প্যাচপ্যাচে ভাদ্রের গরমে  লোডশেডিঙের নির্ঘুম রাত্রির পর  সকাল সকাল মেজাজটা আরও বিগড়োবার পক্ষে যা যা উপাদান থাকতে পারে, তার একটা যদি হয় স্নানের সময় হাত ফসকে ইঁদারার জলে মহার্ঘ্য সাবানটা পড়ে যাওয়া, যখনও ঘেমো পিঠ,  পা এবং ময়লা কনুইতে আদরস্পর্শ পড়েনি, তাহলে অন্যটা অতি অবশ্যই হতে হবে, যখন হতভম্ব কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে ইন্দ্রজিত একবার নিজের পিছলানো হাত আর পরক্ষণেই কুয়োর জল, এই দুইয়ের মধ্যে কোথায় দৃষ্টিকে সেট করবে বুঝে উঠতে পারছেনা, ঠিক তখনই বারান্দা থেকে মিলির চেঁচিয়ে ওঠা সেই স্বরে যেটা বিয়ের শুরুতে আদরের মুখঝামটা হিসেবে রমণীয়তার স্বাদ দিলেও  ছয় বছরের মাথায় এসে আস্তে আস্তে বাসী মুখের টোকো গন্ধের মত কুৎসিত লাগতে শুরু করে, ‘আবার তুমি না ছাড়িয়ে এতগুলো চাপড়া চিংড়ি নিয়ে আসলে? কতবার বলব আমার হাতে অ্যালার্জি হয় চিংড়ির খোসাতে? থাক পড়ে সব! আমি তো এসেছি সংসারের ঝি হয়ে, বাবুর যখন যা মনে হবে তাই আনবেন আর আমি মরব খোস-পাঁচড়া হয়ে!’ ঝনঝন করে থালা বাটি ফেলবার আওয়াজ কথাগুলোর সংগত দিল। তখনও নতুন লাক্স সাবানটা কুয়োর জলে সাঁতার কাটছে, আস্তে আস্তে নিজের চারপাশে তৈরি করছে ঘোলাটে বৃত্ত, ইন্দ্র স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল।

ঝনঝন আওয়াজটা নির্ঘুম মাথার দপদপানি শিরার ভেতর ঢুকে গিয়ে দেহের রক্ত যতটা সম্ভব যেন স্ট্র  দিয়ে শুষে টেনে আনল ওপরে। রুদ্রমুর্তি, আধসাদা ইন্দ্র পিছু ফিরল, ‘যে মাসি মাছ কোটে তাকে দিয়ে করালে পনেরো মিনিট কম সে কম লাগে। তুমি জানো না? বলিনি তোমাকে? অফিসে লেট মার্ক পড়লে আজকাল কী করছে, সব জেনেও ন্যাকামি করছ কেন?’

‘তাহলে চিংড়ি আনবে না! অন্য মাছ আনবে, না হয় ডিম আনবে! তোমার অফিসটা অফিস, আর আমার শরীরটা কিছু নয়, না কি?’

‘আনব না তো  গিলবে কী? নিজে বাজার যাও? পইপই করে বলেছি দোকান বাজারগুলো তুমি করলে আমার চাপ কমে। পটের বিবি হয়ে বাড়ি বসে থাকবে একজন আর আমাকে হুকুম দিয়ে যাবে সারাক্ষণ!’

‘কী করো কী তুমি? অফিস থেকে ফিরেই তো সন্ধেবেলা আড্ডায় চলে যাও। বাড়ির কুটোটি নাড়াও? জানো তো ফিরে এসে মুখের সামনে একথালা গরম ভাত রেখে দেবে বাড়ির দাসি বাঁদি! লজ্জা করে না বাড়ির বউকে বাজারে যেতে বলছ?’

খেতে বসে দেখল গতকালের মুসুর ডাল আর লাবড়ার একটা ঘ্যাঁট। বাজারে সটকা সটকা কালো যে চিংড়িগুলো দেখে জিভ রসস্থ হয়ে উঠেছিল, যে কারণে একটু বেশি দাম দিয়েই কিনে ফেলেছিল আগামী সপ্তাহটা টিপে টিপে চালাতে হবে জেনেই, সেগুলোই পাতে নেই। ঝগড়া করেছে বলে মিলিকেও ধারে কাছে দেখা যাচ্ছে না।

এই ঝগড়া চলতেই থাকত, যদি না ইন্দ্রজিতের মনে পড়ত যে নটার ডাউন লোকাল ধরতে না পারলে পরের ট্রেনের  সাংঘাতিক ভিড়ে ঝুলতে ঝুলতে যেতে হবে তাকে। পরম বিরক্তিভরে ‘ধুর শালা’ বলে  বালতি তুলে ঝড়াস করে গোটা জলটা সর্বাঙ্গে ঢেলে দিল। ইঁদারার সাবানের  দিকে তাকিয়ে দাঁত ঘষে পরের জলভরা বালতিটা তুলল যখন, মিলি ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। ম্যাক্সির ওপর ফেলা জ্যালজ্যালে লাল গামছা, ঈষৎ স্ফীত হয়েছে শরীরটা, মুখময় অস্বাস্থ্যকর ব্রণদাগ ভর্তি অপস্রিয়মাণ মল্লিকার অবয়বকে একটা কচ্ছপের মত লাগছিল। ‘কতবার বলেছি ম্যাক্সির ওপর গামছা ফেলবে না, তবুও ইচ্ছে করে পরবে!’ ঝাল গরগরে রাগটাকে কষিয়ে রান্না করতে করতে ইন্দ্র বিড়বিড় করল। ‘দুদিন বাপের বাড়িও যায় না শালা, গেলে বাঁচি।’

খেতে বসে দেখল গতকালের মুসুর ডাল আর লাবড়ার একটা ঘ্যাঁট। বাজারে সটকা সটকা কালো যে চিংড়িগুলো দেখে জিভ রসস্থ হয়ে উঠেছিল, যে কারণে একটু বেশি দাম দিয়েই কিনে ফেলেছিল আগামী সপ্তাহটা টিপে টিপে চালাতে হবে জেনেই, সেগুলোই পাতে নেই। ঝগড়া করেছে বলে মিলিকেও ধারে কাছে দেখা যাচ্ছে না। বারান্দায় থালাটা বেড়ে দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেছে। অপরিসীম অবসাদে তার মন ভরে উঠল, যার মধ্যে গতরাত্রের ঘেমো ক্লান্তিও লুকিয়ে। কোনওরকমে বিস্বাদ লাবড়ার মণ্ড ডালে ভিজিয়ে পেটে ফেলে দিতে দিতে দেখল, বাগানের পুঁইমাচাটা শুকিয়ে হলদে হয়ে গেছে। ঝাঁ ঝাঁ রোদে জল পড়েনি বেশ কয়েকদিন, এদিকে সেই নিয়ে বলতে যাও, চারশো কথা শুনিয়ে দেবে মিলি! নারকেল গাছটা আবার ঝাঁকালো হয়ে উঠেছে, যে কোনওদিন বড় পাতা বা ডাব কারওর মাথায় পড়ে বিপত্তি ঘটাবে। উঠোনের একপাশ শ্যাওলা ধরা, কতবার বলেছে ছোবড়া দিয়ে একটু মেজে দিতে, কে কার কথা শোনে! দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা ভিজে ভাতের টুকরো আর ঝিঙের অবশেষ জিভ দিয়ে বার করতে করতে ইন্দ্রজিতের মনে পড়ল, মিলি তাকে একটা গুরূত্বপূর্ণ জিনিস আনতে বলেছে আজ। মোটামুটি পথ চেয়ে বসেই থাকবে বলা যায়। মরুকগে! আনবে না! হাড়ভাঙা খাটনির পর যদি কপালে ডাল আর বাসি লাবড়া জোটে, তাহলে প্রতিদানে খুব বেশি আশা করা উচিত নয়।

সাইকেল করে স্টেশনের দিকে যেতে যেতেও বিরক্তিটা মাথা থেকে যাচ্ছিল না। আমডাঙার মোড়ে বাঁক নিয়ে দেখল, গদাইদা দোকান খোলার তোড়জোড় করছে। তার হাতে ধরা বেশ বড় একটা সাদা কাগজে মোড়া প্যাকেট, যাকে সামাল দিতে দিতেই কোনওরকমে জবুথবু পায়ে দোকানের ভেতরে ঢুকে গেল। তার মানে আজ নতুন লট এসেছে। সামনের বেঞ্চিগুলোও পাতা হবে একটু পরেই। হঠাৎ একটা ঝলকা খুশিতে ইন্দ্রর মনটা টালুমালু হতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল–আসলে তো সেই সারাদিন কলম পেষা, আর ধুঁকতে ধুঁকতে নিজের শরীরে চারিয়ে ওঠা বদগন্ধ বয়ে বয়ে বাড়ি ফেরা, যেগুলোকে একটা ম্যাড়ম্যাড়ে গদাইদা কতই বা পালটে দিতে পারে! ওহো, বিরক্তিকর !

ট্রেন নৈহাটি আসতে কামরায় উঠল জয়ব্রত। চৌকশ ছেলে, এর মধ্যেই এলআইসির দালালিটাকে কম্পিউটার মেরামতির ব্যবসার উপরি হিসেবে টাঙ্গিয়ে নিয়ে টু পাইস ভালই কামাচ্ছে। বহুদিন ধরে পেছনে পড়ে আছে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ল্যাপটপ গছাবার জন্যে। দেঁতো হাসি দিয়ে বরাবরই কাটিয়েছে, যতক্ষণ না সৌজন্যের সীমা অতিক্রম করা যায়, এটুকু না বুঝিয়েই যে কম্পিউটার বিষয়টার প্রতি তার আগ্রহ ততটুকুই যা অফিসের কাজে লাগে। তার আগ্রহ যে কীসে, সেসব আর বিষয়ী জয়ব্রত কীভাবেই বা বুঝবে!

বরাবরের মতই এগিয়ে এল, মুখে পানের পিক জারানো লালচে রসের হাসি। ততক্ষণে কামরার মুখোমুখি সিট জুড়ে তাসের আসর বসে গেছে, মুখে কাগজ চাপা দিয়ে ছদ্ম গাম্ভীর্যের ভান করে সেই খেলার দিকে তাকিয়ে আছে বুড়ো মাধব গাঙ্গুলি। ভুল ইংরিজি বললেও জামাই যে অনসাইটে অস্ট্রেলিয়া গেছে, প্রতিদিন একবার করে জানাতে ভোলে না। ইন্দ্রকে আড়চোখে দেখে সিটে ভাল করে জাঁকিয়ে বসল যাতে শেয়ার করতে না হয়। ‘ঢ্যামনা’ বলে বিড়বিড়ে গালি  ছুঁড়ে পাশ ফিরতেই,  লালাসিক্ত হাস্যময়–”আইটি ইন্ডাস্ট্রি তো রিসেসন  সামলে নেবে মনে হচ্চে, কী বলেন?’

সেই ভ্যাজর ভ্যাজর! কে বোঝাবে যে আইটি থাক বা মায়ের ভোগে যাক, ইন্দ্রর কোনও ইন্টারেস্ট নেই! কোলা ব্যাঙের মত শরীর, কপালের ঠিক মাঝখানে একটা ছোট্ট আঁচিল আর কুতকুতে চোখ নিয়ে জয়ব্রত ততক্ষণে শুরু করে দিয়েছে, ‘জাভা-টা এই বেলা শিখে ফেলুন, বুইলেন কী না! সরকারি চাকরির যা অবস্থা, কাল হয়ত দেখলেন গরমেন্ট হুলিয়া জারি করেচে যে ল্যাংগুয়েজ না শিখলে চাকরি নট। কত দেখলাম এমন কেস! ল্যাপটপটা আপনার জন্যই রেখে দিইচি  দাদা। কম করেই দেব, ভাববেন না। দশের মধ্যে, সাথে অফিস সেটআপ, বুইলেন কী না! ভাল কনফিগারেশন আচে। নাহয় ইন্সটলমেন্টেই দিলেন, সে আর কী বড় কথা! আপনার সঙ্গে কি আজ থেকে পরিচয়, যে আপনি আমাকে ঠকাবেন সে ভয় পাব? সে বান্দা জয়ব্বোত বাঁউজ্জে নয়, বুইলেন কী না!’

হয়ত এই ঘরটা থেকে সে আর কোনওদিনই বেরতে পারবে না, পারবে না পাশের টেবিলের নস্কর আর বিপুল পালের আইপিএল গজল্লার অবিশ্রান্ত একঘেয়েমির ট্র্যাপ থেকে নিজের কান মাথা আর সমগ্র চেতনাকে টেনে আনতে, কোথাও যেখানে আলো, নিঃশ্বাস। এমনকি বাইরেও ঝাঁ ঝাঁ রোদ, কী করুণ রকমের ম্যাড়ম্যাড়ে! আটত্রিশ বছর বয়েস হয়ে গেল তার, আর এই সময়কালের প্রত্যেকটা দিন কীভাবে কাটাল?

অবিশ্রান্ত বকবকানির চোটে, তার ওপর বদ্ধ কামরায় বিড়ির ধোঁয়া, গুটখার গন্ধ, মোদী মমতার তরজা, থেকে থেকেই ঝালমুড়ি আর চা বিক্রেতার গুঁতো, সিটের একপাশে ব্যালেন্স করে প্রায় দ-এর মত হয়ে গিয়ে পিঠটাকে কিছুটা বিশ্রাম দেওয়ার চেষ্টা যাতে নির্ঘুম রাত আর নিঃসাবান আধোস্নানের কষ্টটাকে কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া যায়, তারই মধ্যে তাসপার্টির ‘ইন্দ্র দা একদান খেলে যাও আজ’ জাতীয় ডাককে হেঁ হেঁ করে ফেরানো, তার আজ সত্যিই এনার্জি নেই, ইন্দ্রর নিখাদ ঘুম বাদে আর কিছুই পাচ্ছে না। জয়ব্রতর বকবকানির গুঁতোয় ঝিমোতে ঝিমোতে সে দেখে ফেলল, মাধব গাঙ্গুলি তার দিকে তাকিয়ে সামনের দুটো ভাঙা দাঁত আর পায়োরিয়াগ্রস্ত মাড়ি নিয়ে হাসছে, আর বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলছে, ‘কাঁচকলা জুটল তো? মেলবোর্নে বড় বড় লবস্টার দশ ডলারে মেলে, কিছুই তো দেখলে না হে!’ চটকা ভেঙে দেখল মাধব হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। মুখ থেকে অল্প লালা বেরিয়ে পড়েছে। বুড়োর বয়েস ভাঁড়ানো মনে হয়। রিটায়ারমেন্টের এখনও দেড় বছর বাকি থাকে কোন হিসেবে? উফ, ট্রেন সবে পলতা পেরল! উল্টোডাঙ্গা এখনও আধ ঘণ্টা।

নিজেকে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে উল্টোডাঙায় নেমে অটো ধরা, সল্টলেকে সরকারি অফিসভবনের নিজস্ব জায়গাটিতে বসে ঝিমনোর ফাঁকেই বিস্বাদ মুড়ি ছোলাসেদ্ধর ঠোঙা দেখে বমি লাগল ইন্দ্রর। ডান পাশের নস্কর ততক্ষণে হাতে ঢেলে দিয়েছে, ‘খাও খাও। এসব হেলদি খাবার, অম্বল গ্যাস দূরে থাকবে’। অন্ধকার ঘর, তার মধ্যে হিমঘরের মত এসি পরিপার্শ্ব, মৃদু ঘটাং ঘটাং আওয়াজ, অপরিচ্ছন্ন ফাইলের স্তূপ, আদ্যিকালের কম্পিউটারগুলোর পিঠময় মাকড়সার জাল, আর মাঝে মাঝেই হোয়াটসঅ্যাপে তখন মেসেজ আসতে শুরু করেছে, আদিরসাত্মক জোকস, অথবা কী করে বউয়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবেন, কিংবা শেয়ার করুন সীমান্ত এলাকায় সন্ত্রাসবাদীদের ভয়ংকর ষড়যন্ত্র। হয়ত এই ঘরটা থেকে সে আর কোনওদিনই বেরতে পারবে না, পারবে না পাশের টেবিলের নস্কর আর বিপুল পালের আইপিএল গজল্লার অবিশ্রান্ত একঘেয়েমির ট্র্যাপ থেকে নিজের কান মাথা আর সমগ্র চেতনাকে টেনে আনতে, কোথাও যেখানে আলো, নিঃশ্বাস। এমনকি বাইরেও ঝাঁ ঝাঁ রোদ, কী করুণ রকমের ম্যাড়ম্যাড়ে! আটত্রিশ বছর বয়েস হয়ে গেল তার, আর এই সময়কালের প্রত্যেকটা দিন কীভাবে কাটাল? সেই জয়ব্রতর লালচে দাঁত, মাধব গাঙ্গুলির অর্থহীন আস্ফালন, নস্করদের কূটকচালিতে, বিবর্ণ ফাইলের জটলায়, বাড়ি ফিরে নৈমিত্তিক অশন ব্যসনে। একমাত্র যদি গদাইদার দোকানে গিয়ে বসা যেত একটু তাড়াতাড়ি–তবুও মিলির জন্য কিছুতেই সে আজ কোনও জিনিস আনবে না! মিলির বোঝা উচিত ছিল, বাজারে অন্য মাছ পায়নি বলেই বাধ্য হয়ে তাকে, কিন্তু এসব ভাবনাও কী সাংঘাতিক দৈনন্দিন! মাছ, পুঁইমাচা, আইটি, এসবের বাইরে কি তাহলে সে নিজেও ভাবতে ভুলে যাচ্ছে?

মদনপুরে যখন ইন্দ্র নামল, সাড়ে সাতটা বেজে গেছে।  কালোদার সিগারেটের দোকানের ছোট্ট টিভি সেটে তিন চারটি রাজনৈতিক দলের তরজা চলছে স্টুডিওর ভেতর। একঝলক চোখে পড়তেই পেটের ভেতর ক্যান্টিনের বিস্বাদ রুই মাছের ল্যাতপ্যাতে গাদার মণ্ড ঠিকরে গলার কাছে উঠে আসতে চাইছিল। প্রতিদিনকার সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, লোকাল ট্রেনে অফিসে পাড়ায় বাজারে বিদগ্ধ বাণী বিতরণ, এসব থেকে যদি পালিয়ে যাওয়া যেত? অথবা, হয়ত আইন করে দেওয়া হল যে দিনে এক ঘণ্টার বেশি কেউ রাজনীতি নিয়ে কথা বলবে না, বললেই জেল কি জরিমানা। কথা বলবে না আইপিএল, বলিউড, শেয়ার বাজার এসব নিয়েও। বস্তুত, এক ঘণ্টার বেশি কেউ কথাই বলবে না, এমন আইন আনা যেত যদি, যদি শব্দহীন হতাম আমরা সবাই, যেখানে টুপটুপে অন্ধকার হিমের মধ্যে দাঁড়কাকের ডানার ঝাপটের ধ্বনিটুকুও কান এড়িয়ে পালায় না, তাহলে, ইন্দ্রর মনে হল, সে মদনপুরকে মনে মনে বলবে–তোমাকে আমি দিলাম বেড়ালির থাবার নিস্তব্ধতা। কিন্তু আপাতত বাজারের হট্টগোল, মিষ্টির দোকানের সামনে ভিড়, মফস্বলি সন্ধের টাটকা পটলের গায়ে শিশির জমার আগেই ক্রেতার পলিথিনের খনিতে ধ্বসে পড়া, মৃত তেলাপিয়াদের চোখ, যাদের পাহারা দিচ্ছে রক্তাক্ত বঁটি। ইন্দ্র জমা রাখা সাইকেল ছাড়িয়ে হাঁটা লাগাল। একটু পরেই রাস্তাটা অন্ধকার হয়ে যাবে। তখন দুইপাশে পুকুর, সুপুরি বাগান, কিছুটা আদিম হাওয়া, ক্বচিৎ সাপের ব্যাঙ ধরবার শব্দ।

আধো অন্ধকার রাস্তা ধরে আমডাঙার মোড়ে এসে দেখল, কিছু আলোর পুঞ্জ এক জায়গায় জমাট বেঁধেছে, যার ভেতর তেলেভাজার দোকান, মোবাইল সারাইয়ের গুমটি, মুদিখানার টিউবলাইট থেকে আলো ঠিকরে পড়ে ভাঙা পিচপথ ভিজিয়ে দিচ্ছে। এই মোড় থেকে বাম দিকে ঘুরলে গ্রাম ও মফস্বলের মধ্যবর্তী নো-ম্যানস ল্যান্ড, সেখানে ভাঙা মন্দির জুড়ে গজিয়ে ওঠা ভুতুড়ে জঙ্গল অথবা পুরনো বাড়িদের আঙিনার জামগাছ কি বাতাবিফুলের ঝরে পড়বার উঠোনে এখনো রিয়েল এস্টেট হাত বাড়াতে পারেনি, সে যতই নৈহাটি থেকে মদনপুরের রাস্তার দুইধারে ধোঁয়াওঠা ফ্যাক্টরি, না হক গেটেড কমিউনিটিগুলো ইতিউতি মিলির গালের ব্রণর মত গজিয়ে ওঠা।

এককোণে গদাইদার টিমটিমে দোকানের সামনে বেঞ্চ পাতা। তপন, হীরক আর আমিনুল বসে আছে, হাতে চায়ের কাপ। ইন্দ্র সাইকেল রেখে ক্লান্ত শরীর বেঞ্চিতে মেলে দিয়ে পাশের দোকানে হাঁক পাড়ল, ‘বুবাই, একটা লাল চা’।

কিন্তু আপাতত বাজারের হট্টগোল, মিষ্টির দোকানের সামনে ভিড়, মফস্বলি সন্ধের টাটকা পটলের গায়ে শিশির জমার আগেই ক্রেতার পলিথিনের খনিতে ধ্বসে পড়া, মৃত তেলাপিয়াদের চোখ, যাদের পাহারা দিচ্ছে রক্তাক্ত বঁটি। ইন্দ্র জমা রাখা সাইকেল ছাড়িয়ে হাঁটা লাগাল। একটু পরেই রাস্তাটা অন্ধকার হয়ে যাবে। তখন দুইপাশে পুকুর, সুপুরি বাগান, কিছুটা আদিম হাওয়া, ক্বচিৎ সাপের ব্যাঙ ধরবার শব্দ।

গদাইদার পান বিড়ি সিগারেটের গুমটির ভেতর বসে একটা বাচ্চামত ছেলে বিড়ি বেঁধে চলেছে। দোকানের পাশের অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাটা থেকে বেরিয়ে আসল বুড়ো গদাইদা, দেনাভারে শীর্ণ যার বাঁকা পিঠ দেখলে পেট্রাপোল সীমান্তের ধারে মরে পড়ে থাকা বাতিল লরিগুলোর কথা মনে আসে ইন্দ্রর। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, বড় পাওয়ারের চশমা, নাক ঝাড়তে ঝাড়তে গদাইদা দোকানের গুমটিতে উঠে গেল। তপন তখন আমিনুলকে বলছে, ‘অনেকগুলো টাকা ধারবাকি। বাইন্ডিঙটাও শুধতে পারিনি। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ভেবে ভেবে।’

চায়ে চুমুক দিয়ে ইন্দ্র কৌতূহলী হল, ‘এখনও শোধ না দিলে পুজোসংখ্যা বার করবি কী করে?’

‘কে জানে !’ ব্যাজার আমিনুল বিড়ি ধরাল। ‘দুটো অ্যাড আসেনি। বাজারের যা অবস্থা, বন্ধই করে দিতে হবে মনে হচ্ছে। তুই দে না, তোদের গভমেন্টের কটা অ্যাড একটু বার করে আন না, তাতে একটু হিল্লে হয়।’

চিন্তিতমুখে ইন্দ্র বলল, ‘দেখছি’। বস্তুত, গুরুতর অর্থসমস্যা একটা চোরাবালির মত ঘিরে ধরে আছে আমিনুল হীরকদের, গদাইদাকে, এই ছোট্ট দোকানকে, তাদের লিটল ম্যাগটিকে, গত কয়েকবছর ধরেই। এবার কতটা ডুবল, বুক না গলা, সেটার মাপ নিতে নিতেই এখন দেখা যাচ্ছে নাক অবধি ঢুকে আছে, নিঃশ্বাসটুকু নিতেও যেখানে হাপরের মত হয়ে যায় ফুসফুস। যদিও সে পাঠকমাত্র, কিন্তু এরা তারই বন্ধু, স্বজন। ইন্দ্রর বুক থেকে কিছুটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে খাঁ খাঁ উঠোন হয়ে গেল। ব্যাংকে মাত্র পনেরো হাজার টাকা পড়ে আছে, কীই বা করতে পারে সে! ভাবনাটাকে কাটাবার জন্য মাথা ঝাঁকিয়ে গুমটির ভেতর চোখ চালাল, এবং দেখল সারে সারে বই। কলকাতা থেকে আনা লিটল ম্যাগের লট, যাদের কাগজের ভেতর থেকে সেই গন্ধ ইন্দ্র পেয়ে এসেছে এতকাল, টাটকা ফুলকপির ঝোলে কইমাছ ছাড়লে যা মেলে। এই টাউনের একমাত্র দোকান এটাই, যেখানে কলকাতা থেকে নিয়ে আসা লিটল ম্যাগাজিনগুলো পাওয়া যায়। টাকার অভাবে ধুঁকতে ধুঁকতেও ওটুকু জায়গা গদাইদা ছেড়ে রেখেছে। প্রতি মাসেই নতুন ম্যাগগুলোকে ইন্দ্র শুঁকতে পারে, এবং তা সত্বেও প্রতিবারের মতই তার ভেতরটা আবার আলতো আহ্লাদে টালুমালু হয়ে উঠল।

‘কী কী আসল, গদাইদা?’

‘বেশি আনতে পারিনি এবার। কথারূপ পাঁচ কপি, হাওয়াবাড়ি তিন, আর কয়েকটা ভাষাশরীর, কবিসম্মেলন দুটো। তুই কটা নিবি?’

চকিতে মিলির মুখটা মনে ভেসে উঠল। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘থাক আজকে। টাকা আনিনি বেশি।’

‘টাকার জন্য কবে আটকেছে?’ হীরকের মুখ অন্ধকারের ভেতর বিড়ির আলোতে ঝিকিয়ে উঠল, ‘ও গদাইদা দিয়ে দেবে, পরে টাকা দিয়ে দিস।’

‘না না, এবার আর না’, গদাইদা ভুরু কুঁচকে মাথা নাড়ল, ‘এবার আগে ভাগে দাম ধরে দিয়ে আসতে হয়েছে। কমিশনও কম রাখতে হবে। ইন্দ্র তুই টাকা নিয়েই কাল আসিস বাবা। ধার রাখব না।’

‘দিয়ে দাও গদাইদা’, হীরক নরম স্বরে বলল, ‘ইন্দ্র কি ফাঁকি  দেবে, না কাল থেকে আড্ডায় আসবে না?’ একটু থেমে অদ্ভুত হাসল আবার, ‘টাকা দিয়ে বই কেনার সামর্থ্য আমাদের কজনেরই বা আছে !’

গদাইদা চুপ করে সুপুরি চিবোতে চিবোতে অন্যমনস্কের মত দূরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকল। ইন্দ্র ফিকে হাসল হীরকের দিকে তাকিয়ে। প্রতিবারই গদাইদা এরকম করে, তারপর বই দিয়ে দেয়। না চাইলেও কপি হাতে তুলে দেয়, আর পরদিন থেকেই আবার টাকার জন্য তাগাদা দিতে শুরু করে। তপন ততক্ষণে আমিনুলের সঙ্গে হিসেব করতে শুরু করে দিয়েছে আগামী সংখ্যার পাতা কতটা কমানো যায়, পেজ কোয়ালিটি কীভাবে কিছুটা নামিয়ে আনা যায়। তিনটে  ম্যাগাজিন নিয়ে ইন্দ্র উঠে দাঁড়াল। ‘আসি গদাইদা। সামনের সপ্তাহে দাম দিয়ে দেব।’

রোয়াকে অল্প অল্প জ্যোৎস্না পড়েছে। দুধের সর ভেসে বেড়াচ্ছে উঠোন, নারকেলপাতার জাফরি, ভাঙা পাঁচিলের ইটের খোঁদলে। অনেকক্ষণ ইন্দ্র আর মিলি চুপচাপ বসেছিল। কেউ কোনও কথা বলছিল না। মাঝে শুধু মিলি অস্ফুটে একবার বলেছিল, ‘একটা গল্প, মাঝপথেই আটকে থাকল।’

‘সে কী রে, আজ এত জলদি?’ কথা থামিয়ে তপন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।

‘যাই। কাল লোডশেডিং ছিল, সারারাত ঘুম হয়নি। শরীর দিচ্ছে না।’

‘তোরাই আমাকে মারবি !’ গদাইদা ব্যাজার মুখে জাঁতি দিয়ে সুপুরি কাটতে লাগল, ‘এভাবে ব্যবসা হয় না। সামনের মাস থেকে আর বইপত্র আনবই না। যার দরকার পড়বে নৈহাটি যাও।’

ইন্দ্রর পেছন থেকে আমিনুল চেঁচিয়ে উঠল, ‘অফিসের অ্যাডটা ভুলিস না কিন্তু! নাহলে কাগজ বার করা যাবে না।’

সাইকেল হাঁটাতে হাঁটাতে ইন্দ্র মৃদু হাসল। সে কোনওদিনও কোনও অ্যাড আনবার মত কেউকেটা হয়ে উঠতে পারবে না। এবং তার পরেও

টেনেহিঁচড়ে পত্রিকা ঠিকই বেরবে।

সদর দরজা খোলাই ছিল। ঘরের ভেতর থেকে টিভির আওয়াজ ভেসে আসছে। অন্ধকার উঠোনে বাতাবিফুলের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে, কুয়োতলার কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে পাশের বাড়ির মেনি। সাইকেল রেখে পেছন ফিরে দেখল, মিলি এসে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়। একটা ছাপা শাড়ি, তাতে হলুদের দাগ লেগে, দুই বিনুনি করে চুল বেঁধেছে, একটু খুকি খুকি লাগছে বটে, অথবা সন্ধ্যের ভ্রম। এমনকি গালের ফুসকুড়িগুলোতেও নরম আভা এসে পড়েছে। মুখটা হাল্কা উঁচু করে বলল, ‘এনেছ?’

ইন্দ্র হালকা হেসে হাতের প্যাকেট দেখাল। উজ্জ্বল চোখে এগিয়ে এল মিলি। ‘একটা কথারূপ, একটা হাওয়াবাড়ি, একটা গত মাসের দাহপ্রান্ত। চলবে?’

উদ্ভাসিত মিলির শরীর পাশের বাড়ির দোতলা থেকে ছিটকে আসা ম্লান বাল্বের হলদেটে আলোয় নরম মোমের পুতুলের মত গলে যাচ্ছিল, দেখতে দেখতে চোখ বুজে ফেলল ইন্দ্র। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপন মনে হাসল, যখন মিলি প্যাকেট থেকে ম্যাগগুলো বার করে করে দেখছে, আলগা ভালোলাগা ঝুলছে গালের তরুণী ভাঁজ থেকে। ইন্দ্র তাকে পাশ কাটিয়ে কুয়োতলায় গেল হাত পা ধুতে। শব্দ পেয়ে মেনি উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। মিলি তার পেছন পেছন আসল, ‘একটা সাবান কিনে রেখেছি। দেব?’

‘থাক। কাল নেব। একটু চা বসাবে? মাথা ধরাটা যাচ্ছে না।’

‘আজ ডিমের ঝোল দিয়ে চালিয়ে নাও। কাল হাসিনাকে দিয়ে চিংড়িগুলো ছাড়িয়ে নেব।’

আরও কিছুটা সময় পর, যখন রাত্রির গায়ে দিশি মাগুরের রং লাগল, ইন্দ্র আর মিলি খাটের ওপর পাশাপাশি শুয়ে দুজনে দুটো নতুন লিটল ম্যাগ খুঁড়ে খুঁড়ে গল্পগুলো পড়ছিল–নতুন নতুন নাম, অচেনা অজানা লেখক যাদের তারা দেখেনি এবং তবুও ছুঁতে পারে, আর জানালা দিয়ে যখন বাতাবিলেবুর গাছ ঝামরে পড়ছিল, ঠিক তখনই আবার লোডশেডিং হল। যখন গোটা মহল্লা জুড়ে সমবেত একটা ‘হোওও’ শব্দ উঠেই আবার ঝিমিয়ে গেল,  ‘যাহ’ বলে বই মুড়ে ইন্দ্র শুয়ে পড়ল, মিলি আনমনা তাকিয়ে থাকল জানালার দিকে।

‘বারান্দায় গিয়ে বসবে?’ একটু পরে মিলি বলল।

রোয়াকে অল্প অল্প জ্যোৎস্না পড়েছে। দুধের সর ভেসে বেড়াচ্ছে উঠোন, নারকেলপাতার জাফরি, ভাঙা পাঁচিলের ইটের খোঁদলে। অনেকক্ষণ ইন্দ্র আর মিলি চুপচাপ বসেছিল। কেউ কোনও কথা বলছিল না। মাঝে শুধু মিলি অস্ফুটে একবার বলেছিল, ‘একটা গল্প, মাঝপথেই আটকে থাকল।’

অনেকটা সময় পর ইন্দ্র বলল, ‘আমরা নিজেরাই একটা লিটল ম্যাগ বার করি না কেন?’

মিলি উত্তর দিল না। ইন্দ্রর মুখোমুখি বসে সারা মুখে জ্যোৎস্না মেখে নিচ্ছিল। চোখটা আধবোজা, মনে হচ্ছিল তার শাড়ির আঁচলে অনেকগুলো জোনাকি নেমে আসবে। একটা লিটল ম্যাগ যদি বার করা যেত, সে আর মিলি মিলে, হয়ত লোডশেডিং থাকলেও গল্পগুলো আর অজানা থাকত না। নাহলে আমিনুলদের ম্যাগটাতেই –অফিস থেকে কিছু লোন কি আর দেবে না? মিলিও কি একই কথা ভাবছে?  তার হাতে এই অন্ধকারেও ধরা হাওয়াবাড়ির মলাটে হাত বোলাচ্ছে, হাসছেও মৃদু মৃদু, নিজের মনেই। মিলির শরীর থেকে এই মুহূর্তে  চাবরা চিংড়ি না কি ফুলকপির ঝোলে কইমাছ ছাড়বার টগবগে, কোন গন্ধটা ভেসে আসলে তার বেশি ভাল লাগবে, ইন্দ্র বুঝতে পারল না।

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।