– কী করছিস? প্রকল্পর হোয়াটস্যাপ মেসেজ লীনাকে।
– অফিসের কাজ, তোর শেষ হল?
– তথৈবচ অবস্থা আমার, কাজ আর কাজ।
– আরে! তেড়ে বোরড হচ্ছি এই ওয়ার্ক ফ্রম হোম করতে করতে।
– আমার সেটায় অসুবিধে নেই শুধু যদি..মিসিং, মিসিং…!
– মানে? তোর স্টক শেষ?
– ঠিক ধরেছিস বস্।
– জানি তো। আমাকে তুই মোটেও মিস করিস না। বাই দ্য ওয়ে, কবে যে আবার মিট করব আমরা!
– আজ ফ্রাইডে। মিসিং ইউ অ্যান্ড আওয়ার ফ্রেন্ডস।
– যাবি নাকি তবে নাইট ক্লাবে? অথবা পাবে?
– যেতেই পারি।
– ওকে, লেটস প্ল্যান দেন ।
– সারাদিন ঘরে বন্দি হয়ে শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। দু’পেগ পড়লেই চাঙ্গা হবে, কী বল?
– লেটস গো দেন। প্ল্যান ফর অ্যান ইভিনিং। কাল থেকে আবার বেশ এনার্জি পাব তবে।
– তবে জানিস তো আমাদের এখানেও খুব শিগগির সব লকডাউন হতে পারে।
– নো চান্স বস। হলে দেখা যাবে। এখানে তদ্দিনে প্রচণ্ড গরম পড়ে যাবে।
– হ্যাঁ শুনছি খুব গরমেই জব্দ কোভিড নাইন্টিন। তুই দেখ সব ঠান্ডার দেশেই কিন্তু অত অত করোনা কেস।
– আরে! ট্রপিক্যাল কানট্রিতে থাকার বাড়তি কিছু সুবিধে তো আছে নাকি!
সেলফোন রেখে অফিসের একটা জরুরি মেলের উত্তর দিতে গিয়ে লীনার চোখে পড়ল নিউজ পোর্টালের ব্লগ রোল। কেরলে বিশ্রি রকমের সংক্রমণ করোনার। লীনা ভাবে, কিন্তু কেরালায় তো ব্যাপক গরম! সেখানে এমন কেন হচ্ছে? কে জানে বাবা! লীনা আর প্রকল্প পুণের একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে। পুণেতে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব সেই চৈত্রেও। সাধে কি আর রবিঠাকুর বলেছিলেন, চিরবসন্তের দেশ? কী ভালো ওয়েদার অথচ একটু শান্তিতে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে উইকএন্ড কাটানোর উপায় নেই…। ওদিকে আবার কলকাতা থেকে মায়ের হুঁশিয়ারি সর্বক্ষণ। দরকার না হলে কী প্রয়োজন বাইরে বেরুনোর?
লীনা ভাবল, সত্যিই কি ক্রমশ এতটাই মারাত্মক হয়ে উঠছে ইন্ডিয়ার পরিস্থিতি? নাকি রিউমার? নিজের মনকে নিজে বোঝায় সে। যাক্ বাবা! প্রকল্প রাজি হয়েছে। কাল তবে একটু পাবে যাওয়া যাবে। সেইসঙ্গে মলে গিয়ে কিছু গ্রসারিও তুলে নেবে ওরা। ফোন বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনে দূর্বার নাম দেখেই জিভ কেটে লীনা বলল, “এই রে! বাগড়া মাস্টার কলিং।”
— আরে, শুনলাম তোরা নাকি কাল পাবে গিয়ে ড্রিংক করবি?
— এই এক ঠাকুমা মার্কা কথা বললি তো! রাবিশ্! পারলে তুইও অঙ্কন কে বল। লেট ফোর অফ আস মিট টুমরো। লীনা জবাব দিল। দূর্বা বলল, “আইডিয়া ইজ নট ব্যাড, বাট পাবে অত লোক একসঙ্গে…”
লীনা বলল, “ও কিচ্ছু হবেনা। ভাবিস না। উই উইল নট স্পেন্ড টু মাচ টাইম দেয়ার। আমাদের এই জায়গাটায় এখনও তেমন একটা শুনছিও না কিছু আর শোনার কোনও ইচ্ছেও নেই রে।” লীনা এই বলে ফোন রাখে।
পরেরদিন বেশ অপ্রত্যাশিত ভাবেই তৈরি হয়েছে উইকেন্ড প্ল্যান। আয়নায় নিজের মুখটা দেখে খানিক ভেংচি কেটে নেয় লীনা। কী অবস্থা হয়েছে এই ঘরে বসে বসে অফিস করতে করতে! রাবিশ! বাইরে বেরুলে তবু অ্যালার্ট থাকে নিজের লুক নিয়ে। রুক্ষ চুলগুলো এখুনি স্পা করা দরকার। সেই গত মাসে করিয়েছিল। স্কিনের অবস্থাও তেমনি। সেইসঙ্গে হাত-পা। পুণের ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়ায় এখনও বেশ ধার। এখানে চামড়ায় বেশ টান ধরে। ঘরে বসে অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়া, কন-কল, টুকটাক ঘরের কাজ… স্কিন থেকে চুল, হাত-পায়ের নখ সবের দিকে একবার ঝটিতি তাকিয়ে নেয়। বাড়িতে শুধু পার্টটাইম কাজের লোক মুন্নি । খুব পরিষ্কার। পাশেই একটা বস্তি এলাকায় থাকে তাই রক্ষে। মুম্বইয়ের এক বন্ধু জানিয়েছে, তাদের আবাসনে তো কাজের লোক আসা বন্ধ করে দিয়েছে। বাড়াবাড়ি। যত্তসব! লীনা নিজেকে বোঝায়।
মায়ের ফোন এল। “আব্বার কী মা?”
— ফোন করছিস না, অনলাইনেও নেই, কী ব্যাপার তোর?
— শোনও এখন একটু কাজ আছে। পরে ফোন করছি।
ফোন রেখেই লীনা বিউটি সাঁলোর দিকে পা বাড়ায়। তার আবাসনের নিচেই তাই রক্ষে। গাড়ি বের করতে হবেনা। তবে মা শুনলে এখুনি নজরদারি শুরু করবে। উফফ! পারেও এরা।
ঘরে বসে অফিসের কাজ আগেও করেছে, তবে হোয়াটস্যাপ গ্রুপের বন্ধুবান্ধবরা বলছে ইন্ডিয়াতেও এমন লকডাউন নাকি যে কোনও মুহূর্তে হয়ে যেতেই পারে। কেকা বলছিল, বেশি করে গ্রসারি কিনে রাখতে। ধুস্! তেমন হলে কলকাতায় বাড়ি ফিরে যাবে লীনা। অপরূপা সেই শুনে অবিশ্যি আরও আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেছে, “এবার হঠাৎ করে যদি ট্রেন, ফ্লাইট সব বন্ধ করে দেয়?” লীনা মনকে প্রবোধ দিল। তোরা বড্ড বেশিই ভাবছিস রে! অত ভাবিস না প্লিজ। কুল ডাউন কর।
যাক বাবা, সে দিনের মত পার্লারের কাজ মোটামুটি শেষ হল। আইব্রাও থেকে হেয়ারকাটিং, স্পা থেকে ফেশিয়াল, ম্যানিকিওর থেকে পেডিকিওর সব সেরে মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছিল লীনার। এবার একটু সুপার মার্কেটের দিকে পা বাড়ানোই যায়। বন্ধুরা যা করছে! দেখা যাক তবে ক’টা লাইফ সেভার ফুড আইটেমস…আই মিন রেডি টু ইট…! ওই যে লীনার ফেভারিট সব ইনস্ট্যান্ট পাস্তা থেকে ফ্রোজেন পিৎজা, চিকেন নাগেটস থেকে লাচ্চা পরোটা, স্যুপের পাউচ এসব ঘরে আছে কয়েকটা। তবে আরও ক’টা কিনে রাখাই ভালো। বন্ধুরা যদি শান্তি পায় তাতে। দুধের টেট্রাপ্যাকটাও মনে করে নিতে হবে। আর মাত্র একখানা দুধের প্যাকেট পড়ে আছে ফ্রিজে। লীনার আবার দুধ ছাড়া চলে না।
“মিরর এন্ড কোম্ব”-এর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই লীনার চোখে পড়ল উল্টো ফুটপাথে লোকজনের বেশ জটলা। লীনা ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সুপারমার্কেটের গেটের দিকে। কিন্তু সেখানকার সিকিউরিটি বেশ হাত পা নেড়ে জড়ো হওয়া লোকজনদের কী সব বলছে। ও বাবা! এখানেও লোকজন টেলিভিশন দেখে মাস্ক পরছে । তাজ্জব ব্যাপার! লীনা এগিয়ে গিয়ে সিকিউরিটি কে জিজ্ঞেস করল, “সুপারমার্কেট বন্ধ?”
সিকিউরিটি হতাশ করল তাকে। “নো ম্যাডাম জি। নিউজ দেখকর দুকান কা মালিক সব এমপ্লয়ি কো ছুট্টি দে দিয়া।” মানে? লীনার মাথায় হাত। জিনিসপত্র কেনা হবেনা তবে? যাক গে। ভাগ্যিস স্পা টা হয়ে গেছে। কাল আবার পাবে যাবার প্ল্যান। প্রচুর বন্ধুবান্ধব আছে এখানে তার। তাদের তো নিশ্চয়ই খাবারদাবার স্টোর করা আছে। কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে। লীনা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আবার নিজের ফ্ল্যাটের দিকে পা বাড়ায়। রাস্তায় ভালোই ভিড়। অতএব নো চিন্তা সেই মূহুর্তে। কিছুটা খাবারের ব্যবস্থা ফ্রিজে আছে। দিব্য চলে যাবে।
ওদিকে আবার মুন্নি আসবে রাতের রুটি তরকারি বানাতে, দুপুরের বাসনগুলো ধুতে। ভাবতে না ভাবতেই মনে হল আচ্ছা মুন্নিকেই তো বলা যায় ক’টা দুধের পলিপ্যাক আর ডিম, ব্রেড এনে রাখতে। ইন্ডিয়ানরা প্যারানয়েড হয়ে পড়েছে প্যান্ডেমিকের আতঙ্কে। লিফটের দিকে যেতে যেতেই মুন্নিকে ফোন করে লীনা। মুন্নির ফোন সুইচড অফ বলছে। হয়তো কোথাও গেছে। ওদের ফোনে পয়সা ফুরিয়ে যায় অথবা চার্জ থাকেনা, এমন হামেশাই হয়। নিজের ঘরে ঢুকে টিভি অন করে দেয় লীনা। কলকাতার চ্যানেলে বিদেশের করোনা নিয়ে সেই ভয় দেখানো চলছে। এই চ্যানেলগুলোর জন্যেই মা আরও প্যানিকড হয়ে পড়ছে। টিভি অফ করে বাথরুমের দিকে পা বাড়ায় লীনা। মুন্নির ফোন। “দিদি, হম্ গাঁও যা রহে হ্যায়…কব লটেঙ্গে মালুম নেহি…”
মানে?
লীনার কথার উত্তর না দিয়েই ফোনটা কেটে দেয় মুন্নি। আর ফোন করতেও পারেনা লীনা। উপলব্ধ নেহি হ্যায় বলছে ওপ্রান্তে। এদের এই হঠাৎ করে দেশে যাওয়ার অভ্য়েসটা ইনকরিজিবল! দেখেছে, আমি ঘর থেকে অফিস করছি। কাল আবার উইকএন্ড। জানে দিদি ঠিক সামলে নেবে। মুন্নির ওপর বেদম রাগ হল সেই মূহুর্তে। একগাদা মেথিশাক কেটে রেখে গেল না। কড়াইশুঁটি প্যাকেট বন্দিই পড়ে রইল। ছাড়িয়ে রেখে গেল না। ডিসগাস্টিং! শাওয়ার খুলে স্নান করতে করতে লীনার মনে পড়ল প্রকল্পর কথা। ছেলেটা বড্ড ভালোবাসে তার এই শরীরটা নিয়ে খেলা করতে। বড্ড ম্যানলি তার ম্যান। দাড়ি রাখলে আরও সেক্সি লাগে। কিন্তু বেজায় কুঁড়ে, কিছুতেই রাখবে না। তাদের সম্পর্কের কথা দুই বাড়িতেও এখন ওপেন সিক্রেট। কাল আবার দেখা হবে। প্রচুর মদ্যপান হবে। হুক্কাবারেও যেতে পারে। প্রকল্পর টপ ফেভারিট। বলে, বড় ক্লায়েন্ট-প্রজেক্টের শক্ত শক্ত প্রোগ্রামগুলো লিখতে হলে সপ্তাহান্তে একবার গড়গড়ায় টান না দিলে নাকি চলে না। মাথাটা জ্যাম হয়ে যায়। সো স্যুইট অফ ইউ ডারলিং। সবুজ রঙের অ্যালোভেরা বাথ জেলটা সবে বিন্দুবিন্দু ছড়িয়েছে গায়ে। প্রকল্পর ভিডিও কল। অন্য দিন হলে ফোনটা ধরে ফেলে লীনা। ভালোই লাগে নিজের ভিজে শরীরটা এক্সপোজ করে দিতে প্রকল্পর সামনে। কিন্তু এখন একটা অজানা টেনশন কাজ করছে। কই একটু আগেও তো এমন মনে হচ্ছিল না! ফোনটা ধরল না সে। সঙ্গেসঙ্গেই কেকার ফোন। নাহ! এবার স্নানে অব্যাহতি দিতেই হবে। গা মুছতে মুছতেই আবার দূর্বার ফোন।
– কীরে? হোয়াটস্যাপ গ্রুপের মেসেজ দেখছিস না?
– কেন কী হল আবার? কাল তো দেখা হচ্ছেই আমাদের!
– প্রকল্পর খুব জ্বর। তুই টেনশন করবি বলে জানাইনি। ওর গলায় খুব ব্যাথা। একটু ব্রিদিং ট্রাবল আছে।
– তাই তো! ওর স্লাইট সিওপিডি আছে তো। মনে পড়ল, কিছুক্ষণ আগেই ওকে ফোন করেছিল প্রকল্প। দূর্বা বলল, “ও কিন্তু টাইপ টু ডায়াবেটিস পেশেন্ট, আশা করি তুই সেটা জানিস।”
লীনার মাথায় যেন বাজ পড়ল। এত দিন শুনে আসছিল আমেরিকা, ইতালি, স্পেনের কথা। এরা সময় মতো লকডাউন করেনি বলে প্যান্ডেমিক র্যাপিডলি গ্রাস করে ফেলেছে দেশগুলোকে। কিন্তু তাই বলে প্রকল্প? দূর্বার ফোন রেখেই সেই তারিখগুলো মাথায় খাঁড়ার মত ঝুলতে লাগল লীনার। ঠিক দিন দশেক আগে প্রকল্প ফিরেছে লন্ডনের অফিস ট্যুর থেকে। তারপর সিরিজ অফ ব্যাড থটস! অফিস যায়নি ঠিকই কিন্তু আইসোলেশনেও ঠিক মতো থাকেনি। প্রকল্প বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর কম করে তিন চারদিন মিট করেছে ওরা। আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছে লীনাকে। কী হবে তবে? লীনার মা বাবাই একমাত্র জানে তাদের মেয়ের অটো ইমিউন ডিজিজের কথা। প্রকল্পও জানে তবে এটা বোধহয় জানে না যে করোনার সংক্রমণের সামনে সবচেয়ে বেশি সাসেপ্টিবিলিটি তাদেরই!
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।
গল্পটা দারুণ ….সময়টা ধরা রইল চিরন্তন হো এ….অভিনন্দন
সুন্দর প্রকাশ