পূর্ণিমার চাঁদের মতো বড়, গোল, লাল সিঁদুরের টিপ পরতেন ভৌমিকবাড়ির ছোট জেঠিমা। জেঠিমার ফর্সা, গোলগাল চেহারা, লাল-লাল শাড়ির সঙ্গে একদম মানানসই। টুকটুকে কপালখানায় একান্নবর্তী পরিবারের হেঁশেল সামলানোর যাবতীয় চিন্তা আর খানিকটা ঘামে মিশে গিয়ে গোলাকার টিপটা ঈষৎ ধেবড়ে যেত। আর তাতেই তৈরী হতো অদ্ভুত একটা মায়া। জেঠিমা হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়ালেই মন ভরে যেত। যেন কুঁজো থেকে ঢালা একঘটি ঠান্ডা জল। ফোঁটায় ফোঁটায় জুড়িয়ে দিচ্ছে শরীর, মন, মস্তিস্ক। যাবতীয় ক্লান্তি মুহূর্তে ভ্যানিশ। জেঠু মারা যাওয়ার পর প্রথম যেদিন জেঠিমার সঙ্গে দেখা। ওই টিপটা ছিলনা। এক্কেবারে অচেনা লাগছিলো জেঠিমাকে। জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিলাম, ‘টিপ পরাটা ছেড়োনা, জেঠিমা।

বছর তিনেক আগে ক্যান্সার ধরা পড়েছিল ছোড়দির। বরাবরই একটু একরোখা, জেদি, স্বাধীনচেতা। শান্ত, নম্র স্বভাবের মানুষটা অসুখের কথা জানতে দেয়নি কাউকে কিচ্ছুটি। মরার আগে মরতে চায়নি। টানা তিনবছর লড়াইটা চালিয়ে গেছে। একা। মাসখানেক হল ছোড়দি আর নেই। ওঁর হঠাৎ মৃত্যুর পর যতবারই মানুষটার কথা ভাবতে বসেছি, ততবারই, দুই ভুরুর মাঝে ওঁর ছোট্ট, গোল, খয়েরি টিপটা চোখে ভেসে উঠেছে। সমস্ত দৃষ্টি শুষে নেওয়ার মতো জোরালো নয়। অথচ খুব স্পষ্ট। যার অস্তিত্ব অগ্রাহ্য করা কঠিন। আসলে এই টিপগুলো শুধুই সাজগোজের অঙ্গ অথবা শুধুই রুপটান হয়ে থাকেনা। বরং কখন যেন মানুষগুলোর সঙ্গে মিশে, মিলে যায়। কোনও কোনও টিপ তো গল্পও বলে। ছেড়ে যাওয়া মানুষের স্মৃতি আগলে আয়নার গায়ে জ্বলজ্বল করে। ভালোবাসার, ভালো থাকার দিনগুলোর সাক্ষী হয়ে। হাজার বেসুরো, বেমানান লাগলেও সেই টিপ সরাতে মন চায় না  কিছুতেই। আর আয়নাতে টিপের সঙ্গে পড়ে থাকে নস্টালজিয়া।

টিপ, তিলক, কুমকুম, পট্টু, সিঁদুর, বিন্দি। দুই ভুরুর মাঝে কপালের এই  সংক্ষিপ্ত এবং অপরিহার্য  প্রসাধনটুকুর নাম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আলাদা। হয়তো আবেদনও। মহিলাদের কপালে টিপ পরা অথবা না পরার পেছনে রয়েছে ধর্মীয় ও সামাজিক নানান ব্যাখ্যা। কিন্তু সেইসব রমণীরা যাঁরা টিপ পরতে ভালোবাসেন, যাঁদের সাজ এক্বেবারে ফিকে, অসম্পূর্ণ থেকে যায় এককুচি টিপ ছাড়া তাঁদের ভারি বয়ে গেছে ঐসব ব্যাখ্যার ধার ধরতে।

যে নামেই ডাকা হোক না কেন আর মেয়েরা যে অর্থে বা অনর্থেই পরুন না কেন, বিন্দি নামক বস্তুটি কিন্তু বিশেষ আদর পেয়েছে শিল্প-সাহিত্যেও। ‘কপালে সিঁদুর সিঁদুর টিপ পরেছ, পরেছ শঙ্খদ্বীপের শাঁখা’, ‘বিন্দিয়া চমকেগি, চুরি খনকেগি’, ‘তেরি বিন্দিয়া, মেরি নিন্দিয়া’, ‘বিন্দিয়া বোলে, কাজরা বোলে’ ‘লাল শাড়ী লাল টিপ শ্রীমতি যে যায়’ আর অভিমানের সেই গান ‘তেরি বিন্দিয়া রে’ ; টিপ নিয়ে দারুণ সব গানেরও জন্ম হয়েছে যুগে যুগে।

বাঙালি মেয়েদের জীবনে অবশ্য টিপের প্রচলন শুরু সেই সিঁদুর দিয়েই। মনে আছে মায়েদের সময় কাকিমা, জেঠিমারা হাতে পাঁচটাকার নোট গুঁজে দিয়ে দোকানে পাঠাতেন টিপের পাতা আনতে। তখন সবে সবে আঠা দেওয়া সোয়েডের টিপ বাজারে এসেছে। আর বাড়ির মেয়েদের অনেকেরই সেটা খুব মনে ধরেছে কারণ, সিঁদুর-টিপ ঘামে ভিজে লেপ্টে যায়। আবার এখানে ওখানে লেগে যাওয়ার আশঙ্কাও তো আছে। বৌভাতের পরদিন সকালে ছোট কাকার পাঞ্জাবিতে লাগা লাল রং দেখে বড়দের মুখ টিপে হাসাহাসির পেছনে কালপ্রিট যে নতুন কাকিমার ‘সিঁদুরের টিপ’ সেটা বুঝতে বুঝতে অবশ্য আমার আরও একটু বড়ো হয়ে দু-একটা সিনেমা দেখার বাকি ছিল।

সিঁদুর টিপের পাশাপাশি ছিলো কুমকুম টিপ। এরপরে একে একে এসেছে ভেলভেট আর সোয়েডের টিপ। তবে খুব বেশি রঙ্গীন টিপ দেখতে পাওয়া যেত না তখনও পর্যন্ত। আজকাল অবশ্য প্রায় সব রঙের টিপই পাওয়া যায়। আবার টিপের আকৃতিতেও এসেছে বৈচিত্র। কেউ কেউ পোশাকের সঙ্গে রং মিলিয়ে একের বেশি টিপ ওভারল্যাপ করেও পরেন। ইদানিং আবার দেখা যায় স্টোন দেওয়া টিপ পরার প্রবণতা। বিশেষ করে শিফন, জর্জেট শাড়ি, লেহেঙ্গা অথবা সালোয়ার কুর্তার সঙ্গে স্টোনের কারুকার্য করা, জমকালো টিপও পরেন অনেকে। কাপড়ের টুকরো বা অন্য কিছু দিয়ে বানানো ডিজাইনার টিপেরও আজকাল ছড়াছড়ি বাজারে। একটু অন্যরকম সাজতে চাইলে কেউ কেউ কাজল পেন্সিল দিয়ে এঁকে নেন পছন্দমত ডিজাইনের টিপ।

শাড়ির সঙ্গে ছোট্ট টিপ, হালকা লিপস্টিকের প্যাকেজ তো বাঙালি নারীর প্রসাধনের রীতিমতো ট্রেড সিক্রেট হয়ে গেছে। আজকাল ওয়েস্টার্ন পোশাকের সঙ্গেও টিপ কপালে এঁকে চোখ টানছেন অনেকে। টিপের রং, আকার ও ধরনের পরিবর্তন এলেও গোলাকৃতির লাল টিপের আবেদন চিরদিনই এক রয়ে গেছে। টিপ পরতে ভালোবাসেন কিনা জিজ্ঞেস করতে একটা লম্বা সম্মতি শোনালেন দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা, দুই ছেলের মা, কমলা গার্লসের প্রাক্তনী, দীপান্বিতা বর্ধন। বললেন শাড়ির সঙ্গে টিপ চাই ই চাই। সে যেমন টিপ-ই হোক না কেন। দীপান্বিতার ব্যক্তিগত দুর্বলতা অবশ্য লাল, বড়, গোল টিপ।

নিজের ব্যক্তিত্ব, কাজের জগৎ ইত্যাদিকে মাথায় রেখে অনেকে আবার নিজস্ব একটি স্টাইল বেছে নেন টিপ পছন্দের ক্ষেত্রে। যেমন দূরদর্শনের ঘোষিকা ও পরবর্তীকালে সংবাদপাঠিকা হিসেবে প্রথম বড় টিপ পরা শুরু করেছিলেন আজকের বিশিষ্ট ওডিসি নৃত্যশিল্পী, উর্মিলা ভৌমিক। “স্টেজে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে গিয়ে মনে হত কপালে একটা বড় টিপ যেন মানুষের নজর আকর্ষণ করতে খুব সাহায্য করে।” বললেন, “মনে আছে জাপানে অনুষ্ঠান করতে গিয়েও সাক্ষাৎকারে আমাকে এই টিপ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। আমাদের সময় বলতে গেলে এত বড় টিপ পরাটা আমিই শুরু করেছিলাম। আমি আমার ছাত্রীদেরও অনেকসময় বড় টিপ পরতে বলি অনুষ্ঠান বিশেষে। কারণ আমার কাছে মনে হয় টিপ যেন শক্তিকেও চিহ্নিত করে। আমাদের শরীরের সাতটি চক্রের সবচেয়ে শক্তিশালী চক্রটি কিন্তু দুই ভুরুর মাঝে। আর সেখানেই টিপ পরে আমরা মেয়েরা যেন নিজেদের সেই শক্তিকেই চিহ্নিত করি।” বললেন উর্মিলা।

কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী  ঊষা উত্থুপ সব সময় শাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে কপালে পরেন একই ধরনের গোল টিপ, তার ওপরে লেখা থাকে ‘ক’। ওটাই তাঁর নিজস্ব স্টাইল। আর এভাবেই চরিত্র, সাজ-পোশাক অনুযায়ী মেয়েদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যায় তাঁর টিপখানি।

ছোটবেলায় সাজগোজের দিকে একেবারেই মন ছিলনা ঋতচেতার। বলা যায়, বাবার চোখ রাঙানির ভয়ে ইচ্ছেরও উপায় ছিল না মনে উঁকিঝুঁকি মারার।কারণ বাবার ধারণা ছিল মেয়েরা সাজগোজ করলেই বড়ো হয়ে যায়। সেই মেয়েই উত্তরবঙ্গের স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে আবিষ্কার করে বসল একটু কাজল আর একটা বড়ো টিপ কী অদ্ভুতভাবে সঙ্গত দেয় জিন্স-পাঞ্জাবি এমনকি খরখরে টাঙ্গাইল শাড়ির সঙ্গেও! সাজহীন সাজের ওই আবেদনটা মন ছুঁয়ে গেল। ছোটবেলা থেকে দেখা সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় তখনই। ফিল্ম স্টাডিসের ক্লাস করতে করতে ঋতচেতা বুঝল কীভাবে সত্যজিৎ রায়ের নায়িকাদের রূপটানে টিপ আর চোখের সাজে নজর দিয়েছিলেন কিংবদন্তি পরিচালক। শর্মিলা, স্বাতীলেখা হয়ে উঠেছিল সত্যজিতের দেবী, বিমলা। আর এই সব মিলিয়েই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের দিন থেকেই ভুরুর একটু ওপরে বড়সড় একটা টিপ পরার শুরু। আজ একাধারে শিক্ষিকা, এবং সংগীত নিয়ে গবেষণার কাজে যুক্ত ঋতচেতা গোস্বামীর কাছে টিপ আসলে তাঁর জীবনের একটা আত্মবিশ্বাসের জায়গা। হাসতে হাসতে বললেন, “টিপ আসলে মেয়েদের তৃতীয় নয়ন”।

এক সময় বাংলা খবরের চ্যানেলে প্রোডাকশনের পেশায় যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে লেখালেখি করে আর দুই সন্তানের দেখভাল করেই হুশ করে কেটে যায় সংযুক্তার দিন। অবসর সময়ে ভালোবাসেন পরিবারের সকলের সঙ্গে বেড়াতে যেতে।

8 Responses

  1. এ লেখা আমাকে নিয়ে গেল স্মৃতিমেদুরতায়। দ্বিতীয় জীবনের শুরু তে অচেনা বাড়ীতে পদক্ষেপ, তার মধ্যে যা আমাকে আকর্ষণ করেছিল শাশুড়ি মায়ের ” পরনে ঢাকাই শাড়ী কপালে সিঁদুর ”
    জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় বিদেশিনী পুত্রবধূ র আমাদের বিয়ের প্রথার অংগ হিসেবে সিদূর দান কে what is this red dot ceremony প্রশ্ন করেছিল। বোঝাতে হয়েছিল ।
    কাজেই পরিস্থিতি পাল্টে যায় কখনো কখনো ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *