কোরক বসুর কণ্ঠে এই ফিচারটির পডকাস্ট শুনতে হলে ক্লিক করুন

ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ করেই ভীষণ একটা গোলমাল বেধে গেল। হয়েছে কী, মেজর যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন চারটে ধেড়ে ইঁদুর চুপি-চুপি তাদের গর্ত থেকে বেরিয়ে একদম পেছনের সারিতে বসে বক্তৃতা শুনছিল। আচমকা কুকুরগুলোর সে দিকে চোখ পড়ে যায়। ইঁদুরগুলোও অমনি হাওয়া খারাপ বুঝে চটজলদি নিজেদের গর্তে সেঁধিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। সে-জন্যই এই হট্টগোল। মেজর নিজের সামনের পা উঁচিয়ে ইশারায় সবাইকে থামতে বললেন।

“কমরেডস।” তিনি বললেন, “একটা ব্যাপারে এখনই সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। বুনো জন্তুরা, মানে ইঁদুর বা খরগোশ— এরা কি আমাদের বন্ধু না শত্রু? চলো, এ-ব্যাপারে একটা ভোট নেয়া যাক। সর্বসমক্ষে প্রশ্ন রাখছি— ইঁদুররা কি বন্ধু?”

তৎক্ষণাৎ ভোট নেওয়া হল এবং দেখা গেল ইঁদুররা যে বন্ধু তা বিপুল ভোটে সবাই জানান দিয়েছে। বিরুদ্ধপক্ষে মাত্র চারজন ছিল। কুকুর তিনটে আর সেই বিড়ালটা। পরে অবশ্য বোঝা গেল যে বিড়ালটা দু’পক্ষেই ভোট দিয়েছিল।

মেজর আবার বলতে শুরু করলেন, “আমি আর মাত্র কয়েকটা কথাই বলতে চাই। আবার বলছি, মনে রেখো, মানুষ ও মানুষের আচার-আচরণের প্রতি সর্বদা শত্রুতার মনোভাব বজায় রাখাই তোমাদের কর্তব্য। যারা দু’পেয়ে তারাই শত্রু। আর যারা চারপেয়ে বা ডানাওয়ালা তারা সব্বাই বন্ধু। আরও মনে রেখো, মানুষের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে আমরা যেন কখনওই তাদের আদব-কায়দার নকল করতে শুরু না করি। এমনকি মানুষকে জয় করার পরেও যেন মানুষের বদ অভ্যেসগুলোর অনুকরণ না করি। কোনও জানোয়ার কখনও বাড়িতে বসবাস করবে না, কোনওদিন বিছানায় শুয়ে ঘুমোবে না অথবা জামা-কাপড় পরবে না, কেউ মদ ছোঁবে না কিংবা তামাক ফুঁকবে না, টাকা-পয়সায় তো হাত দেবেই না, এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যের নামগন্ধও কখনও করবে না। এ সবই মানুষের মন্দ অভ্যেস। আর হ্যাঁ, খেয়াল রাখতে হবে যেন পশুরা একে অপরের ওপর কখনও অত্যাচার না করে। সবল বা দুর্বল, চালাক কিম্বা বোকা— আমরা সবাই ভাই-ভাই। এক পশু কখনও যেন আর-এক পশুকে হত্যা না করে। পশুরা সকলেই সমান।

“এইবার কমরেডস, আমার গত রাতের স্বপ্নের প্রসঙ্গে আসি। সেই স্বপ্নের কথা তোমাদের গুছিয়ে বলতে পারব সে-ক্ষমতা আমার নেই। পৃথিবী থেকে যখন মনুষ্যজাতি লুপ্ত হয়ে যাবে তখন পৃথিবীর যেমন চেহারা হবে— আমার স্বপ্নে যেন ঠিক সেটাই ফুটে উঠেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই সঙ্গে অনেক দিন আগে ভুলে-যাওয়া একটা কথাও দুম করে মনে পড়ে গেল। অনেক বছর আগে, তখন আমি খুবই ছোট, আমার মা আর তাঁর শূকরী বান্ধবীরা মিলে খুব পুরনো একটা গান গাইতেন। তাঁরা শুধু গানের সুরটা জানতেন আর জানতেন প্রথম তিনটি কথা— ব্যাস। সেই কোন ছোটবেলায় সুরটা শুনেছিলাম— এতদিনে সে-সব আমার মন থেকে মুছেই গিয়েছিল। গতরাত্রে কীভাবে যেন সেই সুরটা আবার আমার স্বপ্নে ফিরে এল। আরও বড় ব্যাপার, সুরটা শুধু নিজেই নয় একেবারে কথাগুলো সমেত ফিরে এল। আমি নিশ্চিত এই গান বহু-বহু বছর আগে পশুরা গাইত। কিন্তু বহু প্রজন্মের অনভ্যাসে পশুরা সে-গান ভুলে গেছে। এখন আমি তোমাদের সেই গান গেয়ে শোনাব, কমরেডস। আমি বুড়ো হয়েছি, গলাও ভেঙে গেছে, কিন্তু যখন আমি এই গানের সুরটা তোমাদের শিখিয়ে দেব, তোমরা নিজেরাই এর চেয়ে অনেক ভাল গাইতে পারবে। গানটার নাম— ‘ইংল্যান্ডের পশুরা’।”

বুড়ো মেজর গলা ঝেড়ে নিয়ে গাইতে শুরু করলেন। তাঁর গলা ভাঙা হলে কী হবে, তিনি কিন্তু বেশ ভাল গাইছেন। অনেকটা ‘ক্লেমেন্টাইন’ আর ‘লা কুকুরাচা’ গানের মাঝামাঝি একটা সুর। গানের কথাগুলো—

“ইংরেজ জানোয়ার, আইরিশ জানোয়ার— 
আরও আছে পশু যত এই দুনিয়ার, 
মন দিয়ে শোনো মোর কথাগুলি ভাই, 
আসছে সোনালি দিন, আর দেরি নাই। 

আজ নয় কাল— দেখো, বদলাবে দিন, 
অত্যাচারী মানুষেরা হবে গদিহীন, 
উর্বর ইংরেজ-জমির ফসল, 
পশুরাই শুধু তা করবে দখল। 

নাকের কড়া থাকবে না আর, 
পিঠ থেকে সাজ খসবে সবার, 
লাগামে-রেকাবে মরচে ধরবে, 
পিঠেতে চাবুক আর না পড়বে। 

চিন্তারও অতীত মোদের সম্পদ হবে, 
ভরবে গোলা— গম, জই, খড় আর যবে। 
বরবটি, ম্যাঙ্গেল-বিট আর ক্লোভার, 
সবকিছু সেই দিন হবে মোদের সবার।

মাঠ-ঘাট হবে সব আলো ঝলমল, 
তৃষ্ণার জল হবে আরও নির্মল, 
চরাচরে মৃদু-মধুর বাতাস বয়ে যাবে, 
যে-দিন পশুরা সব স্বাধীনতা পাবে। 

সেই সংকল্পে মোরা মেহনত করি, 
খেদ নেই যদি মোরা তার আগে মরি। 
গোরু-ঘোড়া আর যত মুরগি ও হাঁস— 
খেটে পাব স্বাধীনতা— আছে বিশ্বাস।

ইংরেজ জানোয়ার, আইরিশ জানোয়ার— 
আরও আছে পশু যত এই দুনিয়ার, 
প্রচার করো মোর বার্তাটি ভাই, 
আসছে সোনালি দিন— আর দেরি নাই।”

গানটা পশুদের ভয়ানক-রকম উত্তেজিত করে তুলল। মেজরের গান শেষ হতে-না-হতে তারা নিজেরাই শুরু করে দিল গাইতে। ওদের মধ্যে সবচেয়ে আকাট-মূর্খ জানোয়ারটাও সে-গানের সুর তুলে নিয়েছে, এমনকি দু-এক কলি মুখস্তও করে ফেলেছে। আর শুয়োর বা কুকুরের মতো যারা আবার বেশি বুদ্ধিমান তারা তো কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো গানটাকেই হৃদয়ে পুরে নিল। তারপর বার-কয়েক রেওয়াজ করেই অসীম উদ্দীপনায় সব্বাই খামার কাঁপিয়ে গেয়ে উঠল— ‘ইংল্যান্ডের পশুরা’।

আবার বলছি, মনে রেখো, মানুষ ও মানুষের আচার-আচরণের প্রতি সর্বদা শত্রুতার মনোভাব বজায় রাখাই তোমাদের কর্তব্য। যারা দু’পেয়ে তারাই শত্রু। আর যারা চারপেয়ে বা ডানাওয়ালা তারা সব্বাই বন্ধু। আরও মনে রেখো, মানুষের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে আমরা যেন কখনওই তাদের আদব-কায়দার নকল করতে শুরু না করি।

গোরুর নিচু গলা, কুকুরের তীক্ষ্ণ স্বর, ভেড়ার ভ্যা-ভ্যা, ঘোড়ার চিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ, হাঁসের প্যাঁক-প্যাঁকানিতে আসর একেবারে জমজমাট হয়ে উঠল। গানটা গাইতে ওদের এতই আনন্দ হচ্ছিল যে, পুরো গানটা ওরা পর-পর পাঁচবার গেয়ে ফেলল। আর যদি বাধা না-পেত তাহলে বোধ হয় সারারাত ধরেই ওরা গাইতে থাকত।

কিন্তু কপাল খারাপ। হই-হট্টগোলে জোন্স সাহেবের ঘুম গেল ভেঙে। তিনি ভাবলেন, খামারে বোধহয় শিয়াল ঢুকেছে। তিনি বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে নামলেন। তাঁর শোবার ঘরের কোণে সবসময় একটা বন্দুক রাখা থাকে। সেটাকে চট করে তুলে নিয়ে তিনি ছ’নম্বর টোটা ভরে অন্ধকারে গুলি ছুড়লেন। ছররাগুলো ফটাফট গেঁথে গেল গোলাবাড়ির দেয়ালে। তৎক্ষণাৎ সভাও গেল ভেঙে। প্রত্যেকে দ্রুত নিজেদের ঘুমোবার জায়গায় ফিরে গেল। পাখিরা যে-যার দাঁড়ে গিয়ে চড়ল। পশুরা শুয়ে পড়ল নিজেদের খড়ের বিছানায়। যেন এক-নিমেষে গোটা খামারবাড়িটা ঝুপ করে ঘুমিয়ে পড়ল। (চলবে)

Arka Paitandi

অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *