রাত সাড়ে এগারোটায় ফোনটা বেজে উঠল। তারস্বরে। লকডাউনের বাজারে নিঝঝুমের সংজ্ঞা নতুন করে শিখছি। সন্ধে সাতটার পরেই মধ্যরাতের ফিলিং। স্ক্রিনে দেখি, ফোনের ও প্রান্তে স্বর্ণাভদা (নাম বদলে দিয়েছি, লকডাউন পরবর্তী স্ব-মঙ্গলের জন্য)। ব্যবসায়িক সম্পর্ক। ভদ্রলোক এক প্রখ্যাত কেক কোম্পানির রিজিওনাল সেলস ম্যানেজার। বাড়ি বেহালায়। গত ছ’মাস ধরে একটা মিটিংয়ের জন্য ডেকে চলেছিলাম আমার ডালহৌসির অফিসে। ফোন করলেই কলার টিউনের মতো উত্তর আসত, ‘যাব, যাব। আসলে বড্ড দূর তো।’ সেদিন ফোন তোলার পরেই, প্রথম যেটা শুনলাম, কাতরধ্বনি, তা হল, ‘ভাই তোমাদের ও দিকে খোলা আছে?’ বুঝতে পারিনি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী খোলা থাকার কথা বলছেন স্বর্ণাভদা?’ উনি বললেন, ‘ওষুধ, ওষুধ। একদম শেষ হয়ে গেছে গো। এ বারে মারা যাব। মরুভূমির উটেরাও আমার থেকে সুখে আছে অনেক। খোলা আছে কি না একটু দেখে জানাও। আমি গাড়ি নিয়ে ঝড়ের মতো দমদম পৌঁছে যাব আধঘণ্টায়।’ বললাম, ‘আপনাদের ওদিকে মেডিক্যাল শপ নেই? কী ওষুধ বলুন তো। আমার মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ বন্ধু আছে কয়েকজন। জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি খুব ইমার্জেন্সি হলে।’
ভদ্রলোক এ বার প্রায় কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘আমার ওষুধ তুমি জানো না? রাম। রাম। একটু জোগাড় করে দাও ভাই, যে ভাবেই হোক। পরের মাসে তোমায় দু’টাকা কম দামে মাল দিয়ে দেব। একদম গ্র্যান্টি। কাউকে বোলও না। কেউ জানতে পারলে আমার চাকরি থাকবে না।’ দশ সেকেন্ডের নীরবতা। ‘চাকরিটা পরে। আগে শরীর। ওষুধটা না পেলে, গুরু, আমি আর থাকব না।’ আমি চুপ। ঘরের মশারি আলো নিভে যাওয়ার অপেক্ষায়। ঝিঁঝিঁ পোকাদের ডাক আলাপ থেকে ঝালায় গিয়েছে বাইরে। স্বর্ণাভদা এ বারে বললেন, ‘একশো কুড়ি টাকার বোতলের জন্য পাঁচশোও দিতে রাজি। টাকাটা কোনও ফ্যাক্টর নয়। একটু দেখে জানাও ভাই। পাঁচ মিনিট পরে ফোন করি?’
মনে হয়, কোনটা যে অত্যাবশ্যকীয়, আর কোনটা যে তা নয়, তার হিসেব করতে গিয়ে মস্ত বড় ‘ভুল’ করে ফেলেছেন আইনের কারবারীরা। বড় বড় মানুষেরা যা বলে গিয়েছেন বহু যুগ আগে, তা ভুলে গিয়েছেন বিলকুল। ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা বলেছিলেন, ‘অ্যালকোহল মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হতে পারে। কিন্তু বাইবেল বলে শত্রুকে ভালবাসতে।’ জর্জ বার্নাড শ’ বলেছিলেন, ‘জীবন যে কষ্ট দেয়, তা সহ্য করার জন্য অ্যালকোহলই অ্যানাস্থেশিয়া।’ আর আইন বলে, মদ নাকি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নয়! এই গোড়ায় গলদের কথা সুরারসিক ছাড়া আর কেউ বুঝলেন না। লকডাউনে যখন বিশ্ব যখন নিদ্রামগ্ন, সুরাহারা-রা প্রত্যেকে কেঁদে চলেছেন নিভৃতভাবে, নিজেদের কুটিরে বসে। তাঁরা যখন কপাল চাপড়ে, মাথা ঠুকরে কাঁদেন, হাহাকার করেন, শেষ হয়ে যাওয়া বোতলের দিকে চেয়ে থাকেন নদীর গ্রাসে চলে যাওয়া ভিটেবাড়ির মতো, সমাজের চ্যানেলে তাঁদের আওয়াজ মিউট করে দিই আমরা। সরকারি উদ্যোগে বয়স্কদের জন্য প্রণাম আছে, দুঃস্থদের জন্য সেলাম আছে, বিপদে পড়া মহিলাদের জন্য ‘এই এলাম’ আছে, ফ্ল্যাটের নিচে বিনা পয়সায় পুলিশের কনসার্ট আছে। শুধু সুরাহারাদের জন্য কিছু নেই। ‘বুঝবে না, কেউ বুঝবে না, কী যে মনের ব্যথা। মুছবে না, কেউ মুছবে না, চোখের পাতা।’ যথার্থ লিখেছিলেন সলিল চৌধুরি।
আমাদের পাড়ার এক সুরাপ্রেমীকে দেখলাম, লকডাউনের বাজারে একটা ছোট্ট আসন পেতে গুটিসুটি হয়ে বসে রয়েছেন রাস্তার উপরে, এক ঝাঁপ বন্ধ এফএল শপের সামনে। নাকের সামনে থেকে মাস্কটা কিছুক্ষণ পর পর নামাচ্ছেন। নিচু হয়ে খাবি খাওয়ার মতো করে শ্বাস নিচ্ছেন। আবার উঠিয়ে দিচ্ছেন মাস্ক। অবাক চোখে তাকিয়েছিলাম। নিজেই বললেন, ‘শাটারের সামনে বসে আছি ভাই। দোকানের ভিতর থেকে একটা গন্ধ বেরোয়। সেটা নেওয়ার চেষ্টা করছি, যতটুকু পারি। আর বাঁচব না।’ আর এক পরিচিত ভদ্রলোক বললেন, তাঁর পাড়ায় যে অন্ধ গলির মধ্যে মদের দোকানটা আছে বিকেলে তিনি সেখানেই পায়চারি করেন। গন্ধের জন্য। বেঙ্গালুরুনিবাসী আমার এক বন্ধুর থেকেও দুঃসময়ে বেঁচে থাকার এক উপায়ের কথা জানতে পারলাম। ওদের পাড়ায় যে লিকার শপ (মদের দোকান বড্ড মিডল ক্লাস শোনায় বলে ওর মত) আছে, সেখানকার মালিকের সঙ্গে কথা বলে ও মদের পিজবোর্ডের কার্টনগুলো জোগাড় করেছে। টেম্পোতে করে দোকানে যখন মাল আসে, কার্টনে পুরে আসে। খবরকাগজওয়ালা পিজবোর্ড আট টাকা কেজি দেয়। ও কুড়ি টাকা দেবে বলায় কয়েক বস্তা পিজবোর্ড ওর বাড়িতে হোম ডেলিভারি করে গিয়েছে দোকানদার। বন্ধুর কথায়, ‘দোকানে আসার সময় একটা বোতলও যদি বাই চান্স ফেটে গিয়ে থাকে বস্, সারা বোর্ড জুড়ে ম্যাজিক গন্ধ!’

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে সাবান দিয়ে হাত ধোবেন— ঠিক ছিল। স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিস্কার করুন— তাও ঠিক ছিল। যত গন্ডগোল হল স্যানিটাইজারের আগে এই ‘অ্যালকোহলযুক্ত’ কথাটা ব্যবহারের পর। অ্যালকোহল কথাটা দেখে বেশ কিছু লোকে দিব্যি ঢকঢক করে ঢেলে দিলেন গলায়। তার পরে যমে-মানুষে মারামারি চলল। চলছেও। রোজই খবরের কাগজে টুকরো খবর হিসেবে এমন ঘটনা ভেসে উঠছে এই বিরাট দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, ড্রপলেটের মতো। হোমিওপাথির ডাক্তাররাও পড়েছেন মহা বিপদে। ওষুধ দেওয়ার আগে রোগীদের কাছে তাঁদের একটা চেনা প্রশ্ন আছে। গ্লোবিউল দেব না লিকুইড? আমার এক মফস্বলের হোমিওপ্যাথ ডাক্তার বন্ধু বলল, এক রোগী সম্প্রতি তাঁর পায়ে পড়ে বলেছিলেন, ‘একটু বেশি বেশি করে লিকুইড দিন না ডাক্তারবাবু। একেবারে তিন মাসের ওষুধ দিয়ে দিন।’ রোগীর আসল রোগ ধরার পড়ার পরে তাঁর আর্তি ছিল, ‘আমায় বাঁচান স্যার। এই বাজারে আর কোথায় যাব বলুন?’
গুগল ট্রেন্ডস বলছে, বাড়িতেই অ্যালকোহল কী ভাবে বানানো যায় জানতে চেয়ে সবচেয়ে বেশি কোয়্যারি হয়েছে মার্চ মাসের শেষ দিকে। সর্বজ্ঞ ওয়েবসাইটও হয়ত এর উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত। যাঁরা পদ্ধতিটা কিছুটা ঠাউরেছেন, তাঁদের কেউ কেউ বাড়িতে শুরু করে দিয়েছেন প্রস্তুতিপর্ব। বাজারে এক ভদ্রলোককে দেখলাম, দোকানে যা আঙুর ছিল, সব কিনে নিলেন। ভাবলাম ইমিউনিটি বাড়াবেন বুঝি। জিজ্ঞেস করাতে বললেন, ইউটিউব থেকে নাকি আঙুল থেকে ওয়াইন প্রস্তুত করার ঘরোয়া পদ্ধতি জেনেছেন। শুধোলাম, ‘যদি না হয় স্যার?’ উনি মুচকি হেসে বললেন, ‘ওয়াইন না হোক, কিছু তো একটা হবে। গেঁজে যাওয়াটাই আসল কথা। দুর্দিনে যা পাই, ঢকঢক করে মেরে দেব। এত বাছবিচার চলে না।’ আরও জানতে পারলাম, দেশের লকডাউন ওঠার পরে নাকি ওঁর আসল লকডাউন শুরু হবে। পার্ক স্ট্রীটের কোনও এক বার-এ চোদ্দ দিনের সেল্ফ-আইসোলেশানে যাবেন, এই প্ল্যান পাকা করে ফেলেছেন।
ফেসবুক অ্যাকাউন্টে যদি বন্ধুর সংখ্যা কোভিড-১৯ সংক্রমণের মতো বাড়াতে চান, তা হলে এর থেকে ভাল সুযোগ আর পাবেন না, গ্যারান্টি সহকারে বলতে পারি। শুধু এক লাইনের একটা ছোট্ট পোস্ট করে দিন— যত্নসহকারে মদের হোম ডেলিভারি করা হয়। দুশো ফ্রেন্ড কুড়ি হাজার হয়ে যাবে তিন দিনে। মিলে সুরা মেরা তুমহারা! এক সহনাগরিকের ইচ্ছে ছিল। ভেবেছিলেন আপৎকালীন পরিস্থিতিতে শহরের বয়স্ক লোকদের পাশে দাঁড়াবেন। ওষুধপত্র পৌঁছে দেবেন। ফোন নম্বর দিয়ে পোস্ট করলেন ফেসবুকে। তাঁর এই পোস্ট মর্ফ করে কেউ লিখে দিলেন, ফোন করলেই মদ পৌঁছে যাবে বাড়িতে। ওই সহনাগরিক নাকি দিনে গড়ে হাজারের উপরে ফোন পেতে শুরু করেছিলেন, কাতর মদ-আকুতি সহ। বাধ্য হয়ে ভাল কিছু করার সদিচ্ছে জলাঞ্জলি দেন।
যারা এখনও ভাবি, মদ্য বাসনা আসলে ফল্গু নদীর মতো বয়, লকডাউন তাঁদের বুঝিয়েছে, এই ফল্গু আসলে নায়াগ্রাকেও দুয়ো দেয়।
অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।
ওঃ দুরন্ত ভাই। ?
park streeter bar-a lockdown….darun prtisodh hobe khubmaja pelam
বাহ। বাহ
শুধু রম্য নয় একটি সুরম্য রচনা।