কোরক বসুর কণ্ঠে এই ফিচারটির পডকাস্ট শুনতে হলে ক্লিক করুন

ম্যানর ফার্মের মালিক জোন্স সাহেব প্রচুর মদ খেয়েছেন। এখন তিনি একেবারে যাকে বলে বেহেড মাতাল। এতটাই মাতাল যে, মুরগির খুপরিতে তালা মারলেও খুপরির ফোকরগুলো ঢাকা দিতে বেমালুম ভুলে গেলেন। এদিক-সেদিক টলতে-টলতে তিনি খামারের উঠোন ছাড়িয়ে এগোলেন বসতবাড়ির দিকে। তাঁর হাতে একটা লণ্ঠন। টলোমলো হাঁটার ছন্দে-ছন্দে সেটাও এদিক-ওদিক দুলছে। কোনওমতে তিনি বাড়ির পেছন দিকটায় গিয়ে পৌঁছলেন। খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে জুতোজোড়া পা থেকে খুলে কথাও একটা ছুড়ে দিলেন। তারপর ঢুকে পড়লেন বাড়ির ভিতর। রসুইখানার পাশে একটা ছোট্ট ঘর আছে, যার গালভরা নাম ‘স্কালারি’। সেখানে একটা বিয়ারের পিপেও রাখা থাকে। সেই পিপে থেকে শেষবারের মতো এক গেলাস বিয়ার ঢেলে নিয়ে তিনি এগোলেন শোবার ঘরের দিকে। সেখান থেকে এখন জোন্স-গিন্নির নাক ডাকার তীব্র আওয়াজ ভেসে আসছে।

জোন্স সাহেবের শোবার ঘরের আলো যেই-না নিভল, অমনি যেন খামারবাড়ি জুড়ে ভীষণ একটা হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল। আসলে আজ সারাদিন ধরে একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে খামারে— বুড়ো মেজর নাকি গতকাল রাত্তিরবেলা অদ্ভুত কী একটা স্বপ্ন দেখেছেন। বুড়ো মেজর এলেবেলে কেউ নন, রীতিমতো পশু-প্রদর্শনীতে পুরস্কার-পাওয়া শুয়োর। তাঁর শরীরের মাঝবরাবর দুধসাদা রং। এখন, সেই বুড়ো মেজরের ইচ্ছে হয়েছে, তাঁর সেই আজব স্বপ্নের কথা তিনি অন্যান্য পশুদের খুলে বলবেন। তাই ঠিক করা হয়েছিল যে, জোন্স সাহেব প্রতিরাতের মতো নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোতে গেলেই পশুরা সব এসে জড়ো হবে গোলাবাড়ির উঠোনে। বুড়ো মেজরকে (তাঁকে সবাই এই নামেই ডাকে। প্রদর্শনীতে দেখানোর সময় অবশ্য তাঁর নাম দেয়া হয়েছিল ‘উইলিংডন বিউটি’) খামারের পশুরা বড়ই শ্রদ্ধা-ভক্তি করে। তাই তাঁর বক্তব্য শুনতে রাতের কয়েকঘণ্টা ঘুম নষ্ট করাটা তাদের কাছে কোনও ব্যাপার নয়।

বিশাল সেই গোলাবাড়ির এক কোণে খড়ের গাদা উঁচু হয়ে হয়ে বেশ একটা মঞ্চের মতো তৈরি হয়েছে। সেখানে ইতোমধ্যেই বেশ গুছিয়ে বসেছেন বুড়ো মেজর। উপরের কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে একটা লণ্ঠন। বুড়ো মেজরের বয়স এখন বারো বছর। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে গায়ে একটু চর্বি লেগেছে বটে, তবু কিন্তু শুয়োরদের মধ্যে এখনও তাঁকে বেশ রাজকীয় দেখায়। তাঁর মুখের সামনের বড় বড় দাঁতগুলো কখনও কাটা হয়নি। তা সত্ত্বেও তাঁর মুখখানিতে কিন্তু বেশ একটা দয়ালু-দয়ালু ব্যাপার আর বুদ্ধির ছাপ রয়েছে।

 

আরও পড়ুন: তৃষ্ণা বসাকের অনুবাদে ই সন্তোষ কুমারের গল্প: আলোকবর্ষ – পর্ব ১

 

কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্যান্য জন্তু-জানোয়াররা আসতে শুরু করল। তারপর প্রত্যেকে নিজ-নিজ ভঙ্গিতে বসে পড়ল আরাম করে। সবার আগে এল তিনটে কুকুর— ব্লুবেল, জেসি, আর পিচার। তারপর শুয়োরের দল। তারা এসেই খোড়ো মঞ্চের একেবারে সামনের জায়গা দখল করল। মুরগিরা সব চড়ল গিয়ে জানলার চৌকাঠে। আর পায়রার ঝাঁক ডানা ঝাপটে উড়ে গিয়ে বসল কড়িবর্গার উপর। ভেড়া আর গোরুর দল শুয়োরদের ঠিক পিছনে বসে জাবর-কাটা শুরু করল। গাড়ি-টানা ঘোড়া বক্সার আর ক্লোভার এল একসঙ্গে। তারা খুব ধীরে হাঁটছে, সাবধানে পা ফেলেছে। খড়ের তলায় কোনও ছোটখাটো প্রাণি থাকলেও যাতে তাদের চওড়া লোমশ খুরের তলায় চাপা না পড়ে। 

ক্লোভার মধ্যবয়সী। তার চেহারা মজবুত। অথচ বেশ একটা মা-মা ভাব আছে। চার নম্বর বাচ্চাটার জন্ম দেওয়ার পরে তরুণী ঘোড়ার মতো চাবুক চেহারাটা সে আর ফিরে পায়নি। আর বক্সার? সে তো বিশালদেহী পশু। আঠারো হাত লম্বা। যে কোনও সাধারণ ঘোড়ার দ্বিগুণ শক্তি তার শরীরে। বক্সারের নাকের নীচে একটা সাদা ছোপ আছে। সেইজন্য তাকে কেমন যেন গবেট-মার্কা দেখায়। অবশ্য সে যে দারুণ চালাকচতুর তেমনটাও নয়। তবে তার দৃঢ় চরিত্র আর অসম্ভব পরিশ্রম করার ক্ষমতার জন্য সবাই তাকে খুবই মান্যিগন্যি করে।

ঘোড়াদের পরে এল সাদা রংয়ের ছাগল মুরিয়েল আর গাধা বেঞ্জামিন। এই বেঞ্জামিন হল ফার্মের সবচেয়ে বয়স্ক জানোয়ার আর অত্যন্ত বদমেজাজি। সে এমনিতে খুব একটা কথাটথা বলে না, চুপচাপই থাকে। কিন্তু মুখ খুললে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায় সে কতটা রূঢ়ভাষী। সাধারণত তীক্ষ্ণ বিদ্রুপাত্মক সব কথাবার্তাই বেরোয় তার মুখ থেকে। ধরা যাক, সে হয়তো বলল, “এই যে আমার ল্যাজটা দেখছ, এটা আমাকে ভগবান মাছি তাড়াবার জন্য দিয়েছেন। কিন্তু আমার ল্যাজেরও দরকার নেই, মাছিরও দরকার নেই।” এই গোটা খামারে সে-ই একমাত্র জানোয়ার যে কখনও হাসে না। কেন হাস না? — একথা জিগ্যেস করলে বলে, সে নাকি আজ পর্যন্ত হাসার মতো কিছুই খুঁজে পায়নি। সে যাইহোক, একটা কথা অবশ্য সবাই জানে, যে বেঞ্জামিন আসলে বক্সারের খুব ভক্ত। যদিও একথা সে নিজের মুখে কখনও স্বীকার করে না। তবে রবিবারগুলোতে তারা একসঙ্গেই সময় কাটায়। ফলবাগানের পেছনে আস্তাবলের যে ছোট্ট মাঠটা আছে, সেখানে ওরা দু’জনে পাশাপাশি চরে। ঘাস-টাস খায়। কিন্তু দু’জনের কেউই কোনও কথা বলে না।

ক্লোভার মধ্যবয়সী। তার চেহারা মজবুত। অথচ বেশ একটা মা-মা ভাব আছে। চার নম্বর বাচ্চাটার জন্ম দেওয়ার পরে তরুণী ঘোড়ার মতো চাবুক চেহারাটা সে আর ফিরে পায়নি। আর বক্সার? সে তো বিশালদেহী পশু। আঠারো হাত লম্বা। যে কোনও সাধারণ ঘোড়ার দ্বিগুণ শক্তি তার শরীরে। বক্সারের নাকের নীচে একটা সাদা ছোপ আছে। সেইজন্য তাকে কেমন যেন গবেট-মার্কা দেখায়।

ঘোড়াদুটো বসেছে কি বসেনি, এমন সময় একঝাঁক হাঁসের ছানা সারি দিয়ে এসে গোলাবাড়িতে ঢুকল। কিছুদিন আগেই বাচ্চাগুলোর মা মরে গেছে। চিঁ-চিঁ করে বেচারিরা কিছুক্ষণ অসহায়ভাবে এদিক সেদিক ঘুরল। ওদের একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় চাই, যেখানে বসলে ওদের কেউ মাড়িয়ে দেবে না। ওদের দুরবস্থা দেখে ক্লোভার তার লম্বা লম্বা সামনের পা দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বেশ খানিকটা জায়গা পাঁচিলের মতো করে ঘিরে দিল। অমনি বাচ্চাগুলো চিঁচিঁ করতে করতে নিশ্চিন্তে সেখানে ঢুকে আরাম করে বসল। আর বসামাত্রই পুটুস পুটুস করে ঘুমিয়ে পড়ল।

একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে পৌঁছল সাদা রঙের মাদি ঘোড়া মলি। সে জোন্স সাহেবের নিজস্ব দু’চাকার গাড়িটা টানে। মলি সুন্দরী হলেও বড্ড মাথামোটা। একটা চিনির ড্যালা চিবোতে চিবোতে সে একেবারে সামনের দিকে গিয়ে বসল। তার ঘাড়ের লম্বা লম্বা লোমগুলো লাল ফিতে দিয়ে বিনুনি করা হয়েছে। মলি বেশ কায়দা করে ঘাড়ের লোমগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল যাতে সবাই ফিতেগুলো দেখতে পায়।

সবার শেষে এল বিড়াল। এসেই তার স্বভাবমতো চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুঁজতে শুরু করল, সবচেয়ে গরম জায়গাটা কোথায়। শেষমেষ সে ক্লোভার আর বক্সারের মাঝে নিজেকে চেপেচুপে ঠেসে দিয়ে মহা আরামে বসল। তারপর আমেজে ঘ-র-র-র ঘ-র-র-র শব্দ বের করতে লাগল গলা দিয়ে। মেজরের বকবকানিতে কানই দিল না।

সকলেই এসে গেছে— মোজ়েস বাদে। মোজ়েস জোন্স সাহেবের পোষা দাঁড়কাক। সে এখন খিড়কি দরজার পেছনের একটা দাঁড়ে বসে ঘুমোচ্ছে। মেজর যখন দেখলেন সবাই বেশ জমিয়ে বসে তাঁর কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে, তখন তিনি গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে শুরু করলেন—

“কমরেডস, তোমরা তো ইতিমধ্যেই শুনেছ, কাল রাত্তিরে আমি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু সে-কথায় আমি পরে আসছি। তার আগে একটা অন্য কথা বলি। ভাইসব, আমার মনে হয়, আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে। খুব বেশিদিন হয়তো আমি আর তোমাদের মধ্যে থাকব না। তাই মৃত্যুর আগে আমার অর্জিত জ্ঞানভাণ্ডার তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাওয়া আমার কর্তব্য বলে মনে করি। এই সুদীর্ঘ জীবনে আমার খুপরি ঘরে একলা শুয়ে শুয়ে আমি অনেক ভাবনাচিন্তা করার সময় পেয়েছি। তাই একথা আমি বলতেই পারি যে, পার্থিব জীবন ও পৃথিবীতে বসবাসকারী যে কোনও প্রাণি সম্বন্ধে আমার বেশ পাকাপোক্ত ধারণা হয়েছে। তা নিয়েই আমি এখন কয়েকটা কথা বলব।”

“এখন বল তো কমরেডস, আমরা কী ধরনের জীবন কাটাচ্ছি? সোজাসাপটাই বলি তাহলে? আমাদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। সারাক্ষণ হাড়ভাঙা খাটুনি আর অতি অল্প আয়ু। আমরা জন্মাই, তারপর আমাদের জন্য যেটুকু খাদ্য বরাদ্দ করা হয়, তাতে এই প্রাণটুকু টিকিয়ে রাখাই দায়। তারই মধ্যে যারা সক্ষম, তাদের জোর করে, দেহের শেষ শক্তিটুকু পর্যন্ত নিংড়ে নিয়ে খাটানো হয়। আর যেই-না আমরা অকেজো হয়ে পড়ি, তৎক্ষণাৎ আমাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একবছর বয়স পার করলেই ইংল্যান্ডের পশুরা ভুলেই যায়, যে আনন্দ বা অবসর বলেও কোন ব্যাপার পৃথিবীতে আছে। ইংল্যান্ডের কোনও পশুই স্বাধীন নয়। মোদ্দা কথাটা হল— পশুর জীবন মানেই হচ্ছে দুর্গতি আর দাসত্ব।”

 

আরও পড়ুন: তৃষ্ণা বসাকের অনুবাদে ই সন্তোষ কুমারের গল্প:  আলোকবর্ষ- শেষ পর্ব

 

“এটাই কি তাহলে প্রকৃতির নিয়ম? আমাদের দেশ কি এতই গরিব যে সেখানে সম্মানজনকভাবে জীবন কাটানো অসম্ভব? না, ভাইসব, না। হাজারবার না। ইংল্যান্ডের মাটি উর্বর, জলবায়ু স্বাস্থ্যকর। এদেশে যত জন্তু-জানোয়ার আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি প্রাণিকে প্রচুর পরিমাণে খাওয়াবার ক্ষমতা আছে এ দেশের। শুধু আমাদের এই খামারটাই একডজন ঘোড়া, কুড়িটা গোরু, শত শত ভেড়ার ভরণপোষণ করতে পারে। সবাই সসম্মানে আর রীতিমতো আরামেই থাকতে পারে— যা এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমরা কল্পনাই করতে পারব না! তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের এমন দুরবস্থা কেন? কারণ একটাই— মানুষ। আমাদের মেহনতের ফসলের প্রায় সবটুকুই মানুষ আমাদের কাছ থেকে চুরি করে নিচ্ছে। হ্যাঁ কমরেডস, এ-ই হচ্ছে আসল সমস্যা। একটাই শব্দ— মানুষ। মানুষই হল আমাদের আসল শত্রু, একমাত্র শত্রু। মানুষকে শুধু এখান থেকে হটিয়ে দাও। দেখবে, খিদের জ্বালা বা হাড়ভাঙা খাটুনির হাত থেকে চিরকালের জন্য মুক্তি মিলেছে।”

“মানুষই একমাত্র জীব যে কিনা কিছুই উৎপাদন করে না, অথচ সবই ভোগ করে। সে না দেয় দুধ, না পাড়ে ডিম, না তার গায়েগতরে লাঙল টানার মতো শক্তি আছে, এমনকি দৌড়ে যে একটা খরগোশ ধরে আনবে, সে-ক্ষমতাও তার নেই। তা সত্ত্বেও সব পশুদের সে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সে সক্কলকে খাটিয়ে নেয়। বদলে কী দেয়? না কোনওরকমে ধুঁকতে ধুঁকতে টিঁকে থাকার মতো যৎসামান্য খাবার। আর বাকিটা সে নিজেই লুটেপুটে নেয়। আমাদের মেহনতে চাষ হয়, আমাদের গোবরে জমি উর্বর হয়, আর আমরা? আমরা সেই হাড্ডিসারই রয়ে যাই।”

“এই যে আমার সামনে গোরুরা বসে আছ, আচ্ছা বলতো, গতবছর তোমরা কত হাজার গ্যালন দুধ দিয়েছ? কোথায় গেল সেই দুধ? সে-দুধ খেতে পেলে কি তোমাদের বাছুরগুলো আরও তাগড়াই হত না? আমি বলছি কোথায় গেল সেই দুধ। তার প্রতিটি ফোঁটা গিলেছে আমাদের শত্রুরা। আর এই যে মুরগির দল, তোমরা গতবছর কতগুলো ডিম পেড়েছিলে মনে আছে? এখন বল দেখি, ক’টা ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়েছে? বেশিরভাগই তো জোন্স টাকার জন্য বাজারে বেচে দিয়েছে। এই যে ক্লোভার, তুমি তো চারটে বাচ্চার জন্ম দিয়েছিলে, তারা এখন কোথায়? বুড়ো বয়সে যাদের ভরসায় তুমি আনন্দে-সুখে দিন কাটাতে পারতে, তাদের মাত্র একবছর বয়স হতে-না-হতেই বেচে দেওয়া হয়েছে। এ-জীবনে তাদের একজনকেও তুমি আর দেখতে পাবে না। এই যে তুমি চারবার প্রসববেদনা ভোগ করেছ, প্রত্যেকদিন চাষের মাঠে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটছ— বিনিময়ে কী পাও তুমি? সামান্য দানা আর আস্তাবলে একটুকরো মাথা গোঁজার জায়গা?”

“এমনকী এই দুঃখ-দুর্ভোগে ভরা জীবনেরও পুরোটা আমাদের বাঁচার সুযোগ দেওয়া হয় না। আমি নিজের জন্য আক্ষেপ করি না, আমি তো ভাগ্যবান। আমার বারো বছর বয়স হল, চারশোর উপর বাচ্চাকাচ্চা হয়েছে। একটা শুয়োরের তো এটাই স্বাভাবিক জীবন। কিন্তু জেনে রেখ, শেষমেষ নিয়তির সেই নিষ্ঠুর ছুরির হাত থেকে কিন্তু কারও রেহাই নেই। এই যে আমার সামনে ছোকরা শুয়োরেরা বসে আছে— এক বছরের মধ্যেই প্রত্যেকে চেঁচাতে চেঁচাতে হাড়িকাঠে গিয়ে উঠবে। সকলেরই ভাগ্যে নাচছে এই ভয়ানক পরিণতি। গোরু, শুয়োর, মুরগি, ভেড়া— কেউই বাদ যাবে না। এমনকী ঘোড়া বা কুকুরও নয়। ওহে বক্সার, তোমার ওই দুর্দান্ত পেশিগুলো যেদিন অশক্ত হয়ে পড়বে, সঙ্গে সঙ্গে জোন্স তোমাকে কোনও বুড়ো ঘোড়া খরিদনেওলার কাছে বেচে দেবে। সে প্রথমে তোমার গলাটি কাটবে, তারপর তোমার মাংস সেদ্ধ করে শিকারি কুকুরদের খাওয়াবে। আর ফার্মের কুকুরগুলো? তারা যখন বুড়ো আর ফোকলা হয়ে যায়, তখন জোন্স কী করে জানো? সে তাদের গলায় ইট বেঁধে এই কাছের পুকুরটায় ডুবিয়ে মারে। এখনও কি ব্যাপারটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট নয় কমরেডস, যে আমাদের এই দুঃসহ জীবনের সব রকম যমযন্ত্রণার জন্য মানুষের অত্যাচারই দায়ী?” 

মানুষই একমাত্র জীব যে কিনা কিছুই উৎপাদন করে না, অথচ সবই ভোগ করে। সে না দেয় দুধ, না পাড়ে ডিম, না তার গায়েগতরে লাঙল টানার মতো শক্তি আছে, এমনকি দৌড়ে যে একটা খরগোশ ধরে আনবে, সে-ক্ষমতাও তার নেই। তা সত্ত্বেও সব পশুদের সে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সে সক্কলকে খাটিয়ে নেয়। বদলে কী দেয়? না কোনওরকমে ধুঁকতে ধুঁকতে টিঁকে থাকার মতো যৎসামান্য খাবার। আর বাকিটা সে নিজেই লুটেপুটে নেয়। 

“কোনওরকমে যদি মানুষের হাত থেকে মুক্ত হতে পার, দেখবে নিজের মেহনতের ফসল পুরোটাই নিজেদেরই থাকছে। আমরা প্রায় রাতারাতিই স্বাধীন হতে পারি, বড়লোক হতে পারি। কিন্তু তার জন্য আমাদের কী করতে হবে? খাটতে হবে। দিনরাত এক করে জানপ্রাণ দিয়ে খাটতে হবে। কমরেডস, তোমাদের প্রতি একটাই আমার বার্তা— বিদ্রোহ! সেই বিদ্রোহের দিন যে ঠিক কবে আসবে, তা আমি জানি না। এক সপ্তাহের মধ্যে আসতে পারে, আবার একশো বছরও সময় লাগতে পারে। কিন্তু আমি জানি সে দিন আসবেই। এই যেমন আমি আমার পায়ের নীচের খড়গুলো দেখতে পাচ্ছি, তেমন করেই সেই দিনটাও আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আমাদের প্রতি সুবিচার হবেই হবে। নিজেদের লক্ষ্য স্থির কর, কমরেডস। নিজেদের জীবনের ছিটেফোঁটা যেটুকু সময় বাকি রয়েছে, সেদিকেই লক্ষ্য স্থির কর। সর্বোপরি আমার এই বার্তা তোমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও পৌঁছে দিও যাতে তারাও এই লড়াই চালিয়ে যেতে পারে।”

“মনে রেখো কমরেডস, নিজেদের সংকল্প সাধনের পথে সর্বদা অটল থাকতে হবে। মানুষ আর পশুর স্বার্থ একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, একের উন্নতি মানে অন্যেরও উন্নতি— এ ধরনের ভুলভাল কথায় কখনও কান দিও না। ওসব ডাহা মিথ্যে কথা। মানুষ নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। এই সংগ্রামের জন্য আমাদের জোট বাঁধতে হবে। মনে রাখতে হবে মানুষ মানেই শত্রু আর পশু মানেই বন্ধু।”   (চলবে)

Arka Paitandi

অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *