেতনে এসে গুরুদেবকে আমি একথা বলেছিলুম। তিনি সকরুণ ভাবে বলেন, “ তখন আমার গানের গলা ছিল।”                        

[‘তার পরেই প্লাবন’(১৯৬১)/গ্রন্থ:‘রবীন্দ্রনাথ’]  

অন্নদাশঙ্কর, তিনজন মনীষীকে─ টলস্টয়, রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধী─ তাঁর জীবনে বিশেষ স্থান দিয়েছিলেন। একটি দু’টি প্রসঙ্গ সরিয়ে রাখলে, মানবজীবনের এমন কোনও অভিজ্ঞতা নেই, যা বিচার করবার সময়ে তিনি তাঁদের ভাবনাবিশ্বের সহায়তা গ্রহণ করেননি। সেই সূত্রে ভাবতে-ভাবতে ওই তিনজনের জীবনের সমান্তরাল রেখা এবং বিপরীত অবস্থান সন্ধান করাও তাঁর এক অন্যতম প্রধান আবেশ (অবসেশন্‌) হয়ে ওঠে।

আমরা যে গদ্যরচনার একাংশ এখানে উদ্ধৃত করলাম, তারই অন্য এক অংশে তিনি লিখছেন, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ঠিক সাত বছরের মাথায় ভারতের জনজীবনে এমন এক বিপর্যয় নেমে আসে, দেশভাগ, যা তাঁর সমস্ত বিশ্বাসের পরিপন্থী এক ঘটনা। তাঁর যৌবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলি যেখানে অতিবাহিত হয়েছিল সেটি, অন্নদাশঙ্করের পরিভাষায়, হল ‘রাষ্ট্রসাৎ’। হিন্দু ও মুসলমান, উভয় ধর্মসম্প্রদায়ের সমমর্যাদা রক্ষার প্রয়োজনের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নিঃসংশয়, অথচ ঠাকুরবাড়ির এস্টেটের আচরণবিধি ছিল অন্যরকম। দ্বারকানাথ, এমনকী মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের আমলেও, শিলাইদহে দরবার আয়োজিত হলে অভ্যাগতদের মধ্যে যাঁরা মুসলমান, তাঁদের বসতে দেওয়া হত মেঝেতে ফরাস পেতে, হিন্দুদের জন্য চেয়ার অথবা বেঞ্চির ব্যবস্থা থাকত। রবীন্দ্রনাথ এই কুপ্রথা বন্ধ করেন।

Gandhi and Tolstoy
রবীন্দ্রনাথ ছাড়া গান্ধী এবং টলস্টয়কে অন্নদাশঙ্কর তাঁর জীবনে বিশেষ স্থান দিয়েছিলেন

রবীন্দ্রনাথের জীবনাবসান ও পরবর্তী ঘটনাবলির সঙ্গে অন্নদাশঙ্কর একটা সমান্তরাল রেখা টেনে বলছেন, ১৯১০ সালে টলস্টয়ের জীবনাবসানের ঠিক সাত বছরের মাথায় রাশিয়ায় বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়। এবং, লক্ষণীয় যে, তিনি যে-সকল আদর্শ তুলে ধরেছিলেন, রাশিয়া তা প্রত্যাখ্যান করে। টলস্টয়ের ভাবাদর্শ গ্রহণ করেন সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় কর্মরত মোহনদাস করমচন্দ্ গান্ধী এবং ভারতবর্ষে তা প্রয়োগ করেন। অর্থাৎ, টলস্টয়ের ভাবাদর্শ গান্ধীর মাধ্যমে রাশিয়া থেকে ভারতবর্ষে রপ্তানি হয়ে যায়, এবং অপরদিকে লেনিনের মাধ্যমে মার্ক্সের ভাবাদর্শ আমদানি হয় রাশিয়ায়।

অন্নদাশঙ্করের আদ্যন্ত মৌলিক ইতিহাসবীক্ষণ আমাদের একটি যুগপৎ মূল এবং পুরাতন প্রশ্নের সামনে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসে: একজন মনীষী তাঁর স্বদেশের আকাশ, বাতাস, জলস্রোত এবং পরম্পরা সিঞ্চন ক’রে যখন একটি কর্মপন্থা গ’ড়ে তোলেন, তখন, তাঁরই দেশের মানুষ, সে-বার্তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন না। অথচ, এমনই শক্তি সে–ভাবধারার যে তা ভেসে বেড়াতে থাকে, পৌঁছে যায় দেশান্তরে, এবং সেইখানে প্রস্ফুটিত হয়।

অন্নদাশঙ্কর কর্তৃক প্রস্তাবিত ভাবাদর্শের রপ্তানি-আমদানির এই অভিনব তত্ত্বের কথা শুনলেই প্রথমেই বৌদ্ধধর্মের কথা মনে প’ড়ে যায়। দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি, আমাদের মনে হয়, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র(১৯২৯-১৯৬৮) কর্তৃক উদ্ভাবিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী আন্দোলন। তরুণ মার্টিন লুথার কিং তাঁর দেশের কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘদিন ধরে একটি কর্মপন্থা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, কিন্তু কোনওটিই তাঁর মনে ধরছিল না। তিনি ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মযাজক, ফলত তাঁকে বিভিন্ন ধর্মসভায় অংশগ্রহণ করতে হত।

এমন এক ধর্মসভায় তিনি মহাত্মা গান্ধী এবং তাঁর যুগান্তকারী কর্মজীবনের কথা প্রথম শোনেন, এবং খুব দ্রুত প্রাসঙ্গিক বইগুলি পাঠ করে বুঝতে পারেন যে, কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার এটিই একমাত্র পথ। নতুন উদ্যম নিয়ে মন্টগোমরি শহরে তিনি আবার শুরু করেন তাঁর কাজ।

তখনকার দিনে, আঞ্চলিক আইনের বলে, শহরের বাসে শ্বেতাঙ্গদের জন্য আসন সংরক্ষিত রাখা হত। ১৯৫৫-এ দুটি ঘটনা ঘটে। ক্লডেট কলভ়িন নামের পনেরো বছরের এক কৃষ্ণাঙ্গ স্কুলবালিকা এক শ্বেতাঙ্গ বাসযাত্রীকে তার আসন ছেড়ে দিতে অস্বীকার করে। ক্লডেট নাবালিকা বলে সে-যাত্রা রক্ষা পেয়ে যায়।

Martin LK
তাঁর পথপ্রদর্শক গান্ধীর মতোই মার্টিন লুথার কিং, মাত্র ৩৯ বছর বয়সে, আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান

এর কয়েকমাস বাদে, রোজ়া পার্কস নামের এক তরুণী এবং ডিপার্টমেন্টাল স্টোর কর্মী, দিনের শেষে বাসে চেপে বাড়ি ফিরছিলেন। শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত আসনের পিছনে বসেছিলেন তিনি। আরও কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ বাসে ওঠায় কন্ডাক্টর চারজন কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রীকে পিছিয়ে যেতে বলেন। ততক্ষণে বাসের সব ক’টি আসন দখল হয়ে গেছে। তিনজন যাত্রী বিনা প্রতিবাদে বাসের পিছনে গিয়ে দাঁড়ান। রোজ়া তাঁর আসন ছেড়ে দিতে অস্বীকার করেন, এবং, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

[তথ্যসূত্র:‘স্ট্‌রাইড টুওয়ার্ড ফ্রীডম: দ্য মন্টগমরী স্টরী’/ মার্টিন লুথার কিং]

এরপর, মার্টিন লুথার কিং-এর নেতৃত্বে মন্টগোমারি বাস বয়কট আন্দোলন শুরু হয়, যা সারা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর পথপ্রদর্শক মহাত্মা গান্ধীর নিধনের কুড়ি বছর দু’মাস বাদে, মার্টিন লুথার কিং, মাত্র উনচল্লিশ বছর বয়সে, আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান। অন্নদাশঙ্করের চিন্তাসূত্রটি আমাদের আবার মনে প’ড়ে যায়। দেখা যাচ্ছে, কেবল অসহযোগের ভাবাদর্শ নয়, আততায়ীর রিভলভারও রপ্তানি হয়ে যায়। 

আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি, অন্নদাশঙ্কর রায় যে-যে বিষয় নিয়ে ভেবেছেন এবং লিখেছেন, সেগুলি পুরাতন প্রসঙ্গ হোক, অথবা নবীন, তাদের অন্তরস্থ প্রশ্নগুলি ব্যতিক্রমহীন ভাবে চিরায়ত।

এই সংক্ষিপ্ত শ্রদ্ধার্ঘ্যে আমরা মাত্র কয়েকটি বিষয় ছুঁয়ে আসতে পেরেছি। বর্তমান আলোচনায় প্রসঙ্গের পরিধিতে বৃদ্ধি না-ঘটিয়ে, আমরা বরং টলস্টয় প্রসঙ্গেই ফিরে আসি। টলস্টয়ের সামগ্রিক রচনা সম্পর্কে অন্নদাশঙ্কর দ্ব্যর্থহীন। বলছেন, টলস্টয়ের কাছে সাহিত্যসৃষ্টি ছিল গৌণ, মুখ্য ছিল সত্য কথা বলা ও সত্যভাবে বাঁচা। এই কারণে তিনি নিজের জন্য যে মানদণ্ড স্থাপন করেছিলেন, তার নিরিখে তাঁরই বিশ্বনন্দিত বহু উপন্যাস ও গল্প, নিজেই বাতিল করে দিয়েছেন।

মাত্র কয়েকটি রচনা এবং তাঁর জীবনের অন্তিম পর্বের ‘মাস্টার অ্যান্ড ম্যান অ্যান্ড আদার প্যারাবেল্‌স্‌ অ্যান্ড টেল্‌স্‌’ তাঁর বর্জিত গ্রন্থের তালিকা থেকে রক্ষা পেয়েছে। ‘সত্য’ অথবা আরও নির্দিষ্ট ভাষায় সুগঠিত করে বলতে গেলে, ‘সত্যের প্রকাশ’ টলস্টয়ের কাছে ঠিক কী অর্থ বহন করত, তা বুঝতে গেলে আমাদের তাঁর ‘হোয়াট ইজ় আর্ট’ নতুন ক’রে প’ড়ে নিতে হবে।

আর রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথও এ-প্রসঙ্গে সারাজীবন জুড়ে ভেবেছেন। বিভিন্ন সাময়িক পত্রে,  রামমোহন লাইব্রেরি থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত বিভিন্ন অভিভাষণে তাঁর অভিজ্ঞান ছড়িয়ে রয়েছে। তাঁর সমস্ত ভাবনার সারাৎসার ধরা আছে আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথ সংলাপে (১৯৩০) যেখানে আইনস্টাইন বলছেন, সত্য মানবচেতনা-নিরপেক্ষ এক সত্তা, এবং তাঁর অভিমত এই যে, মানুষের ভিতর দিয়েই সত্যের প্রকাশ ঘটে, তা না হলে ‘ইট ইজ় অ্যাবসোলিউট্‌লি নন-এক্সিস্টিং।’

অন্নদাশঙ্করের রচনায় একটি অন্য ভাববিনিময়ের বিবরণ খুঁজে পাওয়া যায়। এই কথাগুলি রবীন্দ্রনাথ ১৯২৯ সালে বলেছিলেন তাঁকে নয়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে। অন্নদাশঙ্করের  লিখিত বিবরণটি তুলে দিয়ে আমরা তাঁর প্রতি আমাদের প্রণাম সারলাম:  

‘একদিন অতিথিশালায় ফিরে অচিন্ত্যকুমার বললেন, “তুমি আজ গেলে ভালো করতে। কবি আজ মন খুলেছিলেন। যা বললেন তা অপূর্ব।” আমি জানতে উৎসুক হই। “কী বললেন, শুনি?” কবি বললেন, “অচিন্ত্য, সব সময় মনে রাখবে লোকলক্ষ্মী গর্ভিণী।” অচিন্ত্যকুমার উত্তর দেন। স্তব্ধ হয়ে থাকি আমরা দু’জনে।

এই উক্তির ব্যাখ্যা কবির মুখে শুনিনি। শুনেছিলুম অচিন্ত্যকুমারের মুখে। এতকাল পরে ঠিকমতো লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। মর্ম এই যে, সাহিত্যিক দীর্ঘকাল ধরে এক-একটা স্বপ্নকে বা আইডিয়াকে গর্ভে ধারণ করেন, একটু একটু করে অবয়ব দেন। তারপর যথাকালে প্রসব করেন। যতদিন না প্রসবের সময় হয়েছে ততদিন অন্তরালে থেকে অতি যত্নে গর্ভরক্ষা করেন। গর্ভিণীর এর বাড়া কর্তব্য নেই। লোকের প্রতি সাহিত্যিকেরও কর্তব্য এই। লোকসমাজে অকালে তাড়াহুড়া করে আত্মপ্রকাশ করতে গেলে লোকের ক্ষতি করা হয়,  লেখারও। এই বাণীটি যদিও অচিন্ত্যকুমারের দেওয়া তবু আমিও এটিকে আপনার করে নিই।’                                    

[‘কবির সঙ্গে দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার’(১৯৬১)/গ্রন্থ:‘রবীন্দ্রনাথ’]

*ছবি সৌজন্য: theatlantic, britannica.com, onthisday, wikipedia

কবি গৌতম বসুর জন্ম ১৯৫৫ সালে, দার্জিলিংয়ে। তিনি সেই বিরল কনিদের মধ্যে একজন যিনি নজর কেড়েছিলেন প্রথম বই 'অন্নপূর্ণা ও শুভকাল' থেকেই। সমকালীন বাংলা কবিতায় তাঁর স্থান স্বতন্ত্র। তাঁর প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে অন্যতম: অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে, নয়নপথগামী, স্বর্ণগরুড়চূড়া, রসাতল ইত্যাদি। ২০০৩ সালে রসাতল কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন বীরেন্দ্র পুরস্কার। ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে পেয়েছেন রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, 'স্বর্ণগরুড়চূড়া' কাব্যগ্রন্থের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *