মার্কিন দেশে হলদে খোকার কমিকস প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদপত্রের পাতাতেই। সেই যে শুরু হল, সে থেকে নানান দৈনিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক পত্রিকার পাতায় গুরুগম্ভীর সব খবরের ফাঁকে এক চিলতে হাসির খোরাক নিয়ে হাজির হত ফানি’স কমিকস। সোজা বাংলায় মজার কমিকস। মার্কিনরা এদের নাম দিয়েছিল ‘স্ট্রিপ কমিকস।’ কী থাকত এতে? থাকত দুই বা তিন প্যানেলের একটা টায়ার বা ফালি। তাতেই গল্প শেষ। গল্প তো নয়, চুটকি হাসির খোরাক। টায়ার বাড়তে পারে। দুই থেকে তিন বা চার। কিন্তু গল্প যেন এক সংখ্যাতেই শেষ হয়। রেশ থাকলে থাকুক। এঁদের কেউ কেউ আমাদের দেখা, চেনা। আবার কেউ মার্কিন দেশে দারুণ জনপ্রিয় হলেও আমরা তাঁদের বিশেষ চিনি না। 

এই যেমন খেলা পাগল, থ্যাবড়া নাক আর গোলগোল চোখের বার্নি গুগল। সেই ১৯১৯ সাল থেকে শিকাগো হেরাল্ডে তিনি নিয়মিত দেখা দিতেন। আবির্ভাবেই মাত করে দিলেন বিলি ডিবেক-এর সৃষ্ট এই চরিত্র। তারপর যতই তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে, ততই আকারে ছোট হয়েছেন তিনি। কিছুদিন বাদে গরিব বার্নিকে একটা দুঃখী দুঃখী মুখের ঘোড়া উপহার দিলেন কোনও এক ধনী মানুষ। ব্যাস! বার্নির ভাগ্য গেল বদলে। সেই ঘোড়াকে রেসে দৌড় করিয়ে বার্নি রাতারাতি বড়লোক। সেই শুরু। তারপর বার্নি আর তাঁর ঘোড়া ‘স্পার্ক প্লাগ’ কী না করেছে! হর্স-শ্যু বা টি বোন স্টেকের মতো কঠিন রেসে প্রথম হয়েছে, ইংলিশ চ্যানেল পার হয়েছে, খুনের রহস্য সমাধান করেছে, সিক্রেট সোসাইটিতে যোগ দিয়েছে (বার্নি পরে সেই সোসাইটির প্রেসিডেন্ট–ও হয়েছিল)। ১৯৩৪ সালে বার্নি নতুন এক সঙ্গী পেলেন। তার নাম স্নাফি স্মিথ। এই দু’জনের আজব কীর্তিকলাপ তিরিশের দশকে আমেরিকার মহামন্দার দিনেও সাধারণ মানুষের মুখে এক চিলতে রোদ্দুর ফুটিয়েছিল। ১৯৪২-এ ডিবেক ক্যান্সারে মারা গেলেন। ফ্রেড ল্যাস দায়িত্ব নিলেও বার্নি আর আগের মতো রইল না। 

Bernie Google and Snuffy Smith
শিকাগো হেরাল্ডে নিয়মিত দেখা যেত বার্নি গুগলকে

হেনরির ভাগ্য অবশ্য বার্নির চেয়ে ঢের ভাল। ১৯৩২ এর মার্চে কার্ল অ্যান্ডারসনের হাতে ন্যাড়ামাথা এই বাচ্চাটির যাত্রা শুরু। কার্ল তখন মাত্র বাষট্টি বছরের তরুণ। একেবারে প্রথম দিন থেকেই হেনরি কথা বলতে পারে না। কোনও কোনও ছবিতে তো তার ঠোটই আঁকা হত না। আর ঠিক সেই কারণেই চ্যাপলিনের মতো ভাষার বেড়া ডিঙিয়ে হেনরি হয়ে উঠেছে সব দেশের, সব কালের। কার্ল অসুস্থ হয়ে পড়লে হেনরির দায়িত্ব পেলেন তাঁর সহযোগী ডন ট্রেসি। ট্রেসি এসে হেনরির জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিলেন অনেকগুণ। যে ডাবল টেক বা স্ল্যাপস্টিক পরে হেনরির সিগনেচার হয়ে উঠবে, তার শুরু কিন্তু ট্রেসির হাতেই। 

Henry
হেনরি বাংলাতে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল গাবলু নামে

হেনরির মধ্যে একটা অদ্ভুত বোদ্ধা বোদ্ধা ভাব আছে। গল্পের ঘটনা সমসাময়িক। কিন্তু প্রেক্ষাপটে ভিন্টেজ কয়লার ওয়াগন, আইসক্রিমের গাড়ি বা পাঁচ সেন্টের লজেন্সের দোকান। এই বৈপরীত্য হেনরির গোটা জগৎকে অদ্ভুত এক নস্টালজিয়াতে ঘিরে রাখে। হেনরির গল্পে বাবা, মা, বান্ধবীর প্রথমে কোনও নাম ছিল না। বাচ্চারা সবাই নিজেদের হেনরির সঙ্গে মেলাতে পারত। সবাই হেনরি হতে চাইত। বাংলায় অবশ্য হেনরি এসেছে তিনবার। তিন নামে। ইন্দ্রজাল কমিকস প্রথমবার ‘গুণধর’ নামে হেনরিকে বাঙালির ঘরের ছেলেতে পরিণত করেন। নামটি খুব সম্ভব লীলা মজুমদারের দেওয়া। তার কিছুদিন বাদেই আনন্দমেলার পাতায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর দেওয়া ‘গাবলু’ নামে “আবার সে এসেছে ফিরিয়া”। এই নামটা এখন অবধি সবচেয়ে জনপ্রিয়। অনেকেরই হয়তো মনে নেই শেষবারের মতো হেনরি মুখ দেখায় ‘এই সময়’ পত্রিকায়, গোল্লু নামে। বেশিদিন চলেনি সে বার। এখন নতুন করে হেনরি প্রকাশ হচ্ছে না কোথাও। কে জানে ফিনিক্স পাখির মতো সে হয়তো চতুর্থবার এন্ট্রির পাঁয়তারা কষছে।

গাবলু বা হেনরির মতো অত পরিচিত না হলেও ন্যানসি যা করেছে, তা কমিকসের ইতিহাসে বিরল। সে নিজে সাইড রোলে এসে কিছুদিন বাদে মূল চরিত্রকেই সরিয়ে গোটা স্ট্রিপ দখল করে নিয়েছে। আর্নি বুশমিলারের ফ্লপ-স্ট্রিপ ‘ফ্রিতসি রিৎস’ বন্ধ করে দেবার কিছু আগে কী মনে করে আর্নি রিৎসের ছোট্ট ভাইঝি ন্যানসিকে কাহিনিতে আনেন। হু হু করে কমিকসটির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। শেষমেশ পাঠকদের চাহিদায় ১৯৩৮ সালে স্ট্রিপেরই নাম বদলে আর্নি করে দেন ‘ন্যানসি’।

Nancy by Ernie Bushmiller
পার্শ্বচরিত্র থেকে স্ট্রিপের মুখ্য চরিত্র হয়ে বসে ন্যানসি

একসঙ্গে প্রায় ৮৮০টি পত্রিকায় ন্যানসি ছাপা হতে শুরু করল। খবরের কাগজ খুলে বিন্দুমাত্র মাথা না খাটিয়েও পড়ে ফেলা যেত ন্যানসিকে। এখানে একটা আঁচড়-ও অতিরিক্ত নেই আর সেটাই ন্যানসির ইউএসপি। ন্যানসির সঙ্গে বিখ্যাত হয়ে যায় তার আলসে বন্ধু স্ল্যাগো স্মিথ-ও। সে বেচারা সারাদিন ঘুমিয়েই কাটায়। মা-বাপ হারানো অনাথ আশ্রম পালানো এই শিশুটির জন্যেও থেকে থেকে মন কেমন করে ওঠে।

ন্যানসির সঙ্গে হাবেভাবে যে কমিকসের এককালে দারুণ মিল ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সে নিজেই এক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে, সে হল চার্লস স্যুলজের ‘পিনাটস।’ ১৯৫০-এ শুরু হয়ে মাত্র ছ’বছরেই একসঙ্গে ১০০টির বেশি পত্রিকায় প্রকাশিত হত সর্বকালের জনপ্রিয় এই স্ট্রিপ কমিকস। প্রথমে চারটি চরিত্র নিয়ে শুরু। পারফেকশনিস্ট চার্লি ব্রাউন, তার দুই বান্ধবী শেরমি আর প্যাটি, আর মজাদার কুকুর স্নুপি। পরে একে একে আসতে থাকে বেঠোভেনের ভক্ত শ্রোডার, খিটখিটে লুসি, দার্শনিক উক্তি করা লিনাস। শুধু সংলাপ না, পরিবেশও এই স্ট্রিপে এক চরিত্র। স্যুলজ নিজেই বলেছেন, পিনাটসের যে কোনও কমিকসে নিচের বারোটা জিনিসের একটা না একটা থাকবেই, আর তাহলেই কমিকস হিট। 

১। ঘুড়ি খেকো গাছ ২। শ্রোডারের পিয়ানো ৩। লিনাসের প্রতিরক্ষা কম্বল ৪। লুসির বুথ ৫। স্নুপির ঘর ৬। স্নুপি নিজে
৭। ব্যারন ৮। উড স্টক ৯। বেসবল ১০। ফুটবলে লাথি মারা ১১। বিরাট কুমড়ো ১২। ছোট্ট লাল চুলের মেয়েটা।

peanuts-feat
মানুষর আবেগ নিয়েই পিনাটস-এর সব কমিক্স স্ট্রিপ

এদেরকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করেন স্যুলজ। কিন্তু পাঠক একটিবারের জন্যেও একঘেয়ে বোধ করেন না। এখানে বাচ্চারাই রাজা। তবু বড়রা মুখ গুঁজে বসে থাকে এই কমিকসের পাতায়। মানুষের আবেগ নিয়ে পিনাটসের মতো অন্য কোনও স্ট্রিপ কমিকস কাজ করেনি। আঁকিয়ে হিসেবে স্যুলজ ছিলেন মিনিমালিস্ট। ব্যাকগ্রাউন্ড ডিটেলিং প্রায় নেই। ধীরে ধীরে নার্ভের রোগে আক্রান্ত স্যুলজের হাত কাঁপতে থাকে। কেঁপে যায় লেটারিং-ও। কী আশ্চর্য! সেই কাঁপা কাঁপা লেখাই পিনাটসের সিগনেচার লেটারিং হয়ে দাঁড়ায়। সমকালীন সব কমিকসের ধ্যানধারণা ভেঙে দিয়েছিলেন স্যুলজ। প্রতিটি পাঠকের মনে হয় সে যা, তাই যেন আঁকা হয়েছে এই স্ট্রিপে।

“ওই স্ট্রিপটা আমিই। আর কেউ না”, ঠিক এটাই মনে হত আর এক ছবি আঁকিয়ের, যিনি নিজে স্ট্রিপ কমিকসের সেরা আইকন হয়ে গেছেন। ১৯৮৫ সালের ১৯ নভেম্বর প্রকাশ পাওয়া মাত্র একটা স্ট্রিপ কমিকস কাল্ট ক্লাসিকের মর্যাদা পায়। পরের বছরই সেই কার্টুনিস্ট পেয়ে যান রুবেন পুরস্কার। যাঁর কথা বলছিলাম, সেই বিল ওয়াটারসনের সিরিজের মূল চরিত্র দুটি। ছ’বছরের এক বিচ্ছু ছেলে আর তার পুতুল, এক বাঘ  পুতুল, যাকে এখন আমরা বলি সফট টয়। কলেজে পড়ার সময় রাষ্ট্র বিজ্ঞানে জন ক্যালভিন আর টমাস হবসের গুরুগম্ভীর সব থিয়োরি পড়তে হয়েছিল ওয়াটারসনকে। এঁদের নামেই চরিত্রদের নাম দিলেন ওয়াটারসন। 

Calvin and Hobbes
কাল্ট ক্লাসিকের জায়গা দেওয়া হয় ক্যালভিন অ্যান্ড হবসকে…

ক্যালভিনের সবসময়ের সঙ্গী হবস। তারা একসঙ্গে স্লেজে চেপে ঘোরে, ঢিবির মাথায় চাপে, বান্ধবী সুজ়ির পিছনে লাগে, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া মারামারি করে, আবার গলা জড়িয়ে না ঘুমালে কারও ঘুম আসে না। একবার হবস হারিয়ে গেছিল। তখন কেলভিনের সে কী কান্না!! সংলাপ এই স্ট্রিপের সবচেয়ে জোরালো অংশ। ক্যালভিনের দুনিয়া এক অদ্ভুত দুনিয়া, যেখানে বাস্তব আর পরাবাস্তব মিলেমিশে এক হয়ে যায়। আগের প্যানেলের বাস্তবতা থেকে জাম্পকাট করে পরের প্যানেলেই স্বপ্নদৃশ্যে চলে যাবার সাহস আগে কেউ দেখাননি। কিন্তু ক্যালভিনের অসম্ভব জনপ্রিয়তাতেও খুশি হতে পারছিলেন না ওয়াটসন। সিন্ডিকেটের অর্থলিপ্সা আর ক্রমাগত কাজের চাপ তাঁর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। অবশেষে জনপ্রিয়তার চরমসীমায় আচমকা ঘোষণা করে এই স্ট্রিপ বন্ধ করে দিলেন ওয়াটারসন। কেন? এক কথায় উত্তর দিয়েছিলেন “বিশ্রাম নিতে”। 

sheldon_mayer
শেল্ডন মেয়রকে কজন চেনেন?

শেলডন মেয়ারকে আজ খুব কম কমিকসপ্রেমীই চিনি। বাকিদের কাছে তিনি তো একরকম অজ্ঞাতই। কিন্তু বিশ্ববাসীর মেয়ারের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত অন্তত এই কারণে, যে গোটা পনেরোবার যখন সিগেল-সুস্টারের কমিকস নাকচ করা হয়েছিল, তখন এই মেয়ার-ই অ্যাকশান কমিকসের সম্পাদক ভিন সুলিভ্যানের কাছে বারবার ঘ্যানঘ্যান করতেন একে কমিকস করার জন্য। মেয়ার না থাকলে সুপারম্যান আদৌ দিনের মুখ দেখত কিনা কে জানে। তাঁর নিজের করা প্রথম বিখ্যাত সিরিজ Scribbly,যা একেবারে প্রথম দিকের একটি সিরিজ, যেটা দৈনিক পত্রিকা নয়, সরাসরি কমিক বুকের জন্য আঁকা। বিষয়টা অদ্ভুত। নিউইয়র্কের এক হা-ঘরে ছেলের কার্টুনিস্ট হবার স্বপ্নপূরণ। একটু তলিয়ে দেখলেই জানা যাবে, এ গল্প আসলে এক আত্মজীবনী। কমিকসের প্যানেলে প্যানেলে মেয়ার আসলে নিজের সংগ্রামের কথাই লিখে গেছেন। অনেক পরে স্পিগেলমানের মাউস, সত্রাপির পার্সেপলিস কিংবা আরিতাবার আর্ট অব ফ্লাইং যে কমিকস মাধ্যমে আত্মজীবনীর ঘরানা চালু করবে, তার সূচনা কিন্তু মেয়ার করে দিয়েছিলেন সেই ১৯৩৯ সালে। 

Scribbly
মেয়রের হাতে জনপ্রিয়তার শিখরে ওঠে স্ক্রিবলি ও লাল টর্নেডো

প্রথম দিকে All American Comics-এ স্ক্রিবলি ও লাল টর্নেডো নিয়ে একের পর এক কমিক্‌স বানানোর পর, চল্লিশের দশকে মেয়ার শুরু করলেন সেই সিরিজ, যা তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলে দেয়। ফানি অ্যানিমাল শীর্ষক বইগুলোর মধ্যে Funny Stuff Animal Antics, Funny Folks- শিশুদের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে। তিনটি ইঁদুরকে নিয়ে তিনি কমিকস লেখেন। নাম The Three Mouse Keteers. এ ছাড়াও Sugar and Spike কিংবা J. Rufus Lion-এর গল্প মজার কমিকসকে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল। শেষের স্ট্রিপটিতে খুব সচেতনভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল কমিকসের ফোর্থ ওয়াল এবং স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, পরবর্তীকালে MAD ম্যাগাজিনের আঁকিয়েরা মেয়ারকেই সরাসরি অনুসরণ করেছিল।

মেয়ারের ছবির আরও একটা মজা ছিল, মেয়ারের সবকটা প্যানেল ছিল একেবারে শিশুদের eye level থেকে দেখা। ফলে অনেক আপাততুচ্ছ জিনিস, যেমন খাটের পায়া, গামবুট— দেখা যেত ডিটেলিং-এ। আর বড়োরা উপস্থিত থাকলেও তাঁদের ঘাড়ের ওপরটা কেটে যেত প্যানেলের ডগায়। ফলে বড়ো আর বুড়োদের মাথা দেখা যেত না। টম অ্যান্ড জেরি, লুনি টুনস কিংবা ডিজনির ছোটোদের সিনেমাতেও এই কায়দা বহুবার নকল করা হয়েছে। এ যেন সরাসরি বড়োদের বলে দেওয়া—  ‘এ একান্ত আমাদের জগৎ। এতে বড়োদের প্রবেশ নিষেধ।’

বাচ্চা বড়োদের এই যে দুই জগৎ, তাদের মেলানোর চেষ্টা প্রথম করেন ওয়ান্ট কেলি। তাঁর রূপকথার কমিক্‌স ‘Prince Robin and the Dwarfs’ এক অদ্ভূত জাদুজগতের সন্ধান দেয়। রাজপুত্র রবিনের বামন বন্ধুরা তার ইচ্ছেমতো তাকে বামন বানিয়ে দেন। তাও রবিন বড়ো বড়ো দৈত্যদের যুদ্ধে হারিয়ে তার বাবার কাছে প্রমাণ করে উচ্চতাই সব কিছু নয়। তবে কেলি ১৯৪০-৫০-এর দশকে দারুণ জনপ্রিয় হন ওয়েস্টার্ন পাবলিশিং-এর ডেল কমিক্‌স-এর হয়ে মাদার গুজ় রাইমস আর রূপকথাকে কমিকসের রূপ দিয়ে। এ কাজ করতে গিয়ে ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের রূপকথার ইলাস্ট্রেশন করে যাঁরা বিখ্যাত, যেমন আর্থার ব্যাখাম, এডমন্ড ডিউলাক, ওয়ারউইক গবেল, ওয়াল্টার কেন বা গুস্তাভ ডোরের চৈত্রশৈলীকে অবলম্বন করেছিলেন কেলি। অনেকেই হয়তো জানেন না, ডিজনির কালজয়ী সব সিনেমা, যেমন স্নো-হোয়াইট, পিনোচ্চিও বা ফ্যান্টাসিয়া-র অধিকাংশ ছবিই ওয়ান্ট কেলির আঁকা। 

Prince Robin nd the Dwarfs
ওয়ান্ট কেলির মায়াজগৎ

১৯৪২ সালে প্রকাশিত হয় কেলির সব থেকে বিখ্যাত সিরিজ পোগো। Animal Comics নামে কমিকস বই সিরিজে সরাসরি প্রকাশ পেয়েছিল এটি। শুরুতে কিন্তু এই ওপাসামটিকে নিয়ে কমিকস ফাঁদার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না তাঁর। ১৯৪১ নাগাদ কেলি ‘Albert takes the cake’ নামে একটি কমিকস লেখেন যাতে নায়ক বোম্বাজিন নামে এক নিগ্রো বালক, যার সঙ্গী পোগো নামের ওপাসামটি। অ্যালবার্ট আসলে এক কুমিরের নাম। কিন্তু বছরখানেকের মধ্যেই পোগো ছাড়িয়ে গেল বোম্বাজিনের জনপ্রিয়তা। কেলিও দেখলেন মানুষের থেকে জানোয়ারদের নিয়ে কাজ করতেই অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ তিনি। তাই একেবারে পার্শ্বচরিত্র থেকে নায়কে পরিণত হল পোগো। অনেকটা ন্যান্সির মতো।

স্ট্রিপ কমিকসে কেলি ছাড়াও ড্যান নুনান, উড়ি গেলমান, ড্যান গর্ডনরা নানা বিচিত্র ও মজার প্রাণীদের কীর্তিকলাপ এঁকে শিশুদের মন জয় করতেন। তবে তাঁদের সেরা যিনি ছিলেন, তিনি নিঃসন্দেহে কার্ল বার্ক। বার্কের জীবন বড়ো অদ্ভুত। জীবনের শুরুতে চেরাই কলে কাজ, রঙের মিস্তিরির কাজ, খচ্চরচালক, কাউবয় এমন নানা কাজ করে বছর তিরিশ বয়সে ডিজনি স্টুডিয়োতে ডাক পান। প্রথমে তিনি ছিলেন অ্যানিমেটর। পরে ডোনাল্ড ডাকের স্টোরি আর্টিস্ট। ১৯৪২ সালে ডিজনির চাকরি ছেড়ে দিলেন বার্ক। তখন ডোনাল্ড ডাক কমিকসের স্বত্ব ছিল ওয়ারেন পাবলিশিং-এর হাতে। তাদের হয়ে পরবর্তী তিরিশ বছর ডোনাল্ড ডাক সিরিজের সমস্ত কমিকস একা হাতে সৃষ্টি করতেন বার্ক। তাঁর নামই হয়ে গেছিল, ‘Duck Man’। 

Uncle Scrooge
‘ডাক ম্যান’ কার্ল বার্কের হাতে প্রাণ পেল ডোনাল্ড ডাক, আংকল স্ক্রুজ আর তার ভাইপোরা

এই কমিক্‌স আঁকতে গিয়েই গল্প ও চরিত্রের প্রয়োজনে ডোনাল্ড ছাড়া আরও কিছু স্থান ও চরিত্রের আমদানি করলেন তিনি। Duckberg নামে এক বিশাল শহরে সব হাঁসেদের বাস। এদের মধ্যেই আছেন আঙ্কল সক্রুজ নামের কৃপণ বড়লোক থুড়ি বড় হাঁসটি। আছেন গ্ল্যাডস্টোন গ্যান্ডার, গাইরো গিয়ারলুজ কিংবা ম্যাজিকা ডি স্পেল। এমনকী ডোনাল্ড চরিত্রটিরও আগাপাশতলা পরিবর্তন করলেন বার্ক। ডিজনির ডোনাল্ড চরিত্রটির কাজই ছিল ঝামেলা বাধানো, অকারণে চিৎকার করা কিংবা অনর্থক পাগলামো। বার্কের হাতে এসে ডোনাল্ডের দায়িত্ব বাড়ল। তার বাড়িতে তিন নতুন সদস্য, তিন ভাইপো (নাকি ভাগনে) হুই, ডুই আর লুই। আগে ডোনাল্ড যেসব অপকীর্তি করত, সেসব এখন এরাই করে। বেচারা ডোনাল্ড তাদের সামলাতে সামলাতে নাজেহাল হয়ে যায়।

তাঁর দীর্ঘ কমিক্স জীবনে বার্ক একটা অদ্ভুত পরীক্ষা শুরু করলেন। সেই হাঁসেদের নায়ক রেখেই বলে যেতে থাকলেন জ্যাক লন্ডন, রবার্ট লুই স্টিভেনসন, জুলে ভার্নের ক্লাসিক গল্পগুলো একেবারে নিজের মতো করে। তাঁর কমিকসে ফিরে ফিরে আসত নানা অজানা তথ্য, ইতিহাসের কথা, পৌরাণিক কাহিনি। থ্রিলার আর মজার এই অদ্ভুত ককটেলটা বার্কের মতো খুব কমই বানাতে পেরেছেন অন্যরা। ফলে বার্কের ‘ডাকটেলস’ যে কোনও শিশুপাঠ্য বই বা সিনেমার থেকে বেশি উপযোগী ছিল।

Carl Barks and his ducks
দেশ বা ঐতিহাসিক স্থান-কাল-পাত্রের ডিটেলিং-এ বার্ক একেবারে নিখুঁত ছিলেন

বিভিন্ন দেশ বা ঐতিহাসিক স্থান-কাল-পাত্রের ডিটেলিং-এ বার্ক একেবারে নিখুঁত ছিলেন। ফলে গল্পের সঙ্গে সঙ্গে কোনও স্থান বা দেশের রীতিনীতি পোশাক-আশাক, খাওয়া-দাওয়া সম্পর্কেও শিশুদের স্পষ্ট ধারণা হয়ে যেত। দুঃখের বিষয়, এতকিছু সত্ত্বেও খোদ মার্কিন মুলুকেও বার্ক এখনও তাঁর যোগ্য সম্মান বা কমিকস মাধ্যমে এই বিপুল অবদানের স্বীকৃতি পান না। এখনও লোকে তাঁকে জানে শুধুই এক ‘Good duck artist’ হিসেবে।

কাজেই সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, আমেরিকান স্ট্রিপ কমিকসের পৃথিবী এক অদ্ভুত ইউটোপিয়ান পৃথিবী। এ পৃথিবী আমাদের সবার। মানুষের, পশুপাখির এমনকি ছোট ছোট কীটপতঙ্গের। কিন্তু শুধু জ্ঞান গিলিয়ে দেওয়া না,হাসি মজা দুঃখ কান্না- সব মিলিয়ে এই সব কমিকস আমাদের এক নতুন পৃথিবীর, এক সুন্দর পৃথিবীর চেহারা দেখায়। 

সে পৃথিবীতে সবাই সবার আত্মীয়…

 

*ছবিসূত্র: Youtube, natedsanders, michaelbarrier, comicvine, pinterest, comicsalliance

জন্ম ১৯৮১-তে কলকাতায়। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি-তে স্বর্ণপদক। নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কারক। ধান্য গবেষণা কেন্দ্র, চুঁচুড়ায় বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত। জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ Discovering Friendly Bacteria: A Quest (২০১২)। তাঁর লেখা ‘কমিকস ইতিবৃত্ত’ (২০১৫), 'হোমসনামা' (২০১৮),'মগজাস্ত্র' (২০১৮), ' জেমস বন্ড জমজমাট'(২০১৯), ' তোপসের নোটবুক' (২০১৯), 'কুড়িয়ে বাড়িয়ে' (২০১৯) 'নোলা' (২০২০) এবং সূর্যতামসী (২০২০) সুধীজনের প্রশংসাধন্য। সম্পাদনা করেছেন ‘সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ’ (২০১৭, ২০১৮)'ফুড কাহিনি '(২০১৯) ও 'কলকাতার রাত্রি রহস্য' (২০২০)।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *