কোভিডের গোটা দু’বছর কাটিয়েছি গোরেগাঁও ইস্টে। ওবেরয় উডসের এক দিকের জানালা দিয়ে দেখা যেত পঁয়ত্রিশতলা হাইরাইজ যার এক একটার দাম প্রায় পাঁচকোটি আর অন্যদিকে— আরে মিল্ক কলোনির সারি সারি অ্যাসবেসটসের বাড়ি। সেখানে মস্ত মাঠে গরু মোষ চরে বেড়ায়, জোয়ান ছেলে দুধ দোয়, দেহাতি বৌ ঘুঁটে দেয়। একদিকে পাঁচতারা ইণ্ডিয়া আর অন্যদিকে খেতখামার, একচালা লাইনঘরের ভারত। তখন শহরে আমি নতুন। বাড়িতে বন্দি। তার আগে আমি যে মুম্বইকে চিনতাম, তা অমোল পালেকরের ঘরোন্দা বা ছোটিসি বাতের মুম্বই– টাউন-বান্দ্রা-আন্ধেরি। তাই এই ম্যানিকিওরড লনে ঘেরা আকাশছোঁয়া বাড়ি দেখে গুরগাঁও, রাজারহাটের কথা মনে হত আর আরে কলোনির গোয়ালঘর দেখে মনে হত গোবলয়ের কোনও গ্রাম। আমার বারোফুট লম্বা জানলায় মোষের ছায়া, ডিফিউজারে পাচৌলির সুবাস ছাপিয়ে ঘুঁটে পোড়ার গন্ধ আমাকে আর যাই হোক বম্বে ফিলিং দিত না। নতুন শহর, নতুন চাকরি – আর এই অদ্ভুত বাসা– সব মিলিয়ে আমার নিজেকে উদ্বাস্তু মনে হতো।

আরও পড়ুন: পদব্রজে নেপাল

মাঠ পেরোলে দূরে দেখা যেত ফিল্মসিটি আর ফিল্মসিটি ছাড়িয়ে আরে জঙ্গল। সেখান থেকে চিতা বাঘ রাস্তা ভুলে চলে আসত গকুল ধাম বা মোহন গোখলে রোডে। মোটেও ভালো লাগত না– ভারতের ব্যস্ততম শহরে থেকে এরকম আধা গ্রাম্য জীবন! সবটাই খাপছাড়া। তাই কোনও দিনই ইচ্ছে করেনি বাড়ির কাছেই সঞ্জয় গান্ধী ন্যশনাল পার্ক ঘুরে দেখতে।

Sanjay gandhi national park in Mumbai
ইন্সটাগ্রামে যখন আরে ফরেস্ট ওয়াক-এর খবর পেলাম, ইচ্ছে হল ঘুরে দেখে আসি।

এবছরের গোড়ায় চলে এসেছি আন্ধেরি ওয়েস্ট–  সকাল থেকে দুম দাম বহুতল বানানোর শব্দ, গাড়ির প্যাঁপো হর্ন, মসজিদের আজান আর ভারসোভা থেকে আসা শুঁটকির গন্ধ আমাকে অনেক বেশি আশ্বস্ত করে। তবে, চোখের বাইরে আছে বলে আরে মিল্ক কলোনির প্রতি এখন আর কোনও খারাপ লাগা নেই আমার। তাই হয়তো ইন্সটাগ্রামে যখন আরে ফরেস্ট ওয়াক-এর খবর পেলাম, ইচ্ছে হল ঘুরে দেখে আসি। চোদ্দ তলার জানলা থেকে দূর কুয়াশায় যাকে দেখতাম– তাকে বেশ কাছ থেকে দেখা যাবে– ভেবে মন্দ লাগল না।

ভোরবেলায় উবর ধরে বেরিয়ে পড়লাম। ফিল্মসিটির রাস্তা ধরে আরও ভেতরে গেলে পড়বে বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির অফিস। ১৮৮৩ সাল থেকে বেশ কিছু ব্রিটিশ আর ভারতীয় মিলে তৈরি করেন এই সংস্থা যার উদ্দেশ্য ভারতের প্রকৃতি সংরক্ষণ। সারা বছর ধরে তারা আয়োজন করে বিভিন্ন ন্যাচারাল ট্রেল-এর। জুলাইয়ের শেষ থেকে মুম্বইতে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। তবে মজার ব্যাপার হল – বৃষ্টি বলে বাড়িতে কেউ বসে থাকে না বরং লম্বা লম্বা ছাতা আর রেনকোট নিয়ে লোকে বেরিয়ে পড়ে বৃষ্টির আনন্দ নিতে। আমার মতো সেদিন আরও জনা তিরিশ বিভিন্ন বয়সের মানুষ হাজির ছিলেন বনজঙ্গল আর সেখানে বসত করা পশুপাখিকে চিনতে। সেদিনের সফর দুটি ট্রেলে আমাদের নিয়ে গেছিল। কারভি আর লেপার্ড ট্রেল। না, চিতার দেখা মেলেনি তবে যাত্রা শুরুর দু’মিনিটের মধ্যেই গাছের গায়ে তার নখের আঁচড় দেখতে পেলাম। এ নাকি তার টেরিটরি মার্ক। জায়গা দখলের লড়াইয়ে চিতা গাছের গায়ে আঁচড় কেটে মূত্রত্যাগ করে যায়- যার গন্ধে অন্য চিতা বুঝতে পারে এই জায়গায় তার ঢোকা মানা।

Aarey forest trail
ঝমঝমে বৃষ্টিতে আমরা হাঁটা শুরু করলাম।

সেদিন আমাদের গাইড ছিলেন মহেশ যাদব। সিভিল ইন্জিনিয়ারিং পাশ করেও নাগরিক জঙ্গল নয় প্রকৃতির টানে পেশা ছেড়েছেন তিনি। গত তেইশ বছর ধরে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশের বাঘসুমারিতে তিনি নিয়মিত অংশ নেন। আজ অবধি তেত্রিশটি বাঘ দেখেছেন মহেশ। ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা আরের বনভূমি এই মারাঠি মানুষটির হাতের মুঠোয়।

ঝমঝমে বৃষ্টিতে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। আমাদের যাত্রাপথে এলোমেলো ঝোপের মধ্যে ফুটে রয়েছে লিলির মতো বেগুনি ফুল। ওগুলো নাকি বুনো হলুদ গাছ। আদিবাসী রান্নার অন্যতম উপকরণ। বৃষ্টির ছাঁটে টপ টপ করে ঝরে পড়তে লাগল ছোট্ট সবুজ মিষ্টি এক ফল– তার নাকি বারোটা মুখ তাই নাম বারতোন্ডি। এই জঙ্গলে মহীরূহ না থাকলেও আছে গুল্ম আর লতা। চারিদিকে যে বড় বড় গাছের সারি তার নাম কার্ভি। বসন্তে তাতে জারুলের মতো বেগুনি ফুল ধরে। এই গাছের কাঠকুটো, মাটি আর গোবর দিয়ে এখানকার আদিবাসীরা বাড়ি বানান। কার্ভি গাছে ঢাকা পথ তাই এই জঙ্গল সফরের নাম কার্ভি ট্রেল। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেলাম কার্পাস তুলোর গাছ। গাছের কাঁটা ভাঙলে দেখা যায় রক্তের মতো লাল রং। আমাদের গাইড মহেশ আমাদের থামতে বলে এক ঝুমকো লতার মতো ফুল দেখালেন, কেতাবি নাম সেরোপেগিয়া ইনসাফোলিয়া (ceropegia ensifolia) আর মারাঠি নাম পুষ্পকান্দিল। এই ফুল মাংশাসী, মানে পোকা খায়। ফুলের মতো আপাত নিরীহ দেবতার অনুগ্রহ পুষ্ট বস্তুটি প্রাণীহত্যা করে শুনে দলের সংখ্যাগুরু ভেজ লবি বেশ গোল গোল চোখ করে তাকে দেখতে লাগল। দলের সবাই নতুন কিছু আবিষ্কারের আনন্দে যখন এদিক ওদিক এলোমেলো ঘুরছে, গাইড সাবধান করে জানালেন চারিদিকে ছড়িয়ে আছে কাঁটা ঝোপ। অজান্তে গায়ে লাগলে হবে মহা বিপদ। একজনের থেকে রুমাল চেয়ে হঠাৎ করে সেই হাঁটুর মাপের কাঁটা ঝোপে ফেলে তোলার চেষ্টা করে দেখা গেল রুমাল ফুটি ফাটা। গাইড জানালেন এই গাছের নাম মাসতোড়ি– মানে যা মাংস ছিঁড়ে খায়।

ceropegia ensifolia
এই ফুল মাংশাসী, মানে পোকা খায়।

মাংশাসী ফুল আর বিপদজনক কাঁটার ভয়ে সবাই যখন ভয়ে কাঁটা, গাইড হাতে করে কাঁকড়া ধরে দেখালেন। এক আঁঙুলে কাঁকড়ার পেট আর অন্য আঙুলে কাঁকড়ার দাঁড়া চেপে ধরলেই কাঁকড়া কাবু। ছোটবেলা থেকে আমি খুব পোকা ভালোবাসি। কাচের শিশিতে গুটি পোকা পুষে কীভাবে তা থেকে প্রজাপতি হয় দেখতাম। হাতে গুবরে পোকা হাঁটিয়ে মজা পেতাম। তাই কাঁকড়া ধরার লোভ সামলাতে পারলাম না। দলের ভেজ লবির চোখ আবার গোল গোল হয়ে গেল। পায়ের কাছে প্রায় মাটি রঙের বিছে দেখিয়ে গাইড বলল, কাঁকড়া ধরেছ বেশ করেছ, একে ধরতে যেও না। বিছের নাম ইন্ডিয়ান রেড স্করপিয়ন। না এক কামড়ে কেউ মারা যাবে না কিন্তু বিষ কাটাতে হাসপাতালের দৌড়তে হবে। 

 

জঙ্গল যত গভীর হয় মশার দাপটও ততো বাড়তে থাকে। সাদা কালো ছোপকাটা এক ধরনের ছোট মশা দেখিয়ে আতংকে জানতে চাইলাম, এই মশা কামড়ালে ডেঙ্গি হবে না তো? গাইড জানালেন ডেঙ্গি শহুরে রোগ, জঙ্গলের নয়। এই মশা খুবই নিরীহ। দূরে পশ্চিমঘাটের কুয়াশা ঘেরা পাহাড়, সামনে সেলিম আলির নামে উৎসর্গ করা টিলা। নীচে দেখা যায় পাওয়াই লেক। এদিক সেদিক হাঁটতে হাঁটতে কেমন অবাক করে দিয়ে সামনে চলে এল এক আশ্চর্য শান্ত ঝরনা। বর্ষার জলে টলমল করা এক ছোট্ট জলাশয়। মনে পড়ে গেল সেই লাইন– ‘‘লক্ষ্মণ বলিলেন, আর্যে! এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি। এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমাণ জলধরমণ্ডলীর যোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত।’’ বিদ্যাসাগর তো কোনওদিন আরের জঙ্গলে আসেন নি তবুও এই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি হুবহু সীতার বনবাসের সেই বর্ণনাকেই মনে করাচ্ছে।

crab
এক আঁঙুলে কাঁকড়ার পেট আর অন্য আঙুলে কাঁকড়ার দাঁড়া চেপে ধরলেই কাঁকড়া কাবু।

জলে খালি পায়ে হেঁটে, সেল্ফি তুলে, গাছের ডালে মোগলির মতো দোল খেয়ে যখন ফেরার সময় হয়ে এল, পায়ে লাগল একটা হরিণের শিং– কে জানে, কোন হরিণের মাথা থেকে তা খসে পড়েছে। হঠাৎ গুম গুম শব্দে ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম হয়তো বা বাঘের ডাক। গাইড আশ্বস্ত করে বললেন পশু নয় সাউন্ড বক্সের শব্দ। শুটিং চলছে।

যেখানে জঙ্গল শেষ সেখানেই শুরু ফিল্মসিটি। বড় বাজেটের সিনেমা, সিরিয়ালের শুটিং চলে এখানে। ট্রেল থেকে বেরিয়ে দেখতে পেলাম ইমলিকে। সামনে মাইল ফলকে লেখা আছে বালিয়া। না বালিয়া মুম্বইয়ের কোনও গ্রাম নয়- আর ইমলিও বাস্তবের কোনও মেয়ে নয়। এটি একসময়ের সুপারহিট বাংলা সিরিয়াল ইষ্টিকুটুমের হিন্দি রিমেক – সেখানে বাহার নাম বদলে হয়েছে ইমলি। আসল জঙ্গল আর নকল জঙ্গল এভাবেই মিলেমিশে আছে আরের বনভূমিতে। কিন্তু সেই মিলেমিশে থাকায় ভাঁটা পড়ল বলে।

stream inside aarey forest
বর্ষার জলে টলমল করা এক ছোট্ট জলাশয়।

তেরোশো হেক্টর জমি ঘিরে এই জঙ্গলকে মনে করা হয় মুম্বইয়ে অক্সিজেন ভান্ডার। প্রায় সাতাত্তর প্রজাতির পাখি, চৌত্রিশ রকমের ফুল, ছিয়াশি ধরনের প্রজাপতি, ষোলোটি প্রজাতির প্রাণী আর নয়টি চিতাবাঘের বাসভূমি এই আরের বন। সাতাশটি আদিবাসী গ্রামে ঘেরা তার চারপাশ। দশ হাজার মানুষের বসতি সেসব গ্রামে। ২০১৪ সালে তৎকালীন রাজ্য সরকার নগরোন্নয়নের উদ্দেশ্যে ঘোষনা করলেন কোলাবা থেকে বান্দ্রা মেট্রোরেলের কাজ শুরু হবে। আর সেই মেট্রোগুলো রাখা হবে আরের জঙ্গল কেটে বানানো কার শেডে। ২০১৯ এ নাগরিক আন্দোলন শুরু হয়- তবুও আটকায়নি তার কাজ। মুম্বইয়ের সিভিক বডি, যার নাম ট্রি অথরিটি নিজেই ২১৮৫ টি গাছ কাটার অনুমতি দেয় মেট্রোরেলকে। তবে ২০২০তে সরকার বদল হয়। নতুন সরকার আরের ৮০০ একর জমিতে সংরক্ষণের বিল পাস করেন। সরকার আবার বদল হয়েছে সম্প্রতি। তাই বলা যাচ্ছে না আইনের ঘোর প্যাঁচে এই “জনস্থান মধ্যবর্তী গিরি পর্বতমালা” কতদিন টিঁকে থাকবে।

গোরেগাঁও ইস্টে যখন থাকতাম – সন্ধেবেলা ওই গা ছমছমে জঙ্গল দেখলে মন খারাপ লাগত। ভয় করত। আজ তাকে কাছ থেক দেখে বড় মায়া হল। মনে হল– পোকাখেকো ফুল, বশ না মানা চিতা বাঘ বা রক্তাক্ত কাঁটা ঝোপের থেকেও মানুষ কত বিষাক্ত। আমাদের কাছে ওরা কতটা বিপন্ন।

ছবি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে।

ছাত্রী ইতিহাসের আর চাকরি গণমাধ্যমে। তাতে কী! নেশা কিন্তু আঁকা এবং লেখা। বিশেষত নকশা। নোটবুক ভর্তি তার প্রতিটি ছবিই গল্প বলে চলে। গুছিয়ে বসে বা দফতরের মিটিংয়ের ফাঁকে - রং কাগজ এবং কলম সবসময় মজুত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *