সালটা ১৮৭৪।
৬ নং দ্বারকানাথ লেনের লালবাড়িতে অগস্ট মাসে বাড়ির ছোট ছোট ছেলেদের জন্য কয়েকটি বই কেনা হল।
এ বাড়িতে মাঝেমধ্যেই এমন বই কেনা হয়। তা সেবার তারমধ্যে শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ বইটি ছিল।
সেইসময়ে ও বাড়ির ছেলেদের গৃহশিক্ষক ছিলেন জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য। তিনি তাঁর পড়ানোর বিচিত্র পদ্ধতিতে বালকদের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন।
লেথব্রিজের ‘Selections from Modern English Literature for the Higher Classes in Indian Schools’ বইটির পাশাপাশি কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’-সহ শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’-ও পড়াতেন। কেমন ছিল সে পড়া তার কথা আমরা জেনেছি সেই বাড়ির সেই সময়ের চতুর্বদশর্ষীয় কিশোরের পরবর্তীকালে লেখা ‘জীবনস্মৃতি’র পাতায়।
‘….খানিকটা করিয়া আমাকে বাংলায় মানে করিয়া বলিতেন এবং যতক্ষণ তাহা বাংলা ছন্দে আমি তর্জমা না করিতাম ততক্ষণ ঘরে বন্ধ করিয়া রাখিতেন।’
শেষ পর্যন্ত সমস্ত বইটির অনুবাদ শেষ করতে পেরেছিল চতুর্দশবর্ষীয় কিশোরটি।
লেখা তো শেষ হল। এবার অপ্রত্যাশিতভাবে একটি সুযোগ এল। মেট্রোপলিটন স্কুলের শিক্ষক রামসর্বস্ব বিদ্যাভূষণ ওই কিশোরকে বললেন, ‘চলো আমার সঙ্গে।তোমার এই অনুবাদটি আমি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দেখাতে চাই।’
সেই সময়ে মেট্রোপলিটন স্কুল ছিল সুকিয়া স্ট্রিটে। কিশোর, চল্লিশ বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের প্রথম স্মৃতির কথা লিখলেন,
‘পুস্তকে-ভরা তাঁহার ঘরের মধ্যে ঢুকিতে আমার বুক দুরুদুরু করিতেছিল — তাঁহার মুখচ্ছবি দেখিয়া যে আমার সাহস বৃদ্ধি হইল তাহা বলিতে পারি না।’ তাঁর এই অকপট স্বীকারোক্তিতে আরও ছিল, ‘ইহার পূর্বে বিদ্যাসাগরের মতো শ্রোতা আমি তো পাই নাই — অতএব, এখান হইতে খ্যাতি পাইবার লোভটা মনের মধ্যে খুব প্রবল ছিল।’ এবং বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে সস্নেহ উৎসাহ যে পেয়েছিলেন তা বলাই বাহুল্য।
সেই চোদ্দো বছর বয়স থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর অসীম শ্রদ্ধার কথা আমরা নানা ভাবে জেনেছি।

জীবনের সায়াহ্নে তখন রবীন্দ্রনাথ। বাংলার নবযুগ প্রবর্তক বিদ্যাসাগরের স্মৃতিমন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করতে মেদিনীপুরে এসেছেন আটাত্তর বছরের কবি। সেখানে ভাষণ দিতে উঠে বললেন,
‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্যভাষার সিংহদ্বার উদঘাটন করেছিলেন। …ভাষার একটা প্রকাশ মননের দিকে এবং জ্ঞানের তথ্যসংগ্রহের দিকে, অর্থাৎ বিজ্ঞানে তত্ত্বজ্ঞানে ইতিহাসে; আর একটা প্রকাশ ভাবের বাহনরূপে রসসৃষ্টিতে; এই শেষোক্ত ভাষাকেই বিশেষ ক’রে বলা যায় সাহিত্যর ভাষা। বাংলায় এই ভাষাই দ্বিধাহীন মূর্তিতে প্রথম পরিস্ফুট হয়েছে বিদ্যাসাগরের লেখনীতে।…’
সেদিন অর্থাৎ ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর মেদিনীপুরের সেই সভায় তাঁর নাতিদীর্ঘ বক্তব্যে আরও অনেক কথা বলেছিলেন। তবে সেই শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের শেষে বলেন,
‘এখনো আমার সম্মাননিবেদন সম্পূর্ণ হয়নি। আসলে আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেও বিদ্যাসাগর আপন বুদ্ধির দীপ্তিতে চিরাচরিত আনুষ্ঠানিকতার বন্ধন-মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও এই বন্ধন-মুক্তিই শেষ কথা নয়। বরং ‘যে দেশে অপরাজেয় নির্ভীক চারিত্রশক্তি সচরাচর দুর্লভ, সে দেশে নিষ্ঠুর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্রের নির্বিচল হিতব্রতপালন সমাজের কাছে মহৎ প্রেরণা।’
বিদ্যাসাগরের জীবনীর মধ্যে দেখা গিয়েছে, তিনি ক্ষতির আশঙ্কা উপেক্ষা করেও পৌরুষ শক্তির সতেজ প্রতিমূর্তি হয়ে বারংবার দৃঢ়তার সঙ্গে আত্মসম্মান শুধু রক্ষাই করেননি, ‘শ্রেয়োবুদ্ধির প্রবর্তনায় দণ্ডপাণি সমাজ-শাসনের কাছে তিনি মাথা নত করেননি।’
তবে ৭৮ বছরের কবি কিন্তু জোর দিয়েছেন অনাথা নারীদের প্রতি তাঁর কর্তব্যকে। বলেওছিলেন সেই সভায় সে কথা। আরও বলেছিলেন, ‘তাঁর শ্রেষ্ঠতা আরো অনেক বেশি, কেননা তার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে কেবলমাত্র তাঁর ত্যাগশক্তি নয়, তাঁর বীরত্ব।’
আসলে অগ্রজ জ্ঞানতাপসের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। বিশ্বাস করতেন শুধুমাত্র প্রতিভাসম্পন্ন বলেই তাঁর সম্মান নয়। বরং তাঁর ‘চরিত্রের শ্রেষ্ঠতাই যে যথার্থ শ্রেষ্ঠতা’ সে ব্যাপারে কারও মনে সংশয় থাকা উচিত নয়। নিজে কালোত্তীর্ণ হয়েও অকপটে এই পুণ্যশ্লোক মহাত্মার প্রতি বিনম্র ছিলেন বরাবর।

১৮৮২ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্যোগে সেবার বাংলার সাহিত্যিকদের একত্র করে একটি পরিষদ গড়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তখন যুবক। রাজেন্দ্রলাল মিত্র খুবই উৎসাহী ছিলেন এই পরিষদের ব্যাপারে। তিনি পরিষদের সভাপতিও হয়েছিলেন। এরপর রাজেন্দ্রলাল ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে যাওয়া হল পরামর্শ ও আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। রবীন্দ্রনাথও সঙ্গে ছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে সভার উদ্দেশ্য ও সভ্যদের নাম বলা হল। তিনি মন দিয়ে শুনলেন। এরপর অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বিদ্যাসাগর সেদিন পরামর্শ দিলেন,
‘আমাদের মতো লোককে পরিত্যাগ করো। ‘হোমরাচোমরা’দের লইয়া কোনো কাজ হইবে না, কাহারও সঙ্গে কাহারও মত মিলিবে না।’
এইসমস্ত বলে তিনি সভায় যোগ দিতে রাজি হলেন না। এই চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং দূরদর্শিতা দেখে যুবক রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন। কারণ সেই পরিষদ শেষ পর্যন্ত বেশিদিন টেঁকেনি। সারাজীবন এমন মুগ্ধ হয়ে তিনি বিদ্যাসাগরকে শ্রদ্ধা করেছেন। লিখেছেন, ‘এই অকৃতকীর্তি অকিঞ্চিৎকর বঙ্গসমাজের মধ্যে নিজের চরিত্রকে মনুষ্যত্বের আদর্শরূপে প্রস্ফুট করিয়া যে এক অসামান্য অনন্যতন্ত্রত্ব প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা বাংলার ইতিহাসে অতিশয় বিরল।’
এতটাই বিশ্বাস ছিল যে রবীন্দ্রনাথ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন,
‘আমাদের অপেক্ষা তাঁর একটা জীবন অধিক ছিল। তিনি কেবল দ্বিজ ছিলেন না, দ্বিগুণ-জীবিত ছিলেন।’
ঠাকুরবাড়ির প্রথম বিধবা বিবাহ তাই রবীন্দ্রনাথ নিজের সন্তানের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের প্রতি এ তাঁর এক ঐতিহাসিক নৈবেদ্য বলা যেতে পারে।
প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।