মহাভারতে খাণ্ডববন দহন চলেছিল পনেরো দিন। আমাজনের অরণ্যে এ-বারের দহনপর্ব ইতিমধ্যে মহাভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। ব্রাজিলের বিরাট এলাকা জুড়ে আগুন জ্বলছে পৃথিবীর বৃহত্তম অরণ্যে, যেখানে সব মিলিয়ে দশ লাখ আদিবাসী মানুষের বসতি, তাঁদের সঙ্গে বাস করে প্রায় তিরিশ লক্ষ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ। কয়েক হাজার একর এলাকা পুড়ে খাক, আগের সব রেকর্ড ভেঙে গেছে। আমাজন অরণ্যের আগুন ব্রাজিলের সীমানা পেরিয়ে পেরুতেও ছড়িয়েছে। আগুন জ্বলছে বলিভিয়া এবং প্যারাগুয়ের বনাঞ্চলেও।

বছরের এই সময়ে আমাজনের অরণ্যে আগুন খুব চেনা ব্যাপার। ফি বছরই তার বিভিন্ন অঞ্চলে আগুন লাগে, ছোট বড় মিলিয়ে হাজার হাজার অগ্নিকাণ্ড ঘটেই থাকে। কিন্তু ব্রাজিলের জাতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা হিসেব কষে জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এ-বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সংখ্যায় প্রায় দ্বিগুণ। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা-র তথ্য অবশ্য বলছে যে, গত বছরের তুলনায় এ-বার আগুনের প্রকোপ কিছুটা কম। তবে নাসাও জানাচ্ছে, ব্রাজিলের আমাজোনাস এবং রোরাইমা প্রদেশের অগ্নিকাণ্ড গত বারের তুলনায় বেশি।

সংখ্যার হিসেব শেষ কথা নয়। স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা বলছে, এ-বারের ব্যাপারটা অন্য মাত্রার। ব্রাজিলের সবচেয়ে জনবহুল শহর সাও পাওলোতে সোমবার দিনের বেলায় রাত্রির অন্ধকার নেমে এসেছিল, বহু দূর থেকে আসা ধোঁয়ায়।

এই দাবানল কি নিছক প্রাকৃতিক বিপর্যয়? অনেকেই তা মানতে নারাজ। আমাজনের অরণ্যে আগুন শুধু লাগে না, আগুন লাগানোও হয়। অরণ্য সাফ করে চাষবাসের জন্য, গবাদি পশুর চারণভূমি তৈরি করার জন্য, মাটির নীচে থাকা খনিজ সম্পদ তুলে আনার জন্য, এক কথায় জঙ্গল নির্মূল করে জমি দখল করার জন্য। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, এ বছর সেই ষড়যন্ত্র অনেক বেশি মাত্রায় হয়েছে। এবং তা হয়েছে সরকারের প্রশ্রয়ে।

সরকার মানে প্রেসিডেন্ট খাইরে বলসোনারো-র সরকার। বলসোনারো গত জানুয়ারি মাসে ব্রাজিলে ক্ষমতায় এসেছেন। বামপন্থী-লিবারালদের দীর্ঘদিনের শাসনের পরে এই দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্টের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। সেটা এই যে, আমাজন অরণ্যের বিপদ এ-বার বাড়বে। তার কারণ, এই রাষ্ট্রনায়ক খোলাখুলি বলে এসেছেন, দেশের উন্নয়নের জন্য জঙ্গল সাফ করে জমি উদ্ধার করা দরকার, সেই জমিতে চাষবাস হবে, পশুপালন হবে, খনির কাজ হবে, দেশের আয় বাড়বে। এমন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় এলে অরণ্যে আগুন লাগানোর প্রবণতা বাড়বে, সেটা স্বাভাবিক। ব্রাজিল তথা দক্ষিণ আমেরিকার পরিবেশ সংগঠন ও কর্মীদের অনেকের অভিযোগ— প্রেসিডেন্টের প্রশ্রয়ে বা নির্দেশেই এ-বছর অগ্নিসংযোগ বেড়েছে। বলসোনারো অবশ্য এই সব অভিযোগ ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, এই সময়ে চাষিরা জমি পরিষ্কার করতে আগুন দিয়েই থাকে, পর্তুগিজ ভাষায় এ হল কেমাদা-র (অগ্নিকাণ্ড) কাল। মানে, আগুন জ্বলছে. জ্বলবে।

বিপদ কেবল ব্রাজিলের নয়, এমনকি কেবল দক্ষিণ আমেরিকার নয়। বিপদ গোটা পৃথিবীর। একে তো এই আগুনের ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আবহাওয়ার দূষণ অস্বাভাবিক বেড়েছে, যত দিন যাবে সেই বিষ দূরদূরান্তরে ছড়াবে। কিন্তু তার চেয়েও বড় এবং দীর্ঘমেয়াদি বিপদ এইখানে যে, বাতাসের কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নিয়ে বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রতিরোধের কাজে আমাজনের অরণ্য হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সহায়। সেই অরণ্যের পরিমাণ যত কমবে, ওই প্রাকৃতিক ঢালটি তত দুর্বল হবে, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রকোপ তত বাড়বে। বিপন্ন বিশ্ব পরিবেশ আরও বিপন্ন হবে। বলসোনারোদের তাতে কিছুই যায় আসে না, তাঁরা উন্নয়নের কড়ি গুনবেন।

স্বতন্ত্র‚ চমকপ্রদ ও মন ভালো করা খবর পেশ করার চেষ্টা করি আমরা | প্রতিবেদন বিষয়ে আপনাদের মতামত জানান 'কমেন্ট' বক্সে | আপডেট পেতে ফলো করুন https://www.facebook.com/banglaliveofficial/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *