গতবারের পুজো। উত্তর কলকাতার এক বিখ্যাত পুজোমন্ডপের বাইরে প্রায় চল্লিশ মিনিট লাইন দেওয়ার পরে প্যান্ডেলে ঢোকার সুযোগ পাওয়া গেল। পনেরো কুড়ি ফুট এগোনোর পরেই ছ’ফুট বাই ছ’ফুটের একটা জায়গা। উপরে লেখা, ‘সেলফি জোন’। লাইনে ঠেলাঠেলি করে একটু এগোতে না এগোতেই কানে এসে গেল সেই অমোঘ ঘোষণা, ‘আগত দর্শনার্থীদের উদ্দেশে জানানো যাচ্ছে, মন্ডপে কেউ ভিড় করবেন না। পরবর্তী দর্শনার্থীদের সুযোগ করে দিন।’ এর মধ্যেই বাঁদিক থেকে জামা ধরে টান দিল কে হঠাৎ। ঘুরে দেখলাম, একটা ছেলে। আমারই বয়সী। বলল, ‘যদি কিছু মনে না করো, একটা ছবি তুলতে দেবে?’ কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললাম, ‘ছবি তুলবে দেবে মানে? আমি তুলব কেন? সেলফি নেই?’ ছেলেটা বলল, ‘আছে। সেলফিই তুলব।’ তারপরেই গলাটা নামিয়ে কানের কাছে ফিসফিস, ‘আমার কাঁধে একটু হাত দেবে প্লিজ? দুজনেই হাতের আঙুলে একটা ভি দেখাই?’ আমি বললাম, ‘কি হবে দেখিয়ে?’ ও বলল, ‘ছবি দেব ফেসবুকে, ইনস্টাগ্রামে। ক্যাপশানে দেব, উইথ ফ্রেন্ডস। প্লিজ দাদা, প্লিজ। একটু হেল্প করো না।’ দেখলাম, ছলছল করছে ওর চোখ। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বন্ধু নেই?’ ও চুপ করে থাকে। 

ভি দেখানোর পরে জেনেছিলাম, এটা এই মন্ডপে ওর সাত নম্বর ছবি। উইথ ফ্রেন্ডস। সবার মধ্যে এভাবেই বেঁচে থাকার লড়াই করছিল ও।

আয়রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে বললেই কি সবার হৃদমাঝারে বাদ্যি বাজে? শারদ প্রাতে সবারই কি সত্যি সত্যি ‘রাত’ পোহায়? কেউ কেউ ভিড় পছন্দ করেন না বলে স্বেচ্ছায় একা, অনেকে আবার ভিড়ে সামিল হতে না পারার ব্যর্থতায় একা। রাতভর হুল্লোড় করতে আমার ইচ্ছে করে খুব, হুল্লোড় কথাটার গায়েই কেমন যেন লেগে আছে কোরাস কোরাস গন্ধ, কিন্তু হুল্লোড় করার সঙ্গী কই? একশ ডেসিবেলের শারদ ডিজে বক্সের থেকে, লাল নীল সবুজের পাটভাঙা কাপড়ের মেলা থেকে, কো-পাওয়ার্ড বাই ব্র্যান্ডেড দুর্গার ত্রিনয়ন থেকে, রাত দেড়টার ভিড়ে ভিড়েক্কার স্টপওয়াচ লাইন থেকে আমার যে পালাতে ইচ্ছে করে। গঙ্গার ধারে গিয়ে ছলাৎছল শব্দ শুনতে ইচ্ছে করে। ঘাটের কাছে গল্প করে যে নদীর জল, তার পাশে গিয়ে কান পাততে ইচ্ছে করে। দূর থেকে ফিকে হয়ে আসা কোলাহলের আওয়াজে মন খারাপটা যখন হঠাৎই গলার কাছে উঠে আসে একটা বেমক্কা ঢেকুরের মতো, ফেসবুকের ফ্রেন্ডস লিস্টে গিয়ে খুঁটে খুটে, জোর করে নিয়ে আসতে ইচ্ছে করে স্কুলজীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটার মুখ। আলাদীনের দৈত্যটা, না না দৈত্য কেন, ভাল মানুষটা যদি তক্ষুণি উদয় হতো আমার সামনে, বলতাম, ‘স্যার, তোমার তো ক্ষমতা অনেক। আমার এই বন্ধুটা, হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটাকে এখনই এনে দাও না আমার সামনে।’ জিজ্ঞেস করতাম, ‘ঠাকুর দেখতে যাবি?’ জানি, ও মরে গেলেও না করত না। আমার ফ্রেন্ডস লেখা ফেসবুক আপলোড চাই না। সত্যিকারের বন্ধুটাকে চাই। ভাল মানুষটা, না না, দৈত্যটা তখনই হয়তো বলত, এ আবার কেমনতর আব্দার? পিং কর। কি করে বোঝাই ওকে। নদীর জল, ও ছলাৎছল, আমার সঙ্গে কথা বলবে আজ, সারারাত? আমার যে খুব মন খারাপ। চারদিক থেকে এই আমিটার অনুরণন শুনতে পাই। 

হেইগো মা দুগ্গা, আমার ছেলেটা আসবে বলে এল না কেন এবার? তোমার থেকে তো ওর উন্নতি চেয়েছিলাম। টাকার মোহ চাইনি। সেদিন কলকাতার সব চেয়ে বড়, সব চেয়ে বড়লোকদের বৃদ্ধাশ্রম থেকে দুটো লোক এল। লোক না, রিপ্রেজেন্টিটিভ। ছেলের নাম নিল। আমাকে জায়গাটা দেখাতে নিয়ে যেতে চাইল। শুনলাম, সাত লক্ষ টাকা লাগে। জয়েনিং ফি। মানে ভর্তি হতে। ভর্তিই তো। এর পর মাসে মাসে পঁয়তাল্লিশ হাজার। বুড়িটার হিল্লে করতে চেয়েছিলে নাকি মা, ডলারে? এই নাকি তোমার ত্রিনয়ন? সল্টলেকের এই তিন তলা বাড়িটাতে ভূতেরা খেলা করে। তোমার তো ভরা সংসার। নৈঃশব্দের একটা কাঁটা আছে জানো? কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো? দাঁড়াগুলোতে লোভের মতো ধার। বাবু বলল, প্রজেক্ট এসেছে নাকি। আমি জানি, মিথ্যে কথা। গত বারের আগের বার যখন এসেছিল পালিশ করা বৌ নিয়ে, রাতে ওদের ঘরে চাপা ঝগড়া শুনেছিলাম। বৌমা বলছিল, ‘টাকা ওয়েস্ট কর কেন? এই টাকায় আরামসে হয়ে যেত মিলান-ভেনিস। কি পেলে এসে?’ বাবু কিছু বলেছিল কি না জানি না, শুনতে পাইনি। শুনতে পাইনি বলেই ভাল লেগেছিল। ও কিছু পেয়েছিল কি না জানি না, আমি তো পেয়েছিলাম বাবুকে, বছরে আট দিনের জন্য। আমার প্রতিমা জলে পড়েছিল লক্ষ্মীপুজোর দুদিন পরে, এয়ারপোর্টের বাইরের প্যানেলে ‘বোর্ডিং’ লেখা নিয়ন আলোটা লালে লাল ‘ডিপার্টেড’ হয়ে গেল যখন, তখন। আমার কান্না দেখে ছিল শুধু উবেরের সেই ড্রাইভারটা। আর কে দেখবে? দেখার লোক কই, বাবু? চারটে বাড়ি পরে, সতেরো বছর ধরে ইউরোর গন্ধ মেখে আসা নমিতাদি পচা-গলা দেহ হয়ে গেল হঠাৎ। এই তো মাস তিনেক আগে। না না, এ ভাবে তোদের বিড়ম্বনায় ফেলতে চাই না রে। ছেলে মেয়ে নিয়ে যখন দাঁড়িয়ে থাকো মা, মন্ডপ আলো করে, মনের ভিতরটা কেমন যেন হু-হু করে। তুমি তো দুর্গতিনাশিনী। এত আলোয় আমার কষ্টটা হয়তো তোমার অদেখাই রয়ে গেল। লোকে বলে, আমি রত্নগর্ভা। হাঃ।

গতবার একটা হারামী পলিসি নিয়েছিল আমাদের কোম্পানি। অ্যাপে খাবারের অর্ডারটা মেরে কুপন কোডের জায়গায় ফুডসপ্তমী লিখলেই তিরিশ পার্সেন্ট অফ। অষ্টমীর দিন ফুডঅষ্টমী দিলে চল্লিশ পার্সেন্ট। নবমীতে পঞ্চাশ। বমি করতে করতে কুপন কোড গিলেছিল কলকাতা। শেষ দিনটায়, সারাদিন ধরে আউড়েছিলাম, নবমী নিশি, প্লিজ যাও। ভাগো। মার্কেটিংয়ের বাবুরা, যাদের ঠাটিয়ে চারটে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করে আমার, যে কোনও দিন, যে কোনও সময়, তারা নাকি ফোরকাস্ট করেছে, এবারে বাইশ পার্সেন্ট সেল্স জাম্প হবে। পুরো শহর জোড়া আলোর মালার মধ্যে আমি একটা মাল হয়ে বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়াব আবার। গ্র্যাজুয়েট আমি। একা আমি। কোম্পানির লোগো মারা টিশার্ট। পিঠে খাবারের ডাব্বা। গেল্, কলকাতা, গেল্। গত বার চার প্লেট চিকেন পকোড়া আর তিন প্লেট টেংরি কাবাব নিয়ে একটা বাড়িতে বেল টিপে দেখি, আমারই স্কুলের বন্ধুদের রিইউনিয়ন হচ্ছে সেখানে। ওরা আমায় জোর করে বিয়ার খাওয়াবেই। শেষ পর্যন্ত শুভজিৎকে ঠেলে ফেলে দিয়ে দৌড় লাগিয়েছিলাম। নিজের ওপরে ঘেন্না হচ্ছিল বেশি। ক্যাশ অন ডেলিভারি ছিল। ওরা বলল, ‘ভাগ্ শালা। তোর ট্রিট।’ সেদিনও নবমী ছিল। আবার একটা পুজো এল। গোটা শহর যেন আমায় এ কটা দিনে গিলে খায়। লক্ষ লোকের মধ্যে একেবারে একা। শক্তিদায়িনী, বাইকের স্পিডোমিটারে তোমার মুখ! সাদা জামা পরে যে পুলিশরা ডিউটি করে পুজোর রাস্তায়, ট্রাফিক সামলায়, ভিড় সামলায়, তাদের তো মাথার উপরে অশোকচক্রের আশীর্বাদ আছে। প্রতিবার কাগজে দেখি, পুজোর সময় এই পুলিশগুলোর একা একা ডিউটি করা নিয়ে কত লোক কত কথা বলে। ন্যাকা। এর পরের লম্বা ছুটিগুলোর কথা লেখেনা কেউ।

ও সল্টলেকের দিদা, আরে ও খাবারওয়ালা বাইক, আব্বে সেলফিখেকো ব্রাদার—তফাৎ যাও। বাজলো তোমার আলোর বেণু বলতে বলতে ভাল করে ঘষে মেজে পুজো নিয়ে একটা জম্পেশ লেখা লিখব ভেবেছিলাম, জানেন। মহামিলনের উৎসব তো। বিশ্বাস করুন, এরা আমায় লিখতে দিল না। মনে হচ্ছে কাশফুল ভরা একটা মাঠের ঘুপচি, অন্ধ কাউন্টারে বসে আছি ল্যাপটপে বাংলা ফন্ট নিয়ে, এসে গিয়েছে ঢাকীরাও, ব্যাটারি লাগালেই টানা বাজতে থাকবে ঢাক। কিন্তু ব্যাটারিগুলো ছিনিয়ে নিয়ে আমার সামনে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে শয়ে শয়ে লোক। কয়েকজন ব্লেড দিয়ে নিজেদের হাত চিরে চিরে ইন্ডিয়া লিখছে। কি ভাষায় কথা বলছে নিজেদের মধ্যে? অসমীয়া? একা হয়ে যাওয়ার গল্প করছে নাকি? মরচে ধরা স্টিয়ারিং নিয়ে কয়েকটা লোক দেখি আবার লাইনের মধ্যে দাঁড়িয়েই পাগলামি করছে। গাড়ি চালানোর ভান করছে। লেবার-লেবার চেহারা। ও বুঝেছি, কাজ গেছে মনে হয়। কতগুলো লোক আবার শুধু সেলফি নিচ্ছে। নিয়েই যাচ্ছে। যার কাঁধে খুশি হাত রেখে দাঁত দেখিয়ে শাটার টিপছে। বলছে, ‘ব্যাকগ্রাউন্ডটা কি কালো রে বাবা। আরেকটা নিই।’ এক গ্রাম্য বউয়ের পাশে একটা ভ্যান। ভ্যানের উপরে শোয়ানো ডেডবডি। গাড়িটার হ্যান্ডেলে ক্রমাগত মাথা ঠুকে যাচ্ছে বউটা। চিৎকার করে বলছে, ‘পাঁচটা হাসপাতাল রেফার করে করে মেরে ফেলল। পুজোর আগে আমায় একা করে দিলে মা।’ দামি জামা-প্যান্ট-শাড়ি পরা বুড়োবুড়িগুলো মুখের সামনে ফোন নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করছে বোধ হয়। ভিডিও কল নাকি? তবে বুঝতে পারছি, লাইনটা কেটে যাচ্ছে বার বার। একটা বাচ্চা ছেলে, সারা গায়ে নুন-হলুদ মেখে, হাতে একটা ডাল ভর্তি বালতি নিয়ে বলতে বলতে যাচ্ছে, ‘আর কিছু লাগবে? জলদি বলো, বাসন ধুতে হবে।’ ওর পিছনে পিঠে ডাব্বালাগানো বাইকবাহিনী। এরা সবাই কিলবিল করছে। 

কখন ফ্রি হব জানিনা। লাইনটা বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। 

অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *