সাধারণ আমেরিকানদের কাছে ভারত মানেই তাজমহল, রাজস্থানের উট, হাতি, ইত্যাদি। মূলতঃ সাহেব টুরিস্টদের জন্য সাহেবদের লেখা ‘লোনলি প্ল্যানেট’ নামে বইয়েও ছবি দেখেছিলাম, ভারতের কোনও শহরের রাস্তা দিয়ে একটা গোরুর গাড়ি চলেছে, আর তার মাথার উপরে আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটা জেট প্লেন। প্রাচীন ও নবীনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান! এমন এক দেশ যেখানে বাঘ, সাপ আর জটাধারী সন্ন্যাসীরা ঘুরে বেড়ায়, খুঁজলে দু’এক পিস সভ্য মানুষের দেখাও মেলে– এই ছিল ভারত সম্পর্কে সাহেবদের, বা আমেরিকান আমজনতার ধারণা। সাধারণ একজন ভারতীয় আফ্রিকা সম্পর্কে যেমন জানেন আর কি!

আমি ‘ভয়েস অফ আমেরিকা’-র রিপোর্টার-ব্রডকাস্টারের চাকরি নিয়ে কলকাতা আর আনন্দবাজারের মায়া কাটিয়ে সপরিবার ১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটনে গিয়ে পৌঁছলাম। আর অক্টোবরের ৩১ ইন্দিরা গান্ধী তাঁর শিখ দেহরক্ষীদের গুলিতে নিহত হলেন। রাজীব গান্ধী হলেন প্রধানমন্ত্রী। তার পরের বছর ১৯৮৫-র মে মাসে আমেরিকায়, খাস রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে শুরু হল ভারত উৎসব।

আগের পর্বেই বলেছি, রাজীব গান্ধী গিয়েছিলেন তার উদ্বোধন করতে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেতার বাজিয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তবে উৎসবের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অংশ, ভারত মেলা নিয়ে বলা হয়নি। আমেরিকাতেও হরেক রকমের মেলা হয়, তাতে নাগরদোলা বসে, ম্যাজিক শো হয়, স্ট্রিট ফুড থাকে! কিন্তু এই ‘ভারত মেলা’ এমন একটা ব্যাপার, ওদের ভাষায় এক্সোটিক, যেটা প্রথম দিকে আমেরিকানরা ঠিক বুঝেই উঠতে পারেনি। ওয়াশিংটনের মতো একটা রাশভারী, ভারিক্কি, গম্ভীর রাজধানী শহর, যেখানে বাড়ির উচ্চতা কতটা হবে, তাও বেঁধে দেওয়া রয়েছে, শহরে চওড়া চওড়া রাজপথ ছাড়া কোনও গলি নেই, সারা পৃথিবীর চোখ যে শহরের উপর, এ হেন গেরামভারী শহরে কিনা একেবারে আনন্দের জোয়ার লাগা ভারত মেলা!

ওয়াশিংটন মল, যা ক্যাপিটল ভবন থেকে শুরু করে একেবারে শেষে লিঙ্কন মেমোরিয়াল পর্যন্ত মাইল তিনেক লম্বা, তারই মাঝামাঝি একটা জায়গায় ছাউনি করে নাচ-গান হৈ-হুল্লোড় দিয়ে ভারত উৎসবের মেলা বসল। সেটাই চলতি কথায় ভারত মেলা, যার ভাল নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অদিতি, মাটি ও মানুষের উৎসব’।

Rajasthani Folk Dancers
অদিতি মেলা প্রাঙ্গণ উজ্জ্বল করে রাখতেন এই রাজস্থানী লোকশিল্পীরা

ভয়েস অফ আমেরিকা থেকে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ভারত মেলার খবর করার। আর আমার স্ত্রী ছিলেন মেলার একেবারে ব্যাজধারী স্বেচ্ছাসেবক। ছেলেকে নিয়ে সকাল-সকাল আমরা মেলার মাঠে চলে যেতাম। দেশ থেকে আসা শিল্পীরা আমাদের দেখলে একটু ভরসা পেতেন। একটু প্রাণ খুলে কথা বলতে পারতেন। আমাদেরও সময় কেটে যেত চমৎকার।

এই ভারত মেলা উপলক্ষে সারা ভারত থেকে বেছে বেছে যাঁদের ওখানে নিয়ে গিয়ে হাজির করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজস্থানের বিখ্যাত লঙ্গা ভাইরা। সঙ্গে তাঁদের গান বাজনার দল। যেমন তাঁদের রঙবাহারি পোশাক, তেমনই মনমাতানো গানের তাল আর সুর। সোনার কেল্লায় সত্যজিৎ রায় এঁদের একঝলক দেখিয়েছেন। লঙ্গাদের গানবাজনা শুরু হলে মেলা জমে যেত। সাহেব মেমরা ভিড় করে দেখতেন, অল্পবয়েসিরা গানের তালে তালে পা মেলাত। রাজস্থানী বাহারি সাজের ঘোড়াপুতুলও ছিল গোটা দুয়েক। রঙিন কাপড় আর রাংতা দিয়ে সাজানো পেপার ম্যাশের ঘোড়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সওয়ার, তার ঘুঙুর বাঁধা পায়ের ঝুনঝুন, দুলে দুলে ঘোড়ার নাচ, আমেরিকানরা মোহিত।

শিল্পীও ছিলেন নানান ধারার। কেউ মাটি দিয়ে দেওয়াল লেপে তার ওপরে আলপনা আঁকছেন, কেউ গড়ছেন অপূর্ব সুন্দর মাটির হাঁড়িকুড়ি, কেউ করছেন শোলার কাজ। কোত্থেকে যেন এক হনুমানুষকেও এনে হাজির করেছিলেন উদ্যোক্তারা। সে লম্বা একটা লেজ লাগিয়ে এদিক থেকে ওদিক লাফিয়ে হুপহাপ আওয়াজে কখনও মুখ খিঁচিয়ে, কখনও কসরত দেখিয়ে চমকে দিচ্ছিল। ছিলেন পুরুলিয়া আর ময়ূরভঞ্জ থেকে ছৌ নাচের শিল্পীরা। বাংলা থেকে দু’জন মৃৎশিল্পীকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাঁরা ওখানেই একদম খড়, বাঁশ, মাটি, রং, সব দিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে চোখের সামনে বেশ মাঝারি সাইজের একটা দুর্গা প্রতিমা গড়ে ফেললেন।

Kid-with-a-Ponywalah
ছোট্ট মেয়েটির শখ পূরণে স্নেহময় ঘোড়াওয়ালা

মূর্তি তো হল। এবার প্রশ্নের বন্যা– এই ডিমনটা কে? উত্তর দিলাম, ওটা হল যত খারাপের প্রতীক। গডেস দুর্গা তাকে মেরে যা কিছু ভাল, তা বাঁচাচ্ছেন।

গডেসের দশটা হাত কেন? বললাম, দশ হাত দিয়ে উনি পৃথিবীর দশ দিক রক্ষা করেন। কিন্তু দিক তো চারটে। নর্থ সাউথ ইস্ট ওয়েস্ট! বললাম, আর নর্থ ইস্ট, নর্থ ওয়েস্ট, সাউথ ইস্ট, সাউথ ওয়েস্ট ভুলে গেলেন? ওক্কে, ওক্কে! বাকি দুটো দিক? ওপর আর নীচ। বাঃ, প্রশ্নকর্তা-কর্ত্রীরা খুশি! আমিও খুশি। ভাগ্যিস, নরেন্দ্রপুর স্কুলে মন দিয়ে পরমেশ্বর মহারাজের ইন্ডিয়ান হেরিটেজ ক্লাসগুলো করেছিলাম!

দুর্গা প্রতিমা হবে, ঢাক বাজবে না, তাও কি হয়? তাই একজন ঢাকিও তাই গিয়েছিলেন, সঙ্গে বাচ্চা কাঁসিবাজিয়ে। বীরভূম থেকে গিয়েছিল কিশোর বাউল কার্তিক, এক বহুরূপী, এ রকম অনেকে। বহুরূপী ছিলেন মাঝবয়েসি। একাধারে নারী ও পুরুষের পার্ট করতেন। মুখের একদিকে রং করা নারীর মুখ, অন্যদিকে গোঁফ আঁকা পুরুষ। একটু ঘোমটা সরিয়ে কখনও নারী হন, কখনও পুরুষ। গলার স্বর একেবারে আলাদা করে ফেলতে পারতেন, অবাক হয়ে যাওয়ার মতো। জিজ্ঞেস করলাম, কোত্থেকে এসেছেন আপনি? বিভুঁইয়ে বাংলা শুনে যেন ধড়ে প্রাণ পেলেন ভদ্রলোক। বললেন,
– বোলপুর শান্তিনিকেতন। আসলে আমোদপুর থেকে এসেছি, কিন্তু সে তো কেউ চেনে না, তাই আমাদের বলেছে সবাইকে বোলপুর শান্তিনিকেতন বলতে।
– কোনও অসুবিধা হচ্ছে না?
– অসুবিধা তো একটাই, ইংরেজি জানি না। তবে একটু ইয়েশ, নো, ভেরি গুড, এসব বললেই সাহেবরা দেখি খুশি হয়ে যায়। আর আমাদের কিছু দরকার হলে সঙ্গে যে এসেছে দাদা, তাকে বলি, সে সব ব্যবস্থা করে দেয়।
শুনে খুব মজা লাগল।

Madari-ka-Khel-inside-Natural-History-Museum
ওয়াশিংটন ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের ভেতরে মাদারি কা খেল

ছাউনির ভেতরে ঢুকলাম। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে ঢুকে একদিকে মঞ্চ। লঙ্গা ভাইয়েরা তাঁদের বাজনা নিয়ে মহড়া দিচ্ছেন। একজন দেয়ালে ছবি আঁকছেন। ঘুরতে ঘুরতে সবচেয়ে বড় ফাঁকা জায়গাটাতে দেখলাম ফরাস পাতা। সেখানে ধবধবে পাটভাঙা ধুতি পাঞ্জাবি পরা এক রূপবান ভদ্রলোক বসে ছিলেন। পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে তিনি আমাকে দেখলেন। বসন্ত চৌধুরী। আমাকে দেখে ওঁর বোধহয় মনে হয়েছিল, আমি এগিয়ে গিয়ে একটু কথা বলব! কিন্তু আমার মনে পড়ে গেল এর আগে চার-পাঁচবার কলকাতায় নানা অনুষ্ঠানে ওঁর সঙ্গে কেউ না কেউ আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছে এবং পরেরবার যথারীতি তিনি আমাকে ভুলে গিয়েছেন। যখনই বলতে গিয়েছি, আপনার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল, ‘তাই বুঝি?’ বলে আমার দিকে ফিরে তাকানোর আর দরকার মনে করেননি তিনি। এখানে ওয়াশিংটনে কেউ ওঁকে চেনে না, উনিও কাউকে চেনেন না। আমিও চেনা দিলাম না।

এর বছর ছয়েক পরে কলকাতায় ফিরে এসে আমার সাংবাদিকতার শিক্ষক, অভিভাবক অমিতাভ চৌধুরীর বাড়িতে আবার দেখা। আমাকে আর আমার স্ত্রীকে খেতে বলেছিলেন অমিতদা-বৌদি। সেখানে ফের দেখলাম বসন্ত চৌধুরীকে। অমিতদার বন্ধু, প্রতি রোববার আড্ডা মারতে যান ওই বাড়িতে।

The colorful shop at Aditi
অদিতির রঙের মেলা, রঙিন পসরা

অমিতদা আলাপ করিয়ে দিলেন। উনি হাসিমুখে হাত দুটো একটু নমস্কারের ভঙ্গিতে তুলতেই বললাম,
– আপনি তো ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন! ভারত উৎসবে, ভারত মেলায় আপনি বসেছিলেন, আমি দেখেছি।
– দেখেছেন? একটু কথা বললেন না? খুব বোরড হচ্ছিলাম। ওখানে কাউকে তো চিনি না! উনি বললেন। আমি বললাম,
– আগে কলকাতায় অনেক অনুষ্ঠানে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কেউ-না-কেউ আলাপ করিয়ে দিয়েছেন। তাও পরেরবার আপনি আমাকে চেনেননি। কথাও বলেননি। ওয়াশিংটনে আমি তার আর পুনরাবৃত্তি করতে চাইনি।
উনি লজ্জা পেয়ে বললেন,
– এরপর থেকে আর কক্ষনও ভুল হবে না দীপংকর! চিনবই তোমাকে, যেখানেই হোক!
তারপরেও অবশ্য আমাদের দেখা হয়েছিল এবং যথারীতি উনি আমাকে চেনেননি।

ভারত মেলায় দিল্লির পাঁচতারা সরকারি হোটেল ‘অশোক’ থেকে একটা খাবারের স্টল দেওয়া হয়েছিল। ধাবা স্টাইলে সাজানো। সেখানে যাবতীয় ভারতীয় খাবার, তন্দুরি থেকে শুরু করে কাবাব পোলাও মাংস, সব পাওয়া যেত। পানীয় ছিল নিম্বুপানি, ইংরেজিতে সেটাকেই বলা হত লেমনেড। আর থাকত মাটির ভাঁড়ে দুধে ফোটানো মসালা চায়। সামনে ঠিক ধাবার মতো করে দড়ির খাটিয়া পাতা থাকত। তাতে বসে খাওয়া যায় কী করে? সাহেব মেমরা খুবই সন্দিগ্ধ! একটু দেখিয়ে দেওয়ার পর অবশ্য ওঁরা দিব্যি খাটিয়ায় বসে রসিয়ে রসিয়ে সুস্বাদু খাবার খেতেন।

 

আরও পড়ুন: গোপা দত্ত ভৌমিকের কলমে: বাণীমাসিমার পৌষপার্বণ

 

কিন্তু মেলার জন্য দেশ থেকে আসা বাঙালিরা পাঁচতারা হোটেলের ওই অবাঙালি খাবার আর খেতে পারছিল না। কার্তিক বাউল একদিন আমার স্ত্রীকে ধরল।
– দিদি, আমাদের কয়েকজনকে একটু ডাল ভাত খাওয়াবেন? এই খাবার আর সহ্য করতে পারছি না!
আমরা বললাম,
– সে কী? এই খাবার তো যে কেউ পেলে বর্তে যাবে! কী দারুন স্বাদ, তাও তোমাদের ভাল লাগছে না?
করুণ মুখে কার্তিক বাউল বলে,
– কতদিন আর এ রকম খাওয়া যায় বলুন?
আমার স্ত্রী বুঝলেন। বললেন,
– ঠিক আছে। কালকেই চলে এস, আমি রান্না করে রাখব।
কথা হল, চারজন যাবে। কার্তিক, দুই প্রতিমা শিল্পী। আর ওদের সকলের দাদাস্থানীয়, যিনি ওদের দেখাশোনা করেন।

Rajasthani Folk Artists performing
রাজস্থানী লোকশিল্পীদের আসরে

পরদিন আমার স্ত্রী রান্না করেছিলেন ডাল, ভাত, বেগুনভাজা, আলু পোস্ত, রুই মাছের ঝোল আর চাটনি। আমার বাড়ি থেকে মেলা হাঁটাপথ। তবু আমি গাড়ি নিয়ে গেলাম, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে আসতে সুবিধা হবে বলে। মেলার মাঠে পৌঁছে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! খেতে যাওয়ার কথা চার জনের, ওখানে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আট জন। বলতে গেলে বাঙালিরা সবাই। আমি বললাম,
– এত জন?
কার্তিক কাঁচুমাচু হয়ে বলল,
– আমরা ঠিক ম্যানেজ করে নেব।
কিন্তু এত জনের জন্য তো রান্নাই হয়নি! কার্তিক বলল,
– একটু ভাত বসিয়ে দেবেন শুধু, বাকি আমরা সব ম্যানেজ করে নেব।
– আমার গাড়িতেও তো জায়গা হবে না!
আমরা ঠিক ম্যানেজ করে নেব।

ম্যানেজ করল বটে! সামনে-পেছনে আমি ছাড়াও ওরা আটজন দুটো থাক করে কেউ কোলে কেউ মেঝেতে বসে গেল। গাড়ির চাকা বসে গেছে, প্রায় রাস্তা ছুঁই ছুঁই অবস্থা। খুব আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে চলেছি। মোড়ের মাথায় পুলিশ আটকাল।
– এ কী! এ ভাবে কোথায় চলেছেন?
– এঁরা সদ্য ভারত থেকে এসেছেন, এখানে একেবারে কিছুই জানেন না। আমার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি খাওয়াতে।
শুনে পুলিশ ভদ্রলোকের একটু দয়া হল। ভারত মেলায় গিয়েছেন হয়তো একবার! এদিকে কী কথা হচ্ছে, কার্তিকরা কিছুই বোঝেনি। কিন্তু সকলের চোখেমুখে একটা শঙ্কা। পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে গাড়ির ভেতরের দৃশ্যটা একটু দেখে শুধু বললেন,
– ও মাই গড!
ইশারা করে ছেড়ে দিলেন গাড়ি।

The Poetters Den
মৃৎশিল্পীদের আখড়ায় লেখকপুত্র দ্বৈপায়ন

ওইভাবেই কোনওমতে বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। এ বার আমার স্ত্রীর বলার পালা, ও মাই গড! এতজনের খাবার হবে কেমন করে? তাড়াতাড়ি প্রেশার কুকারে ডাল আর ভাত বসিয়ে দেওয়া হল। সবাই বসার ঘরে খবরের কাগজ পেতে পাত পেড়ে খেতে বসে গেল। পাতে আলু পোস্ত দেখে ওদের, আর খাওয়া দেখে আমাদের চোখ চিকচিক করছিল। কার্তিক খেয়ে উঠে আমার ছেলেকে দু’টাকার একটা নোট দিয়ে বলল,
– এটা রেখে দিও। তোমার পছন্দমতো কিছু কিনবে দেশে গিয়ে।
খাওয়া-দাওয়া সেরে আমাদের কতরকম ভাবে যে ধন্যবাদ দিল ওরা!

বছরকয়েক পরে দেশে ফিরে শান্তিনিকেতন যাচ্ছি। হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠে দেখি, কার্তিক বাউল ওই কামরায় একতারা বাজিয়ে গান গাইছে। বললাম, চিনতে পারো? কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চিনতে পেরেই ভীষণ খুশি! শান্তিনিকেতনে আমার বোনের বাড়িতে উঠব আমরা। কার্তিক ঠিকানা জেনে নিয়ে পরদিন সকালে গিয়ে সেখানে নেচেগেয়ে এল। কী খুশি যে হয়েছিল সেদিন!

ওয়াশিংটনে দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেল। ভারত মেলা শেষ, ওদের দেশে ফেরার পালা। ততদিনে আমাদের একটা অদ্ভুত বাঁধন হয়ে গিয়েছে। ভাঙা মেলায় ছোট ছোট অনেক জিনিস নামমাত্র দামে ওরা বিক্রি করে দিচ্ছে। আমরাও কিনলাম বেশকিছু কাজ। তারপর একদিন ভারত মেলা মিলিয়ে গেল। শুধু আমাদের মনে তার রেশ রয়ে গেল আরও বহু দিন।

ছবি সৌজন্য: লেখক

Dipankar Chakraborty

দুই পুরুষের সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তীর চার দশকের পেশাগত জীবনের শুরু ও শেষ আনন্দবাজার পত্রিকায়। মাঝে এক দশক বেতার সাংবাদিকতা জার্মানিতে ডয়চে ভেলে, আর ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস অফ আমেরিকায়। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে অবসর নিলেও মাল্টিমিডিয়ায় এখনও পুরোপুরি সক্রিয়। করেছেন বই সম্পাদনার কাজও। দেশে বিদেশে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও বিচিত্র ও চিত্তাকর্ষক।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *