পা দুটো একমনে দেখছিলেন অদিতি। আঙুলগুলোর বেশ কয়েকটা বেঁকে গেছে! ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের পর, পরপর দুটো আঙুল বেঁকে মুড়ে গেছে প্রায় আর বাঁ পায়ের তিনটে আঙুল; কড়ে আঙুলের পর! শুকনো পায়ের পাতার চামড়া। এখন আর ত্বক বলা যায় না। বলতে ইচ্ছে করে না তাঁর। শিরাগুলো ফুলে উঠেছে বিশ্রিভাবে। হাউজকোট প্রায় হাঁটু পর্যন্ত তুলে পা দু‘টোকে সামনে সটান মেলে একমনে দেখছেন।
সূর্যাস্তকাল। বর্ষা শেষের এই সময়ে আকাশ চিত্রপট হয়ে যায়! সূর্যের ফেলে যাওয়া রঙে চুবিয়ে চুবিয়ে ছবি আঁকে মেঘের তুলি। দীপ্রাস্ত্র বেঁচে থাকতে যদি বাড়িতে থাকতেন, তাঁকে ডেকে নিয়ে এই চিত্রকলা দেখাতেন নিয়ম করে। বর্ষা নিয়ে একাধিক কবিতা লিখে গেছেন তিনি। তাঁর বর্ষা আর হেমন্তের কবিতাগুলো পাঠক বুকে করে রেখেছে আজও, মৃত্যুর আট বছর পরেও! আচমকাই একটা কবিতার দু‘টো পংক্তি মনে এল অদিতির। মাথার মধ্যে একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার মতো ডাক কবিতার পংক্তি দু‘টোর।
“বিষাদের কাল তবে এলে?
আকাশ প্রদীপ জ্বেলো মনে করে
আমিও তো আসব ফিরে ফের!”
একা একা উচ্চারণ করে আবৃত্তির মতো বললেন। তারপর হাসলেন, বললেন, ভাল! বড় ভাল!
‘বউদি, চা!‘ অলকা চা নিয়ে এসে ডাকতেই বললেন, ‘দেখ তো সব বাড়ির ছাদে আকাশপ্রদীপ জ্বলছে কিনা!’
বারান্দায় গিয়ে এদিক ওদিক দেখে বারান্দা থেকেই অলকা বলল, ‘আজকাল আর আকাশপ্রদীপ জ্বালে না গো কেউ! ওই ইস্টিশনের দিকে পুরনো বাড়িগুলোর ছাদে কয়েকটা জ্বলছে! এখন তো সব ফ্ল্যাট! ফ্ল্যাটে আর কে আকাশপ্রদীপ জ্বালবে!’
— তাহলে ওরা আসবে কী করে অলকা?’ ভারী গম্ভীর স্বরে বললেন অদিতি।
— কারা? কাদের আসার কথা বলছেন? আকাশটা কী সুন্দর হয়েছে দেখেছেন?
বিষণ্ণতা ঘনাল যেন অদিতির শরীরে। খানিক চুপ করে থেকে বললেন, ‘কার্তিক মাস ধরে যাদের আসার কথা! তুই গ্রামের মেয়ে তুই জানিস না?’
অদিতি আজকাল কী বলেন আর কী বলেন না, সেই নিয়ে হাসাহাসি চলে কাজের লোকেদের মধ্যে লুকিয়ে। হঠাৎ হঠাৎ এমন সব কথা বলেন যার মাথামুন্ডু কিছুই বোঝে না তারা। প্রশ্ন করলে ধমকে দেন তিনি, বড্ড জ্যাঠামো করছিস, বলে। অগত্যা চুপ থাকাই শ্রেয়। এই মুহূর্তেও কথা বাড়াল না অলকা। মানুষটা তো মন্দ নয়! বরং বেশিই ভাল। এই বাড়িতে যখন সে এসেছিল, তখন সদ্য বিধবা হয়েছে সে, মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে! সেই থেকে..!
অদিতি চায়ে চুমুক দিয়ে আবার বললেন, ‘দেখ না, ক‘টা বাড়িতে প্রদীপ জ্বালাল? গুণে গুণে বল। কাজ তো নেই, তা একটু গুণতে পারিস না? চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার! আর তোরা আজকাল আমাকে পাত্তাও দিস না দেখছি তোদের দাদা চলে যাবার পর থেকে।‘ গলাটা কেমন আর্দ্র, ভারী শোনাল। অভিমান! কথায় কথায় কেমন কান্না পায় তাঁর। অলকা আপনমনে হেসে ফেলল, বলল, ‘পাগলের কারবার! দেখি গুনি।’ বালিগঞ্জ স্টেশনের রেললাইনের ওপাশে কয়েকটা পুরনো বাড়ির ছাদে জ্বলজ্বল করছে আকাশপ্রদীপ! অন্ধকার নেমেছে আকাশের ঘরে। একটু ধোঁয়াশার আবরণ। গুনে গুনে চারটে বাড়িতে প্রদীপ জ্বলছে।
— চারটে বাড়িতে গো! বউদি, চারটে জ্বলছে।
— মাত্তর!! চা–রটে!! ওতে কী হবে? পথ দেখা যায়? কতজন আসবে তার হিসাব আছে? কতটা রাস্তা পেরিয়ে বল তো? হোঁচট খাবে না? রাগ করে না ফিরেই যায় আবার! তোর দাদা তো আবার রাতকানা! তালকানা! অলকা? আর একটু দেখ বাবা, আর যদি ক‘টা জ্বলে একটু নিশ্চিন্ত হই। কাল মনোরঞ্জনকে বলব ছাদে আকাশপ্রদীপ জ্বালতে।
মাথায় কিছু ঢুকছে না অলকার। বলল, ‘তা বল। গেল বছরে ও তো জ্বেলেছিল, তোমার কথাতেই। আমাদের দেশ পাড়াগাঁয়ে কেউ ভোলে না কিন্তু।’
ঠোঁট উল্টিয়ে অদিতি বললেন, ‘হ্যাঁ রে, তোরা অনেক ভাল। সব নিয়ম টিয়ম কেমন মানিস। আর এই আমরা শহুরে লোকেরা যত্তসব…!’
অলকা ঘরে ঢুকে রান্নাঘরের দিকে যেতে গিয়ে বলল, ‘কে আসবে বললে না তো? তাহলে খাওয়ার ব্যবস্থা করতাম।’
চায়ের কাপটা ঠকাস করে ট্রেতে রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়েই প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন অদিতি। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে বসে পড়েছেন। ‘কী হল?’ বলে ছুটে এসেছে অলকা।
— পা! আমার পা, অলকা!
— ব্যায়াম করেছ পায়ের?
— আর ব্যায়াম! আঙুল বেঁকে গেল আর ব্যায়াম! কিচ্ছু হবে না আমার! আমার পা..!
পা নিয়ে যে ব্যতিব্যস্ত অদিতি, তা গত তিনবছর ধরে সবাই জানে। এই নিয়ে কত কাণ্ডই না হল! হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবার উপক্রম! অথচ হাসাও যাবে না! চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে ঠোঁট ফুলিয়ে অদিতি আবার বললেন, ‘চা দিবি আর এক কাপ? আজ আর মদ খাব না বুঝলি? চা-ই ভাল। মদ খেলে বড্ড ঝামেলা হয়। উড়ে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে। এখন পা-ই নেই তা আর উড়ব কোত্থেকে, বল? পা দু‘টো আমার… আমার পা…!‘ হাত বোলাচ্ছেন আবার পায়ে।
দীপ্রাস্ত্র থাকতে সন্ধ্যেবেলায় কবিরা, গায়করা আসতেন। মদ্যপানের আসর বসত। এ তো আজ তিরিশ বছর ধরেই দেখে এসেছে অলকা। কবিদের বউরাও কেউ কেউ মদ্যপান করতেন। অনেককিছুই চোখের সামনে দেখেছে সে। সেই অভ্যাসমত এখনও প্রায়ই সন্ধেতে মদ্যপান করেন অদিতি, কখনও একা কখনও বোন-ভগ্নিপতি, কখনও পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে। তবে বন্ধুরা আর আজকাল তেমন নিয়মিত আসেন না। অনেকেই পরলোকগত! অনেকেই অতি বৃদ্ধ!
— চা দিচ্ছি। তুমি বসো।
— পায়ে একটু ম্যাসাজ দিবি?
— দেব। দেব। রাতের রান্নাটা চাপিয়ে, দেব। কে আসবে বললে না তো! কতজন আসবে? সেই মতো চড়াতাম রান্না।
চেয়ারে দুলছেন অদিতি। মুখে প্রশান্তির হাসি, বললেন, ‘আরে তোর দাদার মতো লোকজনরা, আবার কে?’ চোখ গোল গোল হয়ে গেছে অলকার, ‘দাদার মতো লোকজন!’
মৃদু হাসি অদিতির মুখ জুড়ে, বললেন, ‘স্বর্গবাসী হয়েছেন যাঁঁরা, এইসময়ে তাঁরা আসেন মর্ত্যে। দেখতে আসেন পরিবারের লোকেদের। দূর থেকে চোখের দেখা দেখতে আসেন এতটা পথ উজিয়ে! আহা! একেই বলে মায়া!’ অলকা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে।
অদিতি আপনমনে নিজেকেই বলে চলেছেন, ‘কত না টান! এইত্তো দীপ্র, ওর কি টান কম? সে হোক না প্রেমটেম করেছে একগাদা, ও তো সবাই করে, তা বলে আমাকে কি কম ভালোবাসত? নিশ্চয়ই আসবে। শুধু কি আমাকে দেখতেই আসবে? পাপিয়া বউদিকেও দেখতে আসবে, আমি একশো ভাগ শিওর। যে সম্পক্কটা না হয়েছিল! ভাগ্যিস অধীরদা বললেন, দীপ্র, তুমি যা করছ কর। আপত্তি নেই। কিন্তু ঘর ভেঙো না। ও পাপিয়া আর অদিতি সব এক কিন্তু। পাপিয়া আমার বউ বলেই বলছি। আমি তাহলে অদিতিকে নিয়ে ভাগব কিন্তু।’
চোখের বৃত্ত আরও বড় হয়েছে অলকার। অদিতির চারপাশে যেন কেউ নেই। দুলছেন, হাসছেন আর বলছেন, ‘জব্দ! কেমন জব্দ হয়েছিলে বলো? হ্যাঁ? অদিতিকে নিয়ে ভাগবে শুনেই সটান বলে দিল, না তা হবে না। আর অদিতি আপনার সঙ্গে ভাগলে তো? হি হি….’
— বউদি! চা দেব?
যেন জ্ঞানে ফিরলেন অদিতি, সচকিত, বললেন, ‘ওমা! দিসনি এখনও? দে। দে।’
— দিচ্ছি। বলেই আপনমনে বলল, ‘তাহলে মাথাটাও এবার গেল!’
— কিছু বললি রে অলকা?
— না তো।
— মাথাটা গেছে বললি, শুনলাম?
— পাগল নাকি!
— না রে, পাগল হইনি কিন্তু আমার পা..! কেমন চাষাভুষোদের মতো হয়ে গেছে! এখন বুঝছি কেন চাষাদের আর পায়ের যত্ন নিতে ইচ্ছে করে না!… বলতে বলতে আনমনা হয়ে গেলেন অদিতি।
স্নানঘর! স্নানঘর সংলগ্ন ঘর। সেখানে স্নানের উপকরণ সাজানো থরে থরে। সদ্য বিবাহিত কবিপত্নীর জ্ঞান মেধা পাণ্ডিত্যে সৌন্দর্যে বন্ধুমহল মুগ্ধ! ফরাসি দেশ থেকে ফরাসি ভাষা অধ্যয়ন করে এসেছে সে! তা ছাড়াও চারটি ভাষায় তুখোড়। তার চলনেবলনে সেই ধার যেন কেটে ফালা ফালা করে দেয় সমস্ত মধ্যবিত্ত চিন্তা দর্শন! বিয়ের পরেই নতুন ছোট ফ্ল্যাটে স্নানঘর ঢেলে সাজাল সে। এটা তার ফরাসি বিলাস! মুখের যত্ন নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের যত্ন নেওয়া যে প্রকৃত সৌন্দর্যের পরিচয় তা সে মেয়ে ভালভাবে জানে। স্নানের আগে তাই মুখের রূপটানের সঙ্গে পেডিকিওর। পদযুগলের পরিচর্যা! অলিভ তেলের মাসাজ। গরম জলে তেল ও সুগন্ধি শ্যাম্পু দিয়ে পা ডুবিয়ে বসে থাকা! তারপর ঘষে ঘষে পা পরিষ্কার! নখ কাটা। নেইল পলিশ লাগানো! সেই পায়ের পাতা দেখেই মুগ্ধ সবাই!
অদিতির চোখের তারায় হাসি। এই পায়ের পাতায় ভর করে সে উড়ে বেরিয়েছে দেশ বিদেশ! ঘরে কতটুকু আর থাকা হত! সে নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তার ওপর বিখ্যাত কবির স্ত্রী!
— কে এল অলকা? কে? দেখ তো? বেল বাজছে?
দরজা খুলে দিতে দিতেই অলকা বলল, ‘বউদি! একজন সাংবাদিক! মহিলা!’
— এখন?
অলকা ঘরে ঢুকে চাপা স্বরে বলল, ‘তোমার সঙ্গে নাকি এপনমেন হয়েছিল, বলল। বসিয়ে রেখেছি।’
— এপয়েন্টমেন্ট! কী জানি বাবা! এই পায়ের জ্বালায় ভুলেও যাই, আজকাল কাকে কী বলি! কখন আসতে বলি…বয়স কত?
— ছেলেমানুষ। বাচ্চা মেয়ে।
— পা ঠিক আছে তো? হাঁটতে পারে ঠিক করে?
দমে গেল যেন অলকা একটু। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘হ্যাঁ পা ঠিক আছে।’
কেমন উদাস হয়ে গেল মুখখানা অদিতির। বললেন… আমারই শুধু পা‘টা!
— নিয়ে আসব ঘরে?
— নিয়ে আয়। আর চা দে দু‘জনকে।
সপ্রতিভ যে তরুণী ঘরে ঢুকল তাকে দেখেই কেমন ভাল লেগে গেল যেন অদিতির।
— নমস্কার অদিতিদি! আমি মৌ বিশ্বাস। আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল দিদি পরশু। সাপ্তাহিক আলোকবার্তা থেকে ফোন…
— আরে, হ্যাঁ হ্যাঁ। একগাল হাসলেন অদিতি, ‘আসলে বুঝলে তো আমার পা!’
মেয়েটি বসতে বসতে অবাক হয়ে বললো, ‘পা?? পায়ে কী হয়েছে?’
অদিতি কিছুটা সাবধানী হয়ে হাউজ়কোটটা টেনে বসলেন। বললেন, ‘ আমার পা দু‘টো বড় জ্বালাচ্ছে! এই দেখ, তুমি কী সুন্দর হাঁটছ, আর আমি?’ মেয়েটি কী বলবে বুঝতে না পেরে হাসার চেষ্টা করল একটু। বলল, ‘কী হল পায়ে? আপনার আর দীপ্রাস্ত্রদার কী ভক্ত আমি জানেন না তো! তাই যখন অফিস থেকে এই অ্যাসাইনমেন্টটা দিল, আমার তো হাতে চাঁদ পাবার অবস্থা! আমি তো তখন বেশ ছোট যখন দীপ্রদা খ্যাতির চূড়ায়! অথচ ছোট বলে আপনাদের সঙ্গে দেখা হওয়া নাগালের বাইরে ছিল। মারা যাবার সময় আমি সদ্য চাকরিতে ঢুকি।’
— কিন্তু আমার পা-টা নিয়ে কী করি বলো তো মৌ?
থতমত খেয়ে গেছে মৌ। এ প্রশ্নের উত্তর তো জানা নেই তার। অলকা চা নিয়ে এসেছে। টেবিলের ওপর চায়ের কাপ প্লেট সাজিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘বউদির পা নিয়ে বড় সমস্যা। নিন চা খান।’
— তোমাকে ড্রিঙ্কস দিতে পারতাম। কিন্তু আমার পা’টার জন্য,বুঝলে..!
কোনও মতে হাসি চেপেছে মৌ। পেটের মধ্যে হাসির দমক ঢেউ হয়ে উঠছে তা সামলানো দায়। হাসি চাপতে গিয়ে কেশে ফেলেছে। সামলেও নিয়েছে। বলল, ‘না আমি ড্রিঙ্ক করি না দিদি। থ্যাংকস।’
প্রায় লাফিয়ে উঠেছেন অদিতি, ‘সে কী! এই বয়সে ড্রিঙ্ক কর না? আজকালকার সব ছেলেমেয়েই তো ড্রিঙ্ক করে! আমরাও করেছি। ড্রিঙ্কসের একটা আলাদা মজা আছে, জানো তো? যে না করেছে সে বুঝবে না। তবে পা… পা ঠিক থাকতে হবে, বুঝলে মৌ? কেমন একটা ভেসে চলেছি, উড়ে চলেছি ভাব হয়! তো, পা না থাকলে উড়বে কী করে?’
মাথা নাড়াচ্ছে মৌ, আবার হাসি পাচ্ছে। অথচ হাসা যাবে না। কথা বলতে বলতেই কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেলেন অদিতি। খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
— ম্যাম! ইন্টারভিউটা শুরু করতে পারি?
— ম্যাম না, ম্যাম না, দিদি বলো। ম্যাম, মাদমােয়াজেল এসব বললে ফরাসি ফরাসি লাগে। সে পা থাকলে তবু মানায়। খোঁড়া মানুষের জন্য ওই ভেতো দিদিই ভাল।… বলতে বলতেই আচমকা প্রসঙ্গ পাল্টালেন অদিতি। বললেন, ‘তোমার বাড়িতে আকাশপ্রদীপ জ্বালাও এই কার্তিকে?’
— আকাশপ্রদীপ!! ন্নাহ তো দিদি! ছোটবেলায় জ্বলত দেখেছি। ছাদের মাথায়। লম্বা বাঁশের মাথায় আলো! খুব মন কেমন করত কেন জানি না দেখে। ওসব ঠাকুমা বেঁচে থাকতে হত। তারপর আর জ্বালায় না কেউ। আমিও ভুলে গেছিলাম। কতদিন বাদে আপনি মনে করালেন! শুনেছি আত্মারা স্বর্গ থেকে আসেন এই সময়ে। তাদের জন্য আলো দেখায় পরিবার!
‘বাহ! বাহ!‘ করে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন অদিতি। বললেন, ‘তুমি তো একালের মেয়ে হয়েও অনেক কিছু জানো? আমার মনটা খুব খারাপ জানো? পা নেই তো, তাই আকাশপ্রদীপ জ্বালতে ছাদে যেতে পারি না! তোমার দাদা তো আসতে পারেন? অবিশ্যি আমার একার কাছেই আসবে বলে মনে হয় না! তাঁর তো হাজারটা প্রেম ছিল। ওই কবি অধীর চন্দের বউ, বুঝলে তো পাপিয়া, তার সঙ্গে তো… অনেকেই জানত সেসব কাহিনি। পাপিয়ার কাছেও আসতে পারে। আরও অনেক আছে! মেয়েদের দল তো পাগল ছিল তোমাদের কবির জন্য! কতবার ধরা পড়েছে হাতেনাতে! তা সে তাদের কাছেও যেতে পারে! ঢেঁকি তো স্বর্গে গেলেও ধান ভানে! তবে আমাকে খুবই ভালবাসতেন। তাই আমার কাছে আসবেনই। কিন্তু আমার পা…!‘
অদিতির মুখে আলো ও বেদনার ছাপ ক্ষণেক্ষণে ফুটে উঠছে। মৌ বিস্মিত। কত অনায়াসে বলে গেলেন অদিতি ব্যক্তিগত যন্ত্রণার কথাগুলো। কী আর প্রশ্ন করবে সে বুঝে উঠতে পারছে না যেন!
— একদিন আত্মহত্যা করব ভেবে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, বুঝলে?
— দিদি!! কেন?
— আহ! শোনই না, আর এই জীবন নিয়ে কী করব বল? সেইদিন ছোট বোনের সঙ্গেও একচোট হয়ে গেল। সকালে খবরের কাগজ এসেছে। আমি বরাবরই ইংরেজিটা আগে পড়ি। তারপর বাংলাটা রসিয়ে রসিয়ে পড়ি। তা মিনু বলল, আমি ইংরেজিটা আগে পড়ব। আমি বললাম, আমি পড়ব, আমার বরাবরের অভ্যাস। তুই তো বাংলাই পড়তিস বরাবর? ও বলল, না আজ ইংরেজিটাই পড়ব। ব্যস, লেগে গেল। সে প্রায় চুলোচুলি! যেমন ছোটবেলায় করতাম! আসলে কী জানো? সংসারে অনেককিছু ছেড়ে দিয়েছিলাম শুধু শান্তির জন্য। সেটাই সবাই ধরে নিয়েছিল যে আমি শুধু ছেড়ে দিতেই পারি! তোমাদের কবি সার্বজনীন! সে তো আমার একার ছিল না কোনও দিন! এত মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, তাও ছেড়ে দিয়েছিলাম! এবারে বাপু আর ছাড়াছাড়ি নয়। পা-ও আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে! ন্নাহ! আর ছাড়ব না।
— নিশ্চয়। ছাড়বেন কেন?
— হ্যাঁ, তা যা বলছিলাম। সেইরাতে আচমকাই মনে হল আত্মহত্যা করি। সতেরোতলা থেকে ঝাঁপ দিলে আর বাঁচব না। সব ঠিক ছিল, বুঝলে? কিন্তু যেই না ব্যালকনিতে এলাম, ঝাঁপ দেব বলে ঠিক করলাম, হঠাৎ মনে হল আমি তো মরে যাব, কিন্তু আমার পা দুটো যে ভেঙে যাবে! বুঝলে, আর হল না!
হাসতে গিয়েও হাসি চলে গেল নিজেই। চোখের কোণ ভিজে উঠল কি একটু মৌয়ের? রেকর্ডারে রেকর্ড হয়ে চলেছে অদিতির কথাগুলো।অদিতি বিষণ্ণ স্বরে বললেন, ‘আমার পা দুটো, বুঝলে? বড় বিট্রে করে আমাকে। তখনও কতবার ভেবেছি সংসার ছেড়ে চলে যাব। এই পা যেতে চায়নি। আর এখন মরতেও দিচ্ছে না!’
— একটা কথা বলব দিদি? আপনি সংসার আর নিজেকে খুব ভালবাসেন যে! আপনার পা ভাল হয়ে যাক, প্রে করছি। দাদা নিশ্চয় আসবেন। কাউকে বলুন না ছাদে একটা আকাশপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিতে?
কবি ও সাহিত্য়িক কাবেরী রায়চৌধুরীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। লেখালেখির শুরু প্রবন্ধ প্রকাশ দিয়ে। সাত পুতুলের সাত কথা‚ চাতক জল‚ নদীটি আজও কথা বলে, যে যেখানে দাঁড়িয়ে‚ ঠাকুরবাড়ির সারদাসুন্দরী, অর্ধেক আকাশ‚ শরীরী ওঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, এই সবকটি মাধ্যমেই কাবেরী নিজেকে প্রকাশ করেছেন।
বেশ ভালো লাগল আপনার ‘পা’
ভালো লাগলো কাবেরী। এই আকাশপ্রদীপ বড় মনখারাপিয়া ধুন ছড়িয়ে দেয় হিমেল বাতাসে।
খুব ভালো লেখা। মনখারাপ হয়ে গেলো।
আপনার স্বাভাবিক ঝরঝরে ভাষায় লেখা সবসময়ই ভাল লাগে।
খুব ভালো লাগলো গল্পটি। পড়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। আকাশপ্রদীপ, কবি,ফরাসী,পা বিলাস সব মিলিয়ে লেখিকার মুন্সীয়ানা গল্পটির ছত্রে ছত্রে লেপ্টে রয়েছে।
অপূর্ব প্রকাশ,গল্পটি পড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম। কবি,ফরাসী,প্রেম,পা ও অবশ্যই আকাশ প্রদীপের আলোর মধ্য দিয়ে নিজের অতীতকে নিরন্তর খুঁজে চলা। গল্পটির ছত্রে ছত্রে লেখিকা ধরে রেখেছেন আস্ত একটা জীবনদর্শন ।