সুচারু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ও দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনের শেডটার ঠিক বাইরে যে কৃষ্ণচূড়া গাছটা আছে, তার আড়ালে। গাছের গুঁড়ি ঘিরে বাঁধিয়ে দেওয়া সিমেন্টের সিট। কিন্তু যাত্রী বেশি নেই স্টেশনে। এর আগে একটা ট্রেন চলে গিয়েছে, পরের ট্রেন আসতে ঘণ্টাখানেক দেরি। সুচারু নেমেছে উল্টো মুখে যে গাড়িটা আরও আগে গেছে, তার থেকে। এ জায়গা ওর আবাল্যপরিচিত, তবে মাঝে যে ক’বছর ছিল না, স্বাভাবিকভাবেই কিছু বদল হয়েছে। পালিশ পলেস্তারা পড়ে স্টেশনটা দেখতে চকচকে হয়েছে, ট্রেন হয়তো বেশিক্ষণ থামে। কিন্তু ও এসব ভাবছে না, অবাক হয়ে শুধু দেখছে… কাকে? একটু দূরে চায়ের স্টলের সামনে যে পরিবারটি এক্ষুনি এসে দাঁড়াল তাদের দেখছে সুচারু। ও কি আয়না দেখছে? আট বছর পিছিয়ে গিয়ে? ওখানে দাঁড়ান যে যুবকটি স্টলের ছোকরার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে স্ত্রীকে দিল সে তো সুচারুই। আর যে তরুণী স্মিতমুখে কাপে চুমুক দিচ্ছে এখন, সে নির্ভুলভাবে বরুণা। পাশে ওর হাত ছাড়িয়ে নেবার জন্য ছটফট করছে একটি বছর ছয়েকের ছেলে।ভাল করে লক্ষ করল সুচারু। বরুণাই। মুখের সন্তোষে, দাঁড়ানোর আয়েসে এক তৃপ্ত সংসারী গৃহিণী– বরুণা চিরকালই যা ছিল, থাকতে চেয়েছিল আট বছর আগেও, সুচারুর সেই অস্থির দিনগুলোতে…। বরুণা কি আবার বিয়ে করেছে? সুচারুর দীর্ঘ অনুপস্থিতিকে ওর বেঁচে না-থাকা ধরে নিয়ে? কিন্তু সঙ্গীটি যেন হুবহু সুচারু। আট বছর আগে যেমন ছিল ও, তেমনি প্যান্টের মধ্যে হাফশার্ট গোঁজা আর পকেটে একটা পাতলা লিটল ম্যাগাজিন ভাঁজ করে ঢোকানো। মাথার চুলগুলো একটু লম্বা, বেশ উদাসীন ভাব। বাইরে থেকে দেখলে কেমন যেন ভীরু ভালমানুষ মনে হত বলে ও শুনেছে। এও তেমনই ।
সুচারু নাম্বার টু? ভেবে মজা পেল ও।
সুচারুর এখনকার চেহারা অবশ্য অন্যরকম। এখন সে পরে পাজামা, গায়ে খাদির হাফ পাঞ্জাবি। কাঁধে বড় একটা ঝোলা, তাতে ওর পুরো সংসার। এক প্রস্ত জামাকাপড়, গামছা, একটা জলের বোতল, কিছু জরুরি ওষুধ আর একটা টর্চ। আগের মতো লিটল ম্যাগাজিন? নিয়মিত না হলেও কখনও সখনও তার জায়গাও হয়ে যায়। টাকায় কুলোলে প্রিয় কবির নতুন প্রকাশিত চটি বই এসে ঢোকে। টাকায় কুলোনো সমস্যা হয়ে থাকে আজকাল। এক পুরনো বন্ধুর টিউটোরিয়াল হোমে পড়ায়, ইতিহাস আর ইংরেজি – সেই সূত্রে এক নোটবই প্রকাশকের ফরমায়েশ মতো কয়েক পাতা লেখা। চলে যায়, আবার যেন যায়ও না।
আট বছর আগে কেমন ছিল জীবন? ছকে বাঁধা, একশো জনের মধ্যে নিরানব্বই জনের যেমন। ইলেকট্রিক সাপ্লাই অফিসে ‘দশটা পাঁচটা’ কেরানির কাজ আর বাড়ি ফিরে রাজ্যের লিটল ম্যাগাজিন আর কবিতার বই। না,সবাই বই পড়ে না হয়তো। কিন্তু যা ভাল লাগে তা করে রিল্যাক্সেশন হিসেবে। সুচারুর রিল্যাক্সেশন ছিল কবিতা আর লিটল ম্যাগাজিন। কবিতা ওর মনে জাগাত একটা স্বপ্ন, চারপাশের এই বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত একটা নতুন অস্তিত্বের আশা। ওই অন্য ভুবনের স্বপ্ন ওকে আস্তে আস্তে টেনে এনেছিল রাজনীতির দিকে। সুবিধেবাদী স্বার্থপর রাজনীতির দিকে নয়,অন্য এক আদর্শের দিকে।
একটু দূরে চায়ের স্টলের সামনে যে পরিবারটি এক্ষুনি এসে দাঁড়াল তাদের দেখছে সুচারু। ও কি আয়না দেখছে? আট বছর পিছিয়ে গিয়ে? ওখানে দাঁড়ান যে যুবকটি স্টলের ছোকরার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে স্ত্রীকে দিল সে তো সুচারুই। আর যে তরুণী স্মিতমুখে কাপে চুমুক দিচ্ছে এখন, সে নির্ভুলভাবে বরুণা। পাশে ওর হাত ছাড়িয়ে নেবার জন্য ছটফট করছে একটি বছর ছয়েকের ছেলে।ভাল করে লক্ষ করল সুচারু। বরুণাই। মুখের সন্তোষে, দাঁড়ানোর আয়েসে এক তৃপ্ত সংসারী গৃহিণী– বরুণা চিরকালই যা ছিল, থাকতে চেয়েছিল আট বছর আগেও, সুচারুর সেই অস্থির দিনগুলোতে…।
নিজে ছিল ইতিহাসের ছাত্র। সমাজতত্ত্বের প্রথম পাঠ হয়েছিল সেই সঙ্গেই। তত্ত্বের সূত্রগুলো বুঝতে চেষ্টা করত, বিতর্কিত অংশগুলো নিয়ে নিজের মতো করে ভাবত। কলেজে পড়তে পড়তে কিছু রাজনীতিমনস্ক দাদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল,তাদের সভা সমাবেশে, তত্ত্ব আলোচনার ক্লাসে যেত কৌতূহলবশে। বিয়ে আর চাকরি, এ দুটো ঘটনায় ওর এই নিজের সময়ের বেশ খানিকটা কমে গেল আর নিজের সময় না থাকলে গভীর কিছু ভাবা যায় না। এখন যেন রুটিন মেনে দিনযাপন। চাকরি, ইনক্রিমেন্ট, সংসারের দায়িত্ব, স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের দাবি মাফিক আবেগ বিনিময়— রুটিনের খোপে খোপে বসানো। বরুণাকে দোষ দেবে না সুচারু। ওর বিয়ের পর বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন উনি আর সুচারুর মা বর্ধমানে ওঁদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকবেন। বৌমা বরুণার ওপর রেখে গেলেন সুচারুর নতুন সংসারের ভার। বরুণা খুশিমনেই দায়দায়িত্ব মেনে নিল। ও ছিল ঘরোয়া মেয়ে, নিজের সংসারটি সাজাতে এত ভালবাসত যে তার খুঁটিনাটি নিয়ে সবসময়, এমনকী ছুটির দিনেও ব্যস্ত থাকত। সুচারুর বইমুখে বসে থাকাকে একটা সস্নেহ প্রশ্রয় দিয়ে ও নিশ্চিন্তমনে গৃহিণীপনা করত। অভিযোগ করত না কেন সুচারু ওকে নিয়ে প্রতি রবিবার সিনেমায় যায় না বা গঙ্গার ঘাটে বেড়িয়ে রেস্তোঁরায় খেয়ে বাড়ি ফেরার প্রস্তাব করে না। ছেলে হবার পর সুচারু চলে গেল দ্বিতীয় কি তৃতীয় গুরুত্বে। আর এমন এক সময়েই ওর দেখা হয়ে গেল কলেজ জীবনের এক দাদার সঙ্গে। পরেশ চৌধুরী।
দেখা হল কলেজস্ট্রিটের সুপরিচিত লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিতে। দু’জনেই একটি পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা খুঁজছিল। পাওয়া গেল একটিমাত্র কপি। দরকার ছিল একটা পারস্পরিক বোঝাপড়ার– কে আগে নেবে আর কে পরে। সুচারুকে পরেশ বললেন, সাতদিন পরে ওঁর বাড়ি থেকে পত্রিকাটা নিয়ে যেতে। সুচারু পরেশের বাড়ি এসে দেখল, একটা ছোটখাট ক্লাস চলছে। ও প্রথমে ভেবেছিল পরেশ বাড়িতে বোধহয় ছাত্র পড়ান। কিন্তু দলের মধ্যে বেশি বয়েসের লোকও আছে এটা নজরে পড়ল। ও এক পাশে বসে পড়ল, ক্লাসে ব্যঘাত ঘটাবে না বলে। শুনতে লাগল আলোচনা। পরেশ লক্ষ করে খুশি হলেন আর পরে যখন পত্রিকাটা এনে দিলেন, ওকে বললেন, ‘বুঝতে পারছিলে? আরও শুনতে হবে।’
সুচারু পরে জেনেছে, পরেশ তখন কলেজের চাকরি ছেড়েছেন রাজনীতিতে পুরো সময়টা দেবেন বলে। দলের নেতৃত্ব ওঁর ওপরে স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়েছিল, কারণ সবাইকে নিয়ে চলবার ক্ষমতা ছিল ওঁর। সুচারু যে ইতিহাসের ছাত্র, পরেশ জানতেন। বললেন, ‘মাঝে মাঝে এস। মনে হয় তোমার ভালই লাগবে।’
আট বছর আগে কেমন ছিল জীবন? ছকে বাঁধা, একশো জনের মধ্যে নিরানব্বই জনের যেমন। ইলেকট্রিক সাপ্লাই অফিসে ‘দশটা পাঁচটা’ কেরানির কাজ আর বাড়ি ফিরে রাজ্যের লিটল ম্যাগাজিন আর কবিতার বই। না,সবাই বই পড়ে না হয়তো। কিন্তু যা ভাল লাগে তা করে রিল্যাক্সেশন হিসেবে।
সুচারুর ভাল লাগত। সময়টা তখন উত্তেজনার। ঘটছিল অনেক কিছু। ওর মনে নানা প্রশ্ন জাগত। পরেশকে প্রশ্ন করলে উনি সহজ করে উত্তর দিতেন, বই পড়তে দিতেন। বইগুলির কয়েকটি তখন প্রশাসনের বিষ নজরে পড়ে গিয়েছে। সুচারু লুকিয়ে পড়ত বাড়িতে নিয়ে এসে। বরুণা সন্দেহ করত বোধহয় খারাপ বই পড়ছে। অফিসের বাবুদের নানারকম গোপন শখ পছন্দের কথা শোনা যায়। বইগুলি পড়বার সঙ্গে সঙ্গে পার্টি পত্রিকা,পার্টি ইস্তাহার পড়াও চলছিল। পুলিশের ধরপাকড় বেড়ে যাচ্ছিল দিনে দিনে। পরেশ সুচারুকে কোনও ঝুঁকির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলতে চাননি প্রথমে। একে পারিবারিক মানুষ, তায় চাকরির কারণে খানিকটা এক্সপোজ়ড। কিন্তু ওঁর বাড়িতে যে সব ছেলেরা আসাযাওয়া করত, তাদের সঙ্গে সুচারুর পরিচয় হচ্ছিল, একই সঙ্গে পরেশের বাড়ি থেকে বেরিয়েছে এমনও হয়েছে। পুলিশ যে ওকেও নজরদারির আওতায় রেখেছে, এটা বোঝেনি প্রথমে। ক্রমে খেয়াল করল অফিসে কিছু লোক ওর টেবিলে এসে ভাব জমাতে চায়, এটা ওটা জিগ্যেস করে, যার সঙ্গে ইলেকট্রিক কানেকশন সংক্রান্ত সমস্যার কোনও যোগাযোগ নেই। ছুটির পর যখন বাড়ি ফিরত, কোনও অদৃশ্য চোখ ওর প্রতি পদক্ষেপ অনুসরণ করত।
অফিসের কাজে সুচারুর সুনাম ছিল। তাই বড়কর্তার ঘরে একদিন তলব পড়াতে ও অবাক হয়েছিল। গিয়ে শুনল পুলিশ এনকোয়ারি হয়েছে ওর সম্বন্ধে। সার্ভিস রেকর্ডে দাগ পড়ে গেল। সরকারবিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্ত বলে। বাইরে এসে মন্তব্য শুনল, সুখে থাকতে ভূতে কিলিয়েছে ওকে। এমনও শুনল যে মুখে ভালমানুষ দেখালেও ওর কারবার বোমাবন্দুক নিয়ে। সহকর্মীদের কৌতূহল, ব্যঙ্গ আর সর্বক্ষণের এক গোপন নজরদারি অসহ্য হয়ে উঠছিল। সুচারু একদিন ধ্যাত্তেরি বলে চাকরিটা ছেড়ে দিল।
স্নিগ্ধা সেন পারিবারিক সূত্রে ওপার বাংলার হলেও আজন্ম কলকাতারই বাসিন্দা। চল্লিশ বছরেরও বেশি ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন, প্রথমে ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশনে, এবং পরে একাধিক ওপেন ইউনিভারসিটিতে। সাহিত্যচর্চার শখ বহুদিনের। আশি পেরিয়েও চর্চা চলছে পূর্ণ উদ্যমে। কলকাতার অনেক পত্র পত্রিকায় লেখা বেরিয়েছে - গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। সাম্প্রতিক প্রকাশিত দুটি বই – ‘হ্যামলেট’ এবং ‘ওদের কি খেতে দেবে’।