বাণী ভাবতে পারেনি, অমলা আসবেন। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে অমলাকে দেখে এতটাই অবাক হয়ে গেল যে খানিকক্ষণ কথাই বলতে পারল না।

অমলা ভুরু কুঁচকে মেয়েকে বললেন, ‘‌কী দেখিস?‌’

বাণী পলক না ফেলা চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘‌তোমায় দেখি মা।’‌

অমলা বিরক্ত গলায় বললেন, ‘‌ঢঙ করবি না। জানিস না আমি ঢঙ পছন্দ করি না?‌ তোমায় দেখি কথাটার মানে কী?‌ আমাকে কি তুই এই প্রথম দেখছিস? অনেকদিন পরে দেখছিস ঠিকই, তাই বলে ঢঙ করতে হবে?‌‌’‌

আনন্দে বাণীর কান্না পেয়ে যাচ্ছে। সে ঠিক করল, কান্না যদি এসেই যায় তো যাবে, আটকাবে না। কতদিন আনন্দে কাঁদেনি!‌ বাণী মায়ের ধমক পাত্তা না দিয়ে চিক্‌চিক্‌ করা চোখে বলল, ‘তোমাকে সত্যি দেখছি কিনা বোঝবার জন্য ‌আমি কি তোমার গায়ে একটু হাত দিয়ে দেখতে পারি মা?‌’‌

অমলা কটমট চোখে বললেন, ‘‌না, পারিস না। তোকে দেখে মনে হচ্ছে, হয় তুই ঘর ঝাঁট দিছ্‌ছিলি, নয়তো বাসন মাজছিলি। হাত নোংরা। নোংরা হাত আমার গায়ে দিবি না। আমি স্নান করে এসেছি। আর অতবার ম্যা ম্যা করছিস কেন? তিন বছর পর দেখা হলে কি বারবার‌ ছাগলের মতো ম্যা ম্যা করতে হয়। দশ বছর পর দেখা হলে কী করবি?‌ গাধার মতো গঁ গঁ করবি?‌’‌‌ 

বাণীর চোখে এবার সত্যি জল চলে এল। এই ধরনের কান্নায় জল চট করে চোখ থেকে পড়তে চায় না, চোখেই থাকতে চায়। সে জলভরা চোখে হেসে মায়ের গায়ে হাত রেখে বলল, ‘‌আচ্ছা বেশ, গায়ে হাত দেব না। এবার বলো কেমন আছ?‌’

অমলা বললেন, ‘‌এতদিন ভাল ছিলাম, তোর কাছে এসে খারাপ হয়ে গেলাম। প্যানপ্যানানি কান্না আমার মোটে পছন্দ হয় না।

বাণী হেসে বলল, ‘‌আমি তো মেয়েটাই প্যানপ্যানে।’‌

অমলা বললেন, ‘‌তা কি আর জানি না?‌ প্যানপ্যানে আর বিশ্রী ভালমানুষ।’‌

বাণী অমলার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘ইস্ কী যে ভাল লাগছে মা!‌ তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। কতদিন পরে এলে বলো তো?‌’‌‌

অমলা শুধু মেয়ের কাছে আসেননি, মেয়ে যা চেয়েছিল, নিয়ে এসেছেন। ব্যাগ থেকে কাগজের মোড়ক বের করে বললেন, ‘‌এই নে ধর। অল্পে কাজ হবে।’‌ 

বাণী হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে কাগজের মোড়ক নিল। বলল,‘ উফ্‌ তুমি এনেছ?‌‌ আমি তো ভেবেছি ভুলেই যাবে।’‌

‘‌জিনিস খাঁটি।’‌

‘‌তুমি তো খাঁটি জিনিসই আ‌নবে মা। তাই তো তোমাকে বলেছি।

অমলা ব্যাগের সঙ্গে একটা কাঁধের ঝোলাও এনেছেন। ঝোলা থেকে পানের ডিবে বের করলেন। পানের অভ্যেস তার তেমন ছিল না। ক্বচিৎ কদাচিৎ একটা আধটা মুখে দিতেন। অভ্যেস হয়েছে স্বামীর মৃত্যুর পর। স্টিলের চৌকো ডিবেতে পান সাজা থাকা। পাশে চুন। পান মুখে দিয়ে, আঙুলের ডগায় একটু চুন নিলেন। চুন এখনই মুখে দেবেন না, আঙুলের ডগায় ধরা থাকবে। ভুলে যাবেন। বেশ খানিকক্ষণ পর মনে পড়লে তখন জিভের ডগায় ঠেকাবেন।

অমলা বললেন,‘‌শুধু খাঁটি নয়, এই জিনিসের মজা আছে।’‌

কাগজের মোড়ক হাতে ধরে বাণী অবাক হল, এই জিনিসে আবার মজা কী!‌ ছোটবেলা থেকেই বাণী দেখছে, তার মা বাইরে ধমকধামক দিলেও ভিতরে একজন হাসিখুশি মহিলা। ছোটখাটো বিষয় নিয়েও মজার কথা বলে। একটা সময়ে সে মাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করত।

‘‌মা, তোমার ভিতরটা এমন মজা মজা কেন?‌’‌

অমলা গম্ভীর হয়ে বলতেন, ‘আমার চেহারা গোলগাল বলে। যাদের চেহারা গোলগাল তাদের ভিতরে মজা থাকে, আর যাদের চেহারা খ্যাঁংড়া কাঠির মতো তাদের ভিতরে থাকে খিটখিটে ভাব। তোর বাবাকে দেখিস না?‌’

বাণীর ভালবাসার বিয়ে। শুধু ভালবাসা নয়, তার থেকেও বেশি। লুকিয়ে বিয়ে। পরে বাড়িতে জানায়। সেও পাঁচ বছর কেটে গেল। অমলা মেয়ের বাড়ি খুব কমই এসেছেন। নীলরতন পছন্দ করতেন না। পছন্দ না করবার জন্য তার হাতে ছিল দুটি কারণ। এক, মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ঘনঘন যেতে নেই। যদিও ওই বাড়িতে মেয়ে জামাই ছাড়া আর কেউ নেই, তা হোক, ওটা তো মেয়ের শ্বশুরবাড়িই হল। আর দু’‌ নম্বর হল, বাণী যে ছেলেকে বিয়ে করেছে, সেই ছেলে অতি বদ।

বাণীর বাবা নীলরতন একটু রোগার দিকে হলেও মোটেও ‘‌খ্যাঁংড়া কাঠি’‌ নয়। তবে মানুষটা রগচটা প্রকৃতির। একমাত্র সন্তান হয়েও বাণী বাবাকে ভয় পেয়ে এসেছে চিরকাল। এত ভয় পাওয়ার পরও অবশ্য সে একটা দুঃসাহসিক কাজ করে বসেছিল। এতটাই দুঃসাহসিক যে নীলরতনও গোড়ায় বিশ্বাস করেননি। তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘‌তুমি বলো কী অমলা!‌ হতেই পারে না। বাণী এ কাজ করতেই পারে না। আমি বিশ্বাস করি না। তুমি ভুল বলছ।’‌

অমলা চুপ করে ছিলেন। যতক্ষণ মানুষটা ভুল ভেবে থাকে, ততক্ষণ‌ই ভাল।  

কাগজের মোড়কটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বাণী বলল, ‘‌এর মধ্যে মজার কী রয়েছে বললে না তো?‌’‌

অমলা এক গাল থেকে অন্য গালে পান সরাতে সরাতে বললেন,‌‘পরে হাজার চেষ্টা করলেও খোঁজ পাওয়া যাবে না এইটা হল মজা। ছাড়্‌ ওসব কথা, আমি কিন্তু থাকব না। সন্ধ্যের গাড়িতে চলে যাব।’‌

বাণী বলল, ‘‌কেন?‌ ক’টা দিন আমার কাছে থাকতে পারো না?‌’‌

অমলা চোখ বুঁজে পানে চিবানি দিয়ে বললেন, ‘‌না, পারি না।’‌

বাণী বলল, ‘তোমার তো এখন ঝাড়া হাত পা। আমার কাছে থা‌কলে কী হয়? তোমার জামাইও তো নেই। বাইরে গিয়েছে।‌

কথাটা ভুল বলেনি বাণী। অমলার এখন সত্যি ঝাড়া হাত পা। বাণীর বাবা নীলরতন মারা গিয়েছেন সাড়ে চার বছর হতে চলল। ঝামেলাহীন মৃত্যু। সকালে বাজার থেকে ফিরে থলি নামিয়ে স্ত্রীকে বললেন, ‘ভাল সজনে ডাঁটা এনেছি। একেবারে কচি। বড়ি দিয়ে তরকারি করো। মাখা মাখা তরকারি। সজনে হল অতি স্বাস্থ্যকর, পিত্তনাশক।’ 

এরপর রোজকার মতো জামা–‌কাপড় বদলে শোবার ঘরের খাটে খবরের কাগজ নিয়ে বসেছিলেন নীলরতন। মিনিট পনেরো পর অমলা চায়ের কাপ নিয়ে গিয়ে দেখলেন, কাগজ পাশে ভাঁজ করা, মানুষটা খাটে শুয়ে পড়েছে। ব্যথায় মুখ কোঁচকানো। 

অমলা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘‌কোথায় কষ্ট হচ্ছে?‌’‌ 

নীলরতন জোরে শ্বাস টেনে বললেন, ‘বুকে ব্যথা, ‌চিন্তার কিছু নেই। পিত্ত থেকে ব্যথা। তরকারি নয়, তুমি বরং বড় করে সজনে ডাঁটার ঝোল বানাও অমলা। বাটিতে চুমুক দিয়ে খাব।’‌

অমলা বললেন, ‘‌মেয়ে জামাইকে খবর দেব?‌’‌

নীলরতন দাঁতে দাঁত চেপে ‌বললেন, ‘‌খবরদার! আমি যদি মরেও যাই, ওই বদ ছেলে যেন আমার মরা মুখ দেখতে না আসে। তুমি রান্নাঘরে যাও।‌’‌

সজনে ডাঁটা কড়াইতে চাপিয়ে, তাতে জল ঢেলে, ঢাকনা চাপা দিয়ে অমলা আবার ঘরে এলেন স্বামীর খবর নিতে। পিত্তের ব্যথা কি কমল?‌ 

নীলরতন ততক্ষণে মারা গিয়েছেন।

বাণীর ভালবাসার বিয়ে। শুধু ভালবাসা নয়, তার থেকেও বেশি। লুকিয়ে বিয়ে। পরে বাড়িতে জানায়। সেও পাঁচ বছর কেটে গেল। অমলা মেয়ের বাড়ি খুব কমই এসেছেন। নীলরতন পছন্দ করতেন না। পছন্দ না করবার জন্য তার হাতে ছিল দুটি কারণ। এক, মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ঘনঘন যেতে নেই। যদিও ওই বাড়িতে মেয়ে জামাই ছাড়া আর কেউ নেই, তা হোক, ওটা তো মেয়ের শ্বশুরবাড়িই হল। আর দু’‌ নম্বর হল, বাণী যে ছেলেকে বিয়ে করেছে, সেই ছেলে অতি বদ। নীলরতনের মতে ক্রিমিনাল। ছেলের পেশা হল ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ ঠকানো। নীলরতন বিশ্বাস করতেন, ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন এবং ঠাণ্ডা মাথার মানুষ ঠকানোর মধ্যে কোনও ফারাক নেই। এই ছেলে বাণীকেও ঠকিয়েছে। নিজের কাজকর্ম, ঘরবাড়ি নিয়ে সব মিথ্যে বলেছে। তিনি একথা মেয়েকেও বলেছিলেন।

‘‌আমার মেয়ে হয়ে তুই এত বড় গর্দভের মতো কাজ কী করে করলি!‌‌ ওই ক্রিমিনাল ছোকরা যা বলল, সব বিশ্বাস করলি!‌‌ ও কোন ব্যবসাপাতি করে?‌ আমি খবর নিয়ে জেনেছি, ছোকরা জোচ্চুরির ব্যবসাপাতি করে। ওর কোনও বাড়িঘর রয়েছে?‌ কিছু নেই। যে বাড়িটায় ভাড়া থাকে, সেখানে ভাড়াও দেয় না। জোর জবরদস্তি করে র‌য়েছে। বাড়িওলা মামলা ঠুকেছে। তুই এত বড় গর্দভ!‌ ওই ছেলের কাজই হচ্ছে মানুষ ঠকানো। গোপনে তুই তার গলায় মালা দিলি!‌ ওই মালা দেখালেও আমি বিশ্বাস করব না।’‌

বাণী বাবার কাছে মাথা নিচু করে থেকেছে। পরে অমলার কাছে গিয়ে চোখ মুছে বলেছিল,‘‌তোমাদের জামাই যাকে খুশি ঠকাক, আমি তাকে ঠকাইনি। আমি তাকে ভালবাসি।

বিয়ের তিনমাসের বাণীর কাছে কানাঘুষোয় খবর এল, সে একা নয়, সত্যেনের আরও বউ রয়েছে। খবর সত্যি কিনা জিগ্যেস করায় সেদিন স্বামীর হাতে বেদম মার খায় বাণী। চোখের নীচে কালশিটে পরে, ঠোঁটের তলা কেটে যায়, বাঁ হাত মুচড়ে যায়। মারধোর শেষ করে সত্যেন স্বাভাবিক গলায় বলে, ‘আমার আর একটা কেন, দশটা বউ থাকলেও তোমার কী?‌ ‌ভুলে যেও না বাণী, এখন আর আমি তোমার প্রেমিক নই, আমি তোমার স্বামী। যাও চোখে মুখে জল দিয়ে এসো। আসবার সময় কাপড় খুলে আসবে। আর শোনো, কান্না বন্ধ করো। আদর সোহাগের সময় কান্না ভাল লাগে না।’‌

বাণী একথা বাবা–‌মায়ের কাছে গোপন করে। মেয়েরা যেমন ভালবাসা গোপন করতে পারে, তেমন ভালবাসার আঘাতও গোপন করতে পারে।

তারপরেও অমলা সব বুঝতে পারতেন। মেয়েকে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন। বাণী টেলিফোনে চাপা গলায় বলেছিল, ‘‌দোহাই মা। তুমি এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। তোমার জামাই জানতে পারলে আরও রাগারাগি করবে।’‌

অমলা অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘‌সে অন্যায় করে, আবার সে–‌ই রাগ করবে!‌’‌

বাণী বলে, ‘আমার তো কোনও ভুল হয়নি, আমি তো ভালবেসেই বিয়ে করেছি।’‌

অমলা ধমক দিয়ে বলেন, ‘‌চুপ কর। একদম চুপ কর। চলে আয় তুই। গরিবের সংসারে যেমন ছিলি তেমন থাকবি। তিনজনে মিলে নুন ভাত খাব।’‌

বাণী একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, ‘‌না। তোমাদের জামাইকে আমি এখনও ভালবাসি।’‌ 

নীলরতনের আপত্তির কারণেই অমলা মেয়ের বাড়িতে আসতেন না। এলেও কখনও রাত কাটাননি। বাবা মারা যাওয়ার পর বাণী একবার জোর করে রেখে দিয়েছিল। সত্যেন সেদিন বাড়ি ফিরে শাশুড়িকে দেখে একেবারে গদগদ হয়ে পড়ল। প্রণাম করে, হাত টাত কচলে একাকার কাণ্ড। 

‘‌আপনি কতদিন পরে এলেন মা। গরিব জামাইয়ের ঘরে পায়ের ধুলো দিতে একবারও কি ইচ্ছে হয় না?‌ জানি, আমাকে আপনারা পছন্দ করেন না। শ্বশুরমশাই গাল দিতেন। শুনেছি, মারা যাওয়ার সময় নাকি বলেছিলেন, ওই বজ্জাত ছেলে যেন আমার মরামুখ না দেখে। আমি তাঁর কথা রেখেছিলাম মা। আমি যাইনি। তবে উনি যাই বলুন আর তাই বলুন মা, সম্পর্কে আমি তো আপনাদের জামাই। ফালতু জামাই নই, একমাত্র মেয়ের জামাই। যাক মা, আপনি থাকুন। যতদিন খুশি থাকুন। বলুন রাতে কী খাবেন?‌ ইস্‌ একটু আগে খবর পেলে স্টেশন থেকে বাজার করে ফিরতাম। যাক কাল ভাল করে বাজার করব। আপনি না বলতে পারবেন না মা। আমি কোনও কথা শুনব না, এই আমি বলে রাখলাম।’‌‌

সত্যেন গোলমাল শুরু করল রাত বাড়লে। বাণীর ওপর চেঁচামেচি। প্রথমে চাপা গলায়, তারপর জোরে। এতটাই জোরে যে ঘরে বসে অমলা সব শুনতে পেলেন।  

‘‌এটা কি রাজপ্রাসাদ?‌ অ্যাঁ, এটা কি রাজপ্রাসাদ? যার ইচ্ছে হবে এখানে এসে রাত কাটাবে?‌ শ্বশুরবাড়ি থেকে আমি কী পেয়েছি? ঘাড় ধরে এদের বের করে দিতে হয়। বাণী, তোমাকে না বলেছি, ‌ওই বাড়ির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখবে না। বলিনি?‌ আর তুমি ডেকে এনে একেবারে বাড়িতে রেখে দিলে!‌’‌

বাণী মিনমিন করে বলে, ‘‌চুপ করো। তোমার পায়ে পড়ি।’‌

সত্যেন গলা আরও চড়াল। বলল,‘‌স্বামী মারা যাওয়ার পর নিশ্চয় এখানে পাকাপাকি থাকবার প্ল্যান করেছে। এদের আমি খুব চিনি।

‌বাণী কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘‌ তুমি চুপ করো।’‌

সত্যেন কড়া গলায় বলল,‘‌কাল সকালে উঠে যেন না দেখি। যদি দেখি মা মেয়ে দুটোকেই ঘাড় ধরে বের করে দেব। তখন দেখব দু’‌বেলা ভাত জোটে কী করে?‌ বাপ তো কানাকড়িও রেখে মরেনি। রাখবেই বা কী করে ? কাজকম্ম তো তেমন ছিল না। মুদি দোকানের কর্মচারীর ক’ পয়সা আয়?‌’‌

সারা রাত জেগে বসে থেকে পরদিন ভোর হতে না হতে স্টেশনে গিয়ে কলকাতা ফেরার গাড়ি ধরেন অমলা। 

এবাড়িতে সেটাই শেষ আসা ছিল অমলার। বাণীকেও কলকাতায় যেতে দেয়নি সত্যেন। বলে দিয়েছিল, কালকাতায় গেলে ওখানেই পাকাপাকি থেকে যেতে হবে। কী করে থাকবে? নীলরতন মারা যাবার পর অমলাকে কসবায় দূর সম্পর্কের এক দিদির বাড়িতে উঠতে হয়। না উঠে উপায় কী ছিল?‌ বাড়ি ভাড়া দেবে কে?‌ অবিবাহিতা, একা থাকা সেই দিদি অমলাকে যে জায়গা দিয়েছিল তাইই অনেক। অমলা অবশ্য সেখানে গিয়েই রান্নাবান্নার দায়িত্ব নিয়ে নেন। পরে কাপড়চোপড় কাচার দায়িত্বও আসে। ফ্রিতে তো থাকা যায় না। কেউ রাখবেই বা কেন?‌ নিজের লোকই রাখবে না, দূর সম্পর্কের দিদির তো প্রশ্নই ওঠে না। 

ক’দিন ধরে মাকে খুব ডাকাডাকি করছে বাণী। আর পারছে না সে। সহ্যের সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে সত্যেন। ক’দিন আগে ঘোষণা করেছে, কোন এক মহিলাকে এ ‌বাড়িতে এনে তুলবে। বাণী চমকে উঠেছিল।

‘‌সেকী‍‌!‌’‌

সত্যেন পা দোলাতে দোলাতে বলেছিল, ‘‌চমকে উঠলে কেন?‌ কাঞ্চনা এখানে থাকলে তোমার অসুবিধে কী?‌’‌

বাণী বলল,‘‌লোকে কী বলবে?‌’‌

সত্যেন কাগজ পাকিয়ে কান চুলকোতে চুলকোতে বলল, ‘‌লোকে আবার কী বলবে?‌ সবাই জানবে তোমার এক বৌদি এসেছে। পাঁচ বছর পরে তোমার কাছে এসেছে, ক’দিন থাকবে। তারপর সবার গা সওয়া হয়ে যাবে। পাপকর্মের মজা কি জানো বাণী?‌ জানো না। বাপে কোনও শিক্ষাই দেয়নি। পাপকর্মের মজা হল, প্রথমটা অসুবিধে হয়, পরে সবাই মানিয়ে নেয়। কেউ মাথা ঘামায় না।’‌‌

বাণী স্থির চোখে তাকিয়ে বলেছিল,‘‌এই মেয়ে কে?‌ কবে আনবে? রাখবে কোথায়?’‌

সত্যেন আধ বোঁজা চোখে বলল, ‘‌এখনও ঠিক করিনি। তাড়াহুড়ো কিছু নেই। অসহায় নারী, আশ্রয় নেই, তাই বাড়িতে রাখব।’‌

বাণী চোয়াল শক্ত করে বলেছিল, ‘‌রাতে সে শোবে কোথায়?‌’‌

সত্যেন চোখ খুলে বলল, ‘রাতে শোবে কোথায় মানে?‌ একথার মানে কী?‌ বাইরে যে ছোট ঘর আছে ওখানে শোবে‌। সে তো আমার বউ নয়, যে রাতে আমার পাশে শোবে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরব। হ্যাঁ, রাতবিরেতে যদি আমার তেমন জরুরি কিছু লাগে, আমি তার কাছে যাব। তুমি থাকবে তোমার ঘরে, সে থাকবে তার ঘরে। তোমার অসুবিধে কী?‌’

একসময়ে বাণী অনেক কেঁদেছে। সে পাট চুকেছে। এখন আর কাঁদে না। ক’দিন ধরে শুধু মাকে বারবার আসতে বলেছে। 

‘‌আর পারছি না মা। একবার এসো, একবারটি। কোনওদিন বলব না আর। আসবার সময় আমার জন্য নিয়ে এসো.‌.‌.‌আমি আর পারছি না.‌.‌.‌। তোমাকে আর কখনও বলব না, এই শেষবার.‌.‌.‌প্লিজ মা.‌.‌.‌।’‌‌

আজ দুপুরে দরজায় খুটখুট আওয়াজে চমকে উঠেছিল বাণী। এখন কে এল?‌ সত্যেন কি ফিরল?‌ একা ফিরল?‌ নাকি সেই মেয়েটাকে সঙ্গে এনেছে?‌ তারপর ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে অমলাকে দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেল। এতটাই অবাক যে খানিকক্ষণ কথাই বলতে পারল না।

অমলা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘‌রিকশ ভাড়া দিয়ে দে। আমার কাছে খুচরো নেই।’‌

বাণী বিস্ফারিত চোখে বিড়বিড় করে বলল, ‘‌মা, তুমি এসেছ!‌’‌

অমলা মেয়েকে সরিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,‘‌না, আমি আসিনি, নে সর, ঢুকতে দে।’‌

এবাড়িতে সেটাই শেষ আসা ছিল অমলার। বাণীকেও কলকাতায় যেতে দেয়নি সত্যেন। বলে দিয়েছিল, কালকাতায় গেলে ওখানেই পাকাপাকি থেকে যেতে হবে। কী করে থাকবে? নীলরতন মারা যাবার পর অমলাকে কসবায় দূর সম্পর্কের এক দিদির বাড়িতে উঠতে হয়। না উঠে উপায় কী ছিল?‌ বাড়ি ভাড়া দেবে কে?‌ অবিবাহিতা, একা থাকা সেই দিদি অমলাকে যে জায়গা দিয়েছিল তাইই অনেক।  

অমলা শোবার ঘরের খাটে থেবড়ে বসেছেন। পাও তুলেছেন। হাতের ব্যাগ, কাঁধের ঝোলা, পানের ডিবে খাটের ওপরেই ছড়িয়েছেন। লাল পাড় শাড়ির সঙ্গে রঙ মিলিয়ে লাল জামা। তাকে দেখাচ্ছে ভারী সু্ন্দর। স্নান করে এসেছেন। চুলগুলো এখনও ভেজা ভেজা। নীলরতন মারা যাবার পর অমলার নিজের দিকে নজর ছিল না। ‘‌খেতে হয়, পরতে হয়, বাঁচতে হয়’‌ ধরনের জীবন কাটাতেন। এখন অনেকটা পরিপাটি হয়েছেন। বাণীর খুব ভাল লাগছে। মায়ের গা থেকে কেমন একটা ‘‌মন কেমন করা’‌ গন্ধ আসছে। সেই ছোটবেলায় পাওয়া গন্ধ। বাণী ঠিক করল, আজ খানিকক্ষণ মায়ের গায়ে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকবে। মা বকবে, বকুক। কিছুতেই সরবে না। বাণী জানে, তার মা বকাবকি করে ঠিকই কিন্তু কখনও তার ওপর রাগ করে না। লুকিয়ে বিয়ে করবার পর শান্তভাবে বলেছিল, ‘‌তোর কোনও দোষ নেই বাণী, ভালবাসা ব্যাপারটাই এমন বিচ্ছিরি। মানুষের বোধবুদ্ধি নিয়ে সে খেলা করে। কখনও জেতে, কখনও হারে। দেখ, তোর বেলায় সে কী করে।’‌ 

বাণী ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে, এই মহিলার মাথা ঠাণ্ডা। মাথা ঠাণ্ডা না হলে, এমন অভাবের সংসার টানা যায়?‌ ওর মধ্যেই মেয়ের বিয়ের জন্য একটু একটু করে পয়সা জমানো শুরু করেছিলেন। সেই পয়সা বাণী নেয়নি। পালিয়ে যাওয়া, লুকিয়ে রাখা বিয়েতে মা–‌বাবার জমানো পয়সা নিতে নেই। পরে সম্পর্ক ভাল হলেও নয়। যদিও বিয়ের ক’দিন পর থেকেই সত্যেন বাপের বাড়ি থেকে টাকা–‌পয়সা আনবার জন্য খুব চাপ দিয়েছে। ক’‌বছর আগেও দিয়েছে।

‘‌মায়ের গলার হারটা তো নিয়ে আসতে পারো। বিধবা মেয়েমানুষ গলায় সোনা পরে কী করতে?‌ ‌কাকে দেখায়?‌’‌

বাণী নিচু স্বরে বলেছিল, ‘‌ মায়ের কোনোও চুড়ি, হার নেই। অভাবের সংসারে ঘরে সোনা থাকে না।

সত্যেন মুখ বিকৃত করে বলেছিল, ‘‌আমার শালা সবটাই লোকসান।

অমলা বেশ আরাম করেই বসেছেন। ঝোলা থেকে একটা শাড়ি বের করে বললেন, ‘‌‌নে, দেখ শাড়িটা পছন্দ হয় কিনা। পছন্দ না হওয়ার কিছু নেই। রঙ একটু চড়ার দিকে। তোর মতো কালোকুলো মেয়ের জন্য চড়া রঙই ভাল। জমিটা ভাল। সস্তার শাড়িতে ভাল জমি পাওয়া যায় না।’‌

বাণী বলল, ‘‌আবার এত খরচ করে এসব করতে গেলে কেন?‌’‌

অমলা হেসে বললেন, ‘‌তোর বিয়ের পয়সা জমা আছে না?‌ পুরো দেড় হাজার। কম টাকা?‌ আরও বাড়ত, দুম করে বিয়ে করে ফেললি যে। যাক্ ওখান থেকেই কেনাকাটা করছি। শাড়ি কিনলাম, তোর ওই জিনিস কিনলাম। খাঁটি জিনিসের দাম বেশি।’‌

দুপুরে বাণী নিজের হাতে রান্না করল। ঘরে যা আছে তাই দিয়ে রান্না। মায়ের জন্য রান্না করবার আনন্দে আলু-কুমড়োর তলা ধরিয়ে ফেলল। সারা দুপুর মা-বেটিতে  গল্প হল। গল্প কি ফুরোয়?‌ এতদিনের জমা কথা শেষ করে এতদিনের ফুরনো কথাও বলা হল। সন্ধের  মুখে বাণী মাকে ট্রেনে তুলে দিতে স্টেশনে গেল। ছোট্ট গ্রামের এই ছোট্ট স্টেশন সবসময় ফাঁকা। আজ যেন বেশিই ফাঁকা। অমলা আর বাণী ছাড়া কেউ নেই বললেই চলে। একসময়ে দিনের শেষ আলো মুচকি হেসে গা ঢাকা দিল। দূর থেকে ভেসে এল হুইসল। ফেরবার গাড়ি আসছে। অমলা বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ঝোলা কাঁধে নিলেন। মেয়ের পিঠে হাত রাখলেন পরম স্নেহে।

‘‌মা রে, একটা কথা বলি শোন। শান্ত আর ভালমানুষ হওয়া কোনও দোষের নয়। নিয়ম হল, তাদেরই বেশি মার খেতে হয়। সে নিয়মও মন্দ নয়। ভালমানুষ হওয়ার দাম লাগে। কিন্তু কোনও কোনও সময় নিয়ম ভাঙতে হয় রে মা। দুনিয়ার সব নিয়মই ভাঙতে হয়। তুই মরবার জন্য আমার কাছে বিষ চেয়েছিলি, এনে দিলাম। এই বিষ তুই খাবি না, বরের খাবারে মিশিয়ে দিবি। যেমন শক্ত মনে ভালবেসে কাছে টেনেছিলি, তেমনই শক্ত মনে ভালবেসে দূরে সরিয়ে দিবি। কাছে দূরে বলে কিছু থাকবে না, শুধু তোর ভালবাসাটা থাকবে। এতে কোনও দোষ নেই। আর বললাম তো, এই বিষে মজা আছে। কেউ বুঝতে পারবে না, জানবে হার্ট অ্যাটাক। মন শক্ত কর বাণী।

বাণী অমলার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল— ‘‌করব মা। অবশ্যই মন শক্ত করব। তুমি বেঁচে থাকতে তোমার কথা শুনিনি, এখন তুমি নেই, তিন বছর হয়ে গেল তুমি নেই, বাবার মতোই নিঃশব্দে চলে গেছ। এখন তোমার সব কথা শুনব। আমার ফাঁসি হলেও শুনব। চিন্তা করো না। সাবধানে যাও।

গ্রামের নিচু প্ল্যাটফর্মের কানে ফিসফিস করে ভালবাসার কথা বলতে বলতে মেল ট্রেন ঢুকছে। বাণী দাঁড়িয়ে র‌য়েছে। দাঁড়িয়ে রয়েছে একা।

জন্ম কলকাতায়, ১৯৬২ সালে। বাঙুর এভিনিউতে স্কুলের পড়াশোনা, বড় হওয়া। স্কুলজীবন থেকেই খেলাধুলার সঙ্গে লেখালেখির নেশা। প্রথম লেখা মাত্র ১২ বছর বয়সে আনন্দমেলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তারপর বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লেখা চলতে থাকে। স্কুল শেষ হলে স্কটিশ চার্চ কলেজ। অর্থনীতিতে স্নাতক হয়ে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়া। তাঁর বহু জনপ্রিয় বইয়ের কয়েকটি, 'ধুলোবালির জীবন', 'মাটির দেওয়াল', 'সাগর হইতে সাবধান', 'গোপন বাক্স খুলতে নেই', 'দোষী ধরা পড়বেই'।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *