স্কুলজীবনের শেষে গিয়ে জানতে পেরেছিলাম, ফিশিংয়ে শুধু মাছ নয়, টাকাও ওঠে।

ক্লাস ইলেভেন। ‘এ পাড়ায় যেন আর না দেখি’ বলা পায়েলের বাবা নয়, জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু তখন সৌরেন্দ্রনাথ দে। ইয়া মোটা অভিধানই যে সবচেয়ে তাগড়া বই, এমন আপাত ধারণা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল এস এন দে-র অঙ্ক বইগুলো দেখে। প্রায় হাজার পাতা জুড়ে শুধু অঙ্ক আর অঙ্ক। ওই বই শেষ করার জন্য সময় মোটে এক বছর। এ জীবন এত ছোট কেনে জপতে জপতে বইটা খুলতাম। একা উদ্ধার করার সম্ভাবনা ছিল না। ফলে গ্রুপ স্টাডি। স্কুল থেকে ফিরে ঝিমোচ্ছি একদিন, হঠাৎ ল্যান্ডলাইনে কিরিং কিরিং। তুলে দেখি, আমার অঙ্ক গ্রুপের অর্ণব। বলল, ‘জীবন বদলে গিয়েছে রে। এইমাত্র।’ তখন ছ’ টাকায় এক কোটি, কোটি টাকা ছ’ টাকায় ছিল না। অবাক কান পেতে ছিলাম। প্রবল উত্তেজিত অর্ণব সাইলেন্সার দিয়ে কামান দাগার শব্দ চাপার মতো করে বলেছিল, ‘এক্ষুণি চলে আয় আমার বাড়ি। ভাগাভাগি হবে। খুব সিক্রেট। আর কিছু বলছি না। জলদি আয়।’ এর পরেই ঠকাস শব্দ।

Phishing
ইউ হ্যাভ ওন এক লক্ষ ষাট হাজার ডলার ইন গ্লোবাল লটারি। ছবি সৌজন্য – cdome.comodo.com

ইউনিফর্মেই দৌড়লাম। অর্ণবের টেবিলে একটা সাদা পাতা। তাতে এক দুই তিন চার করে লেখা ছিল, সোনি মিউজিক সিস্টেম (একুশ হাজার), রাফ অ্যান্ড টাফের পাঁচটা জিন্স (তিন হাজার), আমিনিয়ায় টানা একমাস বিরিয়ানি আর চিকেন চাঁপ (তিন হাজার, স্যালাড নিলে সাড়ে তিন), নোকিয়া ৬৬০০ (দশ হাজার?, অগ্নি টেলিকমের কাকুকে জিজ্ঞেস করতে হবে)। এর পরে পাঁচ নম্বর লিখে ডট ডট। ফিসফিস করে বলল, ‘পঁচাত্তর লাখ পেয়েছি। বাকিটা তুই হেল্প কর। আমার অ্যাম্বিশন এই চারটের বেশি আর এগোচ্ছে না রে।’ সামনে চোদ্দো ইঞ্চির মনিটর কাঁপছে। টিভির মতো দেখতে। অর্ণবের মতো ওটাও হয়তো উত্তেজিত। গরম। একটা ইমেল খোলা। পড়ে দেখলাম, ‘কনগ্র্যাচুলেশন্স। ইউ হ্যাভ ওন এক লক্ষ ষাট হাজার ডলার ইন গ্লোবাল লটারি।’ তখন ছেচল্লিশ টাকায় এক ডলার ছিল, মনে আছে। অর্ণব তাড়া দিয়ে বলেছিল, ‘জলদি করে দে ভাই। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমায় হেল্প করে দিলে টাকা পুরো হাফ হাফ। পঁয়তিরিশ ক্যাশ তোর। বাকি চল্লিশের আমার শপিং লিস্ট। জীবনে দাঁড়িয়ে গেলাম। কাল এস এন দে সেরদরে বেচে দেব।’ কথাটা বলার সময় অর্ণবের কলারটা উঠে গিয়েছিল। মুখ আলো করে ছিল দৈব হাসি।

লস অ্যাঞ্জেলেসের ঠিকানা দেওয়া ওই ইমেল পঁচিশ হাজার টাকা চেয়েছিল ওর থেকে। ওই টাকা ওর অ্যাকাউন্টে ট্র্যান্সফার করার ‘প্রসেসিং ফি’। ‘কী আশ্চর্য, কী আশ্চর্য’ বলতে বলতে ছেলের পিঠ চাপড়ে ওই টাকা যোগাড় করে দিয়েছিলেন অর্ণবের মুদি দোকানি বাবা। 

সে টাকা দিকশুন্যপুরের টিকিট কেটেছিল।

স্বপ্নপূরণের লিস্টিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলার পরে জানতে পেরেছিলাম, আমরা আসলে ফিশিংয়ের শিকার। পর পর খবর বেরোতে লাগল কাগজে। কত লোক যে কত পঁচিশ-তিরিশ হাজার দিয়েছিলেন আগামী দিন গড়ে নেওয়ার ‘প্রসেসিং’-এর জন্য, তার হিসেব ব্যাঙ্কের বোকা পাশবইগুলো জানে। ফিশিংয়ের এক যমজ ভাইয়ের কথাও জানতে পারলাম ক্রমশ। তার নাম হল ভিশিং। পাঁচ নম্বরের প্রশ্ন দিয়ে ‘ফিশিং ও ভিশিংয়ের তফাৎ লিখ’ বললে উত্তরটা এমন হতে পারে। ফিশিং ইমেল মারফৎ হইয়া থাকে। ভিশিং সাধারণত ফোনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। ফিশিংয়ে একটি ঢিল মারিয়া এক সঙ্গে অনেককে বোকা বানানো যাইতে পারে। আর ভিশিংয়ে এক ঢিলে একটিই পাখি জবাই করা সম্ভব। ফিশিংয়ে একটি উল্টোপাল্টা লিঙ্কে ক্লিক করিতে বলিয়া তথ্য ও টাকা চুরি করা হয়। ভিশিংয়ে যিনি মুরগি প্রতিপন্ন হন, তিনি স্ব-মুখেই গড়গড় করিয়া তথ্য উগরাইয়া দেন। অনেকটা গোপন কথাটি রবে না গোপনের মতো। 

Phishing
সাইবার জীবনে কোনও সাবধানতাই আমরা নিই না। ছবি সৌজন্য – thelogicalindian.com

সময়ের সঙ্গে ছলাৎছল করতে করতে দুর্জনের নানা ছল আসে। বিস্ময়ে কতজনের প্রাণ জাগে জানি না, আমার তো জাগে। এক দিকে আমরা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স নিয়ে বড়াই করি, জিপিটি-৩ রোবট নিজে নিজেই একটা নিবন্ধ লিখে ফেললে রোবটময় আগামী দিন নিয়ে গর্ব-বাদ্যি বাজাই, আর অন্য দিকে আমরা আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি জলাঞ্জলি দিই। পুরো ব্যাপারটাই করি এক অন্ধ বিশ্বাসে।

‘কোকন ২০২০’ নামে এক সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত আলোচনাচক্রে ভাষণ দিতে গিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল সম্প্রতি জানিয়ে দিলেন, ভারতবর্ষে সাইবার অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে পাঁচশো শতাংশ। তাঁর মতে, সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে সাধারণ লোকের জ্ঞান তলানিতে হওয়ার জন্যই এমন অপরাধের এই বাড়বাড়ন্ত। সন্দেহ নেই, লকডাউনের ফলে ই-নির্ভরতা বেড়েছে। ব্যক্তিজীবনে মাস্ক লাগিয়েছি। তবে সাইবার জীবনে তা পরতে ভুলে গিয়েছি বিলকুল।

তবে প্রাইভেসি বোধ কিন্তু আমাদের বরাবরই টনটনে। কোনও অচেনা নম্বর থেকে মিসড কল দেখলে কথোপকথনটা মোটামুটি এরকম হয়।

– এই নম্বর থেকে একটা ফোন এসেছিল। কে বলছেন?
– আপনি কে বলছেন মশাই?
– আরে আপনি তো ফোন করেছিলেন। আপনি আগে বলুন কে বলছেন।
– আমি কেন বলতে যাব? আপনি তো এখন ফোন করলেন আমায়। আগে আপনার নাম বলুন।

মজার ব্যাপার হল, যদি (ছদ্ম) ব্যাঙ্ক থেকে কোনও ফোন আসে, আমাদের এই হম্বিতম্বি উধাও হয়ে যায় নিমেষে। ‘অমুক ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বলছি, আপনার এটিএম কার্ড ব্লক হয়ে গিয়েছে’ শুনলেই আমাদের কপালে ঘাম হয়। ওঁরা বলেন, ‘কার্ড চালু করতে গেলে পিন নম্বর বলুন।’ আমাদের মধ্যে অনেকেই আউড়ে দিই সেই গুপ্ত নম্বর। বয়স্ক লোকেরা ফোনে শোনেন, ‘পেনশন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফের চালু করতে হলে পিন নম্বর চাই এক্ষুণি।’ ‘কী টেকনোলজি রে বাবা’ ভাবতে ভাবতে তাঁদের অনেকেই গড়গড় করে সেই নম্বর বলে দেন। মেসেজগুলো এলে বোঝেন, অ্যাকাউন্ট গড়ের মাঠ। এর পরে ওই মাঠে তাঁরা দৌড়ন, হিল্লে হওয়ার আশায়। দৌড়তেই থাকেন। 

Vishing
মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কোনও ব্যক্তিকে বোকা বানিয়ে ব্যাঙ্কের তথ্য হাতিয়ে নেওয়াই হল ভিশিং। ছবি সৌজন্য – kratikal.com

সাইবার বিশেষজ্ঞরা পই পই করে বারণ করেও আমাদের মধ্যে অচেনা লিঙ্কের নিষিদ্ধ হাতছানি এড়ানোর অভ্যেস গড়ে দিতে পারলেন না। দিনকয়েক আগে পাওয়া একটা ইমেলের কথা মনে পড়ছে। নাইজেরিয়া থেকে এক ভদ্রলোক লিখছেন, ‘প্রিয় ভাই আমার। আমার সাতাশি বছর বয়স। দুটো কিডনিই খারাপ। ডাক্তারবাবু বলেছেন, আয়ু আর মাত্র দু’মাস। এ জীবনে জমানো পাঁচ কোটি টাকা আমি জীবনসায়াহ্নে তোমাকে, হ্যাঁ শুধু তোমাকেই দিয়ে যেতে চাই। একটা লিঙ্ক দিলাম। ক্লিক করে প্লিজ তোমার অ্যাকাউন্ট ডিটেলসটা ভরে দিও।’ সান দিয়েগো থেকে এক সাহেব আমায় লিখেছিলেন, ‘জব পোর্টালে তোমার সিভি দেখে আমরা অভিভূত। উচ্চ পর্যায়ে বেশ কয়েকবার কথা বলে আনন্দের সঙ্গে জানাই, তোমায় নাসা-য় নেওয়া হবে সিনিয়র সায়েন্টিস্ট হিসেবে। ভিসার বন্দোবস্ত করার জন্য পাঁচশ ডলার চাই। এই রইল লিঙ্ক।’ বরাবর অ্যানোড ও ক্যাথোড গুলিয়ে যাওয়া এই অধম ইমেলটা পড়ে প্রথমে বিষম খেয়েছিল। তবে বুঝেছিলাম, ইহা ফিশিং।

ভাগ্যিস! ক্যালিফোর্নিয়া থেকে অমুক অ্যাটকিন্সের নামে একটা ইমেল খুলেই দেখি, স্ক্রিনজুড়ে দাউ দাউ। দশ বারোটা ছবি স্ক্রল ডাউন করার পরে দেখি তাতে লেখা আছে দু’লাইন। ‘হে বন্ধু, দাবানলে আমার জ্বলে যাওয়া ঘরের ছবি পাঠালাম। একশো ডলার প্লিজ।’ লিঙ্কে ক্লিক করার পরেই ল্যাপটপের অ্যান্টি ভাইরাস লাল কার্ড দেখিয়ে বলেছিল, সাইট ইজ নট সেফ। যেতে নাহি দিব। বেঁচে গিয়েছিলাম। 

ফ্রডের ফাঁদ পাতা ভুবনে। শুনেছি, বাজার নাকি ছেয়ে গিয়েছে ভুয়ো অ্যাপে। এর বেশিরভাগই অবশ্য চিনা। মোবাইলের মেমরিতে স্থায়ী ঘাঁটি গেড়ে পাসওয়ার্ড ও ব্যাঙ্কিংয়ের তথ্য আদায় করাই নাকি অনেক জাল অ্যাপের মূল কাজ। আমরা বলি হচ্ছি প্রতিদিন। কয়েকজনের কথা জানতে পারলাম। তাঁরা রয়েছেন কলকাতায়। কার্ড সোয়াইপ হয়েছে বিদেশে। তাঁদের ভুরু উঁচোনো ‘এ কী করে হয়?’-এর উত্তর মেলেনি আজও। এমন ভুরুর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন।

স্কুলজীবনের সেই অর্ণব আজ এক নামী বহুজাতিকের ব্র্যান্ড হেড। নেগসিয়েশন, অর্থাৎ অভিজাত কর্পোরেট দরাদরি নিয়েই ওর কর্মজীবন। কবিতাও লেখে টুকটাক। জুম-আড্ডায় কৈশোরে হারিয়ে যাওয়া ওই পঁচিশ হাজারের প্রসঙ্গ উঠল ফের। দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে অর্ণব বলল, ‘আজ এমন মেল পেলে পাল্টা বলতাম, ওই প্রসেসিং ফি আমার থেকেই কেটে নিয়ে বাকি টাকা আমায় দিয়ে দিন স্যার। যদি পেয়ে যেতাম, যদি…।’ বলল, ‘ফিশিং গল্পে ঠকব জানি। তবু কল্প-মাছ জেগে থাকে।’ 

শেষ পাতে বলি, এই সাইবার ওরফে ‘খাইবার’ বাজার আমার এক অতি সাবধানী জ্যাঠামশাইয়ের জন্ম দিয়েছে। কেউ বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে আজকাল আর পিন নম্বর বলেন না। জানতে চাইলে তেড়ে বলেন, ‘বলব না। বারণ আছে।’ এর পরেই বিড়বিড় করেন, ‘নেভার ডিজক্লোজ ইওর পিন।’ ব্যাঙ্ক থেকে পাওয়া এসএমএসে হাত বুলোন।

অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *