সাহিত্যের প্রধান কাজ আরকাইভিং;সময়ের আরকাইভিং। ইতিহাসেরও ওই একই কাজ; সে ক্ষেত্রে ইতিহাস আর সাহিত্যে বিশেষ পার্থক্য নেই বলেই মনে হয়। বিগত আট বছরের প্রবাস যাপনে, গবেষণার কাজ ছাড়া আর যে দু’একটা ব্যাপার আমায় সমৃদ্ধ করেছে তার মধ্যে ইউরোপীয় সাহিত্য এবং ইতিহাস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । সেই ইতিহাসের টানেই পিএইচডি জীবনের পকেটের টান সামলেও বার বার ছুটে গেছি এমন কিছু জায়গায় যা মধ্যবিত্ত বাঙালির ভ্রমণ-পিপাসার ইউরোপীয় “বাকেট-লিস্টের” খানিকটা বাইরে। এই সব জায়গার স্বল্প-জানা বা না-জানা ইতিহাসের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার উন্মোচন ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়ে গেছে প্রত্যেকবার। মনে হয়েছে এই ইতিহাস যদি কোনও প্রকারে বাঙালি পাঠকের কাছে সহজ উপায়ে পৌঁছে দেওয়া যায় তবে মন্দ হয় না। সেই প্রেরণা থেকেই তৈরি করা “ইতিহাসের শহর”-এর লেখাগুলি। প্রত্যেকটি লেখাতে ট্রাভেলগের আকারে ইতিহাস, টুকরো টুকরো আঞ্চলিক মানসিকতা ও প্রচলনকে ক্ষেত্র বিশেষে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।


 

২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
রাত ৩:০০টে।

যথারীতি দু’দিনের ঝটিকা সফর। তাই সারাদিন বৈজ্ঞানিক কচকচানিতেই কেটে গেল। সন্ধ্যে নাগাদ হোটেল ফিরে, হিমাংশুর কথামতো একটু রাতের দিকেই চরতে বেরলাম ড্রেসডেন শহর। হিমাংশু বছর দুই হল জার্মানিতে এসেছে। আসার আগে সোশাল নেটওয়ার্কে নেহাৎ গায়ে পড়েই আলাপ করেছি। ইস্তানবুলে সস্তায় ভারতীয় খাবার পাই না বলে ঠিক হল, দেখা হবে “পোস্টপ্লাটজ় (postplatz)” চত্বরের “শের-এ-পাঞ্জাব” রেস্তোঁরায়। “প্লাটজ়” কথাটির জার্মান অর্থ একটি চৌকোণা খোলা জায়গা, আর “পোস্ট” অবশ্যই ডাকঘরের সমার্থক। হালের বিকিকিনি-কেন্দ্র ও রেস্তোঁরা-গোষ্ঠী জায়গাটাকে পর্যটকদের আড্ডা-ভূমিতে পরিণত করেছে। ঘড়ি জানান দিল আটটা বাজতে তখনও মিনিট পনেরো বাকি। হাতে খানিকটা সময় থাকায় একতলার পানশালায় স্থানীয় বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে আড্ডা জমল হোটেলের তুর্কি মালিকের সঙ্গে। মানুষটি গোলগাল মিষ্টি স্বভাবের। ড্রেসডেনে আছেন প্রায় দশ বছর। আগমনের হেতু, যন্ত্রকৌশলে স্নাতকোত্তর শিক্ষা। তবে মাত্র ক’বছরেই বাণিজ্য ও লক্ষ্মীর সাধনায় ব্রতী হন এবং স্বেচ্ছায় মা সরস্বতীকে শিকেয় তুলতে কণামাত্র বিলম্ব করেননি।

 বেশ গর্ব করেই বললেন, 
— ওটেল ইশ দান চোক পারা ভার (হোটেলের ব্যবসায় বিস্তর টাকা)।
তারপর সুপরিচিত তুর্কি ভঙ্গিতে এক চোখ মেরে বোঝালেন,
— ওসব বিজ্ঞান-টিজ্ঞান করে হবে ঘোড়ার মাথা!  

যে মানুষ গত পাঁচটা বছর এঞ্জিনিয়ারিং পিএইচডিতে প্রাণপাত করেছে, একথা শুনে তার মানসিক অবস্থা পাঠক নিশ্চয়ই বুঝবেন! বিয়ারের বোতলটা কয়েক ঢোঁকে খালি করে, তুর্কি মালিকের স্বাস্থ্য ও লক্ষ্মীলাভ কামনা করে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। গুগল ম্যাপ বলছে, আমার গন্তব্য হোটেল থেকে হেঁটে প্রায় মিনিট পঁচিশ। আমি আছি ড্রেসডেন নয়েশ্টাড (নতুন শহর) স্টেশনের কাছে, হোটেল এলবেতে। একতলার ছোট্ট পানশালাটির পাঞ্জাবি কর্মচারি কথা নিয়ে ছেড়েছেন, রাতে ফিরে বিয়ার সমেত খানিক আড্ডা দিতেই হবে।

Elbe
এলবে নদী। ইউরোপের অন্যতম প্রধান জলধারা। ছবি সৌজন্য – wikipedia

এলবে, মধ্য ইউরোপের প্রধান নদীগুলির একটি। জন্ম চেক রিপাব্লিকের Krkonoše পর্বতমালায়। এর পর বোহেমিয়ায় বিস্তর স্ক্যান্ডাল সামলে, ড্রেসডেন, উত্তরপশ্চিম জার্মানি হয়ে কুক্সহাভেন শহরে উত্তর-সাগরে মিলিত হয়েছে। এলবে ইউরোপের ভৌগলিক বা সামাজিক বিবর্তনের জলজ্যান্ত সাক্ষ্য তো বটেই। তার একটা কারণ অবশ্যই এই যে, ১৯৭০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা করেছিল, হিটলারের অস্থি পরবর্তী সময়ে এলবেতেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়। 

পোস্টপ্লাট্জ় অঞ্চল ড্রেসডেন আল্টশ্টাডের (পুরনো শহরের) মধ্যমণি। হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে ডানদিকে হাঁটতে শুরু করেছি। শীত খুব বেশি না হলেও‌ হাওয়ায় বেশ একটা শিরশিরে ভাব আছে। রাস্তার দু’দিকে নতুন-পুরনো বাড়িঘর, রেস্তোঁরা, গাছপালা, আলো-আঁধারির সাইকাডেলিক মেজাজ দিব্যি লাগছে। ফুটপাথ ধরে মিনিট দশেক হাঁটার পর ডানদিক ঘুরেই একটা সেতু। যেটাকে সেতু বলছি সেটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও প্রায় দেড় দশক আগে তৈরি মহিমান্বিত অগাস্টাসব্রুকে (ব্রুকে অর্থে ব্রিজ)। এখনকার সেতুটি ১৭২১ সালে স্যাক্সন সম্রাট অগাস্টাসের তৈরি ১২ আর্কের স্থাপত্যের ৯ আর্কের নবীনতম সংস্করণ। অবশ্য তারও আগে এই জায়গায় বারোশো শতাব্দীতে তৈরি প্রথম সেতুর ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে। 

Dresden
ফুরস্টেনজ়ুগ বা দ্য প্রসেশান অফ প্রিনসেস; ১৮৭০-এ তৈরি। ৩০০ মিটার লম্বা পোর্সেলিন মোজেইক দিয়ে গড়া স্যাক্সনির ওয়েটিন বংশের রাজাদের কালপঞ্জি। এই পাথর আনা হয়েছিল পাশের শহর মেইসে থেকে। ছবি – লেখকের তোলা

কিন্তু সমস্যা হল, ব্রিজে কাজ চলছে! গোটা ব্রিজটা মাঝখান দিয়ে রাস্তা বরাবর দোতলা বাড়ির সমান উঁচু হলুদ প্লাস্টিকের পর্দা দিয়ে ভাগ করা। তার গা ঘেঁষে সারি দেওয়া ব্যারিকেডের কাঠামো। ফলে যেটুকু জায়গা আমার দিকে রয়েছে তা দিয়ে এই অন্ধকারে আমি আর একটি সাইকেল পাশাপাশি চলতে পারি। কাজেই বেশ মনমরা হয়েই হাঁটছিলাম। যে কোনও নতুন শহরে আসার আগে খানিকটা পড়াশোনা বরাবরই আমি করে আসি। এবার হাতে সময় একেবারেই অল্প, তাই ঠিক করে এসেছিলাম দু’তিনটে ঐতিহাসিক জায়গা মোটামুটি ঘুরে দেখে যাব। কিন্তু কপালে শিকে ছিঁড়ল কই? 

আর মিনিট দুই যেতেই ভুলটা ভাঙল। ব্যারিকেডের শেষে ব্রিজ ছাড়িয়ে ডান হাতে বাঁক নিতেই সম্পূর্ণ হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি হাঁ করে। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে সারি বাধা বিরাট বিরাট স্যাক্সন স্থাপত্ব। একের পর এক জ়ুইঙ্গার প্রাসাদ, ফ্রাউনকারশা, সেম্পের অপেরা, ব্রুলস প্যাসেজ, লালচে আকাশের নিচে আধুনিক বৈদ্যুতিন আলোর ঝলকানিতে এক মায়াবি অপার্থিব পৃথিবী সাজিয়ে অপেক্ষমান যেন শুধু আমারই জন্য। ব্রিজ খোলা পেলে এই হঠাৎ পাওয়ার সুখটা কপালে জুটত না। আমার আনস্মার্ট ফোনের ভগ্নপ্রায় ক্যামেরায় ছবি তুলতে যাওয়ার ভাবনাটাও বিড়ম্বনা। ব্রিজের দু’ধারের স্থিতিশীল এলবে আর তার মাঝে অপার্থিব স্যাক্সন মহিমার মায়া কাটল প্রায় মিনিট পনেরো পর, চনমনে খিদেতে।
এহেঃ! ছেলেটা তো দাঁড়িয়ে থাকবে!

Dresden
জ়ুইঙ্গারের প্রবেশপথ। ছবি লেখকের সংগ্রহ

উর্ধশ্বাসে আল্টশ্টাডের কবলস্টোন গলির মধ্যে দিয়ে হাঁটা লাগালাম। ডান হাতে সেম্পের, জ়ুইঙ্গার ছাড়িয়ে বাঁয়ে বাঁক নিতেই ঝলমলে একটা চত্বর পড়লো। জমজমাট শপিং মল। তার দু’পাশে ৯০ ডিগ্রিতে দু’টো ট্রামলাইন। একটা জ়ুইঙ্গারের দিকে গেছে। অন্যটা ধরে মলের গা-ঘেঁষে বাঁ হাতে মিনিট দু’য়েক হাঁটতেই পাঞ্জাবি ব্যাঘ্রের দেখা পাওয়া গেল। হিমাংশুও হাজির। মাখো মাখো ভেড়ার ঝোল, তন্দুরি মুর্গ, পোলাও আর শেষ পাতে একটা পান্তুয়া গোছের মিষ্টি দিয়ে পেটপুজো সেরে ফুরফুরে মেজাজে ঠিক করা গেল, হাঁটতে হাঁটতে আমার হোটেল পর্যন্ত আড্ডা দেওয়া যাবে।
উত্তম প্রস্তাব! এত খাবার হজম হলে তবে না হোটেল গিয়ে আবার দু’পাত্তর চলতে পারে! পড়াশোনা, বিজ্ঞান, গবেষণা, পলিটিক্সের শেষে উঠল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর ড্রেসডেনের ইতিহাসের কথা।

***

সময়টা ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি। অ্যালায়েড শক্তি হিটলারের সাধের নাৎসি জার্মানিকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরেছে। শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা। পশ্চিমে, বেলজিয়ামের আর্দেনেস জঙ্গলে, তৃতীয় রাইখ সম্পূর্ণ পরাজিত। অন্যদিকে রেড আর্মি থাবা বসিয়েছে পূর্ব প্রাশিয়ায়, বার্লিন থেকে আনুমানিক ৫০ মাইলের ভিতরে। যুদ্ধজয় শুধুই সময়ের অপেক্ষা বুঝে, যুদ্ধোত্তর ইউরোপের ভবিষ্যত আলোচনার তাগিদে, ফেব্রুয়ারি ৪ থেকে ১১ তারিখে, রুজ়ভেল্ট, স্তালিন ও চার্চিল, রাশিয়ার ইয়ল্টায়, লিভাডিয়া প্যালেসে, বৈঠকে (আর্গোনট কনফারেন্স) বসলেন। এই বৈঠকই ঠিক করে দেবে যুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানি ও ইউরোপের রাজনৈতিক পরিকাঠামো।

যুদ্ধ শুরুর অনেক আগে থেকেই ড্রেসডেন কিন্তু তার নান্দনিকতার জন্য বিশ্বখ্যাত। এতই নাকি সে শহরের সৌন্দর্য, যে একাধিক নথিতে ড্রেসডেনকে “এলবের ফ্লোরেন্স” বলতেও দেখা গেছে। ফ্রাউনকারশা, জ়ুইঙ্গার, সেম্পের অপেরা… শহর তথা জাতির গর্ব। এমনকি যুদ্ধের সময়েও ড্রেসডেন পু্রোপুরি ভাবেই এক অসামরিক শহর, রাইখের শিল্পপ্রধান মধ্যমণিদের একটি। আশপাশের ছোটখাটো শহরগুলি অ্যালায়েড শক্তির এরিয়া/স্যাচুরেশন বম্বিং সহ্য করেছে একাধিকবার। সামরিক ঘাঁটিগুলি ছাড়াও শহরতলির বহু জায়গা মুছে গিয়েছে একেবারে। ড্রেসডেন কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি দেখেনি বললেই চলে। বরং রেড আর্মির তাড়নায় বহু জার্মান শরণার্থী ড্রেসডেনেই খুঁজে নিয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়। এছাড়া বার্লিন ফ্রন্টে হিটলার তাঁর বেশিরভাগ সৈন্য সরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় স্তালিনের কাছে ড্রেসডেন একেবারেই সহজলভ্য। কিছু সামরিক হাসপাতাল আছে, যা এই শেষের দিনে লক্ষাধিক আহত-মৃতপ্রায় জার্মান সেনার শুশ্রূষায় অক্ষম; আর আছে পূর্ব-পশ্চিম ফ্রন্টের মধ্যে সৈন্য আনা-নেওয়া করার একটাই রেল স্টেশন। কাজেই অ্যালায়েডদের কাছে এ শহর কোনও ভাবেই চিন্তার কারণ নয়, ফলত এরিয়া বম্বিং-এর প্রশ্নও ওঠেনি।

যুদ্ধ শুরুর অনেক আগে থেকেই ড্রেসডেন কিন্তু তার নান্দনিকতার জন্য বিশ্বখ্যাত। এতই নাকি সে শহরের সৌন্দর্য, যে একাধিক নথিতে ড্রেসডেনকে “এলবের ফ্লোরেন্স” বলতেও দেখা গেছে। ফ্রাউনকারশা, জ়ুইঙ্গার, সেম্পের অপেরা… শহর তথা জাতির গর্ব।

কিন্তু ইয়লটা কনফেরেন্সের মাসখানেক আগে চার্চিলের ওয়ার ক্যাবিনেট, যুদ্ধকে চটজলদি পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করে। তাতে বলা হয়, বার্লিন ছাড়াও পূর্ব জার্মানির কিছু শহরকে কেন্দ্র করে সৈন্য আনা-নেওয়া করছে তৃতীয় রাইখ। এই শহরগুলিকে রেড আর্মি যদি খুব তাড়াতাড়ি অধিগ্রহণ করতে পারে, তবে এপ্রিলের মধ্যেই যুদ্ধের অবসান হওয়া সম্ভব। অন্যথায় নভেম্বর পর্যন্ত ধিকধিক করে হলেও যুদ্ধ চলবে। ১৯৪৪-এর অপারেশন থান্ডারক্ল্যাপকে তুলে এনে ঠিক হয় আরও ছোট কোনও অভিযানের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হবে। রেড আর্মির তরফেও ইয়লটা কনফারেন্সে এই প্ল্যানের পক্ষে সওয়াল করেন জেনেরেল অ্যান্টোনভ। কিছু মত বিরোধের পর সম্মতি আসে, এরিয়া বম্বিং করা হবে বার্লিন ছাড়াও ড্রেসডেন, কেমনিটজ়, লাইপজ়িশের মতো শহরগুলোয়। নথিতে টার্গেট হিসেবে দেখানো হয় তেল, ট্যাঙ্ক এবং উড়োজাহাজের কারখানাগুলিকে।

১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রথমবার যুদ্ধকালীন সাইরেন শোনে ড্রেসডেন। সন্ধ্যে থেকেই ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্স (র‍্যাফ) ও ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি এয়ার ফোর্সের (ইউস্যাফ) মুহুর্মুহু আক্রমণে ধংস হয়েছে আশপাশের সমস্ত স্ট্র্যাটেজিক ট্যাঙ্ক ও বিমান কারখানা। রাত সওয়া দশটা নাগাদ র‍্যাফের ল্যাঙ্কাস্টার বিমান ৮৮০ টনেরও বেশি একটা বোমা ফেলে শহরের বুকে, দু’ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে। ঘণ্টা  তিনেক পর ইউস্যাফের পালা। ততক্ষণে অবশ্য অগ্নিঝড়ের ধোঁয়া ১৫০০০ ফিট ছুয়েছে। মিনিট কুড়ির মধ্যে অগ্নিবলয় ও তার আশপাশে আনুমানিক ১৮০০ টন বোমা ফেলে ইউস্যাফ। সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় “হপ্টবানহফ” (প্রধান রেল স্টেশন) ও শহরের প্রাকৃতিক প্রাণকেন্দ্র “গ্রসার গার্ডেন”। এতেও মুক্তি নেই। ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি, দু’দিন ধরে ড্রেসডেন ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তাণ্ডব চলে সমানে। তিন দিনের অভিযানে ৪০০০ টনের কাছাকাছি ছোট-বড় বোমা ব্যবহৃত হয়। সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয় অন্তত আশি হাজার ঘরবাড়ি, ড্রেসডেনের প্রাণের ফ্রাউনকারশা, সেম্পের অপেরা, জ়ুইঙ্গার প্রাসাদ এবং আরও একাধিক স্থাপত্য। অগ্নিঝড়ে, শহরের তাপমাত্রা ছোঁয় ১৮০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। আক্রমণের পর রাইখ বাহিনী তদন্তে এসে বাধ্য হয় মানুষের গলা মৃতদেহ রাস্তা থেকে ছাড়িয়ে তুলতে। 

Dresden
১৯৪৫ সালের ছবি। ড্রেসডেন সিটি হলের ওপর থেকে তোলা ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাওয়া নগরী। ছবি সৌজন্য – Universal History Archive (UIG) https://mashable.com/

চার্চিল ক্যাবিনেটের রিপোর্ট ঠিকই বলেছিল। এই ঘটনার আড়াই মাসের মধ্যেই ২ মে বার্লিন গ্যারিসন আত্মসমর্পন করে। তার মাস তিনেকের মধ্যেই হিরোসিমা-নাগাসাকির হাত ধরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। এবং সমগ্র পুর্ব ইউরোপ স্তালিনের আয়রন কার্টেনে মুখ ঢেকে পশ্চিমী লিবারালিজ়ম থেকে অব্যাহতি নেয় পরবর্তী চার থেকে পাঁচ দশকের জন্য।

***

আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। তবে যে দেখলাম মস্ত মস্ত স্যাক্সন স্থাপত্যগুলো এলবের পাড়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে?
হিমাংশু ঠিক খেয়াল করেনি। ও বলে চলে…

১৯৫১ সালের পর প্রধানত ১৯৫৬ সালে কভেন্ট্রির (ব্রিটিশ শহর, যা জার্মান লুফ্ৎওয়াফের আক্রমণে সমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল) হাত ধরে ড্রেসডেনের পুনরুত্থানের সূত্রপাত। ১৯৬৩-তে জ়ুইঙ্গার প্রাসাদকে মোটামুটি প্রাকযুদ্ধের অবস্থায় এনে সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয়। আরও অন্তত হাজার দু’য়েক মৃতদেহ আবিষ্কার ছাড়াও মানুষের হাত ধরেই চলতে থাকে শহর পরিষ্কারের দুস্কর কাজ। ৪০ বছর পর, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫, সেম্পের অপেরায় সর্বসাধারণের জন্য মঞ্চস্থ হয় আক্রমণের ঠিক আগের দিন পর্যন্ত অভিনীত Der Freischütz (দা ফ্রিশুটার)। 

Dresden
এরিয়া বম্বিংয়ে ভেঙে খানখান মার্টিন লুথার কিংয়ের মূর্তি। পিছনে ফ্রাউনকারশার ধ্বংসস্তূপ। ১৯৪৫ সালের ছবি। সৌজন্য – Universal History Archive (UIG) https://mashable.com/

যুদ্ধ শেষের এক বছরের মধ্যেই শহরের মানুষ ফ্রাউনকারশা সংস্কারের আর্জি জানিয়েছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত-রাজের কাছে। স্যক্সনির এভ্যাঞ্জেলিক চার্চ কিছু টাকাও তুলেছিল। কিন্তু টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির চাপে কাজ এগোয়নি। ১৯৮৯-৯০ সালে অখণ্ড-জার্মানি-প্রতিস্থাপন আন্দোলনের হাত ধরে “অ্যাপিল ফ্রম ডেসডেন” নামে একটি চিঠিতে ড্রেসডেনের কিছু বিশিষ্ট নাগরিক ফ্রাউনকারশার পুনর্নির্মাণের আর্জি তুলে ধরেন সমগ্র পৃথিবীর কাছে। ব্রিটিশ ও মার্কিন যুক্ত্ররাষ্ট্রের আর্থিক সাহায্যে এবং ড্রেসডেন মেয়র পরিষদের সায়ে ১৯৯২-এর অক্টোবরে শুরু হয় ক্যাথিড্রাল পরিষ্কারের কাজ।

Dresden
২০১৫ সালে তোলা ফ্রাউনকারশার ছবি। পুনর্নিমাণের পরের ড্রেসডেনে। ছবি সৌজন্য – Universal History Archive (UIG) https://mashable.com/

২৭ মে ১৯৯৪ সংস্কারের কাজ শুরু হয় পাকাপাকি ভাবে। তারপর আরও দীর্ঘ ১১ বছরের অপেক্ষা। ২০০৫-এর ৩০ অক্টোবর ফ্রাউনকারশাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ড্রেসডেনের হাতে তুলে দেন কর্তৃপক্ষ। ততদিনে অবশই সম্পূর্ণ আল্টশ্টাড ছাড়াও রমরমিয়ে উঠেছে বর্ধিত ড্রেসডেনের নয়েশ্টাড ও অন্যান্য অঞ্চল।

***

কখন হোটেলে এসে পড়েছি খেয়াল করিনি।
হিমাংশুকে নিয়েই একতলার পানশালাটায় ঢু্কলাম।
বন্ধ হয়ে গেছে অনেক্ষণ; শুধু হোটেলের আবাসিক দু’একজন বসে রয়েছেন এদিক ওদিকে। আমরা তখনও গল্পে এতই মশগুল যে কর্মচারি ছেলেটি কখন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করিনি। কথা দিয়ে বেরিয়েছিলাম, তাই আড্ডা থামাতে হল। মিনিট কুড়ি ওর দেশের বাড়ির কথা কানের আশপাশ দিয়ে বেরবার পর, ভদ্রতা বজায় রেখে হিমাংশুকে যোগাযোগ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনতলার ঘরে উঠে গেলাম। ঘরটা ছোট, তবে ছিমছাম। একটা মাঝারি গড়নের লেখাপড়ার টেবিল রাখা জানলার পাশে। বিখ্যাত ব্যারক আর্কিটেকচা্রে তৈরি বলে পড়ার টেবিলের গা ঘেঁষে জানলাটা একটু কোণাচে ভাবেই ছাদের দিকে উঠে গেছে। অনেকটা আকাশ খুব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। খানিক দূরে রাতের ড্রেসডেনের আকাশ ছুঁয়ে দাড়িয়ে আছে পুননির্মিত বিস্ময়স্তম্ভগুলো। এই আকাশ একই বৃত্তে ছুঁয়ে থাকে ১৭০০ শতাব্দীর স্যাক্সনির রাজপ্রাসাদ, ‘৪৫-এর ১৫০০০ ফুটের অগ্নিগোলকে ২৫০০০ মানুষের জ্বলন্ত আর্তচিৎকার; আর অবশই এক দশক আগের মানব-বিবর্তনের পুনর্বিজয়ের সেই সন্ধ্যে, যেদিন প্রযুক্তির হাত ধরেই ফ্রাউনকারশা আবার আলিঙ্গনে মুড়েছে তাকে। নাহ! আজ রাতে আর ঘুম হবে না; ঘণ্টা তিনেক পরেই ট্রেন।

২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
সকাল ৯:৩০

ট্রেন ছেড়েছিল সাড়ে ছটায়। রাতের ঘুমের খানিকটা দিব্যি মেকাপ করে নিয়েছি। স্টেশন ছাড়ার সময় এক-আধটা বাড়ি নজরে পড়েছিল। ব্যারক আর্কিটেকচার ছাড়াও দেওয়ালগুলো একটু অদ্ভুত। ইউরোপের অনেক শহরেই, বিশ্বযুদ্ধের সমকালীন বাড়িগুলো এক ধরনের লাগে আমার। এক্ষেত্রেও তাই। তবে একই দেওয়ালে ইটের রংগুলো আলাদা। কখনও লালচে, কখনও খয়েরি, আবার কখনও একেবারেই কালো। কিছুতেই কুলকিনারা না পেয়ে প্রশ্ন করতে, পাশের ভদ্রমহিলা পরিষ্কার করে দিলেন। এটি পুরনো শহরের দিক, তাই পুনর্নিমাণের সময়ে সুপরিকল্পিত ভাবেই বাড়িগুলোয় পুড়ে যাওয়া ইট ব্যবহার করা হয়। ওই কালো, খয়েরি ইটগুলো সেই অভিশপ্ত রাতের ঝলসে যাওয়া ইতিহাসের জ্বলন্ত স্বাক্ষর।

Dresden
পুনর্নিমিত ড্রেসডেন শহরে বড়দিনের বাজার। ছবি – শারদীয়া বর্ধন রায়।

অত্যাধুনিক ডয়েশ-বান রেলগাড়ি দু’পাশের পাহাড়-জঙ্গল চিরে ছুটে চলেছে ফ্রাঙ্কফুর্টের দিকে। দু’পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চোখে পড়ছে ছোট ছোট মধ্যযুগীয় শহর। তাদের মাঝে বিস্তির্ণ জমি জুড়ে অত্যাধুনিক উইন্ডমিল বা সোলার প্যানেলের সারি। শহরগুলোর আকাশচুম্বী গথিক ক্যাথিড্রাল মাথা উঁচিয়ে জানান দিচ্ছে ‘ডার্ক এজ’ পেরিয়ে তারাও এখন প্রযুক্তিগত বিবর্তনেরই সাক্ষী। 

ছোটবেলায়, প্রশ্নপত্রে প্রায়শই বিজ্ঞানের ভালোমন্দ নিয়ে একটা রচনা পেতাম। ৩৫-এর কাছাকাছি পৌঁছে বোধহয় বুঝতে পেরেছি, পুরো ব্যাপারটাই সময়ের কোনদিকে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছে তার উপর নির্ভরশীল। ড্রেসডেন, ওয়ারশ, হিরোশিমার মরতে মরতেও বিজ্ঞানের হাতচেপে লড়াই করে বেঁচে ওঠার দিনগুলোই ভোররাতের আকাশের মতো জাগিয়ে রাখে স্বপ্ন, বাকি দিনগুলো নাহয় তুর্কি সাহেবের লক্ষ্মীদেবীর ভাগ্যেই পড়ল?
ফ্র্যাঙ্কফুর্ট পৌঁছতে আরও ঘণ্টাখানেক। ট্রেনের ক্যাফেটাও বেশ। আর এক কাপ কফি হলে মন্দ হয় না!

Rupak bardhan Roy

ড. রূপক বর্ধন রায় GE Healthcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ফ্রান্সের নিস শহরে থাকেন। তুরস্কের সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মসূত্রে যাতায়াত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। লেখালিখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঘোরাঘুরি নিয়েই। এ ছাড়াও গানবাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে আগ্রহ অসীম।

4 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *