সঞ্জয় মহা উত্তেজিত হয়ে এসে জানাল এবার যেখানে পোস্টিং পেয়েছে, কোয়ার্টারের জানলা দিয়ে নাকি পাহাড় দেখা যায় আর সামনে কোনও দোতলা বাড়ি নেই। সঞ্জয় একইসঙ্গে আমার স্কুলের এবং পাড়ার বন্ধু। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হয়ে বহুবছর ধরে কাটিয়েছে যতসব উল্টোপাল্টা জায়গায় যার একটাও আমার বেড়াতে যাবার পক্ষে তেমন সুখকর ছিল না। সঞ্জয়ের নতুন ঠিকানা হল, পাহাড় আর আদিবাসী অঞ্চলে ঘেরা রেলনগরী চিত্তরঞ্জন। বেশ স্বাস্থ্যকর, খোলামেলা পরিবেশ আর আশপাশে ঘুরে দেখার জায়গাও প্রচুর। ঢালাও নেমন্তন্ন তো ছিলই, তার ওপর ওর এই বর্ণনা শুনে আর গড়িমসি করা গেল না। পিঠব্যাগ গুছিয়ে আগস্টের শেষাশেষি বেরিয়ে পড়লাম।
হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেখলাম বিপত্তি। যে ট্রেনে যাব সেই জনশতাব্দী বাতিল। অগত্যা অন্য ট্রেন নিতে হল এবং সেটা ছাড়ল অনেক দেরিতে। কাজেই চিত্তরঞ্জন পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল। সঞ্জয় ওর সাধের রয়াল এনফিল্ড বাইক নিয়ে স্টেশনে হাজির ছিল। আমাকে পিছনে বসিয়ে প্রবল উৎসাহে বলল ‘চল আগে রেশন তারপর কোয়ার্টার।’ সাঁ সাঁ করে বাইকে চেপে চিত্তরঞ্জনের চৌহদ্দি পেরিয়ে বেশ দূরে ছোট বাজার মতো এলাকায় একটা বিলিতি মদের দোকানের সামনে গিয়ে থামলাম আমরা। ‘পার্থ কোথায়?’, বাইক থেকে নেমে হাঁক পাড়ল সঞ্জয়। জালের গেট খুলে হাঁইমাঁই করে বেরিয়ে এল কর্মচারী গোছের একজন। ‘স্যার আসুন, ছোটবাবু এখনই এসে যাবেন। আপনারা ততক্ষণ ভেতরে বসুন।’

দোকানের পিছনে মদের পেটি বোঝাই একটা ছোট ঘরে বসলাম আমরা। বেশ মজা লাগছিল, কারণ সঞ্জয় নিজে কস্মিনকালেও নেশাভাং করেনি। স্রেফ আমাকে আপ্যায়ন করবে বলে গেরামভারী ব্যাঙ্ক ম্যানেজার হয়েও মদের আড়তে ঢুকে পড়েছে। মিনিট পনেরো বাদেই হাত কচলাতে কচলাতে পার্থ এল। ততক্ষণে আমি ওই অবস্থায় সঞ্জয়ের একটা ছবি এঁকে ফেলেছি। ‘ভালো স্কচ কী আছে দেখি’… প্রায় হুকুমের সুর সঞ্জয়ের। পার্থ সেকেন্ডের মধ্যে ফটাফট আধ ডজন বোতল সামনে সাজিয়ে দিল আর সঞ্জয় একটা ভ্যাট ৬৯ তুলে নিয়ে আমায় বলল ‘চলবে?’। এসব ব্যাপারে আমি খুব কিছু শৌখিন নই। বলতে গেলে নেহাতই ছাপোষা গোছের। তবু ওর দাপট দেখে আর কথা বাড়ালাম না।
ব্যাঙ্কের ওপরেই তিনতলায় ঢাউস ফ্ল্যাট সঞ্জয়ের। বউ ইন্দ্রাণী অন্যত্র অধ্যাপনা করে, তাই ও এখানে একাই থাকে। দু’দিকে জানলাওলা একটা বড় ঘর আমার জন্য রাখা ছিল। সামনের ছাদটাও বেশ ছড়ানো। সঞ্জয় কিছু বাড়িয়ে বলেনি, জানলা দিয়ে বাইরেটা যতদূর দেখা যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। একপাশে সরু পিচের রাস্তার ধার বরাবর ছাড়া ছাড়া রেলের একতলা পুঁচকে কোয়ার্টারগুলো গাছের আড়ালে প্রায় অদৃশ্য হয়ে আছে। আর মাইলখানেকের মধ্যেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে কানগোই পাহাড়। প্রথম দিন সকালেই হাঁটা দিলাম পাহাড়ের মাথায় শিবমন্দির আছে সেটা দেখব বলে। কিছুটা বাঁধানো সিঁড়ি। তারপর গাছপালার ফাঁক দিয়ে অনেকখানি চড়াই উঠে মন্দির। বেশ রুগণ চেহারা, চারদিক খাঁ খাঁ করছে। বুঝলাম পালাপার্বণ ছাড়া এখানে তেমন ভক্ত সমাগম হয় না। একপাশে বিরাট গোদা সাইজের সব পাথর থাকে থাকে সাজানো, খাঁজে পা রেখে খানিক কসরত করে একেবারে টংয়ে উঠে একটা চ্যাপ্টা ঢিপির ওপর যেই বসলাম, ওমনি মহাশূন্যে ভেসে থাকার মতো দারুণ একটা অনুভূতি হতে শুরু করল গোটা শরীরে। অনেক নীচে সুতোর মতো রেললাইন, ফুটকির মতো কিছু ঘরবাড়ি, সবুজ ছোপ ছোপ গাছপালা ক্রমশ ধূসর হয়ে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছি আর কেমন যেন মনে হচ্ছে গোটা জায়গার মালিকানা শুধু আমার একার। ফেরার পথে মন্দিরের সামনে একটা ছেলেকে জলের বালতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। এখানকারই কেউ হবে। নির্লিপ্তভাবে আমায় বলল ‘ওদিকটায় সাপ খোপ আছে, কেন গেলেন?’ ভাগ্যিস এই খবরটা আগে পাইনি তাহলে সব মজাই মাটি হয়ে যেত।

হপ্তার মাঝে গেছি। ফলে ম্যানেজারবাবু সকাল থেকে সন্ধে ঘোর ব্যস্ত থাকতেন ব্যাঙ্ক নিয়ে আর আমি নিজের মনে ঘুরে বেড়াতাম এদিক ওদিক। এখান থেকে অজয় নদ খুব দূরে নয়। অনায়াসে হেঁটে চলে গেলাম একদিন রান্নার মাসির তৈরি গরম গরম লুচি আলুর দম খেয়ে। বেচারা সঞ্জয় ওটাই খাবে ন্যাতানো অবস্থায় দুপুরবেলা, যদি অবশ্য কাজ ফেলে উঠে আসতে পারে। যাবার পথে একবার ঢুঁ মারলাম দেশবন্ধু লোকো পার্কে। বাড়ির সবাইকে নিয়ে সময় কাটাবার সুন্দর জায়গা, একটা গোটা রেল ইঞ্জিন-এর মডেল ছাড়াও বাচ্চাদের জাঙ্গল জিম, দোলনা ইত্যাদি খেলবার নানা উপকরণ দিয়ে সাজানো। পার্ক লাগোয়া একটা বড় ঝিলে রয়েছে প্যাডেল বোটিংয়ের ব্যবস্থা। তবে এখনকার চলতি ভাষায় আমার এটা রেইকি হয়েছিল কারণ ঠিক পরের বড়দিনের ছুটিতেই সপরিবার চিত্তরঞ্জনে এসে তুমুল হইচই করার ফাঁকে এই পার্কেও একটা গোটা সকাল কাটিয়েছিলাম। মনে আছে, ওখানে ছেলের সামনে হিরোগিরি দেখাতে গিয়ে অনেক উঁচু একটা রড ধরে ঝোলার সময় জং ধরা লোহায় হাত কেটে যায়। ফলে ডাক্তার-বদ্যি, অ্যান্টিটিটেনাস ইঞ্জেকশন কিছুই বাদ যায়নি।
অজয়ের ধারটা অবশ্য অতি মনোরম জায়গা। যদিও বর্ষাকাল, তবু জল তেমন নেই। মাঝেমাঝে চড়াও পড়েছে অনেক। নদীটাই বর্ডার। ওদিকটা হল ঝাড়খণ্ড। সারাক্ষণ লোকে জল মেপে এপার- ওপার করছে। অনেকের মাথায় ঝুড়ি, বস্তা কিংবা সাইকেল চাপানো। একপাশে রয়েছে চানের ঘাট। মাথার ওপর রোদ চড়ছে। বড় বড় পাথরের চাঁই গজিয়ে উঠেছে জলের ধারে। ছায়া দেখে বসে পড়লুম ছবি আঁকব বলে। হায় কপাল! ব্যাগের মধ্যে দেখি শুধু খাতাটা ভরেছি। আঁকার বাকি সরঞ্জাম থেকে গিয়েছে বিছানার ওপর। এরকম আগেও হয়েছে, কাছেপিঠে হলে অনেক সময় আবার ছুটেছি আনতে। এক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়। অথচ সামনেই দেখছি ঢালু হয়ে উঠে যাওয়া বালিয়াড়ির কোল ঘেঁষে দু’প্রান্ত জোড়া শুধু সবুজের সমারোহ। মাঝে সরু একখানি মেঠো পথ, একেবারে ফ্রেমে বাঁধানো ছবির মতো হয়ে আছে। খালি মনে পড়ছিল আমার প্রিয় শিল্পী ইন্দ্র দুগারের জলরঙ দিয়ে করা সেই সব মায়াবি ল্যান্ডস্কেপগুলোর কথা।

এই আপশোস অবশ্য সুদে-আসলে পুষিয়ে নিয়েছিলাম এর পরের দিন অর্থাৎ রোববার। সঞ্জয়ের ছুটি, সুতরাং সক্কাল সক্কাল আমাকে বাইকে চাপিয়ে ও বেরিয়ে পড়ল দূরদূরান্তে টহল দিতে। এ অঞ্চলে গুমড়ো পাহাড়ের বেশ খ্যাতি আছে। যেতে হয় অনেকগুলো আদিবাসী গ্রাম পেরিয়ে। সঞ্জয় ওদিকটা চেনে না, তবে কিছুটা খোঁজ খবর নিয়ে রেখেছিল। বাইক ফটফটিয়ে আমরা চিত্তরঞ্জন স্টেশন পেরিয়ে ঢুকলাম মিহিজামে। হোমিওপ্যাথি ডাক্তার বাপ-ছেলে দুই পি.ব্যানার্জির কল্যাণে নেহাতই এলেবেলে এই জায়গাটির নাম বহুকাল যাবৎ বাঙালির ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর শুরু হল জামতাড়া। আমরা ক্রমে ঝাড়খণ্ডের পেটের ভেতর সেঁধোচ্ছি।
রাস্তার দু’ধারে শুধু সবুজ কার্পেটের মতো ধানক্ষেত। মাঝেমাঝে কাশফুলের ঝোপ জানান দিচ্ছে শরৎকাল এল বলে। কুড়ি মাইল যাবার পর এবার কিছুটা দূরে ঝাপসা হয়ে দেখা দিল মাটি ফুঁড়ে আচমকা উঠে দাঁড়ানো আকাশছোঁয়া পাহাড়। সঞ্জয় জানাল, এই গোটা এলাকাটার নামেই পাহাড়ের নাম… বোদমা। ওকে থামতে বললাম ছবি তুলব বলে। বাইক ইতিমধ্যে সামান্য গন্ডগোল শুরু করেছে। ঠিক হল, সঞ্জয় কাছেই কোথাও গিয়ে মেরামত করিয়ে আনবে আর আমি ততক্ষণ এখানে বসে পাহাড়টাকে আঁকব। দূর থেকে বোদমার ঘোলাটে চেহারাটা অদ্ভুত সাররিয়াল বলে মনে হচ্ছিল। সেই সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠছিল জন ফোর্ডের ওয়েস্টার্ন ছবিতে দেখা মনুমেন্ট ভ্যালির সেই অবিশ্বাস্য লোকেশনগুলো।

বাইক সারিয়ে আবার এগনো গেল একে তাকে জিগ্যেস করতে করতে আর সেখানেই যত গন্ডগোল বাধল। বুঝে না বুঝে সবাই যে যার মতো পণ্ডিতি ফলিয়ে ভুলভাল রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছে আর আমরা বেকার ঘুরে মরছি। এদিকে ভাদ্রমাসের পিঠপোড়া গরমে আমাদের তখন হাঁসফাঁস অবস্থা। অবশেষে ঘণ্টা দেড়েক বাদে গুমড়ো পাহাড়ের দেখা মিলল। চিত্তরঞ্জন থেকে জায়গাটা প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে মধুপুরের রাস্তায়। পাথর আর সবুজে ঢাকা বেশ ছড়ানো পাহাড়। শীতকাল জুড়ে এখানে রক ক্লাইম্বিংয়ের হিড়িক পড়ে যায়। সামনের খোলা মাঠে সার সার তাঁবু খাটানো হয়, রীতিমত সরগরম হয়ে ওঠে।

উল্টো দিকে মাধবের চায়ের দোকান। গলা না ভেজালে আর চলছে না। ঠা ঠা গরমের দুপুরেও কিছু লোক বসে গুলতানি করছে। ঝাড়খণ্ড হলেও এরা সবাই কিন্তু বাংলাই চালাচ্ছে। আসার পথে গ্রামগুলোতেও তাই দেখেছিলাম। সঞ্জয় এদের সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে টুকটাক খোঁজখবর নিতে শুরু করল। ব্যাঙ্কের লোক, ফলে এ ব্যাপারে ও চিরকাল ওস্তাদ। আমি একটা গাছের ছাওয়ায় বসে গেলাম পাহাড় আঁকতে। ইতিমধ্যে দুটো বাইকে চেপে গোটা চারেক ছেলে এসে হাজির। মাধবকে তারা একপাশে নিয়ে গিয়ে কথা বলতে বলতে আমাদের দেখাচ্ছে। বুঝলাম আচেনা লোক হলেই এরা খোঁজখবর নেয়। আজ থেকে বছর বারো আগের কথা। তখন সত্যিই ওসব এলাকাজুড়ে রাজনৈতিক ডামাডোল ছিল একবারে তুঙ্গে। তবে যে দলেরই হোক, ছেলেগুলো আমাদের স্বস্তি দিয়ে একটু পরেই বিদেয় হয়েছিল।

আমার পক্ষে পাহাড়ে চড়ার লোভ সামলানো মুশকিল। কিন্তু হাতে সময় কম, এতটা পথ ফিরতে হবে। তার ওপর চড়া রোদে এমনিতেই হাঁপিয়ে উঠেছি। মাধব আবার ভয় দেখাল, এই সময় ওখানে চিতাবাঘ থাকতে পারে বলে। ফেরার পথে কাছেই খয়েরাবনি গ্রাম। রাস্তার পাশেই গির্জা দেখেছিলাম। ভেতরে ঢুঁ মারার ইচ্ছে ছিল। অনেকটা খোলা জায়গার মধ্যে সাদা রঙের বড় কিন্তু আড়ম্বরহীন চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গির্জা। বলতে গেলে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়া স্থানীয় আদিবাসীদের জন্যেই তৈরি। রবিবার বলে হাজিরা ভালই, উপাসনাও হচ্ছে নিয়মমাফিক। তবে লেডিজ আর জেন্টসের জায়গা দেখলাম প্যাসেজের বাঁদিক-ডানদিক এই ভাবে পরিষ্কার আলাদা করা। পবিত্র স্থান, তাই বোধহয় নিজেদের মধ্যে একটা দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছে এরা। প্রার্থনাসভায় ঝলমলে রঙের শাড়ি-জামাকাপড়ে সেজেগুজে আসা মা-বোনেদের সংখ্যা ঢের বেশি এবং বাংলা স্তবগানে এরাই গলা দিচ্ছে একজোট হয়ে। গির্জা থেকে বেরিয়ে বাইকে চাপলাম ফিরব বলে। আমাদের রবিবারের আউটিং আপাতত এখানেই শেষ। কাল থেকে সঞ্জয় আবার ব্যাঙ্কের কাজে ডুব দেবে আর আমিও তখন মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি আগামী দু’দিন কোন পথের পথিক হব।
স্বনামধন্য এই অঙ্কনশিল্পী নিজেই এক সম্পূর্ন প্রতিষ্ঠান | তাঁর হাত ধরে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে বাংলার কার্টুন শিল্প | সিগনেচার বেড়াল আর স্ব-নেচারটি কোমল, আত্মবিশ্বাসী, রসিক | বেড়ানো তাঁর নেশা | তাই ঝুলিতে রয়েছে বহু গল্প, সঙ্গে অসাধারণ সব স্কেচ | সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিরলস সাধনার অমর ফসল ‘রঙ তুলির সত্যজিৎ’ |
দারুণ
চিত্তরঞ্জন এ আমার ছোট থেকে বড় হওয়া। এখনো প্রায়ই আমার এই সব দ্রষ্টব্য জায়গা গুলো দেখার সৌভাগ্য হয়। তোমার আঁকায় ও লেখায় এগুলো যেন আরো ভাবে জীবন্ত হয়ে উঠলো।
My Chittaranjan days became alive. Yesterday once more.
SANJOY