শিল্পী মানেই কি পথিক নয়? তিনি আনমনে ঘুরে বেড়ান পাহাড়ে-জঙ্গলে-নদীতে। নিজের সঙ্গে একা। কাঁধঝোলায় পেন্সিল-রবার-রং-তুলি। যেমন ইচ্ছে থামেন। জীবন দেখেন। পথ দেখেন। আলস্য দেখেন। প্রকৃতির গায়ে ঠেস দিয়ে ভাবনের নাও ঠেলে দেন আলগোছে। কখন যেন স্কেচের খাতা ভরে ওঠে পাথেয়তে। ঘরে ফিরে এসে একলা অন্দরে মন মথিয়ে বের করে আনেন সে সব সকাল-দুপুর-বিকেলের রঙিন নুড়ি পাথর। দেবাশীষ দেবের স্কেচের খাতা আর ভাবনপথের যাত্রা ধরা রইল বাংলালাইভের পাতায়! 

 

অযোধ্যা পাহাড়ের মাথায় পৌঁছতে হলে পুরুলিয়া শহর থেকে সরাসরি বাস সার্ভিস আছে। আমি একা যাব, তাই সেটাই সুবিধের। আগে জয়চন্ডী পাহাড় ঘুরে রঘুনাথপুর থেকে মিনিবাসে চেপে ঘণ্টা দু’য়েক পর এলাম পুরুলিয়া সদরে। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ফলে রাতটা এখানেই  থেকে গেলাম একটা চলনসই গোছের হোটেলে। বাস ডিপোটা উল্টোদিকেই। পরদিন সাতসকালে উঠে হাজির হয়ে গেলাম।

অযোধ্যা যেতে হয় ২৬ কিলোমিটার দূরে সিরকাবাদ হয়ে। সে বাস আছে ঘন্টা দেড়েক পর। আপাতত একটা বাস ছাড়ব ছাড়ব করছে যেটা সিরকাবাদ ছুঁয়ে সোজা বেরিয়ে যাবে। সময় নষ্ট না করে তড়িঘড়ি সেটাতেই চেপে বসলাম এই ভেবে, যে সিরকাবাদে নেমে অযোধ্যার মাথা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ হেঁটেই মেরে দেব। সিরকাবাদ বাস স্টপে একটা চায়ের দোকানে বসে গরম চা আর ঠান্ডা পকোড়া খেয়ে স্যাক পিঠে হাঁটা শুরু করার কিছুক্ষণ বাদেই বুঝলাম বেজায় ভুল করেছি। চড়া রোদ্দুরে এতটা পথ পেরনো অসম্ভব। অথচ ন্যাড়া সমতলে দাঁড়ানোও যায়না। পাহাড় এখনো বহু দূর।

অগত্যা জনমানবশূন্য রাস্তা ধরে নিজেকে গালাগাল দিতে দিতে এগোচ্ছি। দেখলাম খুদা মেহেরবান! বড়সড় একটা সরকারি গাড়ি পাশে এসে থামল। জনাকয়েক কর্তাব্যাক্তি সন্দেহজনক চোখে মুখ বাড়ালেন। পনেরো বছর আগের কথা। এসব অঞ্চল তখন চূড়ান্ত অস্থির। এদিকে আমি একজন একলা হাঁটছি। দেখলাম ওঁরা হঁশিয়ার লোক। সব শুনে টুনে আমায় তুলে নিলেন। গাড়ি ছুটল অযোধ্যার দিকে।

Illustration by Debasis Deb Travelogue
পাহাড়ের উপর সস্তার হোটেল। 

একেবারে মাথায় উঠে পড়লে জায়গাটাকে আর পাহাড় বলে চেনা যায় না। মনে হয় সমতলে ছড়ানো ছেটানো কয়েকটা গ্রাম যেন। বাস স্ট্যান্ডের আশপাশে সস্তায় থাকার জায়গা বিস্তর। দল বেঁধে ট্রেক করতে আসা ছেলেপুলেদের জন্য ঘুপচি সব ঘরে সার দেওয়া তক্তাপোষ আর কম্বল। স্লিপিং ব্যাগ ছাড়া গতি নেই। দু’পা হাঁটলেই অবশ্য গাছপালা ঘেরা সরকারি অতিথিশালা ‘মালবিকা’ যার হদিশ দিলেন বেড়াতে আসা জনৈক শিক্ষক পার্থ ঘোষাল মশাই। উনি ওখানেই উঠেছেন দুই ছাত্রকে নিয়ে। বুকিং নেই, তাও বলেকয়ে একতলার একটা ঘর ম্যানেজ করলাম। এ বার দুপুরের খাওয়া, এ বারও পার্থবাবু সহায়। রাস্তার ওধারে ভাতের  হোটেল। উনি সবার জন্য দিশি মুর্গির কারি অর্ডার দিয়ে রেখেছেন।

খাওয়া সেরে বেরিয়ে প্রথমেই সামনে দেখলাম সাইকেলের ওপর চানা আর ঝালমুড়ির ডালা চাপিয়ে বিক্রি করছে সাদা ধপধপে চুল-দাড়িওলা একটা আধবুড়ো লোক। বললাম, “স্থির হয়ে দাঁড়াও, তোমাকে আঁকব।”

Illustration by Debasis Deb অযোধ্যা পাহাড়ের ফিরিওলা
লুড়কুর সাইকেল-দোকানে চানা-মুড়ির পসরা। 

দাঁড়াল বটে কিন্তু তারই মধ্যে অনর্গল বকে চলল। জানা গেল ওর নাম লুড়কু কুম্ভকার। তখন দুপুর একটা। ঘণ্টা দু’য়েক বাদে ঘুরতে ঘুরতে আবার দেখা লুড়কুর সঙ্গে। কিন্তু কেমন যেন অন্যরকম দেখতে লাগছে?

ও বাবা! এর মধ্যেই কোথাও গিয়ে চুল, গোঁফ, দাড়ি সব কুচকুচে কালো করে এসেছে! আমার হাঁ করে তাকানো দেখে নিজেই জোর গলায় বলে উঠল, ‘এ ওয়ান সালফার লাগাইছি, দিখো কেমন জোয়ান লাগতিছে! এখন চুল কালো না রাইখলে কেও তোমারে পাত্তা দিবেক লাই।’

সম্প্রতি ওই অঞ্চলে আবার বেড়াতে গিয়ে অযোধ্যার মাথায় ঝাঁকিদর্শন দিয়েছিলাম। লুড়কুকে ভুলিনি তবে এতকাল বাদে লোকটা আজও সাইকেলে করে
চানা-মুড়ি ফিরি করছে দেখলে যথেষ্ট অবাক হতাম বৈকি!

(চলবে)

 

Debashis Dev

স্বনামধন্য এই অঙ্কনশিল্পী নিজেই এক সম্পূর্ন প্রতিষ্ঠান | তাঁর হাত ধরে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে বাংলার কার্টুন শিল্প | সিগনেচার বেড়াল আর স্ব-নেচারটি কোমল, আত্মবিশ্বাসী, রসিক | বেড়ানো তাঁর নেশা | তাই ঝুলিতে রয়েছে বহু গল্প, সঙ্গে অসাধারণ সব স্কেচ | সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিরলস সাধনার অমর ফসল ‘রঙ তুলির সত্যজিৎ’ |

6 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *