খবরটা জেনে বরুণার প্রতিক্রিয়া কী হল, সুচারু ধরতে পারেনি। সংসারের গাড়িটা চালানোর জন্য তেলের জোগান দিচ্ছিল ওর চাকরি, তবে ড্রাইভারের সিটটা ছিল বরুণার। ছ’ বছরের ছেলে, এতদিন খেলা খেলা একটা স্কুলে গিয়েছে। কিন্তু এখন সে যাবে বড় স্কুলে, ভাল স্কুলে। তার জন্য ব্যবস্থাপত্তরের খরচ আছে। সুচারুর বাবা মা আছেন গ্রামের বাড়িতে, তাঁদের জন্য নিয়ম করে টাকা পাঠায় বরুণাই। উপার্জন এমন ছিল না যে খুব আয়েসে দিনযাপন করা যায়; তবে সুগৃহিণী বরুণার পরিচালনায় বাড়িতে স্বাচ্ছন্দ্যের একটা হাওয়া বইত। সুচারু চাকরি ছেড়েছে মানে বরুণার দুশ্চিন্তার কারণ ঘটল অবশ্যই। তবে ওর মুখ দেখে কিছু বোঝবার উপায় ছিল না। প্রথম দু’মাস ওদের জীবনধারায় কোনও বদল টের পাওয়া গেল না। বরুণা এদিকে ওদিকে চাকরির সন্ধান করছিল সুচারুকে না জানিয়েই। বিয়ের আগে যে স্কুলে পড়াত সেখানেও ঘুরে এসেছিল।
বরুণা একদিন লক্ষ করল ওদের বাড়ির সামনে একটি বিশেষ চেহারা যেন কারণে অকারণে ঘোরাফেরা করছে। সুচারুকে বলাতে ও গম্ভীর হয়ে গেল। পাড়াতেও নানা কৌতূহল, নানা প্রশ্ন। সুচারু এর মধ্যে পরেশের আরও কাছাকাছি চলে এসেছে, রাজনৈতিক বিশ্বাস আর দলীয় কাজকর্মের ক্ষেত্রে। পরেশ আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলে ওঁর সঙ্গে দলের যোগাযোগ যাদের মারফৎ থাকবে, সুচারু তাদের মধ্যে একজন। নানা কথা ভেবে বরুণাকে ও একদিন বলল, ’আমি বাড়িতে থাকলে তোমরা ঝামেলায় পড়বে। আমি বরং বাইরে চলে যাই । কিন্তু তুমি একা সামলাবে কী করে? নাকি তোমার দাদার কাছে চলে যাবে?’
‘ছেলে নিয়ে কারও ঘাড়ে পড়তে চাই না। তুমি যাবে ঠিক করেছ যাও। আমি চালিয়ে নিতে পারব।‘ বরুণার গলায় কি প্রচ্ছন্ন ক্ষোভ? সুচারু জিজ্ঞেস করল, ‘কী করবে?’
‘এখানকার স্কুলে নিচু ক্লাসের জন্য টিচার চাওয়া হচ্ছে। একটা অ্যাপ্লিকেশন করব।’
‘তোমাকে নেবে গ্যারান্টি কী?’
‘বিকুকে আপাতত এই স্কুলেই দেব ভেবেছি। হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, উনি আমি আগে স্কুলে পড়িয়েছি শুনে এই অফারটা করলেন।’
সুগৃহিণী বরুণার পরিচালনায় বাড়িতে স্বাচ্ছন্দ্যের একটা হাওয়া বইত। সুচারু চাকরি ছেড়েছে মানে বরুণার দুশ্চিন্তার কারণ ঘটল অবশ্যই। তবে ওর মুখ দেখে কিছু বোঝবার উপায় ছিল না। প্রথম দু’মাস ওদের জীবনধারায় কোনও বদল টের পাওয়া গেল না। বরুণা এদিকে ওদিকে চাকরির সন্ধান করছিল সুচারুকে না জানিয়েই। বিয়ের আগে যে স্কুলে পড়াত সেখানেও ঘুরে এসেছিল।
সুচারুর একটু খারাপ লেগেছিল। বরুণা আগেও যেমন ওকে ওর মতো থাকতে দিত, এখনও ওর মতো পথ বেছে নিতে দিচ্ছে। কোনও অভিযোগ নেই। নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে হচ্ছিল সুচারুর। বরুণাই আবার বলল, ‘গ্রামে মা-বাবাকে টাকা পাঠানোর জন্য ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ভেব না।’
এই দায়িত্বটাও বরুণার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে ও চলে যাবে? দ্বিধা আর দ্বিধা। কিন্তু সুচারু যে চাইছিল মাঠে নেমে কাজ করতে। এই মাঠে নামার ভাবনা ওর মাথায় এসেছিল পরেশের একটা কথা শুনে। উনি বলেছিলেন ‘আমাদের ছেলেরা অনেক পড়ে, লেখেও বড় বড় প্রবন্ধ। কিন্তু মাঠে নেমে কাজ করতে চায় কম। মাঠে নামতে গেলে পিছুটান রাখলে চলবে না।পরিবার সংসার থেকে নিজেকে ছিঁড়ে আনতে হবে।’ আট বছর আগে সুচারু তাই স্বার্থপরের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চলে যাবার। কোনটা ছিল স্বার্থপরতা, ঠিক বুঝতে পারেনি বলাই বরং ভাল। নিজের একেবারে ব্যক্তিগত সুখ আর নিরাপত্তা নিয়ে থাকাও তো স্বার্থপরতা।
সুচারুর মনে হয়েছিল ও বেড়া ভাঙবে, নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এক বৃহত্তর, মহত্তর কর্মকাণ্ডে যোগ দেবে। দেশের মানুষের বড় একটা সংখ্যা ক্ষমতাসীনের দুরভিসন্ধিতে জীবনের প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই বঞ্চনার শিকার হয়ে বেঁচে আছে। তাদের সংগঠিত করা, অধিকার সচেতন করা, ন্যায্য দাবির জন্য সংগ্রাম করতে শেখানো– এই কাজের কর্মী চাই। সুচারু নেমে পড়ল সেই কাজে।
***
তীব্র হুইসল দিয়ে একটা ট্রেন ওদিকের লাইন দিয়ে চলে গেল। এদিকের লাইনেও সিগন্যাল পড়েছে। কখন যেন কিছু যাত্রী জড়ো হয়ে গিয়েছে স্টেশনে। সুচারু নাম্বার টু্ ছেলেকে ডাকল, ‘পিকু, ট্রেন আসছে। চলে এস।’ ‘পিকু?’ সুচারুর আবার গুলিয়ে গেল। ওর ছেলের নাম ছিল বিকু। ছ’বছরের ছেলেকে ছেড়ে গিয়েছিল, আট বছর কেটে গেছে। তারপর সে ছেলে তো ছ’বছরেই আটকে থাকবে না। কেন এই বিভ্রম? কেন ওর মনে হচ্ছে এই ট্রেনে ও নিজে উঠবে বরুণা আর ছোট বিকুকে নিয়ে? দুটো টুকরো হয়ে গেছে ও। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সুচারু যেন দেখছে আট বছর আগের সুচারু উঠে যাচ্ছে এইমাত্র এসে দাঁড়ানো ট্রেনে।
কিন্তু সুচারু যে চাইছিল মাঠে নেমে কাজ করতে। এই মাঠে নামার ভাবনা ওর মাথায় এসেছিল পরেশের একটা কথা শুনে। উনি বলেছিলেন ‘আমাদের ছেলেরা অনেক পড়ে, লেখেও বড় বড় প্রবন্ধ। কিন্তু মাঠে নেমে কাজ করতে চায় কম। মাঠে নামতে গেলে পিছুটান রাখলে চলবে না।পরিবার সংসার থেকে নিজেকে ছিঁড়ে আনতে হবে।’
ট্রেন চলে যাবার পর স্টেশন প্রায় ফাঁকা। সুচারু এগলো চায়ের স্টলটার দিকে। চাওয়ালা ছেলেটি বলল, ‘কি দাদা, এই ট্রেনে গেলেন না? পরেরটা তো এক ঘণ্টা বাদে।’ সুচারু কিছু না বলে এক কাপ চা চাইল। ছেলেটি কথা বলতে ভালবাসে। জিজ্ঞেস করল ‘দাদা এদিকে নতুন দেখছি। কোথায় যাবেন?’ সুচারু এ কথারও কোনও জবাব দিল না। অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘ওরা কি কলকাতায় গেল?’
‘কারা?’
‘ওই যে এতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল, সঙ্গে ছেলে।’
‘আপনি অতনুদার কথা বলছেন?’
‘অতনু? সঙ্গে বরুণা আর বিকু?’
‘অতনুদার সঙ্গে অর্চনা বউদি আর ওঁদের ছেলে ছিল। আপনি বোধহয় কারও সঙ্গে গোলমাল করছেন।’
অর্চনা? বরুণা নয়? এত মিল? শাড়ির হলুদ রঙে, চুল ঘাড়ের কাছে নামিয়ে বাঁধা খোঁপায়? আর এমন সপরিবার কলকাতায় বেড়াতে যাওয়া? বিকু জন্মানোর আগে সুচারু বরুণাকে নিয়ে বেড়াতে গেছে, বই মেলায় কিম্বা নামকরা কোনও শিল্পীর প্রদর্শনীর খবর পেয়ে। এ সব ছিল সুচারুর পছন্দের জায়গা। কখনও ভাবেনি যে বরুণার অন্য জায়গায় যেতে ইচ্ছে করতে পারে। বরুণা বিনা আপত্তিতে সঙ্গে যেত, তবে মতামত আদানপ্রদান খুব একটা হত না। সুচারু মনে করত বরুণা নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছে সুচারুর ভাবনার ভাগীদার হবে বলে।
চাওয়ালা ছেলেটি বকবক করে চলেছিল। ‘অতনুদা কবিতা লেখে, কলকাতার পত্রিকায় ছাপা হয়।’ কবিতা… সুচারুর স্মৃতিতে ভেসে উঠল ওর প্রিয় লিটল ম্যাগাজিনগুলো। নিজের অজান্তেই ও জিজ্ঞেস করল, ‘এঁরা কি অনেক দিন আছেন এখানে? মানে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।’
‘তা প্রায় বছর পাঁচেক তো হবে। আমি এই স্টল করেছি চারবছর হল। স্টেশনটা ভেঙে বড় করা হচ্ছিল তখন। অতনুদা দেখে বললেন বেশ হল। একটা ভদ্র গোছের চায়ের ঠেক হল। অর্চনা বউদিকে বললেন ভাগ্য দেখ। আমরা আসতে আসতেই স্টেশনটার ভোল ফিরল, চায়ের স্টল বসল।… আপনি এখানে থাকতেন? কত দিন আগে? কোন দিকটায়?’
‘সে অনেকদিন আগে। দরজিপাড়ার দিকে থাকতাম।’ এখন তো সুচারুর আর প্রয়োজন নেই নিজেকে লুকিয়ে রাখার।
‘অতনুদাও ওখানে থাকেন। কালীমন্দিরের পাশে।’
‘একটা দোতলা বাড়ি ছিল…’
‘সে বাড়ি ভেঙে চারতলা ফ্ল্যাট উঠে গেছে। লোকজন বেড়ে গেছে তো।’
অর্চনা? বরুণা নয়? এত মিল? শাড়ির হলুদ রঙে, চুল ঘাড়ের কাছে নামিয়ে বাঁধা খোঁপায়? আর এমন সপরিবার কলকাতায় বেড়াতে যাওয়া? বিকু জন্মানোর আগে সুচারু বরুণাকে নিয়ে বেড়াতে গেছে, বই মেলায় কিম্বা নামকরা কোনও শিল্পীর প্রদর্শনীর খবর পেয়ে। এ সব ছিল সুচারুর পছন্দের জায়গা। কখনও ভাবেনি যে বরুণার অন্য জায়গায় যেতে ইচ্ছে করতে পারে। বরুণা বিনা আপত্তিতে সঙ্গে যেত, তবে মতামত আদানপ্রদান খুব একটা হত না।
তা হলে বরুণারা গেল কোথায়? সুচারু কি আশা করেছিল বরুণা ওর প্রতীক্ষায় থাকবে এই আট বছর? আট বছর তো কম সময় নয়। সুচারু কোনও যোগাযোগ রাখেনি পরিবারের সঙ্গে। শুধু ওদের বিপদে ফেলতে চায়নি বলে নয়, নিজের সময়, মন সবটাই দিয়েছিল পার্টির কাজে। নিশ্ছিদ্র কর্মযোগ। আর বোধহয় ভেতরে ভেতরে বিশ্বাস করত, বরুণা ওর হয়ে সব দায়িত্ব পালন করছে, যেমন বলেছিল মা বাবার জন্য টাকাও ঠিক পৌঁছে যাবে। কিন্তু কে জানে বরুণার পক্ষে হয়তো অত সহজ হয়নি ব্যাপারটা। হয়তো এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। যে রকম অভিমানী ছিল, দাদার সংসারে অবাঞ্ছিত হয়ে থাকবার কথা ভাবতে পারত না। কোথায় গেল তা হলে?
‘একটা স্কুল ছিল, ঋষিবাবু ছিলেন হেডমাস্টারমশাই…।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ঋষিবাবু স্যার তো রিটায়ার করে গিয়েছিলেন। মারাও গিয়েছেন বছর দুয়েক হল। এর মধ্যে ইশকুল হাত বদল হল। এখন সব নতুন স্যার আর দিদিমণিরা পড়ান।’
‘বরুণা পড়ায় না আর? ও তো এখানে থাকেই না।’
‘আপনি কার কথা বলছেন বলুন তো? ওই ইশকুলে অর্চনা বউদি পড়ান বাচ্চাদের।’
স্নিগ্ধা সেন পারিবারিক সূত্রে ওপার বাংলার হলেও আজন্ম কলকাতারই বাসিন্দা। চল্লিশ বছরেরও বেশি ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন, প্রথমে ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশনে, এবং পরে একাধিক ওপেন ইউনিভারসিটিতে। সাহিত্যচর্চার শখ বহুদিনের। আশি পেরিয়েও চর্চা চলছে পূর্ণ উদ্যমে। কলকাতার অনেক পত্র পত্রিকায় লেখা বেরিয়েছে - গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। সাম্প্রতিক প্রকাশিত দুটি বই – ‘হ্যামলেট’ এবং ‘ওদের কি খেতে দেবে’।