আসা যাওয়ার পথে রোজই চোখে পড়ে দোকানটা। কাচ দিয়ে মোড়া। সাদা দরজাটা আর কাঠের প্যানেলটুকু ছাড়া, পুরোটাই কাঁচের। ভেতরে বিভিন্ন আকারের শেল্ফে রাশিকৃত বই। এমনভাবে সাজিয়ে রাখা, যাতে পথচলতি যে কেউ বাইরের কাচে নাক লাগিয়ে পড়ে ফেলতে পারে বইয়ের নামগুলো। আমি একবার সে রকমভাবেই দেখে নিয়েছি, বইগুলো সবই স্প্যানিশে। আর তাতেই কৌতূহলটা কয়েকগুণ বেড়েছে। কারণ আর কিছুই নয়। দোকানের নাম। দোকানের মাথায় কাঠের চওড়া সাদা প্যানেলের ঠিক মাঝখানে একটু পুরনো ধাঁচের ফন্টে লেখা – TAGORE ।

স্পেনের দক্ষিণপ্রান্তে এই ছোট্ট গ্রানাদা শহরে এই নামের একটা বইয়ের দোকান থাকবে, সেটা একটু আশ্চর্যের ব্যাপারই বটে। নোবেল প্রাইজের পর ইউরোপ জুড়ে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটা তুমুল হইচই হয়েছিল, বিশ শতকের প্রথম গ্লোবাল লিটারারি আইকন তিনিই। তবে পরবর্তী কালে সেই উন্মাদনা অনেকটাই থিতিয়ে যায়। আমাদের নিয়ত যাপনের মধ্যে তাঁর উপস্থিতি অমোঘ, কিন্তু বাংলার বাইরে রবীন্দ্রনাথ খুব চর্চিত ব্যক্তিত্ব নন অনেক বছর ধরেই। আর যতদূর জানি, ইউরোপের বহু দেশে গেলেও, স্পেনে কখনো আসেননি রবীন্দ্রনাথ। তাহলে? খটকাটা রয়েই গেল। সকালে যখন বেরোই দোকানটা তখন খোলেইনি, আর সন্ধেতেও ঝাঁপ বন্ধ দেখলাম দু’দিনই, সাদা দরজায় একরত্তি একটা চাবি লাগানো, ভেতরে উজ্জ্বল হলুদ আলোর মধ্যে একরাশ বই ছাড়া কেউ নেই।
এদিকটা একটু হঠাৎ করেই চলে আসা হয়েছে এবার। মূল গন্তব্য মরক্কো, ছবি তোলার কাজে। তার আগে স্পেনটা একটু ছুঁয়ে যাওয়া যাক – এই ভাবনায় বার্সেলোনা আর মাদ্রিদ ঘুরে দেখা গেল কয়েকদিন সময় আছে হাতে। মাদ্রিদ থেকে ঘণ্টা চারেকের বাসপথ, আন্দালুসিয়ার রুক্ষ মাঠপ্রান্তর পেরিয়ে পৌঁছনো গেল গ্রানাদা শহরে।

দুনিয়াজুড়ে গ্রানাদার খ্যাতি আলহামব্রার কারণে। সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালার নিচে তেরো শতকের দুর্গ, তৈরি করেছিলেন নাসরিদ বংশীয় সুলতানেরা। আন্দালুসিয়ায় তখন আরবদের রাজত্ব। বাইরের লাল দেওয়াল আর মূল প্রাসাদগুলো, যাদের দেখলে আমাদের দেশের মধ্যযুগের ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের কথা মনে পড়বেই, সেগুলো সেই আমলেই তৈরি। পঞ্চদশ শতকের শেষে রাজনৈতিক পালাবদলের পর আলহামব্রা হবে স্পেনের রাজা-রানি ফার্দিনান্দ আর ইসাবেলার রয়্যাল কোর্ট। স্থাপত্যশৈলিতেও কিছু পালাবদল ঘটেছিল, স্বাভাবিক ভাবেই, তবে মূল ধাঁচটা বদলানো হয়নি।

আলহামব্রার বাগানও পৃথিবীবিখ্যাত। তবে গাছপালা ছেঁটেকেটে তাদের নানা রকম কৃত্রিম চেহারা দেওয়ার ব্যাপারটা আমার কোনদিনই খুব উচ্চাঙ্গের আর্টফর্ম বলে মনে হয় না। আমি বরঞ্চ মুগ্ধ হয়ে গেলাম সাঁ নিকোলা প্লাজা থেকে আলহামব্রা দেখে। বিশাল চত্বরটার চারদিক থেকে ভেসে আসছে অন্তত আট-দশটা ভাষার কলকল শব্দ, গান আর গিটারের আওয়াজ। আর তার মধ্যে, দূরে, সিয়েরা নেভাদা পাহাড়ের বরফকে একরাশ লাল মাখিয়ে সূর্য ডুবল। তার পরেও সেই আশ্চর্য রং জেগে রইল অনেকক্ষণ, সারা আকাশ জুড়ে আর আলহামব্রার মাথায়, আরবি ভাষায় যে নামের অর্থ ‘লাল দুর্গ’।
শহরটার পুরনো অংশে পায়ে চলা রাস্তাটার নাম কারেরা দেল দারো। ছন্দময় নামটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একপাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে একচিলতে দারো নদী। এখানেই এক্টু রাতের দিকে ফ্ল্যামেঙ্কো নাচের অনুষ্ঠান। আন্দালুসিয়ার একেবারে নিজস্ব এই নাচে অনুষঙ্গ হিসেবে থাকে একটি গিটার, এবং একজন মাত্র গায়ক, যার গলা হতে হবে বেশ চড়া আর রুক্ষ। মেলোডির কোনও জায়গা নেই কিন্তু ফ্ল্যামেঙ্কোর গানে। সুরটা খেলছে মধ্যবয়সিনী ফ্ল্যামেঙ্কো শিল্পীর সারা শরীরে। হাত আর কাঁধের মুদ্রায় স্টেজ জুড়ে হিল্লোল তোলার সময়েও শরীরের নীচের অংশ থাকছে স্থির। কালো রঙের জুতোজোড়া কাঠের স্টেজে অসম্ভব ঝোড়ো ছন্দের পারকাশন তৈরি করে চলেছে। গিটার বন্ধ, সঙ্গত করছে শুধু দু’হাতের তালি আর তুড়ি। গোটা হল একদম চুপ। সেই গুপি-বাঘার গানের সময়ের মতন। নড়াচড়া প্রায় নেই।

অনুষ্ঠান শুরুর আগে সেরকমই নির্দেশ জারি করা আছে। নাচের কঠিন তাল যাতে না কাটে, সেজন্যেই। এমন সময় ছোট্ট একটা গোলমাল বাধালেন আমার পাশের ভদ্রলোকটি। ষাটের কোঠায় ভারভার্তিক মানুষ। তিনি উদ্বেলিত হয়ে নাচের তালে হাততালি দেওয়া শুরু করলেন। মুশকিল হল, তাঁর আবেগ যতটা, তালজ্ঞান ততটা বোধহয় নয়। ফ্ল্যামেঙ্কো-সুন্দরী নাচ থামিয়ে, কোমরে হাত রেখে একটা অপরূপ হাসির সঙ্গে ভ্রূভঙ্গি করে কিছু বলতেই চারদিকে চাপা হাসির হররা। ভদ্রলোক কিন্তু একটুও অপ্রতিভ না হয়ে, স্মার্টলি উঠে দাঁড়িয়ে একটা বড়রকমের ‘বাও’ করে বসে পড়লেন। বাকিটুকু নির্বিঘ্নেই কাটল। অনুষ্ঠানের পর হোটেলে ফিরলাম মধ্যরাতে, মিনিট পনেরোর হাঁটাপথ। গ্রানাদা একদম ঝুটঝামেলাহীন শহর, ক্রাইম রেট প্রায় শূন্য।
অবিশ্যি গত শতকের তিরিশের দশকের সময়টায় এই শান্ত, নিরুপদ্রব ছবি কল্পনাও করা যেত না। স্পেনের তিন বছরের গৃহযুদ্ধের (১৯৩৬-১৯৩৯) একটা প্রধান ভরকেন্দ্র ছিল এই গ্রানাদা। ফ্যাশিস্ট জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে বামপন্থী রিপাবলিকানদের গেরিলাযুদ্ধে স্পেনে মারা যান প্রায় দু’লক্ষ মানুষ, তার মধ্যে সাতাশ হাজার গ্রানাদায়। এই সেই যুদ্ধ যাকে পরবর্তী ইতিহাস চিহ্নিত করবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘ড্রেস রিহার্সাল’ নামে। দক্ষিণপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ে সামিল হবেন দুনিয়ার কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা। ফ্রন্টে গিয়ে আহত হবেন ফরাসি ঔপন্যাসিক আন্দ্রে মালরো। আর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত কলম হাতে হেমিংওয়ে লিখে ফেলবেন তাঁর অমর উপন্যাস ‘ফর হুম দ্য বেল টোলস’।
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা এসব কিছুই দেখে যাননি। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই গ্রানাদা এতটাই উত্তপ্ত ছিল যে, শহরে কোনও মেয়র ছিলেন না অনেক মাস। লোরকার একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মেয়র পদে বসার এক সপ্তাহের মধ্যে নিহত হলেন, আর তার পরেই লোরকাকে নিজের বাড়ি থেকে অপহরণ করল ফ্যাশিস্ট বাহিনী। ১৯শে অগাস্ট, ১৯৩৬। গ্রানাদা শহরের বাইরে একটা কবরস্থানে খুন হয়ে গেলেন ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। তখন তাঁর বয়েস ৩৭, স্প্যানিশ ভাষার উজ্জ্বলতম তরুণ কবি ও নাট্যকার, তাঁর কাব্যভাষা তখন তাঁর বিখ্যাত জিপসি-ফ্ল্যামেঙ্কো কবিতা সিরিজ ছাড়িয়ে নতুন দিগন্তে উড়াল দিচ্ছে।

স্পেনের অন্যতম প্রধান এই কবির মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি কোনওদিন। কিন্তু গ্রানাদা শহর লোরকাকে মনে রেখেছে। গ্রানাদা ক্যাথিড্রাল থেকে বেরিয়েই রাস্তাটা যেখানে ডাইনে বাঁক নিয়েছে, সেখানে সাদা লম্বাটে চেহারার একটা বাড়ি। তার নিস্তব্ধ ঘরগুলোয় আর্কাইভ করা আছে লোরকার যাবতীয় কাজ। এটাই ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা সেন্টার। সাহিত্য-ফিল্ম-নাটক ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ড ছাড়াও ছোট ছেলেমেয়েদের জন্যও বিভিন্ন ওয়র্কশপ করে এরা। লোরকা শিশুদের অসম্ভব ভালবাসতেন। অন্যান্য কাজের ফাঁকে সংগ্রহ করেছেন প্রাচীন সব ঘুমপাড়ানি ছড়াগান, কবিতার বই লিখেছেন ছোটদের জন্য। সেন্টার থেকে বেরলাম তখন প্রায় সাড়ে সাতটা। পড়ন্তবেলার রোদ পড়েছে গ্রানাদা ক্যাথিড্রালের রঙিন জানলায়। ভেতর থেকে ভেসে আসছে অরগ্যানের গম্ভীর সুর, বাইরে খোলা চত্বরে কফির গন্ধ। এসব হাতছানি এড়াতে হবে আজ। কাল একেবারে ভোররাত্তিরের উড়ান।

আর একটু এগিয়েই দেখি ডানধারে সেই বইয়ের দোকানটা আজ খোলা!
একরাশ হলুদ আলোর মধ্যে একা বসে একটা বইয়ের মধ্যে ডুবে আছেন এক বৃদ্ধ। ঢুকতেই চমকে তাকালেন। তারপর একটা নিঃশব্দ, প্রসন্ন হাসি ছড়িয়ে বললেন ‘ইন্ডিয়া’?
দেখলাম হাতের চটি বইটা ‘এল কার্তেরো দেল রে।’ ১৯১১ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকের স্পেনীয় তর্জমা, যেটা করেছিলেন নোবেলজয়ী কবি হুয়ান রামোন হিমেনেথ আর তাঁর স্ত্রী জেনোবিয়া কামপ্রুবি। রবীন্দ্রনাথের বাইশটা কাজের অনুবাদ করেছিলেন এই স্প্যানিশ কবি দম্পতি। ভারতীয় কবির লেখা ছিল তাঁদের মধ্যেকার অন্যতম সেতুবন্ধ। সব বইগুলোই রয়েছে এই ‘লাইব্রেরিয়া টেগোর’ দোকানটিতে। বিদায় নেবার সময় বৃদ্ধ আবার সেই চমৎকার হাসিটা হেসে বললেন ‘একটা আফসোস রয়ে গেছে, বাংলাভাষাটা জানা থাকলে টেগোরের সমস্ত লেখাই পড়তে পারতাম।’
বাইরে বেরিয়ে দেখি, দিনশেষের আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে গ্রানাদার পথঘাট। গৃহযুদ্ধ, রক্তক্ষয়ের স্মৃতি পেরিয়ে যে শহর এখন ইউনেস্কোর সিটি অফ লিটারেচার।
ফোটোগ্রাফার। লেখক। ইন্দোনেশিয়ার সালফার শ্রমিকদের ওপর ছবি তুলতে নেমেছেন আগ্নেয়গিরির মধ্যে, কাশ্মীরের মানুষের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখবেন বলে বারবার ফিরে গেছেন অশান্ত উপত্যকায়, চীন-ভিয়েতনামের অচেনা জায়গায় ঘুরে বেড়ান নতুন গল্পের খোঁজে। সেইসব লেখা-ছবি নিয়মিত বেরোয় দেশবিদেশের পত্রিকা-জার্নালে। তার মধ্যে আছে আল জাজিরা, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ট্রাভেলার, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স ম্যাগাজিন। প্রকাশিত কফিটেবল বই ‘অ্যান অ্যান্টিক ল্যান্ডঃ আ ভিসুয়াল মেমোয়ার অফ লাদাখ’। নির্ভেজাল আরাম পান আড্ডা দিয়ে, আর বাংলায় লেখালেখি করে। আদ্যন্ত দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা, তবে উত্তরের পুরনো বাড়ি, অলিগলি আর তার প্রাচীন কাফেগুলোর ওপর প্রবল টান।
বেশ একটা আমেজ আছে লেখাটার মধ্যে।