প্রথমে ঠিক ছিল শুধু গালুডি যাওয়া হবে।
সুবর্ণরেখার কাছে বহু বাঙালি তাদের বাড়িগুলোকে হোটেল বানিয়ে ফেলেছেন এবং সেখানে বেশ ঘরোয়া ব্যবস্থা। বছর দশেক আগে ২০০২ সালে বড় দলে গিয়ে গালুডি রিসর্টে ছিলাম। খাসা জায়গা। কিন্তু এবার ওখানে বুকিংয়ের সমস্যা হল। তাই ওরকম একটা বাড়ি কাম হোটেলে বলে রাখলাম। থাকব দিন চার-পাঁচ।

যোগাযোগটা হয়েছিল ‘যারা পরিযায়ী’ পত্রিকার অনির্বাণ মারফত। ওরা ওখানে আগে গিয়েছে, থেকেছে। সেবার রিসর্টের লাগোয়া একটা উঁচু টিলার ওপর বসে জামশেদপুর পর্যন্ত চলে যাওয়া হাইওয়ে আর ঘুরে ঘুরে আশপাশের আদিবাসী গ্রামগুলোর বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলাম। পাহাড়ের কোলে ছড়ানো ঘরবাড়ি লোকজন, পুকুর পাড়, তাল গাছের সারি। রিসর্ট থেকে বেরিয়ে রোজ সকালে ওইসব দিকেই হাঁটা লাগাতাম। একেবারে নির্ভেজাল আদিবাসী মুলুকে গিয়ে স্কেচ করার সুযোগ আমার বলতে গেলে সেই প্রথম। হেলে পড়া খেজুর গাছে বেঁধে রাখা হাঁড়ি নামিয়ে নিয়ে সরু পথ ধরে বাড়িমুখো হয়েছে শুকনো, দড়া পাকানো এক গ্রামবাসী কিংবা ছাগল চরাতে চরাতে ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় কলর বলর করছে, এমন সব মেঠো দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতাও আগে হয়নি।
কিন্তু সময় নিয়ে যে আঁকব, তার উপায় নেই। ওদিকে তখন আমার দলের বাকিরা লাঞ্চের আগে রিসর্টের সুইমিং পুলে নেমে যথেচ্ছ ধুন্ধুমার চালাচ্ছে। আমি ওদের ছেড়ে মাঠে ঘাটে চাষাড়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি, এটা কারও ঠিক পছন্দ হত না। ফলে দুকূল রাখতে গিয়ে এত কাছে সুবর্ণরেখার ধারে সেবার যাওয়াই গেল না।

ফেরার আগের দিন সবাই গাড়ি ভাড়া করে বেরলো দলমা পাহাড়ের দিকটায় হাতি দেখার আশায়। আমি আর গিন্নি কায়দা করে থেকে গিয়েছিলাম ওই সুযোগে নদী দেখতে যাব বলে। কিন্তু এমনই কপাল, দুপুর হতে না হতেই মিছিল করে চারদিক থেকে দলে দলে লোকজন এসে রিসর্টের উল্টো দিকের মাঠে রথের মেলা বসিয়ে দিল। দেখলাম বিরাট তাঁবু পড়েছে, ফেস্টুনে ফেস্টুনে চারদিক ছয়লাপ, রাতভোর এখানে যাত্রা হবে। স্টেশন পেরিয়েই নদীতে যাওয়ার রাস্তা। আর ওদিক থেকেই তখন জনসমুদ্র এগিয়ে আসছে। এর মধ্যে অনেকেই দেখলাম সুটেড বুটেড হয়ে দিব্যি সাইকেল চালিয়ে হাজির হয়েছে। পিছনের ক্যারিয়ারে বেনারসি শাড়ি আর গয়না পরা বউ একমনে স্টিক আইসক্রিম চুষছে। আমাদের আর ভিড় ঠেলে বেরুবার ইচ্ছে হল না। গোটা বিকেলটা একেবারে মাঠে মারা গেল।

এসব কথা ভেবেই ঠিক করেছিলাম এবার ঝুটঝামেলা বাদ দিয়ে স্রেফ একা যাব আর নদীর দিকটায় গিয়ে ইচ্ছেমতো কাজ করব। এর মধ্যে অনির্বাণ আবার বলে বসল ‘পারলে একবার ভালোপাহাড়টাও ঘুরে আসুন না!… এখানে দু’দিন, ওখানে দু’দিন। আমি কমলদাকে বলে রাখছি।’ কমলদা অর্থাৎ কমল চক্রবর্তীর সঙ্গে সামান্য আলাপ ছিল। কলকাতায় বার দু’য়েক কথাও হয়েছে। উনি বান্দোয়ান অঞ্চলে প্রকৃতির মাঝখানে থাকেন। আদিবাসী ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল করেছেন, এইটুকু জানতাম। একবার যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করাতে মানা করেছিলেন। তখন চারদিকে নানা রাজনৈতিক গন্ডগোল লেগে ছিল। তবে ২০০৯-তে সেসব প্রায় শান্ত হয়ে এসেছে।
অনির্বাণের মুখে ভালোপাহাড় শুনে চোখের সামনে একে একে ভেসে উঠল পাহাড়ের সারি, জঙ্গল আর সাঁওতাল গ্রাম। ওকে বলে দিলাম কমলদাকে ফোন লাগাতে। ভোরবেলা ইস্পাত এক্সপ্রেসে রওনা হওয়া গেল। প্ল্যানটা শুধু উলটে নিয়েছিলাম। আগে ভালোপাহাড়, পরে গালুডি। ঝাড়গ্রাম ছাড়াতেই কমলদা ফোনে জানালেন, এই ট্রেনে ওঁর কিছু বন্ধুও চলেছেন একই উদ্দেশ্যে। তারমধ্যে একজন কবি আর একজন গায়ককে হয়তো আমি চিনতেও পারি। ওঁর অনুমান নির্ভুল। গালুডি স্টেশনে নেমে সামনেই দেখি অনিরুদ্ধ সিংহ। সঙ্গে আরও কয়েকজন, যার মধ্যে কবি মন্দার মুখোপাধ্যায়ও রয়েছেন। অনিরুদ্ধ আমার গিন্নির গানের দলের এক জবরদস্ত সদস্য, গায়ক হিসেবে নামডাক আছে এবং যথেষ্ট ফুর্তিবাজ। মন্দারের সঙ্গে আলাপ সামান্যই ছিল, মনে হত মহিলা খুব রাশভারি। কিন্তু এখানে সবাই হইহই করে আমাকে ওদের দলে টেনে নিল। কমলদা গাড়ি পাঠিয়েছেন। আমরা উঠে পড়লাম। এখান থেকে একটা রাস্তা সোজা ঝাড়খন্ড ছাড়িয়ে দুয়ারসিনির পাহাড়, জঙ্গল পেরিয়ে পুরুলিয়ায় ঢুকে গেছে। আর তারপরেই ভালোপাহাড়। পৌঁছতে বোধহয় ঘণ্টা দেড়েক লাগল। তারপর গাড়ি থামতেই খেলাম এক ধাক্কা। আর অমনি সুকুমার রায়ের সেই ছড়াটা মনে পড়ে গেল…
‘ট্যাঁশগরু গরু নয়, আসলেতে পাখি সে…।’
দেখলাম ভালোপাহাড় কোনও পাহাড়ি জায়গাই নয়। খটখটে খোলা সমতল জমির ওপর পাঁচিল ঘেরা বাড়ি, বাগান, পিছনে দোতলা স্কুল সমেত আসলে একটা চালু ‘এন.জি.ও’ যাকে বলে। তবে চারদিকে শালের জঙ্গল আর দূরে তাকালে দেখা যায় ছড়ানো রয়েছে পাহাড়ের সারি। তাছাড়া জানুয়ারির শেষে জমাটি ঠান্ডায় আকাশবাতাসের মেজাজটাই তখন বেশ চনমনে।

সাদা দাড়িগোঁফ আর খাটো ধুতির ওপর সোয়েটার পরা কমলদা ‘জয় বাবা বৃক্ষনাথ’ বলে একটা বড়সড় হাঁক ছেড়ে আমাদের ওয়েলকাম জানালেন। হাতে চামড়ার বেল্টে বাঁধা কালো কুচকুচে ল্যাব্রাডর। এখানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ভালোই। খোলামেলা পরিবেশ। রান্নাঘরটিও অবাধ। ফুলের কেয়ারি করা বাগানের মাঝখানে খড়ের ছাউনি। খাবার কাম আড্ডার জায়গা। একেবারে শেষপ্রান্তে একতলা বাড়ির চারখানা পাশাপাশি ঘর অতিথিদের জন্য বরাদ্দ (ইদানীং যেটা শুনলাম দোতলা হয়েছে)। অনিরুদ্ধ, মন্দার ওদের ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝেমাঝে এসে এখানকার স্কুলের আদিবাসী ছেলেমেয়েদের নাচ, গান শেখায়। ফলে ভালোপাহাড় ওদের প্রায় ঘরবাড়ি।
আমরা গুছিয়ে বসতে না বসতেই মন্দার রান্নাঘরে ঢুকে হাত লাগাল। এসে গেল চায়ের সঙ্গে থালাভর্তি গরম গরম ফুলকো লুচি আর ধোঁয়া ওঠা আলুকপির তরকারি। খেয়েদেয়ে পেট ঠান্ডা হতে কমলদা আমাদের দেখাতে নিয়ে গেলেন ওঁর খেতখামার, মাছ চাষের পুকুর ইত্যাদি। বছরকয়েক আগে জামশেদপুরের বড়ো চাকরি ছেড়ে উনি এই বান্দোয়ান অঞ্চলে এসে এখানকার পিছিয়ে থাকা মানুষগুলোর উন্নতিসাধনে মেতে ওঠেন। জন্ম হয় ভালোপাহাড়ের। সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল শুনেছি, তবে বিস্তারিত কিছু জানা হয়নি।
এরই ফাঁকে আমি জায়গাটার মোটামুটি একটা রেইকি করে ফেলেছি। ভালোপাহাড়ের দু’তিন কিলোমিটারের মধ্যে তেমন জনবসতি নেই। ফলে গ্রাম, মানুষজন এসব আঁকতে গেলে পায়ে হেঁটে ঘোরা মুশকিল। এর জন্য সাইকেল চাই এবং তার ব্যবস্থাও আছে। তবে সেটা কাল থেকে হলে ভালো, কারণ আজ বিকেলে সবাই মিলে সানসেট দেখতে যাওয়া হবে বান্দোয়ান পাহাড়ের ওপর থেকে।

বিকেল চারটে নাগাদ বেরনো হল। চালকের আসনে অনিরুদ্ধ নিজে। বাকিরা একটু ঠাসাঠাসি করে। এমনকি কমলদার ল্যাব-বাবুও বাদ গেলেন না।
মাইলের পর মাইল খোলা সবুজ মাঠের মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে তারপর চড়াই শুরু। পিচের রাস্তা পাহাড়ের মাথা অবধি গিয়ে আবার ঢালু বেয়ে নেমে গিয়েছে বান্দোয়ান টাউনের দিকে। আমাদের গাড়ি যেখানে থামল, সেটাই ভিউ পয়েন্ট। রাস্তার দু’ধারে আগাছার জঙ্গল ছাড়িয়ে আশপাশে তাকালে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের মাথাগুলো চোখে পড়ে। আমরা সবাই পশ্চিমমুখো হয়ে দাঁড়ালাম বটে, কিন্তু দেখলাম আকাশ তখন ঘন মেঘ সাজাচ্ছে আর সুয্যিমামা ক্রমেই ভয়ে মুখ লুকোচ্ছেন। বুঝলাম আজ সানসেট পুরো গুবলেট হয়ে বসে আছে। কমলদা প্রস্তাব দিলেন ‘তাহলে আলো থাকতে থাকতে বান্দোয়ানটা একবার ঘুরে আসা যেতে পারে।’
প্রথমেই অনিরুদ্ধ নেচে উঠল। দেখলাম গাড়ি চালাতে পারলে ওর ভারি ফুর্তি হয়। এবারে আমাদের রাস্তা ঘন শাল বনের মধ্যে দিয়ে। বান্দোয়ান পৌঁছতে আধঘণ্টা লাগল। একটা চৌমাথা দেখে গাড়ি থামল। সামনেই চায়ের দোকান। কাঠের বাক্সের ওপর বেতের ঝুড়িতে শুকনো আলুর চপ আর গজা রাখা রয়েছে। কতদিনের বাসি একমাত্র ভগবানই জানেন। আমরা শুধু চায়ের জন্য বললাম। কমলদা জানালেন জায়গাটার নাম আছে দু’টো কারণে। ছৌ নাচের মুখোশ আর গামছা। প্রথমটায় আমি বেশি উৎসাহিত হলাম। পরেরটায় মন্দার!
চায়ের গ্লাসে দ্বিতীয়বার চুমুক দেবার ইচ্ছে কেউই দেখাল না। এখানে মাত্র একঘর শিল্পী মুখোশ বানায়। কমলদার নির্দেশমতো গাড়ি এবার সেদিকেই চলল। একটা মাঠের ধারে এক সার চালা ঘর। এখানেই মুখোশ বানানো হয়। তবে সব ঘরেই দেখলাম তালা মারা। পাশে খাটিয়ায় বসে এক ছোকরা মুড়ি খেতে খেতে আমাদের দেখছিল। কমলদা ওকে জিজ্ঞেস করল, ‘হবুনাথ নেই?’ ও-ই এখানকার হেড এবং জানা গেল সে আজ সদলবলে শহরে গেছে। যাঃ! এখানেও গুবলেট। অতঃপর গামছা। সে দোকানও কাছেই। মন্দার হইহই করে নেমে গিয়ে গোটা কয়েক হাতে ঝুলিয়ে ফিরে এসে আমাকে বলল,
— বৌয়ের জন্য নিয়ে যাও। এখানকার মেয়েরা এই গামছা পরে ফ্যাশন করে। আমি বললাম
— খেপেছ! আর জিনিস পেলে না?

এতক্ষণ কেউ খেয়াল করিনি, চারদিক কখন মিশকালো হয়ে এসেছে এবং ঝড়টাও উঠল প্রায় সেকেন্ডের মধ্যে। অনিরুদ্ধ যখন ফাঁকা জায়গায় গাড়িটাকে নিয়ে এল ততক্ষণে তুলকালাম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। হেডলাইটের আলো ছাড়া সব ঘুটঘুটে অন্ধকার আর চারপাশে শুধু ঘন জঙ্গল। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর পরিবেশ আর তারই মধ্যে আমাদের চালকমশাই গাড়িটাকে গাছপালার ধারে নিয়ে গিয়ে স্টার্ট দিলেন বন্ধ করে। ফলে আলোও গেল নিভে। আমরা তখন যেন একদল ভূত সেজে বসে আছি। আশ্চর্য ব্যাপার, ওই অবস্থায় কমলদার কুকুরটাও বার দু’য়েক মৃদু ভুকভুক করে চুপ করে গেল। ‘গান হোক, গান হোক’… গমগম করে উঠল অনিরুদ্ধর গলা। তারপর নিজেই গেয়ে উঠল, ‘ওরে ঝড় নেমে আয়…।’ গান ধরলেন কমলদাও। ফাঁকে কিছু কোরাস। সেই সঙ্গে মন্দারের আবৃত্তি। কিছুক্ষণের জন্য সবাই কেমন যেন বিভোর হয়ে পড়ল। এরপর একসময় বৃষ্টি থামল। আমরাও গাড়িতে বসে বাঘ-পালানো ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ঘরমুখো হলাম মাঘের ওই বাদলমুখর সন্ধ্যার স্মৃতিটাকে চিরকালের জন্য মনের মধ্যে ধরে রেখে। (চলবে)
স্বনামধন্য এই অঙ্কনশিল্পী নিজেই এক সম্পূর্ন প্রতিষ্ঠান | তাঁর হাত ধরে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে বাংলার কার্টুন শিল্প | সিগনেচার বেড়াল আর স্ব-নেচারটি কোমল, আত্মবিশ্বাসী, রসিক | বেড়ানো তাঁর নেশা | তাই ঝুলিতে রয়েছে বহু গল্প, সঙ্গে অসাধারণ সব স্কেচ | সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিরলস সাধনার অমর ফসল ‘রঙ তুলির সত্যজিৎ’ |
বেশ ভালো লাগলো! যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
ভালো লাগলো ! ছবিগুলোর জন্যেই আরো !! যারা পরিযায়ী বন্ধ হয়ে গিয়ে এই ছবিগুলোই miss করছিলাম !! আন্তরিক অভিনন্দন ! আরো চাই ছবি + লেখা !! ভালো থাকবেন।।
আর একটা কথা ! ” রংতুলির সত্যজিৎ” কিনে পড়লাম। অসাধারণ !!
ভালো পাহাড়ে দুবার গিয়েছি, একবার দুদিন ছিলাম, থাকার ব্যবস্হা ঠিক সুবিধার নয়। গালুডি থেকে ঘোরাটাই বেশি পছন্দের লেগেছিল। আর দুয়ারশিনির সুন্দর কুটিরগুলি পড়ে পড়েই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
যাঁর ছবি অগুন্তি ধারাবাহিক ও পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত গল্প উপন্যাসে না দেখলে মন কেমন করত, আজ তাঁরই কলমের সোনালি পরশ পেয়ে ছবি-লেখায় আস্ত গালুডি মগজে সেঁধিয়ে গেল। বহু পরে তাঁকে সামনে থেকে দেখার সৌভাগ্যও হয়েছে। কথনে মুগ্ধ করেছেন তখনও। কাগুজে প্রণাম নয়, আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।