কলকাতার শীতকালের আর একনাম অঞ্জন দত্ত। সম্প্রতি তাঁর ক্রিসমাস কনসার্ট শোনার পর সে ঘোরের ভেতর থেকেই তাই লিখতে বসা। অবশ্য এই ঘোর যে শুধু আমার একার– তা নয়। তামাম দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা অজস্র যুবক-যুবতীরও। ফেসবুকের ‘অঞ্জন দত্ত ফ্যান পেজ‘-এ তাঁদের অনুষ্ঠানের পরের ধারাবাহিক পোস্টগুলো দেখলেই তা বোঝা যাবে। মূলত কোন কোন বিষয় উঠে আসছে সে পোস্টগুলোয়? শুধুই কি শীতকাল আর নস্টালজিয়া? পার্ক স্ট্রিট আর দার্জিলিং? সম্ভবত না। অঞ্জনকে তাঁরা কানেক্ট করছেন আরও এগিয়ে যাওয়া একটা দুনিয়ার ভাষায় ও প্রাসঙ্গিকতায়। আর সে প্রাসঙ্গিকতার কথা এদিনের অনুষ্ঠানেও ফিরে ফিরে এলো।
অর্থাৎ, আজকের দুনিয়া থেকে ‘বৈচিত্র্য‘ শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। কলকাতাকেও আর পাঁচটা শহরের মতোই দেখতে হয়ে যাচ্ছে। অথচ টাকার বদলে রুচিকেই গুরুত্ব দিয়েছে কলকাতা বরাবর। আর আজকের দুনিয়ায় বারবার সেই রান্নাঘরের গল্পই দেখতে-শুনতে চাইছে মানুষ। কারণ, ধুলোমলিন ধর্মতলা বা নেবুতলা পার্কের ভিড় থেকেই এসেছিল নব্বই দশকের পুরনো অঞ্জনের গানগুলো। সেই গানগুলো হয়তো আমাদের শহরের মতই ভাঙাচোরা, ‘ইমপারফেক্ট‘। কিন্তু আজকের চকচকে বোকা-দুনিয়ার গল্প শুনে শুনে ক্লান্তির চেয়ে সেই ভাঙাচোরা গল্পেই লেগেছিল আধুনিকতা আর আন্তর্জাতিকতার বিকেল। সেই ‘অস্টারিটি‘ বা ‘নিরাভরণ‘-এর কথাই এদিনের অনুষ্ঠানে বারবার বলছিলেন অঞ্জন, বলছিলেন আজও তাঁর কাছে হাতঘড়িটা ততটাই জরুরি যতটা জরুরি মোবাইল ফোন।
আসলে, এমন বহু মানুষ এখনও এ শহরে হেঁটে বেড়ান যাঁদের এটিএম কার্ড নেই, ব্যঙ্কে লাইন দিয়েই টাকা তোলেন। তাঁরা গ্রামে থাকেন না। তাঁরাও নাগরিক। আর এখানেই মানে খুঁজে পাচ্ছিল শীতকালের পার্ক স্ট্রিট, ধর্মতলার পুরনো অফিস বাড়িগুলোর গায়ে টাঙানো ভাঙা লেটার বাক্স, নাহুমের কেক থেকে সত্তরের রাস্তায় খুঁজে পাওয়া বব ডিলানের গান, ডুবন্ত টাইটানিকের হিমশৈলের সামনে দাঁড়ানো সাহসী নাবিক থেকে বর্ধমানের আগ্রহী শ্রোতার অঞ্জনবাবুর কাছে ভূতের গানের আবদার… একে একে গল্পগুলো বলে যাচ্ছিলেন অঞ্জন আর সাহস খুঁজে পাচ্ছিল একদল তরুণ, নিজের মতো গান-সিনেমা বানানোর, এই ভাঙাচোরা শহরটাকে নিজের মতো এলোমেলো কিন্তু একরোখা ভালোবাসার…। অনলাইনে কনসার্টের কমেন্ট সেকশানে তারপর ভেসে উঠছিল একে একে তাঁদের চোখের জল লেগে থাকা আখরগুলো।
ধর্মতলায় একটি পুরনো প্রোডাকশান হাউসের স্টুডিওতে বসেই এদিন গান গাইছিলেন অঞ্জন। এ অঞ্চলের আশপাশেই হয়তো তাঁর গানের ‘অশোকা বার‘ বা হয়তো এই এসপ্ল্যানেড দিয়েই হেঁটে গেছেন মাসের প্রথমদিন মাইনে পাওয়া অদ্ভুত ভালো লোকটা বাচ্চার জন্য খেলনা কিনে, একটু আগে। ‘দার্জিলিং-২‘ গানটি গাইতে গাইতে কেঁদেই ফেললেন অঞ্জন। তাতে সুরটা একটু ভুলও হয়ে গেল খানিক। সামলে নিয়ে বললেন, ‘আসলে ইমোশানাল মানুষদের বয়স হলে এই ভুলগুলো হয়ে যায়… দেখুন, দার্জিলিং উচ্চারণ করতেই কেমন কেঁদে ফেললাম!… আর মিষ্টি সুরটা চটে গেল গানের ওইখানটায়…কিন্তু এই ভুলটাও তো ইমোশান আছে বলেই হচ্ছে।‘ এভাবেই অঞ্জনের বলা নিরাভরণের সঙ্গে বারবার কানেক্ট করছিল এদিনের অনুষ্ঠান।
অঞ্জন বলছিলেন, কলকাতার লয় একটু ধীর ট্রামের মতোই। এখানে দুম করে পার্ক স্ট্রিটের নাম বদলে দিলে বা সাউথ সিটি বানিয়ে দিলে বা টাওয়ার-৪২ আর বিগ-বেন বানালেই গল্পটা ব্যাঙ্ককের মতো হয়ে যায় না। ব্যাঙ্কক-দুবাই-সিঙ্গাপুর থাকবে তাদের মতো আর কলকাতা থাকুক তার স্পিরিটে। এই দর্শন আজও বেজে ওঠে অঞ্জনের গলায়, এমনকি তাঁর বেনেপুকুরের বাড়িতে গেলেও। ‘লোকেল‘ বা স্থানীয় আঞ্চলিকতার সঙ্গেই আজও সহবাস করেন অঞ্জন, যে কোনও আন্তর্জাতিক শিল্পীর মতোই। হাজার প্রোমোটারের প্রোলোভন, তিনটে দাঙ্গা, বম্বে তথা হলিউডের হাতছানি পেরিয়েও মধ্য কলকাতার এই সাবেক বাড়িতেই বারবার ফিরেছেন তিনি। যেভাবে তাঁর অগ্রজ সত্যজিৎ বা মৃণাল সেন বা বাদল সরকাররা বিগ বাজেটের প্রোলোভনের বদলে ভালোবেসেছেন কলকাতার সাহেবিয়ানা, সেই স্পিরিটেই নানা অসুবিধে হলেও কিছুতেই এই শেকড় ছাড়বেন না তিনি।

সেই বাড়ি থেকেই গত দু’বছর প্যান্ডেমিকে একাধিক লাইভ অনুষ্ঠানও করেছেন। কখনও নীল দত্ত তো কখনও অমিত দত্তর সহযোগিতায়। কখনও সেখানে বেজে উঠেছে আজান তো কখনও ডেকে উঠেছে বাড়ির কুকুর। সে সব পেরিয়েই অনুষ্ঠানগুলি হাসিমুখেই করেছেন তিনি। কারণ কাজগুলো কতদিন টিকে থাকছে সেটাই শেষবেশ সাকসেসের মাপকাঠি, বেশি টাকা কোনওভাবেই না- এ বিশ্বাস আজও তাঁর রক্তে।
এই কথা আর আবহগুলো ফিরে ফিরে আসছিল এদিনের অনুষ্ঠানেও। অঞ্জন যেন না-বলেও বারবার যৌবনকে বলছিলেন, প্রতিষ্ঠান আর অর্থের টোপ পেরিয়ে আজও একজন একক প্রান্তিক মানুষ নিজের মতো বেঁচে থাকতে পারে এ শহরে। বিরাট টাকা লাগে না। লাগে না বিরাট হোটেলের মত বাড়িও। দরকার নিজেকে ভালোবাসতে জানা, নিজের মতো করে। মনে পড়ে যাচ্ছিল, নভেম্বরের শীত পড়তেই ইন্টারভিউ নিতে গেছিলাম তাঁর এই বেনেপুকুরের বাড়িতে। সেদিন বারবার করেই খুঁড়ছিলাম, কীভাবে তাঁর লেখার তলায় খেলে যায় শহরের এই অবচেতনের ইমেজ, ব্যক্তিমানুষের গভীর এই দুঃখবোধ? কীভাবে দেখেন তিনি এ ছবিগুলো? অঞ্জন বারবারই জবাবে বলছিলেন, এই শহর থেকেই এসেছে এই দুঃখবোধের গান। তিনি শুধু সচেতন ছিলেন, প্রথম দেখছেন কি না মুহূর্তগুলো! আর বলাটা নিজের মতো হচ্ছে কি না… তাঁর গানের নাগরিক এই দুঃখবোধের কথা তাঁকে প্রথম বলেছিলেন কবীর সুমন। এ কথা স্মরণ করে এ দিন সে গানের অনুপ্রেরণাতেই তিনি গাইলেন ‘আকাশভরা সূর্যতারা‘ গানটিও…
অঞ্জন বলছিলেন, কলকাতার লয় একটু ধীর ট্রামের মতোই। এখানে দুম করে পার্ক স্ট্রিটের নাম বদলে দিলে বা সাউথ সিটি বানিয়ে দিলে বা টাওয়ার-৪২ আর বিগ-বেন বানালেই গল্পটা ব্যাঙ্ককের মতো হয়ে যায় না। ব্যাঙ্কক-দুবাই-সিঙ্গাপুর থাকবে তাদের মতো আর কলকাতা থাকুক তার স্পিরিটে।
নানা শিল্পীর গান এভাবেই বারবার ঢুকে পড়েছে তাঁর জীবনে। এ দিন তাঁদের গানগুলিও অকপটেই গাইছিলেন তিনি। কখনও তা ‘হার্ড রেন গনা ফল‘ তো কখনও সাউন্ড অফ মিউজিকের ‘হার্ড টাইমস কাম এগেইন নো মোর‘ তো কখনও ‘লুক ওয়াট দে হ্যাভ ডান তো মাই সং, মা‘ বা ‘বার্ড অন দ্য ওয়ার‘ বা সেন্ড ইন দ্য ক্লাউন‘… ডিলান-কোহেন-মেলানি-সন্ডহিম-রবি ঠাকুর একাকার হতে থাকছিল, যেন নেশা বাড়ছিল শীতের সঙ্গেই। ‘আলিবাবা‘, ‘ক্যালশিয়াম‘, ‘একদিন বৃষ্টিতে‘র মতো অনেকদিন আগে লেখা গানগুলির পাশাপাশিই এদিন সাম্প্রতিককালে লেখা ‘ভগবান জানে‘, ‘খারাপ সময় যেন আর না আসে‘র মতো গানও গাইলেন।

আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অঞ্জন বলছিলেন,
‘ফারেনহাইট ফোর ফিফটি ওয়ান‘-এ ভ্যালুজগুলো বই হয়ে অনেক কথা বলে যাচ্ছে৷ ফ্ল্যাটের লোকটা পাশের ঘরের খবর না রাখলেও, আমি দেখাব সে খবর রাখছে। ওষুধের শিশিটা খাবার টেবিলেই থাকবে, বাজার দেখাতে সাউথ সিটিতে শ্যুট না-করে নিউ মার্কেটে করব, কারণ আমি অ্যান্টিসেপটিক সিনেমা বা শিল্প বানাব না। মাসের প্রথম দিনটা ধর্মতলায় মদ খেয়ে যে কেরানির পা টলে যাবে, তারপরে সে খাবারটা প্লাস্টিকে প্যাক করে বাচ্চার জন্য খেলনা কিনে ফিরবে– এ মানুষগুলোকে আমি অস্বীকার করতে পারি না। এরা কলকাতার কালচারাল ইতিহাসে অনিবার্য। কোরাপশান থেকে অবনমন এবং মিডিওক্রিটি… আমি তার বিরুদ্ধে এভাবেই ইমেজকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করব। আমার গানেও তাই অকারণ কাব্য থাকে না। অনেক অসংলগ্নতা থাকে হয়তো, কিন্তু সেটা হয়তো রাখতেই চেয়েছি। আমার গানে বা অভিনয়ে এই ন্যাচারাল জায়গাটা বরাবর রেখেছি। সেটা মানুষের ভালোও লেগেছে। ভালো লেগেছে মৃণাল সেনেরও। প্রত্যেকটা উচ্চারণের তো একটা নির্দিষ্ট সমাজ-অর্থনীতি আছে… আসলে, এই সংরক্ষণ জরুরি। একটা অরণ্য থেকে বাঘ সরে গিয়ে স্রেফ শেয়াল থাকলে চালাক হয়ে যাবে জাতি। বাঙালির সাহেবিয়ানাটাও ধরে রাখা তাই দরকার খুবই..‘
অনলাইন ক্রিসমাস অনুষ্ঠানে অঞ্জন বলছিলেন, বাড়িতে নিজের মতো রিল্যাক্স মুডে চা বা পানীয় খেতে খেতে গান শোনার কথা। মনে পড়ছিল, ক’দিন পর ১৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা হবে কলকাতার। পার্ক স্ট্রিটে দুনিয়ার মানুষ তখন। অক্সফোর্ডে ঢুকতে গিয়েও পারব না। এত ভিড়! কুয়াশা। খুব দূর দেখা যাবে না। ব্লেজার চাপালেও ঠান্ডা লাগবে। সিগারেট ধরাব। সস্তায় পান করা যায় কোথায়? হালকা? উল্টোদিকে সিলভার গ্রিল। ঢুকে পড়ব। কোনওরকমে ঠাঁই হবে আমাদের। বন্ধুদের। ভিড়ে গিজগিজ করবেই পানশালা। বাইরের ফুটপাতে শীতের টুপি, মাফলার। হরেক পণ্য শীতের। ফ্লুরিজে সপরিবার মানুষ। আস্তে আস্তে ওল্ড মঙ্ক পান করব আমরা। শান্ত হব। উষ্ণ হব। হালকা টলে যাবে পা। জিভ জড়াবে। একটু নেশা.. এলোমেলো কথা।
ক‘দিন পরই বড়দিন। অঞ্জনের গানে হালকা রাম পান করে আমরা বেরিয়ে পড়ি। শেক্সপিয়র সরণী ধরে রাসেল স্ট্রিট। পর্তুগিজ যুবক এসে গিটার বাজান হো চি মিন সরণীতে। টি-মোমো অর্ডার করেন কোরিয়ান দম্পতি। পার্ক স্ট্রিট জুড়ে কত আলো। কত দেশের মানুষ! মিলেনিয়ালদের পার্ক স্ট্রিটে অবশ্য পিপিং রেস্তোরাঁ ছিল, ছিল মিউজিক ওয়ার্ল্ড! দুটোই আর নেই। ৬৬ বছরের অঞ্জন সেই ছোটবেলার ক্যাসেটের লোকটা হয়েই আজও গান গেয়ে চলেছেন। বয়স তাঁকে খিটখিটে করেনি বরং রসিক করেছে আর করেছে ঈশ্বরের প্রতি আস্থাবান। আমি অবাক হয়ে দেখছি, আমাদের মতো সংখ্যালঘু যুবক, যারা শহুরে, তাদের শহুরে সেন্সেবিলিটির আইকন হয়ে আজও ভেসে উঠছে সেই লোকটারই ভাঙাচোরা মুখ… যে লোকটা হয়তো শেষ রেনেসাঁস ব্যক্তিত্ব এই শহরের, যার জীবন কিছুটা গেয়ে কিছুটা লিখে আর কিছুটা সিনেমায় ধরা থাকল, যাতে পরের প্রজন্মের মন বারবার বিষিয়ে গেলেও এই সব দলিল থেকে একটা আন্তর্জাতিক তাপমাত্রা পায় তারা। তারপর রকস্টার মেজাজ নিয়ে কলার তুলে মুখে সিগারেট ধরিয়েই বেপরোয়া রাস্তা পার হয়ে যায় একদল ‘হাফ চকলেট‘ আর ‘ম্যাডলি বাঙালি‘রা, ব্যকরণের তোয়াক্কা না করে, কিছুটা ভুল বানানের স্বচ্ছতাতেই…।
ছবি সৌজন্য: তপোবন ভট্টাচার্য ও উইকিমিডিয়া কমনস্
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।