কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ।
আর ভোজনরসিক বাঙালির কাছে
পার্বণ মানেই চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়।
সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত শারদীয়া উৎসবে বাঙালির জীবনে এই ধারা আজও প্রবহমান
তবে একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে সেকাল ও একালের পুজোর ধারাতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে স্বাভাবিক পরিবর্তন আর সেই পরিবর্তনকে বাঙালি গ্রহণও করেছে সানন্দে। কিন্তু জীবনের  সায়াহ্নে পৌঁছেও ছ’দশকেরও বেশি আগে আমার বাড়ির পুজো ও পাড়ার পুজোর আনন্দ স্মৃতি আজও অমলিন, আজও উজ্জ্বল।  

দেশভাগের অব্যবহিত পরেই পূর্ববঙ্গের বরিশাল জেলায় বাস চুকিয়ে পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যকেই চলে আসতে হয়েছিল ইটকাঠে মোড়া এই কলকাতা শহরে। অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা কাটিয়ে উদ্বাস্তু তকমা লাগানো একটি পরিবারের পক্ষে ভদ্রস্থ ভাবে থিতু হয়ে বসা খুব সহজ ছিল না সেদিন। একটার পর একটা ভাড়া বাড়ি পালটে যখন দক্ষিণ কলকাতার এক পাড়ায় এসে উঠলাম, ততদিনে আমাদের আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। পরিবারে তখন উপার্জনকারী সদস্য তিনজনএক পিসি, এক কাকা সরকারি চাকুরে আর আমার বাবা এক নামী বেসরকারি সংস্থার ‘মেডিক্যাল অফিসার।’ 

Durgapujo
সেকেলে বাড়ির পুজো মানেই বিশাল ঠাকুরদালান। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা শহরে সবই সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে। ছবি – wikimedia commons

দেশের বাড়িতে ঘটা করে দুর্গাপুজো হত। সেবার পরিবারের সবাই মিলে ঠিক করলেন ভাড়া বাড়ি হোক, সেখানেই দুর্গাপুজো হবে। তবে মূর্তি নয়, ঘটপুজো হবে। নিকটজন আসবেন। সাধ্যমতো তাঁদের আপ্যায়ন করা হবে। আমার বাবার পরের ভাই, আমাদের ‘বড়কাকু’ ছিলেন পুজো, বিয়ে বা বাড়ির যে কোনও অনুষ্ঠানের মুখ্য কর্মকর্তা। ওঁর একটি ‘খেরোর খাতা’ ছিলপুজোর একমাস আগে থেকে সেই খাতা খুলে তিনি বসে যেতেন। শনি, রোববার বাড়ির বৈঠকখানা ঘরে ঠাকুর্দাকে মধ্যমণি করে জমজমাট পারিবারিক সভা বসত। বাবা, কাকা, ঠাকুমা, মা, পিসি- সবাই সামিল হতেন, এমনকি আমাদের মতো কচিকাঁচাদেরও অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল সে সভাতে। পুজোর বাজারের ফর্দ থেকে শুরু করে নিমন্ত্রিতদের তালিকা, পুজোর চারদিনের মেনু, সব ঠিক করা হত এই সভাতেপরিবারের সদস্যদের মধ্যে কাজের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হত। তখন কতটুকুই বা বয়স আমাদের! কিন্তু বয়স অনুপাতে আমরাও ছিটেফোঁটা কাজের ভার পেতাম। আমার দিদি যদি চন্দন পাটাতে পুজোর চন্দন বাটবার বরাত পেত, আমাকে দেওয়া হত ভোরবেলা শিউলিফুল তুলে মালা গাঁথবার কাজ, আর তাতেই কী আনন্দ আমাদের!

ষষ্ঠীর দিন থেকে বাড়িতে অতিথি সমাগম শুরু হয়ে যেত। শ্রীরামপুর থেকে সপরিবার আসতেন আমার ঠাকুর্দার অধ্যাপক ছোটভাই, আমাদের ছোড়দাদু ও তাঁর পরিবার। আমাদের দুই বিবাহিত পিসিও তাঁদের কর্তামশাই এবং ছেলেমেয়ে নিয়ে হাজির হতেন যথাসময়ে। আমার দিদিমাকে নিয়ে ছোটমামাও চলে আসতেন পুজোর ক’দিন আগে থেকে। এছাড়া কলকাতার আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের পুজোবাড়িতে আসা যাওয়া লেগেই থাকত। পুজোর দিনগুলিতে মা-ঠাকুমা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন পুজোর কাজে। তাই রান্নাঘরের কাজ সামলাতে ভবানীপুরের উড়েপাড়া থেকে ঐ ক’দিনের জন্য যোগাড়ে সমেত একজন উড়িয়া ঠাকুরকে বহাল করা হত। তবে সুষ্ঠুভাবে কাজকর্ম সম্পন্ন করতে বাড়ির মেয়ে-বৌরাও রান্নাঘরের কাজে হাত লাগাতেন। সে এক ভারি আনন্দের ধূম পড়ে যেত আমাদের বাড়িতে।

তোরঙ্গ-বন্দি বাড়তি তোষক, হালকা বালাপোশ, বালিশ, চাদর সব বেরিয়ে পড়ত। বড় হল ঘরের কালো বর্ডার দেওয়া লাল মেঝেতে মস্ত বিছানা পাতা হত। সেখানে আমরা খুড়তুতো, পিসতুতো ভাইবোনদের নিয়ে সারি সারি শুয়ে পড়তাম। কী যে মজা হত! পুজোর দিনগুলো খাওয়ায়াদাওয়া, হৈ হুল্লোড়ে কেটে যেত। ভোর ভোর বাবাকাকারা বাজারের মস্ত থলে হাতে বাজারমুখী। আমার বাবার চিরদিনের অভ্যেস ছিল বাজারে ঢুকে প্রথমে দু’চক্কর মেরে দেখে নেওয়া, সেরা জিনিসটি নিয়ে কোন বিক্রেতা কোথায় বসে আছে। তার পরে ফর্দ মিলিয়ে বাজার। মরশুমের নতুন সব সবজি- যেমন নতুন কচি সিম, মিঠেআলু, ছাঁচি কুমড়ো, সবে ফুটে ওঠা ফুলকপি, মটরশুঁটি, কচি মাঝারি মাপের বাঁধাকপি, নতুন আলু, পুজোর ফল থলে ভর্তি করে এনে হাজির করতেন ওঁরা। তারপরে শুরু হত আনাজ কোটার পালা। কাকি, পিসিরা বসে যেতেন বঁটি নিয়ে তরকারি কুটতে। প্রতিদিনের পুজোর ফুল আলাদা করে আনতেন এক ফুলওলা আর তার সঙ্গে বাগান থেকে ডালি ভর্তি করে তোলা শিউলি, টগর, জবা তো থাকতই। 

Durgapujo
পুজো মানেই অষ্টমীর সকালে শাড়ি কিংবা ধুতি পাঞ্জাবিতে সেজে ভক্তিভরে অঞ্জলি। ছবি সৌজন্য – indiatvnews.com

সকাল সকাল স্নান সেরে নতুন জামা পরে আমরা অঞ্জলি দিতাম। তারপরে বাড়ির দালানে বসে জলখাবার খাওয়া। এক এক দিন এক এক রকমের খাওয়া। কোনও কোনও দিন বাজার করে ফেরার পথে বাবা কাকারা সেন মহাশয়ের দোকান থেকে গরম ফুলকপির সিঙ্গাড়া, জিলিপি নিয়ে আসতেন। যেদিন জিলিপি মিলত না, সেদিন আসত ঐ দোকানের বিখ্যাত লবঙ্গ লতিকা বা হাতে গরম অমৃতি। আমার মণিপিসির আবার দারুণ হাত যশ ছিল মুগের ডালের কচুরি তৈরিতে। পুজোর একদিন জলখাবারের মেনুতে বাঁধাধরা ছিল এই কচুরি আর সাদা আলুর দম। এই কচুরির জন্য আমরা বাচ্চারা হা পিত্যেশ করে বসে থাকতাম। মজাদার এই কচুরিতে পিসি দিতেন ভাজা মুগডালের সুস্বাদু পুর, যাতে পড়ত কালো জিরে ও মৌরি ভাজা শুকনো গুঁড়োর মিশ্রণ ও হিংয়ের ফোড়ন।  

সপ্তমীর দুপুরে গরম গরম খিচুড়ি ভোগ। তার সঙ্গে লাবড়া, বেগুনি, চাটনি আর বাড়িতে তৈরি মালপোয়া ও বোঁদে। অষ্টমীতে লুচি, ছোলার ডাল ও ফুলকপি। নবমীতে দেশের বাড়িতে পাঁঠাবলি দেওয়ার রীতি থাকলেও কলকাতায় সে প্রথা বহাল রাখা সম্ভব হয়নিতবে প্রথা মেনে নবমীর দুপুরে কচি পাঁঠার মাংস খাওয়ার রেওয়াজটি কিন্তু কোনওদিন বন্ধ হয়নিপেঁয়াজ, রসুন ছাড়া নিরামিষ পাঁঠার মাংস রান্না করতেন আমার রন্ধনপটু বাবা আর হাতে হাতে যোগান দিতেন তাঁর লক্ষ্মণ ভাইয়েরাসর্ষের তেলে থেঁতো করা গোটা গরম মশলা ফোড়ন দিয়ে আদা, ধনে, জিরেবাটা দিয়ে রান্না এই মাংসের স্বাদই হত আলাদা। রাতে হত লুচি, বেগুনভাজা, ছানার ডালনা আর ফুলকপি দিয়ে এক জম্পেশ পদ, চাটনি আর রসমুণ্ডির পায়েস বা বাঙালি পোলাও, বেগুন বাসন্তী, ধোকার ডালনা, রসমালাই।  

Bhog
পুজোর কদিন, খাওয়া মানেই ভোগ। নোনতা হোক বা মিষ্টি। ছবি সৌজন্য – indiatimes.com

পুজোর দিনে বাড়িতে ছোটখাটো ভিয়েন বসত। প্রধান দায়িত্বে থাকতেন ভবানীপুরের উড়িয়াপাড়া থেকে বহাল করা ঠাকুরমশাই ও তাঁর দুই সহযোগী। কোনওদিন হত মালপোয়া, কোনওদিন বালুশাই, আবার কোনওদিন রসালো বোঁদে আর ছানাবড়া। নবমীর দিনে দুপুরে শেষ পাতে আমাদের পছন্দের মিষ্টি ছিল বোঁদের পায়েস।

পুজো প্রসঙ্গে মনে পড়ছে আমার এক দিদিমার কথা। আমার মায়ের বালবিধবা এই পিসিমা ছিলেন ডাকসাইটে সুন্দরী। আমরা যখন তাঁকে দেখেছি, ততদিনে তিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ, মুখে বলিরেখা- কিন্তু তাতেও তাঁর সৌন্দর্য এতটুকু ম্লান হয়নি। দেশভাগের পরেও ওপার বাংলার কালিয়াতে বসে কলকাতাবাসী ভাইয়ের সম্পত্তি দাপটের সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ করে গেছেন আমৃত্যু। এদেশে স্থায়ীভাবে চলে আসার জন্য ভাইপো ভাইঝিদের হাজার সাধ্যসাধনা অনুরোধ উপরোধ ওঁকে টলাতে পারেনি। প্রতি বছর পুজোর আগে একবার কলকাতায় আসতেন। শীতের পিঠে পার্বণ কাটিয়ে আবার ফিরে যেতেন তাঁর ‘দ্যাশের বাড়ি’তে। মস্ত এক তোরঙ্গ বোঝাই করে আনতেন নিজেদের গাছের ঝুনো নারকেল, বৈয়াম ভরতি করে আম, কুল ইত্যাদি নানা স্বাদের আচার, কাসুন্দি, ঝোলা গুড়, পাটালি গুড়, মোয়া, নাড়ু আর আমাদের সকলের পছন্দের চিঁড়া কুচা। তখন বুঝতাম না, আজ বুঝতে পারি সে চিঁড়া কুচা ছিল নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ শিল্পকর্ম!  নারকেলের শাঁস চিঁড়ের মতো মিহি করে কুচিয়ে, ঘিয়ে হালকা ভেজে চিনির রসে মেখে শুকিয়ে নিলেই তৈরি ঝুরঝুরে স্বাদু চিঁড়াকুচা। সম্বৎসর এই চিড়াকুঁচার জন্য আমরা, পিসিদিদুর নাতিনাতনিরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম। আমাদের পুজোয় আমার ঠাকুমায়ের মান্য অতিথি ছিলেন এই পিসিদিদু! ওঁর হাতে তৈরি  নারকেলের নাড়ু, চন্দ্রপুলি ছিল পুজোর প্রসাদের মুখ্য অঙ্গ।   

আমার বাবার চিরদিনের অভ্যেস ছিল বাজারে ঢুকে প্রথমে দু-চক্কর মেরে দেখে নেওয়া সেরা জিনিসটি নিয়ে কোন বিক্রেতা কোথায় বসে আছে। তার পরে ফর্দ মিলিয়ে বাজার করা। মরশুমের নতুন সব সব্জি- যেমন নতুন কচি সিম, মিঠাআলু, ছাঁচি কুমড়ো, সবে ফুটে ওঠা ফুলকপি, মটরশুঁটি, কচি মাঝারি মাপের বাঁধাকপি, নতুন আলু পুজোর ফল থলে ভর্তি করে এনে হাজির করতেন ওঁরা। তারপরে শুরু হত সব্জি কাটার পালা।

সে সব দিনে পাড়ার পুজো ছিল বাড়ির পুজো নামান্তর মাত্র। কাঁকুলিয়া রোডের যে পাড়াতে আমরা থাকতাম, সারা পাড়ার বাসিন্দারা এই বারোয়ারি পুজোকে কেন্দ্র করে এক যোগে মেতে উঠতেন শারদোৎসবের আনন্দে। পুজো আর তার আনুষঙ্গিক যা কিছু খরচ, তার জন্য পাড়ার বাসিন্দাদের কাছ থেকে  চাঁদা তোলা হত এবং পুজোর সব কাজে তাঁরা সবাই সানন্দে অংশ নিতেন। মনে পড়ে পুজোর মধ্যে একদিন দুপুরে মণ্ডপে পংক্তিভোজনের ব্যবস্থা থাকত সেদিন বাড়ির পুজো ছেড়ে আমরা ভাইবোনেরা দল বেঁধে পাত পেড়ে বসে যেতাম বারোয়ারি ভোজে। মেনুতে থাকত ভোগের খিচুড়ি, বেগুনি, কড়াইশুঁটি আলু দিয়ে বাঁধাকপির ঘন্ট, চাটনি, পাঁপড়ভাজা আর পায়েস। পাড়ার দাদারা কোমরে গামছা বেঁধে পরিবেশন করতেন। সে ভোজের  আনন্দের চেহারা ছিল একেবারে অন্য ধারার। পয়সার চাকচিক্য না থাকলেও সে পুজোয় আন্তরিকতা ও আনন্দের কোন খামতি ছিল না।

শুধু কি খাওয়া? পাড়া-পুজোর আর এক আকর্ষণ ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে ছিল এক মস্ত মাঠ। সারা বছর ছেলেরা সেই মাঠে গরমের দিনে ফুটবল আর শীতকালে ক্রিকেট খেলত। মহালয়ার দিন থেকে সেই মাঠে বাঁশ পড়তে শুরু করলেই আমাদের মনে পুজোর ভেঁপু বেজে উঠত। 

Jolsha
হাট্টিমা টিম টিম ছড়ার গান গেয়ে বিখ্যাত শিল্পী আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি – সৌজন্য – wikipedia

আমাদের বাড়ির খুব কাছে এক দোতলা বাড়িতে থাকতেন ‘হাট্টিমা টিম টিম’ খ্যাত ছড়ার গানের শিল্পী আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর এই ছড়ার গানের রেকর্ড তখন সব বাঙালির ঘরে ঘরে বাজত। ভারি সুন্দরী ছিলেন আলপনা। বাংলা সিনেমার নেপথ্য বা প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের পাশাপাশি আলপনার খ্যাতিও কিছু কম ছিল না! শোনা যায় উত্তমকুমারের ভারি পছন্দের শিল্পী ছিলেন। ‘আল্পস্‌’ বলে ডাকতেন। একবার নাকি ওঁরই কোন ছবিতে আলপনাকে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আলপনার দাদারা অনুমতি দেননি। 

তখনকার দিনের বিখ্যাত সুরকার অনুপম ঘটকেরও বাস ছিল ঐ পাড়াতে। তিনি ছিলেন অতি সজ্জন ও শ্রদ্ধেয় মানুষ। তখনকার কলকাতায় জলসার চল ছিল। পুজোর সময় আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনুপম ঘটকের দৌলতে পাড়ায় বিরাট জলসা হত। ম্যারাপ বাঁধা অতি সাধারণ মঞ্চের ওপর একটি মোটা শতরঞ্চি পাতা, আর তাতে এসে বসতেন তখনকার দিনের নামী সব শিল্পীরা। বাদ্যযন্ত্র বলতে একটি হারমোনিয়াম আর সঙ্গতের জন্য বাঁয়া-তবলা মাত্র সম্বল। শিল্পীদের স্বর শেষের সারির শ্রোতাদের কাছে পৌঁছবার জন্য থাকত পাড়ার ডেকরেটারের কাছ থেকে ভাড়া করে আনা একটি সাধারণ মাইক। মঞ্চে জ্বলত একটি বা দুটি ১০০ ওয়াটের বালব।

মনে পড়ে পুজোর মধ্যে একদিন দুপুরে মণ্ডপে পংক্তিভোজনের ব্যবস্থা থাকত সেদিন বাড়ির পুজো ছেড়ে আমরা ভাইবোনেরা দল বেঁধে পাত পেড়ে বসে যেতাম বারোয়ারি ভোজে। মেনুতে থাকত ভোগের খিচুড়ি, বেগুনি, কড়াইশুঁটি আলু দিয়ে বাঁধাকপির ঘন্ট, চাটনি, পাঁপড়ভাজা আর পায়েস। পাড়ার দাদারা কোমরে গামছা বেঁধে পরিবেশন করতেন। সে ভোজের  আনন্দের চেহারা ছিল একেবারে অন্য ধারার।

বেশি রাত করে আসর বসত। রাতের খাওয়াদাওয়ার পাট শেষ করে সবাই এসে আসরে বসতেন। সারারাত ধরে জলসা চলত। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় কাকে ছেড়ে কার নাম করব? শুধুমাত্র অনুপম ঘটক ও আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধে বিনা পারিশ্রমিকে তাঁরা সাধারণ একটি পাড়ার অনুষ্ঠানে এসে এভাবে গান করে যেতেন! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায় “মুছে যাওয়া দিনগুলি”, গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের “মধুমালতী ডাকে আয়” বা শ্যামল মিত্রের গলায় “সেদিনের সোনা-ঝরা সন্ধ্যা”… কত গান যে শুনেছি তখন শিল্পীদের সামনে বসে! 

পুজোর একদিন সন্ধ্যায় আবার পাড়ার ছেলেমেয়েদের দিয়ে অনুষ্ঠান ছিল বাঁধাপরিচালনার দায়িত্বে  থাকতেন, তখনকার দিনের আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের শিল্পী লীলা রায়। আমরা সবাই, পাড়ার ছোট বড় ওঁকে ডাকতাম ‘লীলাদি’ বলে।  গোলগাল শ্যামলা চেহারা, কপালে বড় করে একটি সিঁদুরের টিপ, পরনে তাঁতের শাড়ি সাদাসিধে করে পরা। আজও লীলাদির কথা মনে হলে আমার সে চেহারাটাই চোখে ভাসে। পুজোর মাস দুয়েক আগে থেকে ওঁর একতলার বাড়ির ঢাকা বারান্দায় মহড়া শুরু হয়ে যেত। কোনওবার নাটক, কোনওবার নৃত্যালেখ্য, আবার কোনওবার ছেলেমেয়ে মিলে কৌতুক নাটক। এতজন ছেলেমেয়েকে দিয়ে নাচগান বা নাটক করানো মোটেই সহজ ছিল না। বিশেষ করে বেশিরভাগ কুশীলব যেখানে আমাদের মতো আনাড়ি। গান ও নাটকের পুরো পরিকল্পনা লীলাদির, শুধু নাচের ব্যাপারটি ওঁর সাধ্যের বাইরে ছিল। পাড়ারই এক দিদি, তিনি আমাদের নাচ শেখাতেন। একবার রবীন্দ্রনাথের ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্য হল। আমি প্রকৃতির মায়ের ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলাম সেবার। আমাদের এই অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বলতে ছিল এস্রাজ, বাঁশি আর তবলা।  বাইরে থেকে আসতেন সেই তিনজন যন্ত্রী আর মঞ্চের পেছনে হারমোনিয়াম নিয়ে লীলাদি নিজে বসতেন পাড়ার মা, দিদি আর দু’একজন দাদাকে নিয়ে। এই রকম একটি গানের দল আর আমাদের মতো কচিকাঁচা, কিশোরকিশোরীদের নিয়ে তিনি কীভাবে বাজিমাৎ করে দিতেন, আজ সে কথা ভাবলে অবাক লাগে। 

Sindur Khela
দশমী মানেই মনখারাপ। তার মাঝেই এয়োস্ত্রীদের সিঁদুরখেলা। ছবি সৌজন্য – janusartgallery.com

দশমীর দিন সকাল থেকে আমাদের মনখারাপকোনও কোনওবার আমাদের মনের সঙ্গে তাল রেখে সারাদিন আকাশের মুখও ভার থাকত আর তার সঙ্গে দু’চার পশলা বৃষ্টি! বাড়িতে, মণ্ডপে সর্বত্রই যেন বিষাদের ছায়া। মনে পড়ে ঐ দিন দেবীকে নিবেদন করার জন্য  বাড়িতে মা দধিকর্মা করতেন। দই, খই, বীরখণ্ডি, খাজা, তিলের নাড়ু, বাতাসা এসব দিয়ে তৈরি দধিকর্মা ছিল ভারি সুস্বাদু। ঠাকুরমশাই এসে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘট বিসর্জন দিতেন। বিকেলের দিকে পাড়ার মণ্ডপে ‘সিঁদুর খেলা’ হত। বাড়ির এয়োস্ত্রীরা মা দুর্গাকে বরণ করে, তাঁর কপালে সিঁদুর ছুঁইয়ে, মিষ্টি মুখে দিয়ে, অতি মমতায় মায়ের মুখ মুছিয়ে দিতেন পানপাতা দিয়ে। সত্যি সত্যি মনে হত মৃৎপ্রতিমার চোখে যেন জলের আভাস। মাদুর্গার চার ছেলেমেয়ে, তাঁদের বাহন এমনকী অসুরও বোধহয় যতদূর মনে পড়ে বাদ যেতেন না, বরণ ও মিষ্টিমুখের পর্ব থেকে। সন্ধ্যের মুখে পাড়ার কর্মকর্তারা প্রতিমা লরিতে চাপিয়ে বাবুঘাটে যেতেন ভাসান দিতে। আমাদের বাড়ির ঘটও যেত ঐ লরিতে। ছোটকাকা শুধু সঙ্গে যেতেন। ভাসান শেষে ছোটকাকা ফিরে এলে ঠাকুরমশাই সবার মাথায় শান্তিজল ছিটিয়ে দিতেন।

আমাদের পরিবারে ঐ দিন একটি বিশেষ প্রথা উদ্‌যাপিত হত। বিজয়া দশমীর শুভক্ষণে আমাদের পুরো পরিবার শাস্ত্রবিধি মেনে সারা বছরের জন্য ‘শুভ যাত্রা’টি সেরে রাখতেন। এর ফলে আগেকার দিনে দিনক্ষণ মেনে যাত্রা করার কোনও প্রয়োজনীয়তা থাকত না। শান্তিজলের পর আমার ঠাকুর্দা সংস্কৃত শ্লোক উচ্চারণ করে দরজা খুলে বেরুতেন আর ওঁর পিছনে পরিবারের সব সদস্য। বেরুবার মুখে দরজার পাশে একটি তাম্রপাত্রে ঠাকুমা সাজিয়ে রাখতেন ফুল, ঘি, দই, রুপো, সোনা, ধান এইসব। শ্লোকে উল্লিখিত কল্যাণের প্র্তীক এই সব সামগ্রী দর্শন করে আমাদের ‘যাত্রা’ শুরু করতে হত। তারপরে বাড়ি প্রদক্ষিণ করে ফিরে এলেই সম্পন্ন হত সারা বছরের ‘যাত্রা’ পর্ব।

Durgapujo
বাড়ির পুজো মানেই ঠাকুরদালানে আড্ডা আর দেদার ভোজ। ছবি সৌজন্য – mint.com

বিজয়ার রাতে জ্ঞাতিগুষ্টি নিয়ে পংক্তিভোজনে বসার প্রথাও ছিল আমাদের পরিবারে। সারাদিন ধরে বাড়িতে রান্নার ধূম। পুজোয় বহাল করা ঠাকুর শুধু যোগাড়ের কাজটি করতেন। প্রধান রান্নার দায়িত্বে থাকতেন আমাদের মা-ঠাকুমা। ঐদিন বাড়তি যা কিছু রান্নাই হোক না কেন, কিছু পদ ছিল একেবারে বাধ্যতামূলক। তার মধ্যে নারকেল কুচি, জিরে-আদাবাটা দিয়ে মানকচুর ডালনা, আলু দিয়ে পাঁঠার মাংসের গা-মাখা ঝোল, আমআদা দিয়ে কাঁচা তেঁতুলের মিষ্টি চাটনি আর শেষ পাতে যে মিষ্টিই থাকুক না কেন, কাজু কিশমিশ দেওয়া গোবিন্দভোগ চালের পায়েস রাখতেই হত। অন্য সব পদে পরিবর্তন করা গেলেও এই ক’টি পদ প্রতি বছর ছিল বাঁধাধরা।

বিজয়ার অনুষ্ঠানের সঙ্গে শেষ হত দুর্গাপুজোর উৎসবের রেশ! অতিথিরা একে একে বিদায় নিতেন।
কিন্তু শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে!
আর তাই বিজয়ার বিষাদের মধ্যেই সেদিন যেন নীরবে বেজে উঠত আবাহনের সুর!
বাঙালির জীবনে আগামী শারদ উৎসবের জন্য এক বছরের সানন্দ প্রতীক্ষা!

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।

3 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *