আগের পর্বের লিংক: [] [] [] []

ওহ! কী কষ্ট যে হল ফসল কাটতে! খাটুনির চোটে ওরা একেবারে ঘেমে-নেয়ে একসা হয়ে গেল। তবে সেই হাড়-ভাঙা পরিশ্রমের পুরস্কারও পাওয়া গেল হাতে হাতে। এবছর প্রচুর ফসল হয়েছে। তারা যা আশা করেছিল তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি। তবে কখনও সখনও ওদের যে বেগ পেতে হয়নি, তা নয়। আসলে ফসল কাটার যন্ত্রপাতিগুলো সবই তো মানুষের কাজের জন্য তৈরি, পশুদের জন্য তো নয়। বিশেষ করে যেসব যন্ত্রগুলো পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ব্যবহার করতে হয়, সেগুলো নিয়ে হয়েছে মহা ঝামেলা। কোনও জানোয়ারই ওগুলো নিয়ে কাজ করতে পারে না। 

তবে শুয়োররা এতই বুদ্ধিমান, যে মাথা খাটিয়ে ঠিক কিছু-না-কিছু উপায় বের করে ফেলে। আর ঘোড়ারা তো খেতের প্রতিটি কোণা হাতের তালুর মতো চেনে। সত্যি বলতে কী, খড় কাটা বা আঁটি বাঁধার মতো কাজগুলো কীভাবে করতে হয়— সেটা তারা জোন্স আর তার লোকেদের চেয়ে ঢের ভাল জানে। শুয়োররা অবশ্য খুব একটা কাজ-টাজ করার ধার দিয়ে যায় না, খালি বাকিদের নির্দেশ দেয় আর তদারকি করে। তারা জ্ঞানে-বুদ্ধিতে পশুদের মধ্যে সেরা, তাই নেতৃত্বের ভার যে তাদের উপরেই এসে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক।

বক্সার আর ক্লোভার এখন নিজেরাই নিজেদের ফসল কাটার যন্ত্রের সঙ্গে জুতে নেয় (এখন অবশ্য নাকে কড়া আর লাগাম লাগাবার দরকার পড়ে না)। তারপর দৃঢ়, ভারী পদক্ষেপে খেত-জুড়ে ঘুরতে থাকে। ওদের পেছন পেছন হাঁটে একটা শুয়োর। সে দরকার মতো ‘হ্যাট হ্যাট কমরেড’ বা ‘রোককে কমরেড’ বলে হাঁক পাড়ে। সবচেয়ে নগণ্য জানোয়ারটা পর্যন্ত খড় কাটা আর তোলার কাজে লেগে পড়েছে। এমনকী হাঁসমুরগিরাও রোদের মধ্যে সারাদিন ধরে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘুরে ঘুরে কাজ করছে। একটা সামান্য খড়কুটো পর্যন্ত নিজেদের ঠোঁটে করে এনে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে যাচ্ছে। 

শেষমেষ দেখা গেল, জোন্স আর তার দলবল ফসল কাটতে যে-সময় নিত, তার চেয়ে দু’দিন আগেই ফসল কাটার কাজ সেরে ফেলছে জন্তুরা। আরও বড় ব্যাপার— এত ফসল এই খামারে জীবনে কখনও হয়নি। তবুও কোনওরকম অপচয় যাতে না হয়, সে জন্য হাঁস-মুরগিরা কড়া নজর রেখে শেষ কুটোটা পর্যন্ত এনে জমা করল। খামারের একটা জানোয়ারও এবার খুব একটা চুরি করেনি। গালভর্তি করে খাওয়ার মতোও নয়।

পুরো গ্রীষ্মকালটা জুড়ে একেবারে ঘড়ির কাঁটা মেনে কাজ চলল খামারে। এসব যে কোনওদিন সম্ভব হতে পারে, তা পশুরা কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি। খাবারের প্রতিটি গ্রাস মুখে পুরতেই যেন আনন্দের লহর বয়ে যাচ্ছে— এ খাবার এক্কেবারে তাদের নিজেদের মেহনতের ফসল, কোনও হিংসুটে মনিবের দয়ার দান নয়। 

পরজীবী অকর্মার ধাড়ি মানুষগুলো যেই না বিদেয় হয়েছে, অমনি দেখো সকলের জন্য কত্ত খাবার! শুধু খাবার? অবসরও তো যথেষ্টই পাওয়া যাচ্ছে। যদিও এসব কাজে তারা এখনও অনভিজ্ঞ। কখনও কখনও যে সমস্যায় পড়তে হয় না, তা নয়। যেমন, পরের দিকে ফসল কেটে নিয়ে এসে তা মাড়াই করতে হল একেবারে মান্ধাতা আমলের পদ্ধতিতে। তারপর ভুসিগুলো উড়িয়ে দিতে হল ফুঁ দিয়ে। কারণ একটাই, খামারে কোনও মাড়াই যন্ত্র নেই। তবে শুয়োরদের বুদ্ধি আর বক্সারের অসাধারণ পেশিশক্তির জোরে সব সামাল দেওয়া গেল। 

পুরো গ্রীষ্মকালটা জুড়ে একেবারে ঘড়ির কাঁটা মেনে কাজ চলল খামারে। এসব যে কোনওদিন সম্ভব হতে পারে তা পশুরা কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি। খাবারের প্রতিটি গ্রাস মুখে পুরতেই যেন আনন্দের লহর বয়ে যাচ্ছে— এ খাবার এক্কেবারে তাদের নিজেদের মেহনতের ফসল, কোনও হিংসুটে মনিবের দয়ার দান নয়। 

বক্সার হচ্ছে খামারের সবার অনুপ্রেরণা। জোন্সের সময়ও সে প্রচুর পরিশ্রম করত, তবে এখন তাকে দেখলে যেন মনে হয়, তিনটে ঘোড়ার শক্তি এসে ভর করেছে তার শরীরে। কোনও কোনও দিন তো যেন ফার্মের সব কাজ গিয়ে চাপে বক্সারের শক্তিশালী কাঁধে। সারাটা দিন সে কিছু না কিছু করেই চলেছে। যেখানে সবচেয়ে কঠিন কাজ, বক্সার সেখানে সবসময় হাজির। একটা ছোট্ট মোরগছানাকে বক্সার বলে রেখেছে, রোজ সকালে সবাই ওঠার আধঘণ্টা আগে তাকে ডেকে দিতে। প্রতিদিনের গতানুগতিক কাজ শুরু হওয়ার আগে এই আধঘণ্টা খামারের সবচেয়ে জরুরি কোনও কাজে সে স্বেচ্ছাশ্রম দেয়। যে কোনও সমস্যা বা বাধাবিপত্তির সামনে পড়লে তার মুখে সবসময় একটাই কথা, ‘আমাকে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হবে।’ এই কথাটা যেন এখন ওর জীবনের মূলমন্ত্রই হয়ে গেছে। 

প্রত্যেকেই নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করছে। মুরগি আর হাঁসেদের কথাই ধরা যাক। তারা যে পরিমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শস্য একজোট করেছে, তা প্রায় পাঁচ বুশেলের (১ বুশেল = ৮ গ্যালন) সমান। কেউ চুরি করছে না, কেউ তার বরাদ্দ খাবারের পরিমাণ নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে না। ঝগড়াঝাঁটি, কামড়াকামড়ি, যেগুলো এক সময় ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার— সেসব এখন আর নেই বললেই চলে। কাজের সময় কেউ ফাঁকি দেয় না। 

‘প্রায়’ কেউই দেয় না, বলাই ভাল। সত্যি বলতে কী, মলি সক্কাল-সক্কাল ঘুম থেকে উঠতে পারে না। ওদিকে আবার আজব ছুতোয় মাঠ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেও আসে। বলে তার খুরের ভেতর নাকি পাথর ঢুকেছে। আর বিড়ালটার স্বভাবও কিছুটা বিটকেল রকমের। কাজের সময় তার টিকিও পাওয়া যায় না। ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা সে বেপাত্তা থাকে। অথচ খাবার সময় সে ঠিকই এসে হাজির। কিংবা কাজ শেষ হবার পর, সন্ধেবেলা সে উদয় হয়, এমন একটা ভাব করে, যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু সে এমন চমৎকার সব কৈফিয়ৎ দেয় আর এমন আদুরে গলায় ঘরর-ঘরর করে যে তার শুভ উদ্দেশ্য নিয়ে কারও পক্ষেই আর সন্দেহ করা সম্ভব হয় না।

কেবলমাত্র বুড়ো গাধা বেঞ্জামিনের মধ্যেই বোধহয় বিপ্লবের পরেও কোনও বদল আসেনি। জোন্সের আমলে সে যেমন একগুঁয়ের মতো ঢিমেতালে কাজ করত, এখনও তেমনই করে। ফাঁকি দেয় না বটে, তবে স্বেচ্ছায় বাড়তি কোনও কাজও করে না। বিপ্লব বা তার ফলাফল নিয়েও সে কোনও মতামত দেয় না। জোন্স চলে যাওয়ায় সে আগের চেয়ে বেশি আনন্দে আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে সে শুধু বলে, “গাধারা বহুকাল বাঁচে। তোমাদের মধ্যে কেউই কখনও কোনও মরা গাধা দেখনি।” এ-রকম একটা দুর্বোধ্য উত্তর পেয়েই সবাইকে সন্তুষ্ট হতে হয়।

রবিবার ছুটির দিন, কোনও কাজ থাকে না। সকালের জলখাবার অন্যদিনের চেয়ে সেদিন একঘণ্টা দেরিতে হয়। জলখাবারের পর একটা অনুষ্ঠান থাকে। আর কিছু হোক বা না-হোক, এই অনুষ্ঠানটা প্রতি সপ্তাহে হবেই। প্রথমে পতাকা তোলা হয়। জোন্সগিন্নির সাজগোজ করার ঘরে একটা সবুজ রঙের পুরোনো টেবিলক্লথ পেয়েছিল স্নোবল। তার ওপরে সে সাদা রং দিয়ে একটা খুর আর শিং এঁকে নিয়েছে। সেটাকেই খামারবাড়ির বাগানে প্রতি রবিবার সকালে একটা খুঁটির ওপর ওড়ানো হয়। পতাকার রং সবুজ কেন সে ব্যাপারে স্নোবল-এর ব্যাখ্যা— সবুজ রংটা ইংল্যান্ডের সবুজ মাঠের প্রতীক। অন্যদিকে শিং আর খুর মানুষজাতিকে পৃথিবীর বুক থেকে পুরোপুরি উৎখাত করার পর যে পশু-প্রজাতন্ত্রের উত্থান হবে তার প্রতীক।

বক্সার হচ্ছে খামারের সবার অনুপ্রেরণা। জোন্সের সময়ও সে প্রচুর পরিশ্রম করত, তবে এখন তাকে দেখলে যেন মনে হয় তিনটে ঘোড়ার শক্তি এসে ভর করেছে তার শরীরে। কোনও কোনও দিন তো যেন ফার্মের সব কাজ গিয়ে চাপে বক্সারের শক্তিশালী কাঁধে। সারাটা দিন সে কিছু না কিছু করেই চলেছে। যেখানে সবচেয়ে কঠিন কাজ, বক্সার সেখানে সবসময় হাজির।

পতাকা তোলার পর জানোয়াররা একটা সাধারণ সমাবেশের জন্য বড় গোলাবাড়িতে এসে একজোট হয়, যার নাম দেয়া হয়েছে সভা। এই সভায় আগামী সপ্তাহের কাজের পরিকল্পনা করা হয় এবং বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক হয়। প্রস্তাব পেশ করার কাজটা শুয়োররাই সবসময় করে থাকে। বাকি জন্তুরা জানে কীভাবে ভোট দিতে হয় কিন্তু নিজেরা কখনও কোনও প্রস্তাব রাখার কথা ভাবে না। বিভিন্ন বিতর্কের সময় সবচেয়ে সক্রিয় থাকে স্নোবল আর নেপোলিয়ন। কিন্তু দেখা গেছে যে, তারা নিজেরা কখনও কোনও বিষয়ে একমত হতে পারে না। একজন কোনও একটা প্রস্তাব দিলেই অন্যজন ঠিক তার বিরোধিতা করে। 

যেমন একটা সভায় ঠিক করা হল যে, কাজ থেকে অবসর নেওয়া পশুদের বৃদ্ধাবাস হিসেবে ফলবাগানের পেছনের ছোট মাঠটা— যেখানে ঘোড়াদের প্রশিক্ষণ দেয়া হত— সেটা ছেড়ে দেওয়া হবে। সবার সম্মতিতেই সেই প্রস্তাব গ্রহণ করা হল। এবার স্নোবল আর নেপোলিয়নের মধ্যে তর্ক বেধে গেল বিভিন্ন পদের অবসর নেওয়ার সঠিক বয়স নিয়ে। সভা শেষ হয় ‘ইংল্যান্ডের পশুরা’ গেয়ে। রবিবারের বিকেলবেলা কাজে ছাড় থাকে।  সবাই মিলে একটু আনন্দ-ফূর্তি করে। 

ঘোড়ার সাজঘরটাকে এখন শুয়োরেরা নিজেদের প্রধান কার্যালয় বানিয়েছে। রোজ সন্ধেবেলা তারা এখানে বসে বই পড়ে পড়ে কামারের কাজ, ছুতোরের কাজ-সমেত আরও বিভিন্ন কারিগরি বিদ্যে শেখে। এইসব বইপত্তর তারা খামারবাড়ি থেকে খুঁজেপেতে নিয়ে এসেছে। ওদিকে স্নোবল আবার লেগে পড়ল বিভিন্ন জানোয়ারদের একজোট করে পশুসমিতি তৈরি করার কাজে। এসব ব্যাপারে তার কোনও ক্লান্তি নেই।

মুরগিদের জন্য সে তৈরি করল ‘আরও ডিম পাড়ো সমিতি’। গরুদের জন্য ‘লেজ সাফাই সমিতি’। ইঁদুর বা খরগোশদের পোষ মানাতে ‘বনের বন্ধু আবার শেখো সমিতি’, ভেড়াদের জন্য ‘তুষারধবল পশম আন্দোলন’— এরকম আরও কত-শত সমিতি গড়ে ফেলল সে। এ-ছাড়াও পড়তে-লিখতে শেখার ক্লাস তো আছেই।

Arka Paitandi

অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *