১৯৭০ সালে শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ফেলুদা’র গোয়েন্দা উপন্যাস ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’–এ প্রথম পড়েছিলাম নর্থ সিকিমের কথা, যেখানে ন’হাজার ফিট উঁচুতে লাচুং আর লাচেন নামের দু’টো অসম্ভব সুন্দর জায়গার উল্লেখ আছে। যে খুনটা নিয়ে এই গপ্পো সেটাও আবার হয়েছিল ওই নর্থ সিকিম হাইওয়ের ওপরেই। সে যাত্রায় ফেলু মিত্তির না গেলেও বাঙালি টুরিস্ট কিন্তু ওই অঞ্চলে নিয়মিত ভিড় জমাতে শুরু করে বছর দশ-পনেরোর মধ্যেই। অনেকটাই চিন-সীমান্ত বলে নর্থ সিকিম যাওয়ায় বরাবর একটু কড়াকড়ি আছে, তবে ভারতীয়দের পারমিট পেতে তেমন অসুবিধে হয় না। অবশ্য এসব হ্যাপা পোয়ানোর জন্য গ্যাংটকে ঝুড়ি ঝুড়ি ট্যুর অপারেটর ব্যবসা ফেঁদে বসেছে, মাথা পিছু টাকা ফেললে ওরাই পারমিট, যাতায়াত, থাকা-খাওয়া আর ঘোরানোর বন্দোবস্ত করে দেয়। মেরেকেটে দু‍’ থেকে তিন দিনের ঝটিকা সফর হয় এগুলো।

২০০৪ সালে এ ভাবেই আমরা একটা বড় দলে লাচুং আর ইউমথাং ভ্যালি ঘুরে এসেছিলাম। ভালোই মজা হয়েছিল, কিন্তু ছবি আঁকার একেবারেই সুযোগ পাইনি বলে আমার ভেতরের ছটফটানিটা কিছুতেই যাচ্ছিল না। অতএব ঠিক করলাম এ বার একবার নিজের মতো করে লাচেন-এ গিয়ে টানা কয়েকদিন থাকব আর চুটিয়ে এঁকে বেড়াব। অতএব লেগে পড়লাম সুযোগ সন্ধান করতে। খবরের কাগজে কাজ করি, ফলে আমাদের ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর সিকিম-রিপোর্টার পেমা সেংদোরপা-র সঙ্গে যোগাযোগ হল। আমি কে, কেন যাচ্ছি, কতদিন থাকব সব ফিরিস্তি ওকে পাঠিয়ে দিলাম। গ্যাংটক-এ বসে পারমিট জোগাড় করার ব্যবস্থা ও-ই করবে, ওখানে গিয়ে আমাকে নিয়ে নিতে হবে। মিস্টার দাস বলে বিএসএনএল-এর একজনকে পেলাম যিনি লাচেন-এ কাটিয়েছেন অনেক বছর।উনি নম্বর দিলেন ওখানকার স্থানীয় পোস্ট মাস্টার লাচেনপা-র। ফোন করে কথা বললাম। শান্ত ভাবে জানালেন ‘আসুন,আপনার থাকার ব্যবস্থা করা থাকবে।’

lachen sketch by debasis deb
লাচেনের জিপ স্ট্যান্ড

সুতরাং মাভৈঃ বলে ট্রেনে চেপে ২০০৭-এর পয়লা ডিসেম্বর হাজির হলাম প্রথমে গ্যাংটক। শহরের উত্তরপ্রান্তে ‘বজ্র’ সিনেমা হলের কাছেই হল নর্থ সিকিমের জিপ স্ট্যান্ড। দাসবাবু ওর পাশেই একটা হোটেলে বলে রেখেছিলেন। ওখানে গিয়েই পেমাকে ফোন করে দিলাম। বিকেলের মধ্যেই পারমিট হাতে এসে গেল। পেমার কথামতো বেশ কয়েকটা ফটোকপি করিয়ে নিলাম। পথে বারবার দিতে হবে কিনা।

পরদিন গাড়ি ছাড়তে আটটা বাজল। আমি অনেক বলে-কয়ে সামনে ড্রাইভারের পাশে বসতে পেলাম ঠিকই কিন্তু ব্যাটার জ্যাকেটের বোঁটকা গন্ধের ঠ্যালায় পথে সিংঘিক থেকে অত ভালো হিমালয়ের দৃশ্যটা পর্যন্ত উপভোগ করা গেল না। লাচেন পৌঁছতে দুপুর আড়াইটে বাজল। শহরে ঢোকার পর থেকেই দেখছিলাম জায়গায় জায়গায় ছোটবড় জটলা আর চারদিক লাল রংয়ে যেন ভেসে যাচ্ছে। ব্যাপার কিছুই না, এখানে প্রতি বছর ডিসেম্বরের দুই আর তিন তারিখে সবাই যে যার নিজেদের পোষা ইয়াকগুলোকে জবাই করে মাংসটাকে জারিয়ে রেখে সারা বছর ধরে খায়। সব্বোনাশ! আমাকে দু’দিন ধরে এই রক্তগঙ্গা দেখতে হবে? গন্ধগোকুল ড্রাইভারটি অবশ্য দাঁত বের করে আশ্বস্ত করল ‘ভালোই তো, আপনি টাটকা ইয়াকের মাংস খেতে পাবেন!’

skettches by Debasis Deb
লাচেন গুমফা যাওয়ার রাস্তা

বেশ দুর্গম জায়গা হলে কী হবে, লাচেনে দেখলাম জনবসতি মন্দ নয়। চারদিকে আকাশছোঁয়া পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঘরবাড়ি ঠাসাঠাসি। একপাশে গভীর খাদ নেমে গেছে লাচেন চু বা নদী অবধি। মাঝখান দিয়ে শহরের প্রধান রাস্তাটা আরও উত্তরে ঠেলে উঠেছে। এই রাস্তাটাকে ঘিরেই যত দোকান, হোটেল, পুলিশ-চৌকি আর লাচেনপা-র পোস্ট অফিস। সবাই দেখিয়ে দিল, পানের দোকানের থেকে একটু বড় সাইজের কাঠের ঘর। ওপরে বোর্ডের লেখা আর পাশে লাল পোস্টবক্সটা না থাকলে বোঝার উপায় নেই। তবে অফিসে আপাতত তালা ঝুলছে। কাছেই লাচেনপা-র বাড়ি। খুঁজে পেতে গিয়ে হাজির হলাম। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে গিন্নি ছিলেন। লাচেনপা গেছেন কালিম্পং। বড় দুই মেয়ে ওখানেই পড়ে। শীতের ছুটিতে বাড়ি নিয়ে আসছে, ফিরতে রাত হবে। আমি কোন হোটেলে থাকব গিন্নিই বলে দিলেন। আমিও সেই মতো গিয়ে হাজির হলাম ‘গুরুদোংমার লজ’-এ।

দিব্যি হোটেল, দিব্যি ঘর, সামনে টানা বারান্দা, চারদিকে চমৎকার দৃশ্য, অফ-সিজন ডিসকাউন্ট… আর কী চাই। আমি ছাড়া লোক বলতে শুধু সুমন, যে একাধারে রাঁধুনি থেকে খিদমদগার। সারাদিন খাওয়া হয়নি শুনে ছোকরা বোঁ করে এক প্লেট ইয়াকের মাংস ভেজে নিয়ে এল। আরে! এ তো মেঘ না চাইতেই জল নয়, একেবারে আখের সরবত! নিচের লাউঞ্জে বিকেলের পর অনেকেই আড্ডা দিতে আসে, ঢুকুঢুকু চলে আর চাট হিসেবে থাকে এই মাংস। হোটেলের মালকিন মিসেস নাংপা নিজেই সব তদারক করেন, বয়স চল্লিশের আশে পাশে, বেশ চটপটে আর মিশুকে। তখনও নিজের মোবাইল ফোন হয়নি, ওঁর নম্বরটাই বাড়িতে দিয়ে রেখেছিলাম। গিন্নি ক’দিন ওখানেই মাঝে মাঝে ফোন করে আমার খবর নিতেন।

skettches by Debasis Deb
লাচেন গুমফা

পরদিন সকালেই লাচেনপা সশরীরে উপস্থিত। চশমা পরা, কমবয়সি, ভদ্র-নিরীহ গোছের চেহারা। বলল ‘চলো তোমায় এখানকার গুম্ফা দেখিয়ে আনি।’ পাহাড়ের আরও ওপর দিকে কিছুটা ফাঁকা জায়গায় রয়েছে ‘গেনুরুপ চোলিং’ গুম্ফা। সিঁড়ি ভেঙে শর্টকাট রাস্তা দিয়ে লাচেনপা

skettches by Debasis Deb
রিংঝিং লাচেন পা

নিয়ে গেল। পথে ভুট্টার মতো হলুদ ফলওলা একটা গাছ দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। লাচেনপা জানাল এর নাম ‘দারুপ।’ ফলগুলো দিয়ে ওষুধ তৈরি করে। এমনিও খাওয়া যায়। প্রচুর ভিটামিন সি। লাচেন ছাড়া শুধুমাত্র লাদাখ আর চিনেই এই গাছ হয়। গুম্ফার ভেতর আর বাইরেটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বেশ ফাঁকাই। লাচেনপা বলল, প্রতি বছর জানুয়ারির গোড়ায় লোসোং উৎসবে এখানে ঘটা করে লামাদের মুখোশ-নৃত্য হয়। নিয়ম করে ন’ তারিখে ধর্মীয় বই-টই নিয়ে শোভাযাত্রা করে। গুম্ফার সামনে থেকে নিচে গোটা লাচেন শহরের পিছনে পাহারাদারের ভঙ্গিতে দাঁড়ানো পাহাড়ের সাদা সাদা চুড়োগুলো দেখে বুঝলাম এ মরসুমের বরফ পড়া শুরু হয়ে গেছে।

এখানে এসে পর্যন্ত খাতা খোলা হয়নি। চটপট একপাশে বসে পড়লাম গুম্ফা আঁকব বলে। লাচেনপা তো থ। বলল, ‘দেন ইয়ু আর অ্যান আর্টিস্ট! তোমাকে আমাদের পিপন-এর কাছে নিয়ে যাব, হি লাভস আর্ট।’ আগেই শুনেছিলাম এ সব অঞ্চলে সমান্তরাল ভাবে একটা শাসনব্যবস্থা চালু আছে। লোকেরা ইচ্ছেমতো এক জনকে বছর চারেকের জন্য তাদের মেয়র হিসেবে বেছে নেয়। এই মেয়রকেই বলা হয় পিপন। তাঁর আদেশই সবাই মেনে চলে। ঠিক হল আজ বিকেলেই যাব পিপন-দর্শনে। লাচেনপা-র দেখলাম এবার একটু ইতস্ততঃ ভাব। বলল, “ওখানে সবার সামনে আমাকে কিন্তু ‘রিংঝিং’ বলে ডেকো, ওটাই আমার নাম।”

তাহলে লাচেনপা? জানা গেল, এখানে সবাই হল লাচেনপা, মানে লাচেন-এর ছেলে। তাহলে এ বার বলতো রিংঝিং-এর মানে কী? এতক্ষণে মুখে হাসি ফুটল পোস্টমাস্টারের… ‘এ জোভিয়াল পার্সন।’     (চলবে)

Debashis Dev

স্বনামধন্য এই অঙ্কনশিল্পী নিজেই এক সম্পূর্ন প্রতিষ্ঠান | তাঁর হাত ধরে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে বাংলার কার্টুন শিল্প | সিগনেচার বেড়াল আর স্ব-নেচারটি কোমল, আত্মবিশ্বাসী, রসিক | বেড়ানো তাঁর নেশা | তাই ঝুলিতে রয়েছে বহু গল্প, সঙ্গে অসাধারণ সব স্কেচ | সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিরলস সাধনার অমর ফসল ‘রঙ তুলির সত্যজিৎ’ |

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *