ওয়াজিরাবাদ আমি যাইনি কোনওদিন। তবে, ক্যামেরাটা টিল্ট ডাউন হয়ে চাঁদোয়া আলোর নীচে ফ্ল্যাট-কালচারের রাজধানী শহর লাগোয়া যে পানাপুকুরের ভেতর, বিশাল, বীভৎস এক ওয়েস্ট ডাম্পিং সাইটের গভীরে নামে, তেমনই এক একটা দৃশ্যের খুব কাছাকাছি থাকি আমি। শুয়োর, ঘোড়ায় মিলেমিশে একটা সুরিয়ালের ভেতর— আমি থাকি। দিল্লিওয়ালাদের নিজেদের যে কত গল্প, বুঝি। এই সেদিনও বাঁদর তাড়ানোর অন্য এক গল্প থেকে বেরিয়ে মেলানকোলিক টোনে চলে যাবে দুই বন্ধুর টান, গল্পের শেষে এক বন্ধু হঠাৎ চলে যাবে একদিন। মুখে রং মেখে অন্য বন্ধু রাজধানী শহরে মৃত্যু মৃত্যু খেলায় নামবে। গল্পের পরেরটা অবশ্য সিনেমা শেষের বেল পড়ে যাওয়ায় আমরা দেখতে পাই না আর। সেই ‘এব অ্যালি ও’-র দিল্লি কি বদলায় নাকি? ওই যে ওয়াজিরাবাদের সেই ছেলেটা ব্যাকগ্রাউন্ডে বলছে, এখানে ঘোড়া, গরু, কুকুর, শুয়োর, চিল— মিশে একটাই এন্টিটি। আলাদা করে এখানে কেউ নেই। সবাই শহরটার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করছে, মেনে নিচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বৃহত্তর দিল্লি, গলিঘুঁজির ঘর, বুকের ভেতর চিলের কান্না, আর তাকিয়ে থাকা… ছবির শেষটা জুড়ে ভিডিও কলে দুই ভাইয়ের একজনের এমনই তাকিয়ে থাকা হঠাৎ— আমরা নেটওয়ার্ক চলে গেছে বলে সান্ত্বনায় থাকি। আসলে ডাম্বশো খেলা নিরুত্তর দিল্লির মুখ সেসব। ছবির শেষে, দৃশ্যের শেষে কথা নেই, উত্তর নেই, সমাধান নেই। জাস্ট দেখে যাও। টিকে যাও, যদ্দিন পারো।
তো, এইসব কথা একটু মাথায় রাখি তরুণ পরিচালক শৌনক সেনের ‘অল দ্যাট ব্রিদস’ দেখতে দেখতে। শৌনক এই শহরকে চিনেছেন আগেই। রাতের শহর, ঘুমের শহর, ঘুমহীনতার শহরকে নিয়ে তাঁর আগের তথ্যচিত্র হন্টিং ‘সিটিজ অফ স্লিপ’ ঘুম কেড়ে নেয়। শৌনক গল্প পাল্টান। ধরন পাল্টান না। টার্গেট করে নেওয়া, হেরে যাওয়া, টিকে যাওয়ার লড়াই করতে করতে হেরে যাওয়া দিল্লিওয়ালাদের গল্প বলা থেকে সরে আসেন না।

ওয়াজিরাবাদের কথা বলছিলাম। দুই ভাই মহম্মদ সওদ আর নাদিম শেহজাদ। সঙ্গে আর এক তরুণ কর্মী সালিক। আর এই ট্রায়োর নিরন্তর চিল ধরা। চিল বলতে কালো চিল, এবং তার সঙ্গে কিছু স্পটেড হকসহ অন্যান্য অনেক শিকারী পাখি, যাদের ‘নন-ভেজ বার্ড’-এর আওতায় ফেলে চিকিৎসায় সাহায্য করে না প্রথাগত বার্ড হসপিটালগুলি। অক্লান্ত পরিশ্রমে কুড়ি বছর ধরে প্রায় কুড়ি হাজার অসুস্থ চিল বাঁচানো, আঘাত সারিয়ে আবার আকাশে পাঠানো– “যা, জি লে আপনি জিন্দেগি”। চিলকে খাবার দিলে দোয়া করবে ওদের ঈশ্বর, ‘সওয়াব’ মিলবে, তারপর সেই চিল মনের সব কষ্ট খেয়ে নেবে–‘দিককত খা জায়েগা’। চিলের খিদে যে অপরিসীম!
একটা লো অ্যাঙ্গেলের শটে সিঁড়ির ওপর অনন্ত চিল, চিল আর চিল। তথ্যচিত্র না ফিকশন, ফিকশন না তার বাইরের কিছু– এইসব দোলাচলের বাইরে বেরিয়ে আসে এ ছবির গল্প। প্রথাগত সিনেমা-ভেরিটে স্টাইলের তথ্যচিত্র নির্মাণের পথ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ড্রামাটিক, পোয়েটিক রাস্তায় কিছু অবিশ্বাস্য ট্র্যাকিং শট। রাজধানী শহরের উত্তরের পূতিগন্ধময় অঞ্চল, ঘিঞ্জি, কোনওরকমে টিকে থাকা এক শহরে দুই ভাইয়ের সোপ ডিসপেনশারির ব্যবসা। আর তার সঙ্গে প্রতিপালিত অন্য এক নেশা। দিল্লির আকাশে অনন্ত ওড়া চিলের ভেতর যারা মাটিতে এসে পড়ে, আহত, প্রায় পঙ্গু, মরতে বসা সেই চিলগুলোর সেবা শুশ্রূষা করে আকাশে ছেড়ে দেওয়ার তাগিদ… একসময়ের বডি বিল্ডিং-এর নেশায় পাওয়া মহম্মদ আর নাদিমের ছোটখাটো জ্ঞানকে ভিত্তি করেই চিলগুলোর সেবা শুশ্রূষা করে তারা, ব্যান্ড-এইড বেঁধে দেয়। সঙ্গে চলে সহকর্মী সালিকের নিরন্তর কামারাদেরি। মাঝেমধ্যে সওদ বলে, আর কত বাকি, কত? এক একটা উদ্ধার করা আহত চিল-ভর্তি প্যাকিং বাক্স নিয়ে আসতে আসতে সালিক বলে, এই তো, এটাই শেষ…

ওদের ঘর বলতে একটা ক্লসট্রোফবিক বেসমেন্ট, কাতারে কাতারে পাখি, মেশিন, কখনও পয়ঃপ্রণালীর জল ঢুকে আসছে ভেতরে– তীব্র এক টিকে থাকার সংকট এই ছায়াছবি। অন্যদিকে প্রায় গোটা ছবি জুড়ে ওদের নির্বাক পিতা আর কখনও কাজে সাহায্য করা অথচ সংসার নিয়ে, টিকে থাকা নিয়ে, সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত সওদের স্ত্রী। আর সর্বোপরি এই কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্যাশন, ক্লান্তি, অর্থসমস্যা, টালমাটাল রাজনৈতিক ভারতবর্ষ ও সংখ্যালঘু সমস্যা… ‘অল দ্যাট ব্রিদস’ আসলে ওই চিলগুলোর সঙ্গে বাঁদর, কুকুর, মানুষ, এবং হয়তো অত্যাচারী আর অত্যাচারিতের একসঙ্গে টিকে থাকার একটা প্যান্ডেমোনিয়াম– আক্ষরিকভাবেই অল, অল দ্যাট সারভাইভস, অল দ্যাট ব্রিদস (All That Breathes)…
আরও পড়ুন: বইয়ের কথা: সাম্প্রতিকতম ইতিহাসের পদচিহ্ন
আলো কোথায়? অন্ধকার? প্রেডিকশনের বাইরে গিয়ে এই ছবি আসলে আশার কথা বলে না। আবার হেরে যাওয়ার কথাও নেই। শুধু ওই হাইফেনটুকু আছে। আর তাই এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স সাতশ পেরিয়ে গেলে সওদের স্ত্রী আশঙ্কা করে। সওদ বলে, চিল বেশি করে পড়ছে আকাশ থেকে। মহিলা বলেন, আমি আমাদের ছেলের কথা বলছি। ওর শরীরের কথা বলছি। ঘরের ভেতর থেকে ছুটে আসা নিষ্পাপ শিশু তখন পর্দা নিয়ে খেলতে খেলতে হাসছে আর বলছে, চিল পড়ছে, চিল পড়ছে …।
একটি আহত চিলের মুখোমুখি তাকিয়ে থাকা সালিকের একটা সিগনেচার ফ্রেম আছে এক দৃশ্যে, যা গোটা ছবিকেই ডিফাইন করছে। মনে পড়ছে সালিকের চশমা নিয়ে যাচ্ছে চিল, অনেক অনেকটা দূরে সেই চিলেরই লং শট। কিংবা অসংখ্য মৃত চিলের সামনে ছাদের একপাশে বেবাক বসা সওদ, এর ঠিক পরেই প্রায় হু হু কাঁদিয়ে দেওয়া মাটি খোঁড়ার দৃশ্য, যেন সন্তানের মুখাগ্নি করছে খোদ পিতা।

আসলে এই ছবি ভীষণ ত্রিস্তরীয়। প্রথম লেয়ারে আহত পাখি এবং দিল্লির পরিবেশগত অবস্থান— নিউক্লিয়ার যুদ্ধ, ধোঁয়াময় বাতাস এবং সংকুচিত হওয়া এক ভীষণ রকম ন্যারো আরবান ইকোলজিকাল নিশে তৈরির প্রসঙ্গ। পাখি না, আসলে গোটা শহরের গায়ে ব্যান্ড-এইড লাগানোর নিরন্তর প্রয়াস। দ্বিতীয় স্তরে একটা পরিবারের টিকে থাকা, আর্থিক অনটন, এইসব… এবং পুরো ছবি জুড়েই লেইট মোটিফ হয়ে থাকা তৃতীয় স্তর অর্থাৎ রাজনৈতিক ভারতবর্ষ। রায়ট। ওয়াইল্ডলাইফ রেস্কিউ সেন্টারের সাইনবোর্ড আসার পর নাদিম বলছে, ভালো লাগছে, না? নিরুত্তর সওদ। ওর মুখ ফোকাস শিফটে অদ্ভুত তীব্র এক অন্ধকারে অনুভূতিহীন বেবাক হয়ে যাচ্ছে। গোটা ছাদ জুড়ে চিল হাসপাতাল, রায়টের ভয়ার্ত আবহের ভেতর উদ্বাস্তু শিবিরের মতো শ’খানেক চিলের হন্টিং-এর এক স্লো প্যান শট… ছবির প্রায় শেষদিকে ছাদের নবনির্মিত খাঁচার ভেতর যেন নিজেদের বানানো প্রিজনার্স ক্যাম্পে নিজেদেরই দেখছে দুই ভাই। একজন চলে যাচ্ছে অন্য গোলার্ধে, অন্যজন অল্প ঝুঁকে তাকিয়ে আছে অনন্তের দিকে। আ সেন্স অফ অ্যাবানডনমেন্ট। এখানে আসতে পারবে তো লোকে? এই রায়টের ভেতর? এই রাস্তায়? আহত পাখি পৌঁছে দিতে পারবে ঠিক সময়ে? আমেরিকা থেকে শেষের সেই ভিডিও কল। সিগনেচার। স্ট্যাটিক হয়ে যাওয়া সওদের মুখ। এপাশ থেকে জিজ্ঞাসু নাদিম, “ওদিকে সব ঠিকঠাক? কী রে, শুনতে পাচ্ছিস, শুনতে পাচ্ছিস ভাই?”
অসম্ভব ডিটেলিং ফ্রেম থেকে ফ্রেমে। শুরুর দৃশ্যের সেইসমস্ত ইঁদুর, দূর থেকে আসা গাড়ির হেডলাইট, রাস্তার নোংরা জলের ওপর বসা মশামাছি, শুঁয়োপোকার শরীরের ডিটেইল, জমে থাকা জলে হঠাৎ ওপর থেকে আসা বিমানের প্রতিবিম্ব– আবার এসবের মাঝে সোপ ডিসপেনসারির অ্যালিউশনে প্রায় স্বপ্নদৃশ্যের মতো ফ্রেমজুড়ে আসা একরাশ সাবান আর সাবান। সেই যে তারকোভস্কির ডায়েরি– ‘টাইম উইদিন টাইম’। তারকোভস্কি লিখছেন, ‘We have forgotten how to observe. Instead of observing, we do things according to patterns’। সমাপতন হলেও মনে পড়ছে একটি সাক্ষাৎকারে এই তারকোভস্কির স্টকারের প্রসঙ্গ তুলে ‘অল দ্যাট ব্রিদস’ ছবির বেসমেন্টের দৃশ্যায়নের কথা বলেছিলেন পরিচালক শৌনক। যন্ত্র, মানুষ এবং পরিবেশের জাক্সটাপোজিশনের তিক্ত-মধুর দৃশ্য রচনার, এই নিখুঁত অবজারভেশনের কথা মাথায় এসেছিল তখনই …

ভ্যারাইটি পত্রিকার সঙ্গে ছবি তৈরির ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে শৌনক বলছিলেন, ‘দ্য ফিল্ম ওয়াজ নেভার মেন্ট টু বি আ সুইট ফিল্ম অ্যাবাউট নাইস পিপল ডুইং কিউট থিংগস’। বলছিলেন, আকাশের অসংখ্য কালো বিন্দুগুলোর কথা। ড্রাইভিং করতে করতে বাড়ি ফেরার পথে একদিন দেখলেন সেইসব কালো বিন্দু ওপর থেকে পড়ছে। তারপর বাড়ি ফিরেই গুগল ঘেঁটে দেখলেন ঠিক কী হয় ওইসব কালো বিন্দুর, ওপর থেকে পড়া কালো চিলগুলোর? আর তখনই ওয়াজিরাবাদের সওদ-নাদিমদের খোঁজ। শৌনক বলছেন, পরিবেশ আসলে দিল্লিওয়ালাদের মূলগত একটি যন্ত্রণার দিক। কালো আকাশ, ধোঁয়াশা, এবং তার মধ্যেই ওড়া অসংখ্য পাখি। ‘আ ট্রায়াঙ্গুলেশন অফ এয়ার, বার্ডস অ্যান্ড হিউম্যান’– এই ত্রিকোণে বড় হওয়া দিল্লিবাসীর নিজস্ব কথাই আসলে এই ‘অল দ্যাট ব্রিদস’। ‘হাম সব হাওয়া কি বেরাদরি হ্যায়’। তাই কি পাখিদের সঙ্গে এত টান! এত বন্ধুত্ব! আত্মীয়তা…

প্রায় আড়াই বছর ধরে চলা ছবির শুটিং এবং ন-দশ মাসের পোস্ট প্রোডাকশন– যার কিছুটা দিল্লি এবং বাকিটা ডেনমার্কে এডিটর শারলট বেংস্টেনের অফিসে। শৌনকের কথায় বারবার উঠে আসা ছবির হন্টিং এবং আশ্চর্য রকমের পোয়েটিক দৃশ্যরচনায় এ ছবির ভরসা প্রধান চিত্রগ্রাহক বেন বারনার্ড। কোনও কোনও মুহূর্ত রচনায়, আকাশে চিলের উড়ে যাওয়া, ওয়েস্ট ডাম্পিংয়ের একটি আধা সুরিয়াল মায়াবী দৃশ্যে রজার গাওলার আবহসংগীত অসম্ভব কাঁপিয়ে দেয়।
এসমস্ত কিছুর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মূল্যায়ন ২০২২ কান চলচ্চিত্র উৎসবের ‘গোল্ডেন আই’ প্রাপ্তি। অথবা অ্যাকাডেমি পুরস্কারে সেরা তথ্যচিত্রের মনোনয়ন। হয়তো তার চেয়েও বেশি সওদ-নাদিম-সালিকদের কাজকে গোটা পৃথিবীর চিনে নেওয়া। পরিশ্রম, অনটন এবং রাজনীতি– এই ত্রিমুখী লড়াইয়ে, আলোহীন একটা বেসমেন্ট ঘরে না হলে যে অনন্ত ক্যাম্প ওদের! ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকা একটা সত্যিকথার স্বর, ভীষণরকমের ক্রুড রিয়েল জীবন– ‘ইস ছোটে সে বেসমেন্ট মে ওয়াক্ত কা হিসাব নেহি রহতা। ইঁহা কুছ সাল কাম করনে কে বাদ লগনে লগা কি একদিন ইঁয়েহি হার্ট অ্যাটাক আ জায়েগা, অউর ইঁয়েহি ফর্স পে গিরুঙ্গা। ছাতি ফাটেগি অউর অন্দর সে চিলে নিকলকে উড় জায়েগে …’
যা কিছু শ্বাস নেয়, তা যেন আলো পায় আরও।
ছবি সৌজন্য: লেখক, allthatbreathes.com
অনির্বাণ ভট্টাচার্য পেশায় প্রসারভারতীর অধীনে দিল্লি দূরদর্শন কেন্দ্রের প্রোগ্রাম একজিকিউটিভ। লিখেছেন গদ্য, কবিতা, প্রবন্ধ। বিশেষ আগ্রহ - চলচ্চিত্র, প্রাচীন স্থাপত্য, মন্দির-শিল্প এবং ক্রীড়াজগত।
I am getting interested.Where can we watch the documentary ? Thanks anyway for this apt review.Love the ending and i want to watch the docu badly.