আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১], [পর্ব ২], [পর্ব ৩], [পর্ব ৪], [পর্ব ৫]

সুমিতাভ মৈত্র এ পাড়ায় ফ্ল্যাট কিনে এসেছেন বেশ কিছুদিন। সুমিতাভর বই আছে অনেকগুলি। সকলে চেনে না, কেউ কেউ চেনে। আমরা না চিনতে পারি, আমার মেয়ে চেনে। সে বলে, কলকাতায় এসে ওঁর বইয়ে ওঁকে দিয়ে সই করিয়ে নেবে। তাঁর বই বড় প্রকাশক ছাপে। তিনি নামী ম্যাগাজ়িনে লেখেন। মেয়ের কথা শুনে আমি তাঁর বই পড়েছি। আমার মনে হয়েছে তাঁর লেখার ভিতরে দার্শনিকতা ফুটে ওঠে। তিনি অবান্তর কথা পছন্দ করেন না। তিনিও গুণেন সরকারের মতো সব দিন আসেন না। তিনি এলে আমার ভাল লাগে। আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলি।

আসলে আমারও লেখার বাসনা ছিল। লিখেওছিলাম কলেজ ম্যাগাজ়িনে। আমার সেই গল্পে শ্যামাশ্রী ছিল। শ্যামাশ্রীকে নিয়ে আমি দু’টি গল্প লিখেছিলাম। সেই পত্রিকা খুব যত্ন করে রেখে দেওয়া আছে। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয়, সুমিতাভ মৈত্রকে পড়াই আমার সেই গল্প। কিন্তু কী এক সংকোচ ঘিরে ধরে। বলব বলব করেও বলতে পারি না। 

নীলমাধব বলে: আমরা তো ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না, সব জানতে পারি। কী প্রসঙ্গে নীলমাধব কথাটা বলল তা বোধগম্য হয় না। কার প্রসঙ্গে বলল, তাও বুঝতে পারি না। কিন্তু বলেছে যখন, উদ্দেশ্য আছে একটা। আমার মনে হয়, গুণেন সরকার ও জুড়ান রায়ের বন্ধুতা নিয়েই কথাটা বলা। জুড়ানের সঙ্গে গুণেনের যোগাযোগ আছে যে, তা জানে নীলমাধব। এবং তা তার পছন্দ নয়।  নীলমাধব বলে:
– ব্যর্থ মানুষের সঙ্গে মিশতে নেই। তারা শুধু সফল মানুষের নিন্দা করে।
– ব্যর্থ হয় মানুষ নিজে, কিন্তু সফল হয় অন্যের দ্বারা, তাই তার সফলতা সফলতা নয়। গুণেন বলে। 

কথাটা আংশিক সত্য। বড় বড় বিজ্ঞানী, লেখক, কবি, খেলোয়াড়ের সফলতা কি তাঁদের নিজস্ব নয়? সুমিতাভ বলেন: এমন হয়েছে কম না, যেখানে সফলতা না পেয়ে কবি, লেখক মারা গেছেন। পরে তাঁদের মূল্যায়ন হয়েছে, খ্যাতি হয়েছে বিশ্বময়। গুণেন বলে: তাঁরা অন্যের সাহায্য পাননি, তাই বেঁচে থেকে সফলতার মুখ দ্যাখেননি। সাহায্য পেলে জীবনটা সুখের হত, জীবন তো একবার।

সুমিতাভ মৈত্র বললেন:
– ফ্রাঞ্জ কাফকা বলে একজন লেখক ছিলেন। বিশ্বের সেরা লেখকদের একজন। তিনি তাঁর বন্ধুকে বলে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর যেন তাঁর সব লেখা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বন্ধু তা করেননি। তাই আমরা তাঁকে পড়তে পারছি। তিনি এই যুগের ঈশ্বরপ্রতীম লেখক।
– জীবিতকালে তাঁর খ্যাতি হয়নি, কারণ তিনি কারও সাহায্য পাননি। গুণেন বলল।
আমাদের কবি জীবনানন্দ দাস তাঁর সব গল্প উপন্যাস বাক্সবন্দি করে রেখে মারা গিয়েছিলেন কিংবা আত্মহত্যা করেছিলেন। তিনি অসামান্য কবি, অসামান্য ঔপন্যাসিক। সুমিতাভ বললেন।
– এসব আমি বুঝি না। কিন্তু বুঝতে পারছি, এঁরা সফলতা পাননি কারণ পেছনে কোনও খুঁটি ছিল না। যাঁদের খুঁটি থাকে, তাঁরা সব পারেন। টাকা থাকলে কী না হয়। গুণেন বলল। গুণেনের কথা একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। সুমিতাভ তবুও বলেন:
– প্রতিভার এক রকম আলো আছে, সেই আলো বিচ্ছুরিত হবেই।
– পাপের একরকম অন্ধকার আছে, তাকে দেখা যায়, বুঝলেন? চাপা থাকে না। তা-ও বিচ্ছুরিত হয়। পাপের আগুন বলুন অন্ধকার বলুন, আচ্ছা নরকের আগুনের রং কেমন?

 

আরও পড়ুন: বিহু রায়ের কলমে: বইয়ের কথা: কালো নগ্নিকার আখ্যান

 

সুমিতাভ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন গুণেনের দিকে। কথাটা তাঁর মনে ধরেছে। বললেন:
– নরকের আগুনের কথাটা কে বলেছে আপনাকে?
কেউ বলেনি। নরকে পাপীদের শুনেছি আগুনে ঝলসানো হয়। সেই আগুনের কি আলো আছে, নাকি তা কালো আগুন? সুমিতাভ বললেন:
– আপনি অদ্ভুত বললেন। সত্যিই তো! নরকের আগুন কেন আলো ছড়াবে? কিন্তু কথাটা মনে হল কেন?
কারণ জুড়ান রায়। গুণেন বলল: জুড়ানের মেয়ে ডায়ামন্ড প্লাজা শপিং মলে কাজ করে জানেন?
আমি বললাম, থাক।
হ্যাঁ থাক এসব কথা। বললেন সুমিতাভ।
আপনি লেখক, আপনি এসব শুনবেন না? জানবেন না, ব্ল্যাক ফায়ার, কালো আগুনের কথা? শুনবেন না, কালো আগুনে কি তাপ আছে, না হিমশীতল?
– এইসব কথা কী করে মনে আসে? সুমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন।
জুড়ানের সঙ্গে মিশি তো, জুড়ান রায়! একমাত্র যে নীলমাধব পালোধীদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে, কেয়ার করে না। সে সব জানে, তার কথা শুনে এইসব মনে হয়। বলল গুণেন সরকার।

আসলে আমাদের দলটি অনেক বড়। পাশাপাশি হাঁটা যায় না। সামনে নীলমাধব, বিমল, কার্তিক, আরও কয়েকজন থাকে। নীলমাধবের গায়ে গায়ে হাঁটতে কেউ কেউ পছন্দ করে। নীলমাধবের পয়সা আছে, তাই ক্ষমতা আছে, থানা পুলিশ, কাউন্সিলর, এমএলএ– সর্বত্র তার গতায়াত আছে। সুতরাং তার কথায় সায় দিয়ে চলায় লাভ আছে। আমরা তিনজন একটু পিছিয়ে পড়ে হাঁটি। সুমিতাভ আত্মমগ্ন মানুষ, বেশি কথা পছন্দ করেন না। নিজে বলেন কম, শোনেন বেশি।  গুণেন বলছে:
– লেখক কি জগতের সুন্দর কথাই শুনতে পছন্দ করেন? ফুল, পাতা, সুন্দর জীবন, এর বাইরে কি মানুষ নেই? মানুষের দুঃখকষ্টের কথা, পাপের কথা লেখক শুনবেন না?
এই মানুষের সংখ্যা বেশি, দুঃখী মানুষের কথাই লেখা হয়েছে বেশি। সুমিতাভ বলেন। 
যখন কলেজে পড়ি, সোভিয়েত বই পড়তাম কত। তলস্তয়ের একটা বই পড়েছিলাম স্যার, বলতে সংকোচ হয় স্যার। গুণেন বললেন।

নীলমাধব বলে: আমরা তো ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না, সব জানতে পারি। কী প্রসঙ্গে নীলমাধব কথাটা বলল তা বোধগম্য হয় না। কার প্রসঙ্গে বলল, তাও বুঝতে পারি না। কিন্তু বলেছে যখন, উদ্দেশ্য আছে একটা। আমার মনে হয়, গুণেন সরকার ও জুড়ান রায়ের বন্ধুতা নিয়েই কথাটা বলা। 

– আরে স্যার স্যার করছেন কেন? সুমিতাভ অস্বস্তি বোধ করছেন যে তা বোঝা যাচ্ছে।
এমনি। পাস গ্রাজুয়েট, অনার্স কেটে গিয়েছিল। চাকরি করেছি সামান্য। একবার ঘুষ খাওয়ার লোভ ছাড়তে পারিনি। সামনে বোনের বিয়ে, বড় অফার। অফিসে অনেকেই ঘুষ নেয়। আমার ভয় করে, ভয়ই  সত্যি হল। ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। কী অপমান, বস শেষ অবধি সতর্ক করে রিপোর্ট করেননি বলে চাকরি থেকে গিয়েছিল। বলতে লাগলেন গুণেন আবেগতাড়িত হয়ে… তারপর আর ওপথে যাইনি। সত্যি কথা রাইটার স্যার।
– আপনি তলস্তয়ের কোন বইয়ের কথা বলছিলেন? সুমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন।
নাম মনে নেই। একটা খুব নামী আর ক্ষমতাবান লোক, মৃত্যুর আগে যত অন্যায় করেছিল তা বলে যাচ্ছে, পাপ স্বীকার করে যাচ্ছে।
হুঁ, ইভান ইলিচের মৃত্যু। ওর ভিতরে আর একটি গল্প ছিল, ক্রয়টজ়ার সোনাটা। বললেন সুমিতাভ।

আমারও মনে পড়ল, ওই বয়সে সস্তায় সোভিয়েত বই আসত। অনেক পড়েছি বড় বড় লেখকের গল্প, উপন্যাস। একটি মেয়ের কথা পড়েছিলাম। খুব সরল, জলে ধোয়া সুন্দর মুখ। কাতেরিনা, মারফা, লিজ়া,  মিশিয়া, নাতাসা এমনি কোনও নাম হবে। স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক দেবীর মতো এঁকেছিলেন তাঁকে লেখক। আমার মনে হয়েছিল শ্যামাশ্রী, কাকলি গানের বাড়ি। গুণেন জিজ্ঞেস করল:
– ওই যে সোনাটা, ওর মানে কী স্যার?
– পশ্চিমী সঙ্গীতের একটা রাগ, সেই গল্পও তো অনাচারের ছিল। বললেন সুমিতাভ।
– পাপ স্বীকারের গল্প রাইটার স্যার। বলছি পাপ হল কালো ধোঁয়ার মতো। কারখানার চিমনি দিয়ে বেরয়।  আমি ক’দিন আগে বাঁকুড়া গিয়েছিলাম বোনের ছেলের বিয়েতে। দুর্গাপুর থেকে বাসে যেতে গিয়ে দেখি শালবনের সবুজ পাতা সব কালো হয়ে গেছে স্যার, পাপের ধোঁয়া। 

এখন বসন্ত বিদায় নিয়েছে। গ্রীষ্ম এসেছে। ভোরের বাতাস আরামের। আর হাঁটলে ঘর্মাক্ত হয়ে যাই দ্রুত। এই ঝিলের মধ্যে একটি দ্বীপ আছে। আগে মানে আমাদের শৈশবে, কৈশোরে, যৌবনেও দেখেছি দ্বীপে কত গাছ, গাছের মাথায় বকের বাসা। বিকেলের শেষে, সন্ধ্যার সময় গাছ সাদা হয়ে থাকত। সেই গাছ সাফ করে দ্বীপে একটি রেস্তরাঁ বানানোর পরিকল্পনা হয়েছিল। এলাকার কিছু মানুষ, তাঁর ভিতরে ছিলেন বিখ্যাত এক চিত্রকর, গায়ক, ফুটবল খেলোয়াড়, এবং সুমিতাভও… প্রতিবাদ করে চিঠি লিখেছিলেন সংবাদপত্রে। মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে। টেলিভিশন চ্যানেলেও বলেছিলেন তাঁরা। ফলে সেই পরিকল্পনা বাতিল  হয়ে যায়। 

 

আরও পড়ুন: সুগত মুখোপাধ্যায়ের কলমে: আলোয় ধোওয়া অক্ষরমালা

 

ব্যাপারটা খুশি করেনি নীলমাধবকে। সে খুব চেষ্টা করেছিল ঐ উন্নয়ন যেন হয়। সে নাকি চিঠিও লিখেছিল পাল্টা, কিন্তু সেই চিঠি ছাপা হয়নি। সে টিভি চ্যানেলে বলতে চেয়েছিল, পাত্তা পায়নি। সুমিতাভ বলেছিলেন। সুমিতাভকে পছন্দ করে না নীলমাধব। নীলমাধবের স্বপ্ন ছিল রেস্তোরাঁটি। তার নাকি শেয়ার ছিল জয়সোয়ালের ওই খানাপিনার ঘরে। সব মাঠে মারা গেছে। অথচ মর্নিংওয়াকের পরে দ্বীপের ভিতরের রেস্তোরাঁয় আড্ডা হত চায়ের কাপ হাতে। সন্ধ্যার পর আনন্দের ব্যবস্থা। একটা সেতুও করা হয়েছিল যাওয়ার জন্য। সেই সেতু এখন বাঁশের বেড়া দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গাছ আর বক তো উধাও হয়ে গেছে। পাড় বাঁধিয়ে দিয়ে অতি বৃহৎ চৌবাচ্চা করে দেওয়া হয়েছে জলাশয়টিকে। ফলে আগের মতো পানকৌড়ি দেখতে পাই না। কিন্তু জলাশয় ঘিরে প্রচুর গাছ এখানে। প্রচুর পাখি। সন্ধ্যায় তাদের কলকাকলি রেকর্ড করেছিলাম আমি একদিন। সকালেও কম থাকে না। গাছে ঝুলে থাকা বাদুড়ও দেখা যায়। সব দেখা যায়, কিন্তু সেই বকেরা নেই। সেই যে উড়াল দিল, আর ফেরেনি। তারা সব দেশের বাড়ি চলে গেছে।

আমাদের মধ্যে সুমিতাভ মৈত্র ফেসবুক করেন। তিনি ফেসবুকেও লিখেছিলেন, দ্বীপ নষ্ট করে পরিবেশ ধ্বংস করার বিপক্ষে। নীলমাধব লিখেছিল উন্নয়নের পক্ষে। কিন্তু জিতে গিয়েছিলেন সুমিতাভ। ফেসবুক নিয়ে আমার কৌতুহল আছে, কিন্তু আমি পারি না। আমার হোয়াটস্যাপ আছে। ফোনে যত ইচ্ছে কথা বলতে পারি। হোয়াটস্যাপ কল করতে পারি ব্যাঙ্গালুরুবাসী কন্যার সঙ্গে। ভাবছি বড় একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন কিনে ফেসবুক খুলব। নীলমাধবই খুলে দেবেন বলেছেন। কিন্তু আমার বউ বলে, কী হবে? অহেতুক পয়সা খরচ। ওসব ছোট ছেলেমেয়েদের ব্যাপার। 

সুমিতাভর কাছে শুনেছি চঞ্চলচন্দ্র চন্দ্রও ফেসবুকে আছেন। ফেসবুকে কমন ফ্রেন্ডের মাধ্যমে তাঁরা বন্ধু হয়েছেন। আর চঞ্চলচন্দ্র সুমিতাভর লেখা পড়েছেন। নীলমাধব সকালের সঙ্গী হলেও ফেসবুকে সুমিতাভর বন্ধু নন। সুমিতাভ খুব ভেবেচিন্তে বন্ধু করেন। গুণেন সরকার আছেন তাঁর বন্ধু তালিকায়।  ফেসবুক বিষয়ে জুড়ান রায় গুণেন সরকারকে বলেছিল: নীলমাধবের ফেসবুক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রিপোর্টে। একশো মহিলা ওর নামে রিপোর্ট করেছিল। লোকটা রাত হলেই মেয়েদের মেসেজ পাঠায়, ‘শুয়ে পড়লে নাকি?’

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *