আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] []

গ্রীষ্মকাল শেষ হয়ে এসেছে। ইতোমধ্যেই উইলিংডন জেলার প্রায় অর্ধেক অংশে পশুখামারের ঘটনাটা রীতিমতো চাউর হয়ে গেছে। প্রতিদিন নিয়ম করে স্নোবল আর নেপোলিয়ন কয়েকঝাঁক পায়রা উড়িয়ে দেয়। পায়রাগুলোকে আগে থেকেই বেশটি করে শিখিয়ে পড়িয়ে রাখা থাকে। তারা করে কী, আশপাশের খামারগুলোতে গিয়ে সেখানকার পশুদের সঙ্গে প্রথমে বন্ধুত্ব পাতায়। তারপর সময়-সুযোগ বুঝে তাদের বিপ্লবের গল্প শোনায়, পারলে ‘ইংল্যান্ডের পশুরা’ গানটাও শিখিয়ে দিয়ে আসে।

অন্যদিকে জোন্স সাহেব আবার আজকাল বেশিরভাগ সময়টাই কাটান রেড লায়ন পানশালায়। সেখানে তিনি যাকে পান, তাকেই ধরে নিজের দুঃখ দুর্দশার কাহিনি শোনাতে শুরু করেন— কীভাবে একদল অপদার্থ বদমাইশ জানোয়ারের হাতে নিজের জমিজমা সব খুইয়ে তাঁকে পালিয়ে আসতে হয়েছে। সে সব শুনেটুনে অন্যান্য চাষিরা তাঁকে আদর্শগতভাবে সহানুভূতি দেখায় বটে, তবে তাদের কাছ থেকে কোনওরকম সাহায্য পাওয়া যায় না। লোকগুলো আসলে পয়লা নম্বরের ধান্দাবাজ। সবাই তলায় তলায় ভাবছে, কী করে জোন্সের এই দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে ফাঁকতালে কিছুটা ফায়দা লুটে নেওয়া যায়।

তবে এটাই রক্ষে, যে জোন্সের প্রতিবেশী দুই খামার-মালিকের মধ্যে একেবারেই বনিবনা নেই। এর মধ্যে ‘ফক্সউড’ নামের খামারটা একটু সেকেলে ধরনের হলেও বেশ বড়সড়। হেলাফেলায় খামারের অধিকাংশটা জঙ্গলে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। পশুদের চরার জন্য যে মাঠ, সেটার অবস্থাও খুবই খারাপ। বেড়াগুলোরও বেহাল দশা।

ফক্সউডের মালিক মিস্টার পিলকিংটন নির্ঝঞ্ঝাট লোক। মাছ ধরে আর শিকার করেই তাঁর বেশিরভাগ সময় কেটে যায়। 

আর অন্যদিকে রয়েছে ‘পিঞ্চফিল্ড’ খামার। এটা আকারে আগেরটার তুলনায় ছোট হলেও অবস্থা ভাল। পিঞ্চফিল্ডের মালিক মিস্টার ফ্রেডরিক কড়া ধাতের বদমেজাজি মানুষ। যেকোনও বিষয়ে দরকষাকষিতে তিনি সিদ্ধহস্ত। সঙ্গে মামলাবাজ বলেও তাঁর বেশ বদনাম আছে। কিন্তু এই দুই খামার মালিক পরস্পরকে এতই অপছন্দ করেন যে নিজেদের মুনাফার খাতিরেও কোনও রকম সন্ধি করতে তাঁরা রাজি নন। যদিও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, যে তাঁদের দু’জনকেই কিন্তু পশুখামারের এই বিপ্লব বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছে। তাঁদের নিজেদের খামারের জন্তুরা যাতে এই বিপ্লবের কথা খুব বেশি জেনে না ফেলে সে-ব্যাপারে তাঁরা সবসময় কড়া নজর রেখে চলেছেন। 

গোড়ায় অবশ্য ওঁরা এমন একটা ভাব করছিলেন যেন, জন্তুরা নিজেরাই একটা খামার চালাচ্ছে, এরকম একটা হাস্যকর ঘটনাকে তাঁরা পাত্তাই দিচ্ছেন না। বলছিলেন, “আরে বাবা, দিন পনেরো যেতে দাও, দেখো না কেমন সবার হাওয়া বেরিয়ে যায়। ম্যানর ফার্মের (ওঁরা এখনও ম্যানর ফার্মই বলে চলেছেন। অ্যানিমাল ফার্ম নামটা ওদের কাছে একেবারেই অসহ্য।) জন্তুগুলো তো নিজেদের মধ্যেই মারামারি লাগিয়ে দিয়েছে। এভাবে ক’দিন টিকবে? অ্যাঁ? কিছুদিনের মধ্যেই না খেতে পেয়ে মরবে সব।”

কিন্তু দিনের পর দিন কাটতে থাকল। যখন দেখা গেল অ্যানিমাল ফার্মের কোনও জন্তুই না খেতে পেয়ে মরল না, তখন ফ্রেডরিক আর পিলকিংটন সুর বদলালেন। তাঁরা বলতে লাগলেন, “অন্ধকারের রাজত্ব চলছে অ্যানিম্যাল ফার্মে। জন্তুগুলো নিজেরাই নিজেদের খেতে শুরু করেছে। দুর্বল প্রাণীদের ঘোড়ার নাল গরম করে ছ্যাঁকা দেয়া হচ্ছে। অকথ্য অত্যাচার করা হচ্ছে মাদি জানোয়ারগুলোর উপর। প্রকৃতির নিয়ম-কানুনের বিরুদ্ধে যাওয়ার এই হচ্ছে ফল।” যদিও তাঁদের কথা কখনওই কেউ পুরোপুরি বিশ্বাস করল না। 

অন্যদিকে জোন্স সাহেব আবার আজকাল বেশিরভাগ সময়টাই কাটান রেড লায়ন পানশালায়। সেখানে তিনি যাকে পান, তাকেই ধরে নিজের দুঃখ দুর্দশার কাহিনি শোনাতে শুরু করেন— কীভাবে একদল অপদার্থ বদমাইশ জানোয়ারের হাতে নিজের জমিজমা সব খুইয়ে তাঁকে পালিয়ে আসতে হয়েছে।

আশ্চর্য এক খামারের কথা চারিদিকে রটে গেল, যেখানে জানোয়াররা মানুষকে হটিয়ে নিজেরাই সবদিক সামাল দিচ্ছে। কিছুটা সত্যি কিছুটা কল্পনা মেশানো এইসব গল্পগুলো ছড়িয়ে পড়তে থাকল চারিদিকে। এর ফলে যেন বছরভর একটা বিদ্রোহের ঢেউ বয়ে গেল গ্রামগঞ্জের খামারগুলোয়। যে ষাঁড়গুলোকে খুব সহজেই পোষ মানানো যেত, সেগুলো হঠাৎই কেমন যেন জংলি হয়ে উঠল। বেড়াটেড়া ভেঙে সব ক্লোভার ঘাস খেয়ে ফেলল ভেড়ার দল। গরুরা লাথি মেরে দুধের বালতি উল্টে দিতে লাগল। ঘোড়দৌড়ের সময় ঘোড়াগুলো পর্যন্ত হার্ডল টপকাতে চায় না, বরং পিঠ থেকে চালককে উল্টে ফেলে দেয় হার্ডলের ওপাশে। সবচেয়ে বড় কথা ‘ইংল্যান্ডের পশুরা’ গানটার সুর, এমনকী কথাগুলো পর্যন্ত সবাই জেনে গেল। দাবানলের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এই গানটাকে নিয়ে মানুষেরা অনেক মজা মশকরা করে বটে, কিন্তু এ-গান কানে গেলে তাদের পক্ষে আবার রাগ সামলানোও মুশকিল হয়ে পড়ে। তারা বলে, “তাজ্জব ব্যাপার! এমন একটা বিটকেল গান জন্তুগুলো শিখল কী করে?” এই গান গাইতে গিয়ে কোনও জন্তু যদি কখনও ধরা পড়ে তা-হলে সেখানেই তাকে বেশ করে চাবকানো হয়।

এতকিছু সত্ত্বেও কিন্তু এই গানটাকে দমিয়ে রাখা গেল না। ব্ল্যাকবার্ডরা ঝোপেঝাড়ে বসে এই সুরে শিস দিয়ে যায়। দেবদারু গাছের ডালে পায়রার দল সেই সুরে বকবকম করে, আর তারই প্রতিধ্বনি যেন শোনা যায় কামারের হাতুড়ির ঘায়ে, গির্জার ঘণ্টার আওয়াজে। এই সুর যেন কোনও অমঙ্গলের ভবিষ্যৎবাণী। মানুষের অন্তরাত্মা অবধি যেন কেঁপে ওঠে সেই সুর শুনে।

অক্টোবরের শুরুর কথা। তখন সবে-সবে ফসল কাটা হয়েছে। কিছুটা ফসল মাড়াই করাও হয়েছে। এমনই একদিন পায়রার ঝাঁক হাওয়ায় পাক খেতে খেতে খামারের উঠোনে নেমে এল। তারা অসম্ভব উত্তেজিত— জোন্স আসছে, সঙ্গে তার দলবল। এছাড়াও রয়েছে ফক্সউড আর পিঞ্চফিল্ডের আরও ডজনখানেক লোক।

ইতিমধ্যেই ওরা পাঁচ-গরাদের সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। এখন গাড়ি-রাস্তা ধরে খামারের দিকে এগিয়ে আসছে। জোন্স বাদে সবার হাতেই লাঠিসোঁটা রয়েছে। জোন্সের হাতে রয়েছে বন্দুক। সেটা বাগিয়ে ধরে সবার আগে আগে হেঁটে আসছে সে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, খামারটাকে ফের নিজেদের দখলে আনাটাই ওদের উদ্দেশ্য।

এমন কিছু একটা যে হতে পারে, সেরকম আশঙ্কা করে জন্তুরা আগে থেকেই মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে ছিল। খামারবাড়িতে নেপোলিয়নের সমরাভিযানের ওপর একটা বই পেয়েছিল স্নোবল। বইটা সে খুব মন দিয়ে পড়েছে। সুতরাং আজকে খামার প্রতিরক্ষায় নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব গিয়ে পড়ল তারই ওপর। স্নোবল দ্রুত সবরকম নির্দেশ দিয়ে দিল। জন্তুরাও অমনি নিজের নিজের জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে বসল।

মানুষের দল খামার বাড়ির দিকে এগোতেই প্রথম দফার আক্রমণ শানাল স্নোবল। পঁয়ত্রিশটা পায়রার একটা ঝাঁক সোজা গিয়ে হাজির হল সেই মানুষগুলোর মাথার উপরে। তারপর মাঝ-আকাশে এদিক সেদিক উড়তে উড়তে ওদের মাথায় বিষ্ঠা ফেলতে লাগল। মানুষের দলটা যখন বিষ্ঠা মেখে নাজেহাল, ঠিক তখনই ঝোপের আড়াল থেকে ছুটে বেরিয়ে এল রাজহাঁসের দল। তারপর মানুষদের পায়ের গোড়ালিতে ভয়ংকরভাবে ঠোকরাতে শুরু করল। 

বলা বাহুল্য, এগুলো সবই কিন্তু আলগা লড়াই। মানুষের দলটায় সামান্য বিশৃঙ্খলা তৈরির কৌশলমাত্র। জোন্সের দলবল খুব সহজেই লাঠির বাড়ি মেরে হাঁসগুলোকে হটিয়ে দিল। এবার শুরু হল দ্বিতীয় দফার আক্রমণ। স্নোবলকে সামনে রেখে মুরিয়েল, বেঞ্জামিন আর ভেড়ার পাল ঝাঁপিয়ে পড়ল মানুষদের উপর। সবদিক থেকে ধাক্কা দিয়ে, গুঁতো মেরে একেবারে অস্থির করে দিল। বেঞ্জামিন তার পেছনের পায়ের ছোট ছোট খুর দিয়ে সমানে চাঁট মেরে যেতে লাগল। কিন্তু এবারেও খুব একটা সুবিধে হল না। মানুষের লাঠির ঘায়ে আর কাঁটা লাগানো জুতোর লাথি খেয়ে জন্তুগুলো বেকায়দায় পড়ল।

আশ্চর্য এক খামারের কথা চারিদিকে রটে গেল, যেখানে জানোয়াররা মানুষকে হটিয়ে নিজেরাই সবদিক সামাল দিচ্ছে। কিছুটা সত্যি কিছুটা কল্পনা মেশানো এইসব গল্পগুলো ছড়িয়ে পড়তে থাকল চারিদিকে। এর ফলে যেন বছরভর একটা বিদ্রোহের ঢেউ বয়ে গেল গ্রামগঞ্জের খামারগুলোয়।

হঠাৎ স্নোবল একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল। এটা পিছু হটার নির্দেশ। অমনি সব জানোয়াররা উল্টো দিক ফিরে খোলা দরজা দিয়ে খামারের উঠোনের দিকে চম্পট দিল। যুদ্ধ জেতার আনন্দে মানুষের দল একেবারে হইহই করে উঠল। তারা ভেবে বসল জানোয়ারের দল বুঝি ভয়ের চোটে ময়দান ছেড়ে পিঠটান দিচ্ছে। তাই জোন্সের দলবল যে যেমন পারল এদিক ওদিক জানোয়ারগুলোর পিছু ধাওয়া করল। আর এটাই ছিল স্নোবলের উদ্দেশ্য।

 

যেই না তারা জন্তুদের পিছুপিছু ফার্মের উঠোনে এসে ঢুকল, অমনি কোত্থেকে তিনটে ঘোড়া, তিনটে গরু, আর ফার্মের বাকি শুয়োরগুলো পেছন থেকে এসে লাফিয়ে পড়ল ওদের ওপর। ওরা এতক্ষণ গোয়ালঘরের ভেতর ঘাপটি মেরে ছিল। আচমকা বেরিয়ে এসে মানুষের দলটাকে পুরো ছত্রভঙ্গ করে দিল। এবার আক্রমণের সংকেত দিল স্নোবল এবং সে নিজে ধেয়ে গেল সোজা জোন্সের দিকে। তাকে ছুটে আসতে দেখামাত্র জোন্স বন্দুক উঁচিয়ে গুলি চালালেন। গুলিটা স্নোবল-এর পিঠে একটা রক্তের আঁচড় কেটে গিয়ে লাগল একটা ভেড়ার গায়ে। ভেড়াটা তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। স্নোবল কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও থমকাল না। তার পঁচানব্বই কিলো ওজনের শরীরটা দিয়ে সজোরে ধাক্কা মারল জোন্সের পায়ে। সেই ধাক্কা জোন্স সামলাতে পারলেন না। উল্টে গিয়ে পড়লেন গোবরের গাদার মধ্যে। হাতের বন্দুকটাও কোথায় যেন ছিটকে পড়ল। 

 

তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল বক্সার। সে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সামনের পাগুলো চালাতে লাগল। লোহার নাল লাগানো তার বিশাল খুরের প্রথম আঘাত গিয়ে পড়ল এক ছোঁড়ার মাথায়। সে ব্যাটা ফক্সউডের আস্তাবলে কাজ করত। ওই একটা আঘাতেই সে নিষ্প্রাণ শরীরে কাদায় লুটিয়ে পড়ল। এই দৃশ্য দেখে কয়েকজন ভয়ের চোটে হাতের লাঠি ফেলে দিয়ে পালাবার চেষ্টা করল। পরমুহূর্তেই দেখা গেল খামারের উঠোনে গোল গোল ছুটে চলেছে মানুষগুলো। আর তাদের পেছনে তাড়া করে চলেছে জানোয়াররা। কখনও গুঁতো মারছে, কখনও লাথি মারছে, কখনও কামড়ে দিচ্ছে, কখনও বা মাটিতে ফেলে পিষে দিচ্ছে। 

 

এভাবে ফার্মের প্রত্যেকটা জন্তুই নিজের নিজের মতো করে মানুষের উপর প্রতিশোধ নিয়ে নিল। এমনকি বেড়ালটা পর্যন্ত আচমকা ছাদ থেকে গোয়ালার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে তার গলায় আঁচড়ে দিল। গোয়ালা নিদারুণ যন্ত্রণায় চিৎকার করতে শুরু করল। এমন সময় একটু ফাঁক পেয়ে লোকগুলো হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল খামারের উঠোন ছেড়ে। তারপর বড় রাস্তার দিকে দে দৌড়। যে রাস্তা ধরে মিনিট পাঁচেক আগে সবাই মিলে বুক ফুলিয়ে খামার-বিজয়ে এসেছিল, এখন লজ্জাজনকভাবে হেরে ভূত হয়ে সেই রাস্তা ধরেই সবাই পালাচ্ছে। একদল হাঁস রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কিছু দূর পর্যন্ত ওদের পিছু নিল আর সমানে ওদের পায়ের গোড়ালিতে ঠোক্কর মারতে লাগল। দুর্দশার একশেষ আর কাকে বলে!

 

সব্বাইকে খেদিয়ে দেয়া গেল, একজন বাদে। বক্সারের চাঁট খাওয়া সেই ছোঁড়া তখনও একইভাবে খামারের উঠোনে কাদায় মুখ গুঁজে পড়ে আছে। বক্সার পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে তাকে চিত করে শোয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ছেলেটা নড়াচড়ার নামগন্ধও করছে না। বক্সার কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, “ইস! ছেলেটা বোধ হয় মরে গেছে। সত্যি বলছি আমি কিন্তু ওকে মেরে ফেলতে চাইনি। আমার খুরে যে লোহার নাল লাগানো আছে তা একদম মনে ছিল না। কিন্তু এখন এসব কথা আর কে-ই বা বিশ্বাস করবে!”

স্নোবল-এর পিঠের ক্ষত থেকে এখনও রক্ত ঝরছে। সেই অবস্থাতেই সে হুংকার দিয়ে উঠল, “মানুষের জন্য কোনও সহানুভূতি নয় কমরেড। যুদ্ধটা যুদ্ধই। সব মানুষের মধ্যে একমাত্র এই মরা মানুষগুলোই হল গিয়ে সবচেয়ে নিরাপদ।”

 

“আমি কাউকে মারতে চাই না। এমনকী মানুষদেরও নয়।” বলতে-বলতে বক্সারের চোখে জল চলে এল। এমন সময় কেউ একজন হঠাৎ বলে উঠল, “আরে! মলিকে দেখছি না যে! ও আবার কোথায় গেল?” সত্যিই তো! মলি কোথায়? এক মুহূর্তের জন্য সবাই ঘাবড়ে গেল। মলি কি কোনওভাবে চোট পেয়েছে? না কি লোকগুলো ওকে ধরে নিয়ে চলে গেল? যাইহোক, শেষমেশ অবশ্য ওকে খুঁজে পাওয়া গেল। মলি ওর আস্তাবলের ঘরটাতেই জাবনার গামলার খড়ের মধ্যে মুখ গুঁজে চুপটি করে বসেছিল। বন্দুকের আওয়াজ পাওয়ামাত্রই নাকি সে চম্পট দিয়েছিল। তখন থেকে এখানেই লুকিয়ে আছে। 

 

সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে আবার খামারের উঠোনে ফিরে আসতেই দেখা গেল সেই মরা ছেলেটা কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেছে! কী কাণ্ড! তার মানে হতভাগা মরেনি! একটুখানি মূর্ছা গিয়েছিল কেবল! জানোয়াররা এবার একজোট হয়ে আনন্দে উত্তেজনায় একেবারে লাফালাফি হইচই জুড়ে দিল। প্রত্যেকে গলা চড়িয়ে ফলাও করে নিজের নিজের বাহাদুরির কাহিনি বলছে। একটা তাৎক্ষণিক বিজয়োৎসবের আয়োজনও করা হল। পতাকা উড়িয়ে সবাই মিলে ‘ইংল্যান্ডের পশুরা’ গাইল বেশ কয়েকবার। তারপর গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে সেই মৃত ভেড়াটাকে কবর দেওয়া হল। কবরের উপরে পুঁতে দেয়া হল একটা কাঁটাঝোপ। কবরের পাশেই দাঁড়িয়ে একটা ছোটখাটো বক্তৃতা দিল স্নোবল। পশুখামারকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে নিজের জান কবুল করার জন্যও কেন সকলকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে— এই ছিল তার মূল বক্তব্য।

 

জন্তুরা এবার সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিল যে, যুদ্ধে যারা সাহসিকতা দেখিয়েছে তাদের বিশেষ কিছু সামরিক সম্মান দেওয়া হবে। তৎক্ষণাৎ ‘প্রথম শ্রেণীর জানোয়ার বাহাদুর’ খেতাব পেল স্নোবল আর বক্সার। সঙ্গে একটি করে পেতলের পদক। এগুলো অবশ্য পাওয়া গেছে ঘোড়ার লাগাম-ঘরে। ঠিক হল এই পদক ওরা প্রতি রবিবার আর ছুটিছাটার দিনগুলোয় পরবে। মৃত ভেড়াটাকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর জানোয়ার বাহাদুর’ নামক মরণোত্তর খেতাব দিয়ে সম্মান জানানো হল। আর এই যুদ্ধটারও তো একটা নাম দিতে হবে। কী নাম দেওয়া যায়! সেই নিয়ে অনেক আলোচনা হল। অবশেষে ঠিক হল যুদ্ধটাকে ‘গোয়ালঘরের যুদ্ধ’ বলা হবে কারণ গোয়ালঘর থেকেই সেই দুরন্ত লড়াইটা শুরু হয়েছিল। জোন্স সাহেবের বন্দুকটা পড়েছিল কাদার মধ্যে। সবাই জানে খামার বাড়িতে কিছু কার্তুজ আছে। সুতরাং সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে পতাকাদণ্ডের পায়ের কাছে বন্দুকটা তোপের মতো করে রাখা থাকবে। প্রতিবছর দু’বার তোপ দাগা হবে। ১২ অক্টোবর ‘গোয়ালঘরের যুদ্ধ’-র বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আর গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে বিপ্লবের বর্ষপূর্তির আনন্দে।

Arka Paitandi

অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *