ইন্দোনেশিয়া বা ভিয়েতনাম ঘুরতে গেলেন অথচ লুয়াক কফি বা কোপি লুয়াকের (বালিনিজ় ভাষায় কোপি শব্দের অর্থ কফি) তত্ত্ব-তালাশ কিছুই করলেন না, সত্যি বলছি মশাই, এমন করলে কিন্তু ঠাকুর পাপ দেয়। বিশেষ করে বালি ঘুরতে গেলে লুয়াক কফির রসাস্বাদন করা অবশ্য কর্তব্য। এমনিতে উবুদ, গিয়ান্যার, বাটুর-সহ বালির বেশ কিছু জায়গাতেই লুয়াক কফি উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। নিজস্ব ট্যুর গাইড থাকলে খুবই ভালো, নচেৎ ট্যাক্সি ভাড়া করে নিলেও চলে। আমরা যেখানে গিয়েছিলাম সেই উৎপাদন কেন্দ্রের নাম “লামবুং সারি হাউস।” নামমাত্র মূল্যে (তিনশো টাকা) সেখানে লুয়াক কফি ছাড়াও স্থানীয় আরও অনেক ধরনের কফির রসাস্বাদনের সুযোগ রয়েছে। নারকেল কফি, আদা কফি, জিনশেং কফি, ডুরিয়ান কফি এমনকি হলুদ কফি এগুলোর মধ্যে অন্যতম।

কোপি লুয়াকের ইতিহাস খুঁজলে জানা যায় যে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন জাভা ও সুমাত্রা ওলন্দাজ (ডাচ) শাসনের অধীনে ছিল, তখন ডাচ প্রভুরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি থেকে কফি বীজ আমদানি করে সেখানে কফি চাষ শুরু করেন। পানীয় হিসেবে কফির মূল্য তখন আকাশছোঁয়া। মহার্ঘ্য সেই পানীয়ের স্বাদগ্রহণের অধিকার ছিল না স্থানীয় কফি চাষিদের। কিংবদন্তি বলে, একদল কফিচাষি কফি ক্ষেতে পড়ে থাকা লুয়াক বেড়ালের মলের মধ্যে অবিকৃত অবস্থায় কফি বীজ দেখে নিতান্ত কৌতূহলের বশেই সেই বীজ গুঁড়ো করে কফি খেতে শুরু করে। পরবর্তীতে ডাচ প্রভুদের নজরে পড়ামাত্র তারাও সেই কফির স্বাদগ্রহণ করেন এবং পরের ব্যাপারটা ইতিহাস। গরিব চাষির পানীয় রাতারাতি পৌছে যায় ইউরোপে, ধনকুবেরদের বসার ঘরে।

Coffee
কফি টেস্টিং প্ল্যাটার। বিভিন্ন ধরনের কফির সমাহার। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

কফি-প্রেমিকরা প্রায় সোনার দরে কেনেন এই লুয়াক কফির গুঁড়ো। বিলেতের যে কোনও বড়ো কফিশপে সর্বোত্তম কোয়ালিটির এককাপ অ্যারাবিকা কফির দাম যদি হয় ভারতীয় মুদ্রায় চারশো টাকা হয়, তবে সেই একই জায়গায় এক পেয়ালা লুয়াক কফির মূল্য হবে কুড়িগুণ বেশি, অর্থাৎ প্রায় আটহাজার টাকা! তবে উৎপাদন কেন্দ্র থেকে সরাসরি কিনলে অনেক কম দামে ভালো কোয়ালিটির কফি কেনা সম্ভব। লুয়াক কফি-র উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে জানলেই বুঝবেন সে বস্তু অমন সোনার দরে বিকোয় কেন?

‘লুয়াক’ নামের প্রাণিটি বেড়াল বংশীয়। পোশাকি নাম এশিয়ান পাম সিভেট (Asian Palm Civet) এবং বিজ্ঞানসম্মত নাম প্যারাডক্জুরাস হার্মাফ্রোডিটাস (Paradoxurus hermaphroditus) এবং উক্ত মার্জারপ্রবরের আদি বাসস্থান দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও ও বালি দ্বীপে ইনি নিজের পরিবার-পরিজনকে নিয়ে মহানন্দে ল্যাজ তুলে ছুটোছুটি করে বেড়ান। লুয়াক স্বভাবে নিশাচর এবং বেশ লাজুক, যদিও বিপদে পড়লে যথেষ্ট হিংস্র হয়ে ওঠেন। লুয়াকের প্রধান খাদ্য কিন্তু কফি ফল নয়। বরং এরা আম-কলা-রামবুটান (লিচু জাতীয় একধরনের ফল) এবং ছোটো ইঁদুর জাতীয় পশু ও পোকামাকড় শিকার করে খেতেই বেশি ভালোবাসেন। লুয়াকমশাই কফি ফল খান পথ্যি হিসেবে। 

Coffee
ইনিই লুয়াক বেড়াল। লুয়াক কফির প্রাণপুরুষ। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

মজার ব্যাপার হল এই যে, লুয়াক খান শুধু কফিফলের শাঁস অর্থাৎ টুসটুসে পাকা ফলের বাইরের লাল খোসা ও বীজের মধ্যের নরম শাঁসালো অংশটি। পাতলা ঝিল্লিতে ঢেকে থাকা কফির বীজ হজম করার সাধ্যি ওদের নেই। আর ঠিক সেই কারণেই কফির বীজগুলি পরদিন সকালে বড় বাইরের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসে!

কী বললেন? বেড়ালের ইয়ের সঙ্গে বেরিয়ে আসা কফি… তার অ্যাত্তো দাম! অ্যাঁ!

আরে বাবা আগে শুনুন তো পুরো ব্যাপারখানা!
লুয়াক কফির এমন অস্বাভাবিক মূল্য হওয়ার পেছনে কারণ রয়েছে বেশ কিছু।
প্রথমত, লুয়াক মশাই প্রথম শ্রেণির গাছপাকা
, মিষ্টি ও রসালো ফল ছাড়া অন্য কফি ফল মুখে তোলেন না।
কফি চাষিরা তাই আদর করে লুয়াক বেড়ালের নাম দিয়েছেন, “কোয়ালিটি কনট্রোল অফিসার।”
এই কারণে লুয়াক কফির প্রতিটি বীজ প্রকৃতির নিজের হাতে বাছাই করে নেওয়া।
নষ্ট বা রোগগ্রস্ত কফি ফল দিয়ে  লুয়াক কফি তৈরি হওয়া সম্ভব নয়।

Coffee
লুয়াক বেড়ালের মল এবং তার থেকে প্রাপ্ত ধোয়া কফির বীজ। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

দ্বিতীয়ত, লুয়াক কফি তৈরির কাজ অত্যন্ত শ্রমসাধ্য। জংলি লুয়াকের মল সংগ্রহ করা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। রীতিমতো কোমর ভাঙা পরিশ্রমের কাজ। প্রতিদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও কফি চাষিরা মাত্র পাঁচ থেকে সাত কিলোর বেশি মল সংগ্রহ করতে পারেন না। অন্ততঃ পাঁচ থেকে ছ’বার খুব ভালো ভাবে ধোয়ার পর পাঁচ কিলোগ্রাম মল থেকে মাত্র আড়াই কেজি কফি বীজ পাওয়া যায়। কফি ফলের বীজ পাতলা এক ধরনের ঝিল্লি দিয়ে ঢাকা থাকে। সেই কারণে বেড়ালের মল কখনওই কফি বীজের সরাসরি সংস্পর্শে আসে না। এরপর পরিষ্কার কফি বীজের উপরের ঝিল্লি সরিয়ে, শুকনো খোলায় ভেজে তবে তৈরি হয় লুয়াক কফির বিন। এই বিনের গুঁড়ো থেকে তৈরি হয় খাঁটি লুয়াক কফি। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা অত্যন্ত শ্রমসাধ্য। 

বেড়ালের খাদ্যনালিতে থাকাকালীন বিভিন্ন এনজ়াইমের প্রভাবে কফি বীজের মধ্যে বেশ কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন দেখা দেয়। এর ফলে  লুয়াক কফিতে ক্যাফেনের পরিমাণ থাকে অত্যন্ত কম। সাধারণ কফিতে যেখানে ক্যাফিনের পরিমাণ ২% সেখানে ভালো কোয়ালিটির লুয়াক কফি বীজে ক্যাফেন থাকে মাত্র ০.৫%। এছাড়া ফারমেন্টেশনের ফলে এই কফির স্বাদ ও গন্ধ দুটোই সাধারণ কফির তুলনায় অনেক বেশি লোভনীয় হয়ে ওঠে। কাছাকাছি কোনও কিছুর সঙ্গে তুলনা করতে হলে আমি বলব আটপৌরে আখের গুড় আর শীতকালে মিষ্টি খেজুর রস জিরেন দিয়ে তৈরি খাঁটি নলেনগুড়ের মধ্যে যতখানি পার্থক্য, ঠিক তেমনভাবেই সাধারণ কফির তুলনায় স্বাদে-গন্ধে লুয়াক কফি অনন্য।

Coffee
লুয়াক কফির খোসা ছাড়ানো এবং রোস্টিং প্রক্রিয়া। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

ছাড়াও লুয়াক কফির বাৎসরিক উৎপাদনের পরিমাণ অত্যন্ত অনিশ্চিত, কারণ আগেই বলেছি যে বুনো লুয়াক বেড়াল কোনওভাবে অসুস্থ হলে তবেই কফি ফল খাবে। সুস্থ অবস্থায় তারা কফি ফল খায় না। এই জন্য লুয়াক বেড়ালের কফি খাওয়া বেড়ে গেলেও তা কফি চাষিদের জন্য যথেষ্ট চিন্তার বিষয়। কারণ এতে লুয়াক কফি উৎপাদন সাময়িক ভাবে বেড়ে গেলেও লুয়াক বেড়ালের অসুস্থতা দীর্ঘমেয়াদি ভাবে অত্যন্ত ক্ষতিকারক।

Coffee
প্যাকেট ভরা লুয়াক কফি বা কোপি লুয়াক। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

ঠিক বলেছেন। এ তো আজব ব্যাপার!
বেশি হলেও বিপদ, আবার কম হলেও সমস্যা।

তবে এই সব কিছুর ওপরে রয়েছে মানুষের লোভ।
প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে লুয়াক কফির উৎপাদন এত শ্রমসাধ্য হওয়ার কারণবশত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু জায়গায় বেআইনি ভাবে জংলি লুয়াক বেড়ালদের জোর করে খাঁচায় আটকে রেখে, জবরদস্তি শুধুমাত্র কফি ফল খাইয়েও লুয়াক কফি তৈরি শুরু হয়েছে।
ভাবুন তো মশাই, আপনাকে যদি শুধুমাত্র জেলুসিল খাইয়ে কেউ খাঁচায় আটকে রাখে, তবে অবস্থাটা কেমন হবে!
সবচাইতে দুঃখের কথা হল, শেষের পদ্ধতিতে কফি চাষের কারণে লুয়াক কফির স্বাদ, গন্ধ ও লুয়াক বেড়ালের আয়ু তিনটেই গিয়েছে কমে।
শেষ বিকেলে দু’প্যাকেট লুয়াক কফি কিনে বেরনোর সময় মনে হল, লুয়াক কফির আবিষ্কারক সেই চাষিরা যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তবে তাঁরা কী ভাবতেন কে জানে! নিজেদের আবিষ্কারের সাফল্যে খুশি হতেন, না লোভি উত্তরপুরুষের নিষ্ঠুরতায় লজ্জা পেতেন?
কে জানে
? প্রশ্ন তো অনেক রয়েছে। কিন্তু সব প্রশ্নের তো উত্তর হয় না!

যূথিকা উত্তরবঙ্গের মেয়ে। পেশায় রেস্তোরাঁ ম্যানেজার। ভারতবর্ষের পাঁচটি শহরে বড় কিছু গ্রুপের সঙ্গে কাজ করার পর অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেন। ঘুরতে ঘুরতেই লেখালিখির সূত্রপাত। আপাতত মেলবোর্নে একটি নামী রেস্তোরাঁর দায়িত্বে আছেন। যূথিকা বিভিন্ন দেশের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রা নিয়ে দুই বাংলার বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রথম বই "আশাবরী" দুই বছর আগে প্রকাশ পেয়েছে। ভ্রমণ সম্পর্কিত লেখা ছাড়াও মুক্ত গদ্য এবং গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখতে ভালোবাসেন।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *