অক্টোবর, ১৯৯৯। দুর্গাপূজার এখনও কিছুদিন বাকি। সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার। সেই সঙ্গে মুখ কালো করে বসে আছি আমরা কয়েকজন কলকাতা ইউনিভার্সিটির রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের ‘কম্পিউটার সায়েন্স’-এর ছোট্ট ল্যাবে। আজ আমাদের আসন্ন সেমিনারের বিষয় জানানো হবে লটারি করে। সেই বিষয় নিয়ে বক্তব্য রাখতে হবে। আমার ভাগ্যে জুটল Reinforcement Learning। খায় না মাথায় মাখে, ভাবতে ভাবতে বাড়ি আসার পথে ঢুকে পড়লাম গড়িয়া মোড়ের তখনকার সবেধন নীলমণি ছোট্ট সাইবার ক্যাফেতে। বেশ কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল Reinforcement Learning নিয়ে পড়াশোনায়। অবাক হয়ে গেলাম। কম্পিউটারের স্মৃতি-সর্বস্ব দেহে এ যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করা যাক। ধরুন, আপনি সাইকেলকে নিজে নিজে চলতে শেখানোর চেষ্টা করছেন। প্রথমে তার মাথায় কিছু তথ্য ঢুকিয়ে দিয়েছেন যে, সোজা রাস্তায় সে কীভাবে চলবে। কিন্তু বাঁক ঘোরার সময় কী করবে তাকে কিছু বলেননি। বরং বলেছেন যে যতবার বাঁক ঘুরতে গিয়ে পড়ে যাবে, নিজের মাথায় সেই তথ্য ঢুকিয়ে নেবে যে কত গতিতে কোন কোণে গেলে তুমি পড়ে যাচ্ছ। এইভাবে অজস্র বার চললে তুমি আপনাআপনি শিখে যাবে কীভাবে বাঁক ঘোরা নিরাপদ। অর্থাৎ, তোমার অভিজ্ঞতা তোমায় নিজে চলতে শেখাবে। বাইরের সাহায্য লাগবে না।

আজ প্রায় চব্বিশ বছর পর চারিদিকে ChatGPT নিয়ে এত হইচই দেখে মনে হল এ তো সেই কবেকার বিদ্যার নতুন করে ব্যবহার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা কি তবে এতদিন শুধু বাণিজ্যিক কিছু আবিষ্কারেই থমকে ছিল? এই প্রসঙ্গে বলতে গেলে একটু অতীতে যাবার লোভ সামলানো মুশকিল।

আরও পড়ুন: চ্যাট-জিপিটি, কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা ও শিল্প-সৃষ্টি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৩৯-৪০ সাল। জার্মানির অশ্বমেধের ঘোড়া কোনও বাধা মানছে না। তাদের সবচেয়ে বড় সহায় Enigma কোড। গুপ্ত খবর কোডের মোড়কে পৌঁছে যাচ্ছে যথাস্থানে। পোলিশ গণিতজ্ঞরা কখনও কখনও খবর ডিকোড করেও বিশেষ সুবিধা করতে পারছেন না। কারণ জার্মানি প্রতিনিয়ত তাদের কোড বদলে যাচ্ছে। গণিতজ্ঞ এলান টিউরিং-এর ডাক পড়ল বাকিংহ্যামশায়ারের গোপন সেনাদপ্তরে। তৈরি হল Bombe মেশিন। Enigma কোডের রহস্য ফাঁস করে যা মোড় ঘুরিয়ে দিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে সেই মানুষের প্রথম পদক্ষেপ। এই টিউরিং সাহেবের হাতেই প্রথম কম্পিউটার আবিষ্কার। তিনি যার নাম রেখেছিলেন ACE (Automatic Computing Engine)। ১৯৫৪ সালে, মাত্র ৪২ বছর বয়সে রহস্যজনক মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর অনেক কাজের মধ্যে বর্তমান প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ১৯৫০ সালে তাঁর তৈরি দাবা খেলার মেশিন Turbochamp। সেই মেশিন তিনি তৈরি করেছিলেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করতে। যে পথে অনেক পরে, ১৯৯৬ সালে তৈরি হবে Deep Blue মেশিন, আর তার এক বছর পরে যা হারিয়ে দেবে সর্বকালের অন্যতম সেরা দাবাড়ু কাস্পারভকে।

man playing chess with bot
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে হেরে গেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা দাবাড়ু কাস্পারভ

টিউরিং সাহেবের মৃত্যুর এক বছরের মাথায় ১৯৫৫ সালে আমেরিকান বিজ্ঞানী জন ম্যাকারথি প্রথম ব্যবহার করেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence বা AI) শব্দটি। এই জন ম্যাকারথির হাত ধরেই তৈরি AI-এর আদি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ LISP, এবং আরও পরে ALGOL। আমাদের কলকাতা কিন্তু সেই সময়েও পশ্চিম দুনিয়ার সঙ্গে তাল রেখে চলেছে। ১৯৫৩-৫৪ সালে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও অধ্যাপক সমরেন্দ্র কুমার মিত্র ডিজাইন, তৈরি এবং ইন্সটল করেছিলেন ভারতের প্রথম কম্পিউটার। তার পরের কয়েক দশকে কীভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণার সঙ্গে আমাদের দূরত্ব তৈরি করেছে— সে এক অন্য প্রসঙ্গ।

এরপর ১৯৬১ সালে তৈরি হল প্রথম বাণিজ্যিক রোবট আল্টিমেট। তখনও রোবট কাজ করত তার মস্তিষ্কে জমা রাখা নির্দিষ্ট কিছু কোডের ওপরে নির্ভর করে। ১৯৬৪ সালে আবিষ্কার হল প্রথম চ্যাটবট এলিজা। সে এক অর্থে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মেশিন সেই প্রথম বুঝতে শুরু করল সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা। মেশিনের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ আরও সহজ হল। জন্ম হল এক নতুন শব্দের “The Eliza Effect”— যার অর্থ, অবচেতন মনে কম্পিউটারের ব্যবহার আর মানুষের ব্যবহারের মধ্যে সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া। সেই পথে ১৯৬৯ সালে এল প্রথম হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে চলা Shaky। এরপর কিছুদিন বিভিন্ন কারণে থমকে গেল, বা গোপনে চলতে থাকল গবেষণা। ১৯৯৫ সালে জন্ম নিলো মানুষের কথা শুনে কাজ করতে পারা প্রথম রোবট এলিস। আরও তিন বছর পরে MIT-র বিজ্ঞানীরা তৈরি করলেন মানুষের মনের ভাব বুঝে ব্যবহার করতে পারা রোবট কিস্মেত।

AI

এরপরের প্রায় বিশ বছর ‘রোবট’-এর বাণিজ্যিক ব্যবহারের যুগ। একে একে বাজারে এল ঝাঁট দেওয়া রোবট রুম্বা, ‘অ্যাপেল’-এর সিরি, আইবিএম-এর ওয়াটসন আর ‘অ্যামাজন’-এর অ্যালেক্সা। ২০১৬ সালে হংকং-এ তৈরি হওয়া রোবট সোফিয়া তো মানুষের সামাজিক ব্যবহার পর্যন্ত নকল করতে শুরু করল। বিভিন্ন পত্রিকায় সোফিয়ার ইন্টারভিউ প্রকাশ পেল। মানুষ সোফিয়ার প্রেমেও পড়তে শুরু করল। ২০১৭ সালে সোফিয়াকে সৌদি আরবের নাগরিকত্ব পর্যন্ত দেওয়া হল। সোফিয়ার নিজের আঁকা নিজের ছবি ২০২১ সালে বিক্রি হয়েছে প্রায় সাত লক্ষ ডলারে। আপনি হয়ত ভাবছেন শুধু ছবি আঁকা, গান-বাজনা — এমন কিছুতে যদি রোবটের সাহায্য পাওয়া যেত, তাহলে বড় ভাল হত। তার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে সেই ১৯৬০ সাল থেকে রাশিয়ান গবেষক রুদলফ যারিপভ-এর হাত ধরে। অবশেষে ২০১৭ সালে তৈরি হল ‘আম্পার দ্য মিউজিসিয়ান’ যে নাকি নিজে একটা গোটা মিউজিক অ্যালবাম কম্পোজ করল।

এইভাবে সুখে দুঃখে দিব্যি চলছিল AI-এর সংসার। কিন্তু ২০২০ সালে জন্ম নিল GPT-3। OpenAI কোম্পানি ডিপ লার্নিং পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে তৈরি করল এই সফটওয়্যার, যা কিনা মানুষের মতো গুছিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারে অনায়াসে। আর এই ডিপ লার্নিং পদ্ধতির সুবিধা হল যে, এই মেশিনের ট্রেনিং-এর জন্য মানুষের সাহায্য লাগে না সব সময়। মেশিন নিজেই শিখে নিতে পারে বিপুল তথ্যভাণ্ডার, তাঁর আগের উত্তরের প্রশংসা বা নিন্দে থেকে। অর্থাৎ এই প্রথম মেশিন আক্ষরিক অর্থে মানুষের হাতের বাইরে বেরতে শুরু করল। পত্রপত্রিকাতে সমালোচনা শুরু হল। নিউ ইয়র্ক টাইম্‌স লিখল— মেশিনের এই ক্ষমতা শুধু অসাধারণ নয়, তা খানিকটা অলৌকিক, এবং কিছুটা ভয়ঙ্কর-ও। পক্ষে বিপক্ষে অনেক মতামত তৈরি হল। কিন্তু কাজ থামল না।

Sophia (robot)
রোবট সোফিয়ার প্রেমে পড়তে শুরু করে মানুষ

একের পর এক ভার্সন আসতে শুরু করল GPT-3 র। ২০২২ পর্যন্ত তা মোটামুটি ছিল গবেষণাগারের চৌহদ্দির মধ্যে। কিন্তু নভেম্বর ২০২২-এ chatGPT নামে সে চলে এল ওয়েব অ্যাপ্লিকেশান হিসাবে একেবারে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে। আপনার যাবতীয় প্রশ্নের সে গুছিয়ে উত্তর দেয়। আপনার সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে সে আপনার প্রয়োজন মতো উত্তর সাজিয়ে দেয়। কবিতা লিখে দেয়। কোন শেয়ার কিনলে আপনার লাভ হবে তা পর্যন্ত বলে দেয়। আপনার অসুখের চিকিৎসা কী হবে, এই আবহাওয়াতে আপনার পোশাক কী হবে, আপনার রেসুমেতে ঠিক কী কী উল্লেখ করলে চাকরিটা আপনার হয়ে যেতে পারে, সব বলে দেয়। আপনার বেড়াতে যাবার প্ল্যানটাও করে দেয়।

কিন্তু এই অনেক সুবিধের মধ্যে যেটা উহ্য থাকে তা হল, সব তথ্য সঠিক নাও হতে পারে, অর্থাৎ ব্যবহারের দায় কিন্তু আপনার। মেশিন যতই মানুষের মতো উত্তর দিক, তা কিন্তু শিক্ষকের বিকল্প নয়। কারণ শিক্ষক আর ছাত্রের সম্পর্ক শুধু কিছু তথ্যের আদানপ্রদান নয়। তাহলে তো তার জন্য বই-ই যথেষ্ট ছিল। মেশিন যতই নির্ভুল চিকিৎসার উপায় বলুক, সে আপনার ডাক্তারবাবুর বিকল্প নয়। আপনি ড্রাইভার-বিহীন গাড়ি শখ করে একটু চড়তেই পারেন, কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়।

সংগীতে রোবটের ব্যবহার বিষয়ে একটু আগে বলেছি। সাহিত্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার আরও হাস্যকর। আপনি যদি chatGPT-কে বলেন কোনও বিষয়ে একটা গল্প লিখতে, সে প্রথমেই সেই বিষয়ে আগে যা লেখা হয়েছে সেগুলো খুঁজবে আর সেগুলো সাজিয়ে আপনার প্রয়োজন মতো গুছিয়ে দেবে। আপনি যদি তাকে আপনার লেখা বলে প্রকাশ করেন, তাহলে কিন্তু আসলে সেই সাহিত্য কীর্তিগুলি যাঁদের, তাঁরা আপনার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে।

ai-monitoring-desktop-business-man
কোন শেয়ার কিনলে আপনার লাভ হবে তা পর্যন্ত বলে দিচ্ছে চ্যাট জিপিটি

এই লেখা যখন লিখছি, এই দু-একদিনের মধ্যেই দুটো বড় ঘটনা ঘটে গেছে এই প্রসঙ্গে। chatGPT-র নতুন পরীক্ষামূলক ভার্সন এসেছে যে সরাসরি ইন্টারনেট থেকে তার তথ্য সংগ্রহ করছে, আর অন্যদিকে গুগল তাদের BARD অ্যাপ্লিকেশানের নতুন পরীক্ষামূলক ভার্সন এনেছে, যা নাকি chatGPT-কেও অনেক অংশে টেক্কা দেবে। একটি বিশেষ সুবিধা হল BARD আপনাকে তথ্যগুলির আসল উৎস দিয়ে দেবে, যাতে আপনাকে নকলের দায় না নিতে হয়। অর্থাৎ গবেষণা খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে, যা কিনা আপনার কাজ অনেক তাড়াতাড়ি আর অনেক সহজ করে দেবে। কিন্তু ওই যে বললাম, সঠিক ব্যবহারের দায় কিন্তু আপনার।

তাহলে এই যে গেল গেল রব ChatGPT নিয়ে, এর কি কোনও গুরুত্বই নেই? এই যে ধর্মগুরু থেকে বিজ্ঞানী, সবাই অশনি-সঙ্কেত দেখছেন, তার কারণ কী? কারণ, সেই আদি এবং অনন্ত লোভ। মেশিন এখন শিখেছে কী করে ভুল থেকে নিজে নিজে অসাধারণ দ্রুততায় শুধরে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায়। আরও আরও আরও উন্নতি করা যায়। এই লোভে মানুষ আজ নিজের মনুষ্যত্ব অনেকাংশেই হারিয়ে ফেলেছে। প্রকৃতির ক্ষুদ্র অংশ থেকে আজ সে প্রকৃতির সবচেয়ে বড় শত্রু। এবার মানুষের তৈরি মেশিন যদি নিজের ‘মেশিনত্ত’ থেকে বেরিয়ে আসে আরও উন্নতির লোভে, বিশেষত সে যখন মানুষের ওপর আর নির্ভরশীল নয়, তখন সে কি মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে উঠবে না? হয়ত সেটাই হবে এই অতিরিক্ত লোভী প্রাণীটির জন্য পোয়েটিক জাস্টিস। 



প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই লেখা এক চ্যাটুজ্জের কলম থেকে, ChatGPT থেকে নয়।

ছবি সৌজন্য: Pixabay, Wallpaper Flare, Wikimedia Commons

Sarit Chatterjee

লেখক সরিৎ চ্যাটার্জি রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র, পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, নেশায় হিমালয়প্রেমী ও পর্যটক। বর্তমানে নিউ ইয়র্ক এ কর্মরত।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *