রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে বাংলা গানে সার্থক কম্পোজার হিসেবে তাঁর কথাই সর্বাগ্রে মনে আসে: সলিল চৌধুরী (১৯২৫-১৯৯৫)। একাধারে গীতিকার-সুরকার। কী কথায়, কী সুরের আঙ্গিকে, যন্ত্র-আয়োজনে প্রচলিত রীতিনীতি ভেঙে বাংলা গানকে নবদিগন্তের সন্ধান দিলেন। পুরনোকে অস্বীকার করা নয়, ঐতিহ্য মেনেই তাঁর অন্য পথে যাত্রা।

ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের আবহে মানুষ। বাবা জ্ঞানেন্দ্র চৌধুরী পেশায় চিকিৎসক হলেও গানবাজনার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তবে সলিল সবচেয়ে লাভবান হন দাদা নিখিল চৌধুরীর সঙ্গীতময় সান্নিধ্যে এসে। মিলন পরিষদনামে অর্কেস্ট্রার দল ছিল তাঁর। ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়েছিল কান। প্রথম থেকেই তাঁর সঙ্গী বাঁশি। দারুণ বাজাতে পারতেন। ভালবাসার জিনিস এই বাঁশির ব্যবহার তাঁর গানে বিশেষভাবেই দেখা যায়। এছাড়া নানা যন্ত্র বাদনেই তিনি পারদর্শী ছিলেন।

গত শতকের চারের দশকের প্রথম দিকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রগতিশীল গণ- আন্দোলনে শামিল হন সলিল চৌধুরী। যুক্ত হন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ‘-এর সঙ্গে। বিনয় রায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান তাঁকে সঙ্গীত রচনায় উদ্বুদ্ধ করে। এইভাবে গণসঙ্গীত রচনার মধ্যে দিয়েই তাঁর গানের অঙ্গনে প্রবেশ। সলিলের কলমে একে একে উঠে এল তেভাগা আন্দোলন নিয়ে হেই সামাল, হেই সামাল‘ , ‘ও আলোর পথযাত্রী‘, ‘বিচারপতি তোমার বিচার‘, ‘হাতে মোদের কে দেবে‘, ‘আমাদের নানান মতেএমন কত না গান। নিছক স্লোগানধর্মী নয় তাঁর গান, বরং গানকে কম্পোজ়িশন হিসেবে সম্পূর্ণতা দেয়ার এক সচেতন লক্ষ্য ছিল তাঁর। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে দেশি মেলোডিকেও চমৎকার ভাবে কাজে লাগিয়েছেন সুররচনায়। সুর-আঙ্গিক নিয়ে বিশেষ চিন্তা ভাবনা ছিল।

Salil Chowdhury
তরুণ সলিল। ছবি সৌজন্য: wikipedia

রেকর্ডে তাঁর যে-গানটি প্রথম প্রকাশিত হয় তা হল গণসঙ্গীত নন্দিত নন্দিত দেশ আমারনবারুণ রাগে‘। তবে চারদিকে নাম ছড়িয়ে পড়ল যখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রেকর্ড করলেন কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা। কাহিনিধর্মী গান। কাহিনী-সঙ্গীত আগে জগন্ময় মিত্রের কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়েছিল চিঠি‘, ‘সাতটি বছর আগে ও পরে। কিন্তু গাঁয়ের বধূবিষয়, সুর-আঙ্গিকে একেবারেই স্বতন্ত্র। তালফেরতার বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার রয়েছে। হেমন্ত একে স্মরণীয় করে রাখলেন। সলিল কয়েকজন কবির কবিতাতেও সুর দিলেন। কবি সুকান্তের অবাক পৃথিবী‘, ‘রানার‘ ,পরে ঠিকানা। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পালকি চলে‘। কথার সঙ্গে চমৎকার মেলবন্ধন ঘটালেন সলিল তাঁর অভিনব সুর ও ছন্দবিন্যাসের মাধ্যমে। হেমন্তই রূপকার, সার্থক রূপকার। 

সলিল-হেমন্ত জুটির আরও কিছু স্মরণীয় গান: ধিতাং ধিতাং বোলে‘ ,’পথ হারাব বলেই এবার‘, ‘পথে এবার নামো সাথী,’ ‘আমি ঝড়ের কাছে‘, ‘দুরন্ত ঘূর্ণির‘, ‘আমায় প্রশ্ন করে‘, ‘শোনো কোনো একদিনইত্যাদি। হেমন্ত সম্পর্কে একটা কথা চালু আছে, যে তিনি নাকি সহজ চলনের গানেই স্বচ্ছন্দ। সলিলের গানের রূপায়ণ কিন্তু মোটেই সহজ নয়। স্বরের বিন্যাস, চকিত ওঠানামা এসব গলায় সাবলীলভাবে আনা বেশ কঠিন। হেমন্ত অত্যন্ত সাবলীলভাবে তা রূপায়িত করেছেন। সলিল মনে করতেন, হেমন্ত না থাকলে তিনি এইভাবে উঠে আসতে পারতেন না। হেমন্তের গলাকে সলিল বলতেন দেবকণ্ঠ । আবার হেমন্তও সলিলের প্রশংসা করতেন সর্বত্র। 

Salil and Lata
সলিল-লতা জুটি বাঙালির মননের সঙ্গী হয়ে সুরের জগতে রাজত্ব করেছে দীর্ঘদিন। ছবি সৌজন্য: quint.com

সলিলের গানের আর এক অসামান্য রূপকার লতা মঙ্গেশকর। প্রথম রেকর্ডে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে গাইলেও লতার অধিকাংশ আধুনিকই সলিল চৌধুরীর কথায় সুরে। লতার তীক্ষ্ণ সুরেলা কণ্ঠে প্রাণবান হয়েছে সলিলের কত না রকমারি গান: সাত ভাই চম্পা‘, ‘না যেও না‘, ‘ওগো আর কিছু তো নাই‘, ‘কী যে করি‘ , ‘কে যাবি আয়’, ‘ও মোর ময়না গো‘, ‘আজ তবে এইটুকু থাক’, ‘ও তুই নয়নপাখিপ্রভৃতি। প্রতিটি গানে বুদ্ধিদীপ্ত যন্ত্র-আয়োজন মানুষকে মনে রাখতেই হয়। লতা কিছু গান হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের সুরে গেয়েছিলেন, সেগুলির গীতিকার সলিল। যেমন, ‘ বাদলকালো ঘিরলো গো‘, ‘ওগো মা গঙ্গা‘, ‘দে দোল দোল দোল‘ (হেমন্তের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে)। 

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সলিলের বেশ কিছু গান কণ্ঠে ধরেছেন সার্থকতার সঙ্গে। প্রথম গাইলেন উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা‘– এটি অবশ্য বিমলচন্দ্র ঘোষের কবিতা। গানে সবটা ব্যবহৃত হয়নি। কাটা কাটা সুর ছন্দে গানটি দারুণ ফোটে সন্ধ্যার চর্চিত কণ্ঠে। সন্ধ্যা আর গেয়েছেন যা রে যা ফিরে যা‘, ‘ গুনগুন মন ভ্রমরা’, ‘ যদি নাম ধরে তারে ডাকি‘, ‘সজনী গো কথা শোনো‘, ‘গা গা রে পাখি গা‘, ‘গহন রাতি ঘনায়‘, ‘কিছু আর চাহিব নাইত্যাদি। মেলোডির সঙ্গে ছন্দ প্রয়োগের যে চাতুর্য, তাকে সহজভাবেই প্রকাশ করেন সন্ধ্যা। শ্যামল মিত্রের সামান্য অনুনাসিক অথচ মধুর কণ্ঠে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল সলিলের একাধিক গান: যা যারে যা পাখি‘, ‘আহা ওই আঁকাবাঁকা যে পথ‘, ‘যদি কিছু আমারে শুধাও‘ , ‘দূর নয়ইত্যাদি। এখানে যদি কিছু আমারে শুধাও‘- এর গঠনটি অন্য ধরনের। স্থায়ী ও অন্তরা তালছাড়া, অন্তরার পর স্থায়ীতে ফিরে তাল শুরু। এখানেই উল্লেখ্য যে, দেবব্রত বিশ্বাসও এই গানটি খুবই গাইতেন। 

সবিতা চৌধুরীর প্রায় সব গানেরই গীতিকার সুরকার সলিল চৌধুরী। হলুদ গাঁদার ফুল‘, ‘সুরের এই ঝর ঝর ঝর্ণা‘, ‘মরি হায় গো হায়‘, ‘মনোবীণায় এখনই কেন‘  , ‘ঘুম আয় ঘুম আয়‘ — এমন সব গানে সবিতা তাঁর যোগ্যতার পরিচয় রেখেছেন। সুরের এই ঝর ঝরগানে স্বরসন্ধির ব্যবহার চমকে দেয়। সলিলের আরও অনেক গানেই এই স্বরসন্ধির চমকপ্রদ প্রয়োগ আছে। সবিতার একটি গান আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য : আঁধারে লেখে নাম। এখানে সলিল শুধুমাত্র গীতিকার, সুর নচিকেতা ঘোষের। সলিল- নচিকেতা কম্বিনেশন কিন্তু একেবারেই বিরল। 

সলিলের গানের আরও এক সফল রূপকার দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। গেয়েছিলেন একদিন ফিরে যাব চলে‘, ‘শ্যামলবরণী ওগো কন্যা‘ , ‘পল্লবিনি গো সঞ্চারিণীইত্যাদি। সলিলের সুরে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা রেখ মা দাসেরে মনেদ্বিজেনের ভরাট কণ্ঠে প্রাণ পায়। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের একটিই মাত্র বেসিক অ্যালবাম সলিলের কথায় সুরে: ঝনন ঝনন বাজেঅন্তবিহীন এই অন্ধরাতের শেষ। দুটি গান দুই গোত্রের। কলাবতী রাগাশ্রিত ঝনন ঝনন বাজে‘-তে অন্তরাতে ছন্দটা যেভাবে ভাঙেন সলিল, তা অভিনব। সুরটি অবশ্যই রাগসর্বস্ব নয়। অন্তবিহীন এইপাশ্চাত্য ধরনে। 

সলিলের আরও একটি মনে রাখার মতো রচনা: নিজেরে হারায় খুঁজি। গেয়েছিলেন মাধুরী চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া সলিলের আরও কিছু গান, ‘ওই যে সবুজ বনবীথিকা‘, ‘আজ শরতের আকাশেপ্রাণ পেয়েছিল মাধুরীর কণ্ঠে।  প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া নাও গান ভরে নাওসেই ঝিম ঝিম সুরে ঝিঁঝি ডাকা দুপুরে আসা শান্তির আহ্বানসলিলের সুরে যেমন ফুটেছে তেমনি মরমী সুরময় গায়ন সুকণ্ঠী প্রতিমার। ছন্দ, সুরের অনবদ্য কারুকাজ দেখি আর একটি গানে: পাগল হাওয়া। ছয়ের দশকে এটি প্রথম রেকর্ড করেন জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। অনেক পরে ১৯৮০-তে গানটি ফের রেকর্ড করেন মধুকণ্ঠী সুবীর সেন। এই রেকর্ডের অন্য গানটি কথায় সুরে মেজাজে একেবারে অন্যরকম: ধরণীর পথে পথে ধূলি হয়ে রয়ে যাব এই কামনা। এর গভীরতা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। সুর- ছন্দের উচ্ছলতার সেই চেনা সলিল প্রায় অচেনা এখানে। 

Salil Chowdhury
রাজেন তরফদারের গঙ্গা ছবিতে সলিল চৌধুরীর সুর মুগ্ধ করেছিল বাঙালিকে। ছবি সৌজন্য: bollywoodirect.medium.com

এই অন্যরকম সলিলকেই পাওয়া যায় সুচিত্রা মিত্রের সেই মেয়ে‘  বা উৎপলা সেনের প্রান্তরের গান আমার‘ – এ। সলিলের সুরের গভীরতায় আবিষ্ট হতে হয় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের আমি পারিনি বুঝিতেবা নির্মলা মিশ্রের আমার এ বেদন মাঝে অশ্রু হয়ে এলেগানেও। শেষোক্ত গানটির গীতিকার অবশ্য পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সলিলের আরও নানা গান বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: মন মাতাল সাঁজ সকাল‘ (মুকেশ), ‘আমি চলতে চলতে‘ (পিন্টু ভট্টাচার্য), ‘যায় যায় দিন‘ ( বিশ্বজিৎ), ‘এমনি চিরদিন তো‘ (অনুপ ঘোষাল), ‘কি হল চাঁদ‘ (সাগর সেন), ‘ চলে যে যায় দিন‘ (অরুন্ধতী হোম চৌধুরী)। শেষোক্ত গানটি প্রথমে শ্যামল মিত্র গেয়েছিলেন রেডিওতে, পরে এই সুরে একটি হিন্দি গান গেয়েছিলেন কিশোরকুমার অন্নদাতাছবিতে। 

বেসিক আধুনিক মূল ক্ষেত্র হলেও ভারতের বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন চলচ্চিত্রে, বাংলা, হিন্দি, তামিল, মালয়ালম — সলিল সুরযোজনা করেছেন। হিন্দিতে সর্বাধিক, তারপর বাংলা, মালয়ালম। বাংলা ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: পাশের বাড়ি (১৯৫২), একদিন রাত্রে (১৯৫৬), গঙ্গা (১৯৬০), কিনু গোয়ালার গলি (১৯৬৪), রায়বাহাদুর (১৯৬১), মর্জিনা অবদাল্লা (১৯৭৩)। মনে রাখার মতো গান: ঝির ঝির ঝির বরষায়‘ ( ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পাশের বাড়ি), ‘এই দুনিয়ায় ভাই‘ (মান্না দে, একদিন রাত্রে), ‘আমায় ভাসাইলি রে‘ (মান্না দে, গঙ্গা), ‘রাতকুহেলি ছড়ানো‘ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রায়বাহাদুর), ‘দখিনা বাতাসে‘ (সবিতা চৌধুরী, কিনু গোয়ালার গলি), ‘বাজে গো বীণা‘ (মান্না দে, মর্জিনা আবদাল্লা), ‘বুঝবে না‘ (লতা মঙ্গেশকর, কবিতা) ইত্যাদি। 

Salil Chowdhury
হিন্দি বাংলা ছাড়াও একাধিক ভারতীয় ভাষায় সুরারোপের কাজ করেছেন সলিল চৌধুরী। ছবি সৌজন্য: discogs.com

প্রায় ষাটটি হিন্দি ছবিতেও সুর দিয়েছেন সলিল। উল্লেখযোগ্য গান: আজারে পরদেশী‘ (লতা মঙ্গেশকর, মধুমতী), ‘সুহানা সফর‘ (মুকেশ, মধুমতী), ‘ ইতনা না মুঝসে তু‘ (লতা ও তালাত মেহমুদ, ছায়া), ‘জিন্দেগি ক্যায়সে‘ (মান্না দে, আনন্দ), ‘কোই হোতা জিসকো আপনা‘ (কিশোরকুমার, মেরে আপনে), ‘অ্যায় দিল কাহা তেরি‘ (দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, মায়া), ‘গঙ্গা আয়ে কাঁহাসে‘ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কাবুলিওয়ালা), ‘জানেমন জানেমন‘ (আশা ভোঁসলে ও জেসুদাস) প্রভৃতি। সলিলের সুরে উল্লেখ্য দক্ষিণী ছবি : চেম্মিন ।

সবমিলিয়ে এক সার্থক কম্পোজার সলিল চৌধুরী। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা আলোচনা করব তাঁর এক একটি গান ধরে ধরে, কীভাবে সুরের জাদুতে তামাম ভারতবাসীকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলেন সলিল।

Swapan Shome

স্বপন সোম এ কালের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ও সংগীত গবেষক। গান শিখেছেন মোহন সোম, মায়া সেন ও সুভাষ চৌধুরীর মতো কিংবদন্তীদের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে 'দেশ' পত্রিকায় সংগীত সমালোচনা করেছেনl গান নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন 'আনন্দবাজার পত্রিকা', 'দেশ', 'আনন্দলোক', 'সানন্দা', 'আজকাল', 'এই সময়', 'প্রতিদিন' প্রভৃতি পত্রপত্রিকায়l

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *