বর্ষা মূলতঃ তিনপ্রকার – (এক) টিপটিপ বৃষ্টি, (দুই) গাড়ির চাকায় ছিটকে আসা কাদাজল আর (তিন) নিরন্তর, প্রবল বর্ষণে ডুবে যাওয়া রাস্তাঘাট। বর্ষার দিনগুলো আসলে জলছবি, যেখানে মুখ্য চরিত্র হল উঠোন, দেওয়াল, ছাতা, রেইনকোট, ছাদ, খানাখন্দ, ভেজা জামা ইত্যাদি। এই চরিত্ররা নিজেদের ইচ্ছেমতো পার্শ্বচরিত্র বেছে নেয়। দর্শকদের হাসায়, কাঁদায়, ধন্দে ফেলে আবার উৎসাহও দেয়। এই ক্যানভাসে আঁকা দৃশ্যগুলিতে একগলা জলে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার রং ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু পার্শ্বচরিত্রদের নাম পরিবর্তিত।
জলছাদ
অরিজিতের যখন বিয়ে হয়, তখন সে এক বহুজাতিক সংস্থার ছোটকর্তা। শ্বশুরবাড়ি থেকে একটিও উপঢৌকন গ্রহণ করবে না, এই ধনুকভাঙা পণ করা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তাকে হার মানতে হয়। কারণ, দোর্দণ্ডপ্রতাপ করপোরেট বড়কর্তা শ্বশুরমশাই। বাধ্য জামাতা হিসেবে সে একটি ঝকঝকে সেডান গাড়িতে বাড়ি থেকে অফিস যাতায়াত শুরু করে। গাড়িটিতে ও বাড়ি থেকে তত্ত্ব এসেছিল। লেদার সিট কভার, পাওয়ার স্টিয়ারিং, বোতাম টিপে জানলা খোলা যায়, উচ্চমানের সাউন্ড সিস্টেম। একটি সানরুফ-ও আছে! কিন্তু বর্ষার প্রথম দিনেই গাড়িতে একটি গোলযোগ ধরা পড়ল। সানরুফের পাশে কয়েকটি ফুটো লুকিয়ে ছিল, বৃষ্টির লাই পেয়ে আত্মপ্রকাশ করল। প্রথমে দু’ফোঁটা জল অরিজিতের মাথায়, তারপর ব্র্যান্ডেড শার্ট ও ট্রাউজারে এবং বৃষ্টি বাড়লে সারা শরীরে, গাড়ির সিটে। প্রথমে অরিজিত যারপরনাই অবাক হয়, তারপর বিরক্ত এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ভীষণ রেগে শ্বশুরমশাইকে ফোন করে। ভদ্রলোক মন দিয়ে অরিজিতের বক্তব্য শোনেন। তারপর ঈষৎ বকুনি দেন – “বিয়েতে যে জাপানি ছাতাটা পেয়েছিলে, সেটা নিয়ে বের হলে তো এই বিপত্তি হত না!”
ছত্রখণ্ড অর্থাৎ ভাঙা ছাতা
বর্ষাকালে শিভালরি দেখাতে গেলে সঙ্গে ছাতা রাখা যে একান্ত প্রয়োজন, সেটা একমাত্র সোমনাথ বুঝেছিল। অঙ্কের কোচিং ক্লাসে, বাকি কিশোররা ভাবত ভিজে বেড়াল হয়ে থাকাটাই আসল মাস্তানি। তাই মৌমিতা যে দিন ছাতা আনতে ভুলে গেল, সোমনাথ বুক ফুলিয়ে এগিয়ে এল। দু’জনে এক ছাতার নিচে হাতিবাগানের দিকে হাঁটা দিল। সোমনাথ ছাতা ধরে আছে মৌমিতার মাথায়। নিজে ভিজছে, কিন্তু বেড়ালের বদলে বাঘের মতো তার হাবভাব। এরপর থেকে মৌমিতা প্রায়ই ছাতা আনতে ভুলে যেত আর প্রকৃতির খেয়ালে ওই বিকেলগুলোতেই বৃষ্টি হত। বন্ধুদের অনেকে গলির মোড়ের শনিমন্দিরে ধূপ-ধুনো দিল সোমনাথের অকল্যাণ কামনা করে। তার ফলও মিলল কয়েকদিন পর। এক বিকেলে বৃষ্টির সঙ্গে একটু ঝোড়ো হাওয়া দিতেই ছাতা উল্টে গেল। ছাতা নাছোড়বান্দা প্রকৃতির। একবার অবাধ্য হলে তাকে বাগে আনা প্রায় অসম্ভব। সোমনাথের মত জিম করা ছেলেও পেরে উঠল না। মৌমিতা এক ছুটে গাড়িবারান্দার নিচে দাঁড়াল। সোমনাথ মুখ নিচু করে ‘সরি’ বলেছিল কিন্তু পরের ক্লাস থেকে মৌমিতার নিজের ছাতা নিয়ে ক্লাসে আসা বন্ধ করতে পারেনি।
শিয়ালদহ সাউথ
ভালো কোয়ালিটির ছাতার মাহাত্ম্য অনস্বীকার্য। শিয়ালদহ মেইন স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে এক যুবতী, মেধা। সকাল থেকে রাশভারী মেঘ হুমকি দিচ্ছিল। মেধাকে দেখেই যেন মাটিতে নেমে এল। তড়িঘড়ি ব্যাগ থেকে ছাতা খুলেই সে দেখতে পেল সামনে, রাস্তা আটকে এক সমবয়সী যুবক। বুকের কাছে তিন-চারখানা বই জড়ো করা। কিছু বোঝার আগেই হাতে ধরিয়ে দিল – “সরি দিদি, লাইব্রেরির বই, ভিজে গেলে ফাইন। আপনি সাউথে আসুন প্লিজ।” বলেই বৃষ্টিকে ধাঁধায় ফেলে এক ছুট। মেধা প্রথমে ভুরু কুঁচকে ভাবে – দিদি? তারপর নিজের মনে হেসে হাঁটা দেয় সাউথ স্টেশনের দিকে। বইগুলো ঢেকে নিয়েছে ওড়নায়। শোনা যায় সে ট্রেনে চেপে যাদবপুর পর্যন্ত গিয়েছিল।
সাঁকো
একদিন ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আধঘণ্টা বাইক চালিয়ে খাল পাড়ে এল গলায় সোনার চেন, হাতে রুপোর বালা, মফসসল কাঁপানো মাস্তান ট্যাঁপা। শহরে হাতের কাজ শেষ করে গা ঢাকা দেওয়ার জন্য ট্রেন আদর্শ। কিন্তু ভোররাত থেকে মেঘভাঙা বৃষ্টি হয়েছে। ট্যাঁপা যখন খালপাড়ের কাছাকাছি, বৃষ্টি একটু ধরল। তবে খালের ওপর বাঁশের সাঁকো ডুবুডুবু। শুকনো দিনে এই সাঁকো হেঁটে পার হলে চার আনা আর বাইকে আট। আজ দশ পয়সা ছাড় আছে। সাঁকো কমিটির এক মাতব্বর সকাল থেকে লক্ষণরেখার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। এক হাতে ছাতা, অন্যহাতে লম্বা কঞ্চি। সেটি পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে জলের দিকে তাক করা। উনি সমানে সতর্কতামূলক ঘোষণা করে চলেছেন – “সামনে তাকিয়ে হেঁটে যান। এদিকে এলেই খালে পড়বেন” ইত্যাদি। ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস। লোক পারাপারের চাপ একটু কমলে উনি কঞ্চিটি বগলে নিয়ে একটু তামাক ডলতে লাগলেন। আর সেই মুহূর্তেই বাইকে চেপে ট্যাঁপার এনট্রি। খালের জলে কেউ সচরাচর ডোবে না, কিন্তু পাঁকে পড়া নিশ্চিত। হাঁচড়ে পাঁচড়ে যখন পাড়ে এল মোটরবাইক, রীতিমত ভিড় জমে গেছে। এই প্রথমবার ট্যাঁপা নিজের অজান্তেই পকেট থেকে খুচরো বের করল। ক্যাশ কাউন্টারের কর্মী একগাল হেসে পয়সা ফেরত দিলেন – “সাবমেরিনের জন্য কোনও টোলট্যাক্স নেই দাদা।”
নিভে যাওয়া আগুন
ছোটখাটো চেহারার মণীশ অবিশ্যি কোনও রিস্ক নেয় না। সে রেইনকোটে আপাদমস্তক ঢেকে উল্টোডাঙার মোড় থেকে সল্টলেকের বাস ধরে। করিৎকর্মা ছেলে। চেহারায় ব্যক্তিত্ব আনার জন্য লম্বা সিগারেট ধরিয়ে রিং পাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। বাস এলে জোরে দু’টো টান দিয়ে তুড়ি মেরে ফেলে দেয় এবং লাফিয়ে ওঠে পা-দানিতে। সে দিন প্রায় বুকজল। বাসটা আসার সঙ্গে সঙ্গে ঢেউ উঠল পুরীর সমুদ্রসম। মণীশের মুখ থেকে সাধের সাদাকাঠি লুফে নিল ঘোলাজল। হকচকিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরতে যেতেই সে বুঝল, ভাসছে। পদ্মপুকুরে সাঁতার কম্পিটিশনে রানার আপ হয়েছিল ছোটবেলায় তাই বাঁচোয়া। ফ্রি-স্টাইল পৌঁছে দিল কন্ডাকটরের কাছে। মণীশ গুম মেরে রইল অফিসে সারাদিন। সহকর্মীরা শরীর ঠিক আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে দর্শন আওড়ালো – “আগুন নিভে গেছে ভাই।” .
পাতাল লোক
জল যে আগুন জ্বালাতেও পারে সেটা বাবলু জানতে পারল এক বর্ষায়। বিকেলে বৃষ্টি শুরু হতেই সে পাড়ার ক্লাবে চলে যায় এবং কিছুক্ষণ ক্যারম খেলার পর ডিভিডি দেখতে বসে। মিস্টার ইন্ডিয়ার ‘কাটে নেহি কাটতি’ গানটি তার মরমে গেঁথে যায়। অনেকটা সময় থম মেরে বসে থাকে বাবলু। বাইরের রাস্তায় তখন বিস্তর জল জমেছে। এলাকার অত্যুৎসাহী সমাজসেবীর দল গলির মুখে ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে দিয়েছে। সাবধানবাণীর মত একটি গাছের ডাল ওই গর্ত থেকে মুখ তুলে আছে, পাতাগুলো জলে ভিজে নেতিয়ে পড়েছে। একটু পরেই জমিয়ে সন্ধ্যে নামল এবং রাস্তার আলো চলে গেল। কেউ অতি সতর্ক হয়ে কিট-কাট ফিউজ নিজের বাড়ি নিয়ে গেছে বোধহয়। তখনও ভালোই বৃষ্টি। বাবলু দু’চোখে উদাস দৃষ্টি নিয়ে ক্লাব থেকে বাড়ির পথে। মাথায় প্লাস্টিকের থলে, মিস্টার ইন্ডিয়ার টুপির মত। এই মানসিক পরিস্থিতিতে গাছের ডাল এমনিতেই খেয়াল করার কথা নয়, তার ওপর অন্ধকার। সুতরাং গর্তে পড়ে গেল। শেষ মুহূর্তে দু’টো হাত বাইরে রাখতে পেরেছিল, তাই বড়ো কেলেঙ্কারি হল না। তবে দু’পায়ে ফ্র্যাকচার। এক মাস ট্র্যাকশন। বন্ধুরা ওকে অনিল কাপুর বলে খ্যাপাতে শুরু করল। সেই থেকে জল দেখলেই নাকি বাবলু ‘আগুন আগুন’ বলে চেঁচাতে থাকে।
বর্ষামঙ্গল
আগুন ছিল মিঠুর মনে। অসংখ্য চিঠি লিখে পুড়িয়ে ফেলা ছাই। তাতেই চাপা থাকত ওই আগুন প্রায় সারা বছর। তবে বর্ষাকালে ছাদের রেইনওয়াটার পাইপ যখন ভাসিয়ে দিত দোতলার বারান্দা, মিঠুর একতলার কোণের ঘরের পশ্চিমের দেওয়াল অজানা ভয়ে কুঁকড়ে যেত। সারারাত বৃষ্টি হলে, ঘুম থেকে উঠে মিঠু দেখতে পেত দেওয়ালে ঝরনা। নিজেকে অরণ্যদেব মনে হত। ঘরটা খুলিগুহা আর ওই পশ্চিমের ঝরনার ওপার থেকে ডায়ানার হাসির শব্দ। মিঠু গায়ে চাদর টেনে নিত। একবার ভরা শ্রাবণে প্রায় ঘুমঘোরেই দেখল পাশের বাড়ির টুনি আঁকিবুঁকি কেটে দিচ্ছে ওই দেওয়ালে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে সে। কিন্তু কোত্থাও কেউ নেই। আবছায়ায় মনে হল ভিজে দেওয়ালে টানা টানা দুটো চোখ আঁকা। মিঠু টি-শার্টের খুঁট দিয়ে জল মুছে নেয়।
অনুব্রত নামী বহুজাতিক সংস্থায় অতি উচ্চপদে আসীন ছিলেন। কিন্তু মনে মনে এখনও স্কটিশের সেই লেখা-পাগল ছাত্রটি। লেখালিখি তাঁর হাড়ে-মজ্জায়। নিয়মিত লেখেন পত্রপত্রিকায়। শখ, সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো আর ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি।
ভালো মজিয়েছেন।