ধানচো-তে রাস্তার দু’পাশে উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে কিছুটা সমতল জায়গা জুড়ে সব অস্থায়ী আস্তানা। কিছু দাতব্য ভান্ডারা, আবার কিছু সামান্য মূল্যের বিনিময়ে সরাইখানা। বিট্টুর নির্দেশমতো সরাইখানায় থাকার ব্যবস্থা হয়। পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে খাটের মতো বানিয়েছে। তার ওপরে ফেল্ট আর কম্বল বিছিয়ে সুন্দর বিছানা। সবচেয়ে মজার হল ঘরের প্রাইভেসি দিতে থাকার জায়গাটিকে সি-থ্রু সিন্থেটিক শাড়ি দিয়ে ভাগ ভাগ করা হয়েছে। ফেলে আসা রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি, দুই পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে ঘন নীল আকাশ, আর সামনে পাহাড়ের মাথায় মেঘের রাশি। পাহাড়ের গায়ে বড় গাছ প্রায় নেই। বেশিটাই গড়ানে বুগিয়াল, আর মাঝে মাঝে ধসের ধূসর দাগ। খালি গলার হিমাচলি লোকগীত শুনে পায়ে পায়ে এগিয়ে দেখি, এক লোকশিল্পী আপনমনে একটি দোতারা জাতীয় বাদ্যযন্ত্র আর একটি বাঁয়ার মতো তালবাদ্য বাজিয়ে গাইছে। শুনতে শুনতে গানের বিষয় বুঝতে চেষ্টা করি- ওপারে যাওয়ার বাধা। বেগবান নদীকে একটু ধীরে বওয়ার অনুরোধের গান। মনে মনে হাসি। সত্যি, ওপারে যাওয়ার যে কত বাধা… তবু সুখের সন্ধানে ওপারেই। সন্ধ্যা নামে, চরাচরের আপাদমস্তক মেঘ আর আঁধারের ওড়নায় ঢাকে। ডেরাগুলিতে জ্বলে ওঠে বেমানান সৌরবাতি।
আশা-আশঙ্কার দোলাচলে রাতে ভালো ঘুম হল না। সকালেও আকাশের মুখ ভার। মেঘে, কুয়াশায় চারদিক ঢাকা।আশেপাশের পাহাড়ের গায়ে রূপোলি সলমা চুমকির মতো ছড়িয়ে বরফের গুঁড়ো। মনে হল, আকাশ মুখ ভার করে থাকলেও হাতছোঁয়া পাথরের গায়ে যেন হাসির ছোঁয়াচ। তাকিয়ে দেখি কাল যেখানে ছিল শুধুই সবুজ গুল্ম, আজ তারই ফাঁকে ফাঁকে লাল, নীল, হলদে তারার মতো অজস্র ফুল। হলামই বা আমরা ছোট! আমাদের আকাশচুম্বী ঔদ্ধত্য নেই বটে, তাই বলে কি আমাদের হাসতে মানা? দেখতে দেখতে পাথুরে পথে উপরে উঠতে থাকি, মেঘের দেওয়াল সরিয়ে সরিয়ে। পাশে পাশে চলতে থাকে অবিরাম অবিশ্রান্ত কলহাস্যময়ী সঙ্গী- ডানচু নালা। এখানে নালার ওপর আর একটি পুল পার হই। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে স্টিম ইঞ্জিনের শব্দ। সামনেই এক ঝুপড়িতে ধপ করে বসে পড়ি।একটু ধাতস্থ হয়ে দেখি ঝুপড়ির বাইরে একদিকে কাত হয়ে ঝুলে আছে এক সাইনবোর্ড (এখানেও সাইনবোর্ড!!!!), হিমালয় রেস্টোরেন্ট, সুন্দরাসি, প্রোঃ-…..। তাহলে এ জায়গার নাম সুন্দরাসি? এখানে ঘোড়াওয়ালাদের ইতঃস্তত আনাগোনা দেখে আন্দাজ করি, সামনের চড়াই কঠিন।
এগোতে থাকি গৌরিকুণ্ডের দিকে। বাঁ দিকের পাহাড়ে এক পথরেখা দেখতে পাই, সোজা উঠে গেছে পাহাড়ের মাথায়। ও পথেও যাওয়া যায় গৌরিকুণ্ড। তবে মানুষের মতো দু’পায়ে ভর দিয়ে নয়, শাখামৃগের মতো চার হাতপায়ে ভর করে। তাই ওই চড়াইপথের নাম বান্দরঘাটি। তারও পরে ভৈরবঘাটি পার হয়ে গৌরিকুণ্ড। আমার চলার পথে ঝুরো পাথরের পাহাড়, মাঝে মাঝে সবুজের পোঁচ। রাস্তার সাথে প্রায় ষাট ডিগ্রি কোণ করে পড়ে থাকা এক বরফের দেওয়াল পেরিয়ে, প্রাণান্তকর চড়াই ঠেলে পৌঁছে যাই গৌরীকুণ্ড। মূল রাস্তা থেকে তিন-চার ধাপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটি ছোট্ট জলাধার, মাঝখানে পাতলা চটের চাদর দিয়ে দু’ভাগ করা। রঙিন পতাকা, ত্রিশূল ইত্যাদি দিয়ে দেবতার থান সাজিয়ে বসে থাকা মহিলাকে (পুরোহিত??) প্রশ্ন করে জানা গেল, যে এখানে মণিমহেশ যাবার সময় পার্বতী স্নান করেছিলেন। তাই এখানে চটের পর্দার ওপাশে কেবল মহিলাদের স্নানের প্রথা।
প্রণাম করে এগিয়ে চলি। ডানচু নালার ওপরে একটি ছোট পুল পার হয়ে চলতে থাকি মণিমহেশ হ্রদ ও মণিমহেশ কৈলাশ দর্শনে। শরীরে ক্রমাগত চড়াই ভাঙার ক্লান্তি। অথচ মনে দেখছি অপার আনন্দ আর উত্তেজনা। আবহাওয়া একেবারেই অনুকূল নয়- জলভরা মেঘে পুরো এলাকাটাই ঢাকা। কেবল সামনের পথ কিছুটা দেখা যাচ্ছে। যত এগোচ্ছি, ততই কানে আসছে একটা সমবেত উল্লাসধ্বনি। বিট্টু বলে, আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি, তারই প্রমাণ ঐ সমবেত প্রার্থনার শব্দ। পায়ের আগে মন ছুটে চলে যায়। ঘন কুয়াশায়, মেঘে, ঝিম ঝিম বৃষ্টিতে মাখামাখি হয়ে অকাল সন্ধ্যায় আমরা পৌঁছলাম মণিমহেশ।
পৌঁছতেই চরম বিপত্তি। ঝমঝম করে নামল প্রবল বর্ষা। সঙ্গে গুরুগম্ভীর মেঘগর্জন। দৌড়ে ঢুকি কাছাকাছি এক আস্তানায়। ব্যবস্থা ধানচোর মতোই। তবে আকারে অনেক বড়। একটা বিছানা বেছে অশান্তমনে বসে থাকি। মন পড়ে থাকে বাইরে। বার বার উঁকি মেরে দেখি। কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি ধরে আসে। বর্ষাতি গায়ে চাপিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই মণিমহেশ হ্রদের দিকে।

অনেকটা জায়গা জুড়ে পান্থশালা, ভান্ডারা, লঙ্গরখানা আর নিত্যব্যবহার্য জিনিসের দোকানপাট। সেগুলো পেরিয়ে হ্রদের ধারে এসে দাঁড়াই। প্রায় চোদ্দোহাজার ফুট উচ্চতায় হিমবাহগলা জলে পুষ্ট এই মণিমহেশ হ্রদ। কুণ্ডের পাড় পুরু পাথরের স্ল্যাব দিয়ে বাঁধানো। পরিক্রমার জন্যে গোলাকৃতি কুণ্ডের চারপাশে বেশ প্রশস্ত বাঁধানো পথ। আমরা পায়ে পায়ে পরিক্রমা করতে থাকি। মাঝামাঝি জায়গায় একটি চাতালের মধ্যে পতাকা, ত্রিশূল, ঘন্টা এবং বিভিন্ন আকারের শিবলিঙ্গ স্থাপনা করে পূজার ব্যবস্থা। বৃষ্টি আবার শুরু হয়। কোনও রকমে পূজা-প্রার্থনার নিয়মরক্ষা করে তাড়াতাড়ি ফিরতে থাকি পরিক্রমা পথ ধরে আস্তানার দিকে। তখনও দেখছি একদল ভক্তিপ্রাণ মানুষ ঐ ঠান্ডায় বরফগলা জলে স্নান করে উদোম গায়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সমবেত প্রার্থনাধ্বনি উচ্চারণ করে চলেছে মহাদেব-দর্শনের ইচ্ছায়। ওদের বিশ্বাস- ওই সমবেত প্রার্থনার ধ্বনিতরঙ্গের আঘাতে সরে যাবে মেঘের আবরণ। প্রকাশিত হবেন হৃদয়ের দেবতা।
বিশ্বাসের অপরিমেয় শক্তির কথা ভাবতে ভাবতে ক্ষুণ্ণমনে আস্তানায় ফিরি। বসে বসে ভাবতে থাকি প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনী– একবার এক গদ্দি ভেড়ার দল চরাতে চরাতে এই পাহাড়ে এসে হাজির হয়। এখানকার অপরূপ শোভায় মোহিত হয়ে যখন গদ্দির হতভম্ব অবস্থা, তখনই দৈববাণীর সঙ্গে তার সামনে হাজির হয় জটাজুটধারী এক বিশাল পুরুষ। তিনি বলেন, “তুই কে? কী চাস?” “আমি এক সাধারণ গদ্দি মহাত্মা- আমি এক হাজার ভেড়া পেলেই খুশি।” দৈপৃবপুরুষ বলেন, “তথাস্তু। তবে সাবধান, এই কথা আর স্থান যেন কেউ জানতে না পারে।” মহানন্দে গদ্দি ফিরে এসে তার হাজার ভেড়া পেয়ে খুশি হয় ঠিকই, কিন্তু মন বড় উন্মনা। সে আবার ফিরে যায় মণিমহেশ পাহাড়ে। ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। দেখা হয় এক সাধুবাবার সঙ্গে। তিনি পথের সন্ধান চাইলে প্রথমে গদ্দি রাজি হয় না। পরে অনেক অনুরোধের পর সে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে, সঙ্গে চলে ভেড়ার পাল ও একটি কুকুর। পাহাড়ে অর্ধেক পথ ওঠার পর হঠাৎ দৈববাণী হয়, “আমার নিষেধ সত্ত্বেও এঁদের পথ দেখিয়ে আনছিস? থাক তোরা ওইখানে পাথর হয়ে। মুহূর্তে অভিশাপ বাস্তবায়িত হয়। অজানিতভাবে একটি কাক ও একটি সাপও ওই অভিশপ্ত বলয়ে ঢুকে পড়ে।
মন বড় অস্থির। বারে বারে সরাইখানার দরজায় দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু প্রকৃতি আজ কোনও ভাবেই সাথ দেবে বলে মনে হচ্ছে না। ভারাক্রান্ত মনে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি ফ্যাকাসে মেঘ-কুয়াশার চাদরের দিকে।আমাদের অবস্থা দেখে এক ভদ্রলোক এগিয়ে আসেন। বলেন মনখারাপ করবেন না, ” ম্যায় কুণ্ডমে নাহাকে আতা হ্যায়, উসকে বাদ মহেশজি কা দরওয়াজা খুলেগা জরুর।” মৃদু হেসে ঢুকে পড়ি আমাদের নির্ধারিত বিছানায়, কম্বলের ওমে। পলিথিনের চাদরের চালে অবিশ্রান্ত ধারাপাতের ঘুঙুরের শব্দ শুনতে শুনতে কখন দু’চোখের পাতা এক হয়ে আসে। কতক্ষণ পরে বলতে পারব না, গায়ে মৃদু আঘাত অনুভব করি আর সঙ্গে আনন্দউল্লাসধ্বনি- “বাহার আইয়ে, দরশন হো রহা হ্যায়!” তাড়াহুড়ো করে বাইরে বেরিয়ে ছুটে যাই হ্রদের ধারে। সেখানে তখন প্রচুর মানুষের সমাবেশ। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি আঠারো হাজার ফুট উঁচু মণিমহেশ শৃঙ্গের দিকে। দেখা নয় দর্শন,তাকানো নয় অবলোকন! কেবল তার রূপমাধুর্য অনুভব নয়, যেন রূপ-অরূপের সাগরে অবগাহন।
সমবেত প্রার্থনামন্ত্রের অভিঘাতে কেটে যাচ্ছে মেঘের আস্তরণ, দৃষ্টিপথে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে এখনও মানুষের কাছে হার না-মানা মণিমহেশ পর্বতশৃঙ্গ। আমাদের কল্পনায় জটাজুটধারী মহাদেবের ত্রিকোণাকৃতি মস্তকের মতোই এই শিখরের বিন্যাস। কালো পাথরের ত্রিকোণাকৃতি এই পর্বত। শীর্ষবিন্দু থেকে শৃঙ্গের মাঝবরাবর নেমে এসেছে এক রজতশুভ্র বরফের ঢাল। ঠিক যেন হোমভস্ম দিয়ে ঢাকা শিবের প্রশস্ত ললাট। এই বরফের ঢালের মাঝখানে একটি গভীর কালো দাগ। দূর থেকে বোঝা যায় না সেটি কোনও গহ্বর, নাকি উঁচিয়ে থাকা কোনও মসৃণ পাথর, যেখানে বরফ জমতে পারে না! ঐ কি তবে শিবের তৃতীয় নয়ন? এই বরফের ঢালের মধ্যেই কিছু কালো পাথর এমনভাবে সাজানো যে বিশ্বাসীর কল্পনায় সেগুলিকে শৈবললাটে ত্রিপুন্ড্র অথবা ওঙ্কার চিহ্ণ বলাই যায়।

সমগ্র পর্বতশৃঙ্গের পাথরের খাঁজে খাঁজে এমন ভাবে বরফ পড়ে আছে যেন মনে হচ্ছে পূজা অর্ঘ্যে নিবেদিত শ্বেত পদ্মের ছিন্নদল। কতক্ষণ ওইভাবে চিত্রার্পিতের মতো প্রকৃতির অপরূপ রূপ দেহে মনে অনুভব করেছিলাম জানি না। একসময় দেখি পাহাড়ের তলদেশ থেকে আবার পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘরাশি ধীরে ধীরে উঠে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল মণিমহেশ কৈলাশ শৃঙ্গ।
মনে অপার আনন্দ তৃপ্তি নিয়ে ফিরে আসি আস্তানায়। বৃষ্টি নামে জোর। উচ্চতাজনিত কারণে বা সফল অভিযানের উত্তেজনায় ভাল ঘুম আসে না। অনেক রাতে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়াই। দেখি মেঘমুক্ত আকাশে চাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। আজ আপশোস করি, তখন কেন একবার তাঁর দিকে তাকাইনি। আবার মনে হয়, থাক কিছুটা অদেখা কিছুটা অধরা। পরদিন বৃষ্টি মাথায় নিয়েই নামতে থাকি। কিছুদূর নামার পর বৃষ্টি কমলে পিছন ফিরে শেষবারের মতো তাকাই। দেখি মেঘমুক্ত নীল আকাশে তাঁর ধ্যানগম্ভীর রূপ। তবে হ্যাঁ, যে মানুষটি বিশ্বাসের দর্পে আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন এবং আমাদের সুপ্তি ভাঙিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন সেই বিশালের সামনে, তাঁকে আর দেখতে পাইনি।
পেশায় অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী। নেশা বহুল। গ্রুপ থিয়েটার, পাখির ছবি তোলা আর পাহাড়ে পাহাড়ে ভ্রমণ তার মধ্য়ে তিন। খেপে ওঠেন সহজে। হেসে ওঠেন গরজে! খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসেন। আর পছন্দ টেলিভিশন দেখা!
খুব ভালো লাগলো। এই তীর্থে পথিক কম কিন্তু যে মানুষেরা সাহস করে যান , প্রকৃতি তাদের হৃদয় ও মন ভরিয়ে দেয় ।