আনন্দ পুরস্কারের মঞ্চে জয় গোস্বামীর সঙ্গে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম আলাপ। এবং তৎপরে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক ও ভক্ত অনুজপ্রতিম কবি একটি বইতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাঁর পাঠপ্রতিক্রিয়া এবং সুভাষের সঙ্গে সম্পর্কের অন্তরকাহিনি। আগামীকাল, ১২ ফেব্রুয়ারি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের  ১০১তম জন্মবার্ষিকী । সেই উপলক্ষে দে’জ পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত সেই বইটি (‘জয়ের সুভাষ’) থেকে বাংলালাইভের পাঠকদের জন্য আমরা তুলে দিলাম পাঠপ্রতিক্রিয়ার কিয়দংশ। 

 

সেই রকম কোনও কবির দেখা পাওয়া সব সময়ই কঠিন, যাঁর লেখা একই সঙ্গে দীক্ষিত পাঠক এবং সাধারণ পাঠককে মুগ্ধ করবে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তেমনই এক জন কবি, যাঁর কবিতা বহু বছর ধরে সেই কাজ করে চলেছে।  সুভাষ প্রথম থেকেই কবিতায় নতুন সমাজের স্বপ্ন এনেছেন। বলেছেন সাধারণ মানুষের আশা স্বপ্ন হাতাশা যন্ত্রণার কথা। এবং তা বলেছেন যেন খুবই সাধারণ ভাষায়। ধরা যাক, ঠিক তার পূর্ব প্রজন্মের এক প্রধান কবি, বিষ্ণু দে, তিনিও নতুন ও সুস্থ সমাজের দিকে এগিয়ে দিতে চেয়েছেন, তাঁর কবিতার স্বপ্নকে। বলেছেন, দাঙ্গা, যুদ্ধবিধ্বস্ত, সদ্য-ভেঙে-যাওয়া দেশের কথা, তাঁর অন্য কোনও সমসাময়িকদের সঙ্গেই। তার মধ্যেও সাধারণ মানুষই ছিল। কিন্তু বিষ্ণু দে সে-সব কথা বলেছেন এমন ভাষায়, এত দেশবিদেশের এত শিল্পসাহিত্য প্রসঙ্গের উল্লেখে, জানাঅজানা, পুরাণকে এমন ভাবে মুহূর্তে মুহূর্তে গেঁথে দিয়েছেন তাঁর কবিতাশরীরে যে, তাতে জীবিত পাঠক বার বার চমৎকৃত হবে, উদ্দীপিত হবেন, পূর্ণও হয়ে উঠবেন কখনও কখনও। কিন্তু নানা গ্রন্থে, পুরাণে, দেশবিদেসের সংগীতশিল্পে যাঁদের যাতায়াত নেই, তাঁরা পাঠক হিসেবে, থেকে থেকে যে ধাক্কা খাবেন তাতে সন্দেহ নেই। সেই কারণেই সে, কয়েক বছরের লেখা বাদ দিলে, বিষ্ণু দে-কে বলা যায় কবিদের কবি।

অন্য় পক্ষে সুভাষের কবিতা, সাধারণ পাঠক এক পলকে স্পর্ষ করতে পারবেন। বুঝবেন, যে তাঁরই অভিজ্ঞতার কথা, তাঁরই দুঃক-আনন্দের কথা বলছেন এই কবি। সেই সঙ্গেই কিন্তু তিনি কবিদেরও কবি। কেন না, তাঁর কবিতা সংকেত করে। বিষ্ণু দে-র একটি কবিতার বইয়ের নাম ‘সংবাদ মূলত কাব্য’। কাগজে প্রত্যেকদিন যে-সংবাদ আমরা পড়ি, তার মধ্যে দিয়ে অনেকখানি জানতে পারি আমাদের দেশকে, সমাজকে, আমাদের পৃথিবীকে। জানতে পারি দিকে দিকে ঘটে-চলা নানা অত্যাচার, উৎপীড়ণ, শোষণ, বঞ্চনার কথা। তার বিরুদ্ধে মানষের উঠে দাঁড়ানোর কথাও। এবং সেইসব অন্ধকার ও তার বিরুদ্ধতার চলমান ইতিহাসই তো কবির যোগ্য প্রেরণা। সুতরাং, কবি তাঁর কবিতার নাম দিত পারেন  ‘সংবাদ মূলত কাব্য’, বলতে পারেন যেন, দ্যাখো, আজ সংবাদই আমার কাব্যের মূল। চাঁদ ফুল পাখি নয়। 

কিন্তু এই কাব্যগ্রন্থ বেরোবার বেশ কয়েক বছর আগে, সুভাষের সমসাময়িক দু-এক জন সুভাষের ঈষৎ অনুজ দু-এক জন কবির হাতে বিষ্ণু দে-র এই কবিতা শিরোনামটি য়েন অজান্তেই ব্যবহৃত হতে লাগল, খানিকটা যেন পূর্বাভাষ হিসেবেই। এবং আজ থেকে প্রায় ৪৫-৫০ বছর আগেকার সেই সময়টায়, নিরন্তর লেখা চালিয়ে যাওয়া সেই সব কবি ততটা খেয়াল করলেন না যে, তাঁদের কবিতায় শেষ পর্যন্ত সংবাদ শব্দটার ওপরই জোর পড়ছে, কাব্যটা আর দেখা যাচ্ছে না সেভাবে। বাচ্চারা পার্কে যখন ঢেঁকি চড়ে, তখন একদিকটা যেমন ভারী হয়ে নেমে যায়, আর তারা সমান করার চেষ্টা করে দু-দিক থেকে– তেমনই, কেবল সংবাদের দিকটাই, সাময়িক প্রসঙ্গের দিকটাই, কাগজের উৎক্ষিপ্ত উত্তেজক ঘটনার দিকটাই, বড়ো হয়ে ভারী হয়ে নেমে যাচ্ছে তখন সেই সব কবির লেখায়– যদিও ভারসাম্য ঠিক রেখে, তাকে সমান করার যে-ব্রত, যে-দায় কবির থাকে– সমবাদকে কাব্যে উত্তীর্ণ করার জন্য যে ভাষাসংকেতের জোর দরকার হয় তার আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। 

এমনটা হওয়া কিন্তু স্বাভাবিকও। যখন কোনও কবির মনে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায় যে, এই সময়ে এটাই লেখা উচিত, তখন তিনি সেই ঔচিত্যটাকেই জোর করে ধরে বসেন, কখন যেন, তা থেকে সত্যের, অভিজ্ঞতার সংশয়ের, প্রশ্নের ভূমিকা চলে যায়। কবির অজান্তেই। তখনই ওই একটা দিকেই সমস্ত ভার গিয়ে পড়ে। যান্ত্রিক তত্ত্বমাত্র হয়ে পড়ে কবিতা। ৪৫-৫০ বছর আগের সেই সময়টায় চল্লিশের কবিদের হাতে সেই টাই হচ্ছিল। এবং সেই ঝোঁকে যে-কোনও সাধারণ বিবৃতিকে মনে করা হচ্ছিল কবিতা। যেমন: ‘প্রচুর হয়েছে শস্য, কেটে গেছে আকালের ভয়।’ শুধু তাই নয় এই পংক্তিকে ব্যবহার করা হয়েছিল জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের এক দিন’-এর মতো কবিতার মুখোমুখি, এমনকী বিরুদ্ধে। 

আজ আমাদের অবাক লাগতে পারে, কিন্তু সেদিন অমনটাই হয়েছিল। আজ আমাদের রামেন্দ্র দেশমুখ্যের এই পংক্তিটিকে দেখে মায়া হয়। জীবনানন্দের ভয়ানক স্পিনের সামনে, ধুলো ওড়া পিচে, সন্ধের আগে জোর করে নামিয়ে দেওয়া এক জন টেলএন্ডার বলে মনে হয়, যার ভাগ্য তক্ষুনি আউট হয়ে ফিরে আসা। অবশ্য আরও একটা কতা মনে রাখা দরকার। জীবনানন্দের বিরুদ্ধে রামেন্দ্র দেশমুখ্যের এক লাইন ব্যবহার করেছিলেন যে আলোচক, কবি হিসেবে তিনিও তখন তরুণ। সামান্য বয়সে এমন ধরনের ভুল বোঝা কবিদের পক্ষে আশ্চর্য কিছু নয়। বিশেষত জীবনানন্দের মতো সংকেতময় কবিকে। সুভাষও ভুল বুঝেছিলেন জীবনানন্দকে। পরবর্তী সময় এঁরা সঙ্গতভাবেই ভালবেসেছিলেন জীবনানন্দকে, ভুল স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু সেই কালে, সুভাষের লেখাতেও অনেকসময়ই কাব্যের বদলে সংবাদই শুধু পাব আমরা। যেমন, জাপপুষ্পকে ঝরে ফুলঝুরি জ্বলে হ্যাঙ্কাও। অথবা ‘অগ্নিকোণ’-এর অনেক কবিতা। 

অবস্য সত্যিকারের কবি যিনি, তিনি একদিন, ঠিকই বুঝতে পারেন, সংবাদ দেওয়ার কাজ নয় কবিতা– তার কাজ সংকেত করার। তাই তো আমরা কবিতার কাছে যাই। নইলে তো সংবাদপত্র পাঠ করেি আমরা তুষ্ট তাকতে পারতাম, তাই না? তাই পরবর্তীকালে সুভাষকে আমরা বার বার দেখি সাময়িক প্রসঙ্গকে ব্যবহার করতে কবিতায়। কিন্তু তার মধ্যে দেখি লুকিয়ে রাখা সংকেতও, যার ফলে মনে হয় সাধারণ এই ভাষাষ ঠিক যেন সাধারণই নয়। যেমন: 

বাঁধা রাস্তায় পেটো চমকাতে চমকাতে
আমরা হাঁক দিই
আমাদের আওয়াজে বাসুকি নড়ে উঠুক।

এই লাইনগুলি ‘এই ভাই’ বইয়ের ‘উত্তরপক্ষ’ কবিতা থেকে নেওয়া। বইটি বেরিয়েছিল ৭১-এর সেপ্টেম্বরে। এই বইটির কবিতাগুলি সম্পর্কে রণেশ দাশগুপ্ত জানিয়েছেন : ‘ষাটের দশকের শেষ এবং সত্তর দশকের শুরুতে লেখা।’ সেই বিশেষ কয়েকটি বছরের কথা আমাদের স্মৃতি ও আমাদের ইতিহাস– ধরে রেখেছে। 

অস্থির, অগ্নিগর্ভ, হত্যা ও ভ্রাতৃহত্যা ও পালটাহত্যার কথা সুভাষের পরবর্তী বই ‘ছেলে গেছে বনে’তে আরও আরও প্রবল ভাবে ফিরে আসে। কিন্তু এই কবিতাতেও তার ছাপ রয়েছে। পেটো চমকাতে চমকাতে আমরা হাঁক দিই– এইখানে বোঝা যাচ্ছে আমরা কারা। যৌবনেরই একটা চেহারা, ঠিকই, কিন্তু পেটো চমকাতে চমকাতে শুনেই আমরা একেবারে রকের ভাষা টের পেয়ে যাই। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় বারবার রাস্তার কথা আছে– এও হল আরেকটি তার উদাহরণ, যখন, কবিতা রাস্তা দিয়ে চলছে। কিন্তু কবিতার কোনও ‘বাঁধা রাস্তায়’ নয়। বাঁধা রাস্তা শব্দটি লেখায় এসে যেমন বুঝিয়ে দেয় এই লাগাম ছাড়া ক্রুদ্ধ নতুন যৌবন সব পুরনো ছক ভেঙে দেখতে চায়, তেমনই কবিতাতেও এই ‘পেটো চমকাতে চমকাতে’ নতুনত্ব এনে দেয়। কিন্তু কেবলই নতুনত্ব নয়। যেমন কেবলই নয় সংবাদ। যে-সময় এ কবিতা লেখা হয়েছে — সমসাময়িকের মনে নিশ্চয়ই পড়বে তৎকালীন সংবাদপত্র। পেটো-চমকানো এই তাণ্ডব অনেক কিছুকেই ভেঙে ফেলেছিল সেদিন, বাঁধা রাস্তা ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু পাঠককে চমকে দেয় শেষ লাইনটিতে: ‘আমাদের আওয়াজে বাসুকি নড়ে উঠুক।’ বাসুকি, সে পুরাণে বর্ণিত মহানাগ, সে যে-অতলেই থাকুক, আমরা তাকে নাড়াব। একমুহূর্তে সঙ্কেত পৌঁছে গেল, মাটির তলায়, পুরাণ বিশ্বাস স্পর্শ করে এল। বাঁধা রাস্তা বদলানোর শপথ, যেন অনড় বাসুকি, তথা অনড় এই ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দেবে এ কথাও বলল না তা নয়। সেইসঙ্গে, মহানাগের কল্পনাযুক্ত হয়ে নিতান্ত যেন সাধারণ ভাবে বলা এই কবিতা, এই ভয়ানক বা টেরেবল ধারণাকেও একইভাবে একসঙ্গে ছুঁয়ে এল। আবার, জোর পেল, দৃপ্ত হল বাঁধা রাস্তাকে ভাঙার অঙ্গীকারও। — এই যে একই সঙ্গে দুটো দিককে নিতান্ত অনায়াসে ছুঁয়ে আসা, এইখানেই তিনি কবিদের কবি। এইখানেই, তিনি সংকেতময়। 

‘নিতান্ত সাধারণ’ কথাটা সুভাষের ভাষা সম্পর্কে আমি বারবার ব্য়বহার করে চলেছি। ভাষাকে এই ‘সাধারণ’ করে রাখাটাই সুভাষের অসাধারণত্ব। এতদূর, যে অনেক সময়ই তিনি এমনভাবে কবিতা শুরু করেছেন, যে তাঁকে কবিতা বলে মনেই হয় না। পাঠকের মনে হয়, এ আর এমন কী। এ তো আমিও বলতে পারি। এটাই সুভাষের শক্তি। একটা কবিতা শুরু হয়েছে এইভাবে। 

কারো মুখের কথায় আর আমার বিশ্বাস নেই
আমি হাতেনাতে প্রমাণ চাইব
আমাকেও কেউ মুখের কথায় বিশ্বাস করুক
আমি চাই না –
আগুনে,
রক্তে
সংঘাতে
সবাই আমাকে বাজিয়ে নিক। 

প্রথম তিন-চারটি লাইন পড়ে মনে হয় স্টেটমেন্ট। এর মধ্যে কবিতা কোথায়? নিতান্ত সরল একটা বিশ্বাসের কথা। কিন্তু আমরা চমকে উঠি যখন দেখি, আগুনরক্ত সংঘাতে সবাই আমাকে বাজিয়ে নিক। ‘বাজিয়ে নেওয়া’ কথাটা পরখ করে নেওয়ার অর্থে খুবই চালু একটা কথা। প্রধানত বাজিয়ে নেওয়া কথাটা আসে মুদ্রা নকল কি না তা পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে। এখানে একজন মানুষ নকল কি না তা পরীক্ষা করে নেওয়া হচ্ছে, আগুনে রক্তে সংঘাতে। এবং সঙ্গে সঙ্গে আমরা কবিতায় আশ্চর্যকে দেখতে পাচ্ছি। আমরা ভুলে যাচ্ছি না, ‘বাজিয়ে নিক’ এই চলতি বুলিকে কীভাবে প্রয়োগ করা হল এবং প্রথম চার লাইনের স্টেটমেন্ট কীভাবে কবিতা হয়ে দাঁড়াল। আশ্চর্য হবার এমন অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে আছে সুভাষ মুখোপাধ্য়ায়ের সারাজীবনের কবিতায়। এবং এইখানে এসে মনে হয় যেন কখনওই কবিতা লিখতে চাননি এই কবি। কেবল বলতে চেয়েছেন কয়েকটি কথা। তাঁর সহযাত্রী মানুষকে, বন্ধুকে, নারীকে। তাঁর নিজের কথা, সময়ের কথা। আর বলতে গিয়ে সমস্তরকম প্রচলিত কাব্য থেকে নিজের অজান্তেই যেন মুক্তি দিতে দিতে চলেছেন কবিতাকে। 

ঋণ: শুভঙ্কর দে। দে’জ পাবলিশিং 
(বানান অপরিবর্তিত রেখে পুনর্মুদ্রিত)

 

 

Joy Goswami

জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *