ছবি: ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি
পরিচালক: অরিত্র মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে: ঋতাভরী চক্রবর্তী, সোমা চক্রবর্তী, মানসী সিনহা, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, সাহেব চট্টোপাধ্যায়, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, সোহম মজুমদার
রেটিং:৪/৫
প্রতি বছর বচ্ছরকার এই দিনটায় এ প্রশ্নটা বুড়বুড়ি কাটে মনে। কবে মেয়েরা ভোগের ঊর্ধ্বে উঠে যোগে যোগ দেবে? কবে অভিনেতা, পরিচালক, যাত্রী, পুরোহিত, পাইলট, গাড়ির চালকের আগে ‘মহিলা’ শব্দটি আর বসবে না? সমস্ত সংস্কার ভেঙে মুক্ত জীবনের প্রতীক্ষার অবসান কবে হবে ‘শবরী’দের? আরও আছে। ঋতুস্রাব নিয়ে অকারণ ট্যাবু ভাঙার প্রতীক্ষা। ছেলের বদলে একটা মেয়ে হোক– এই কামনা নিয়ে মায়ের সন্তান কামনার প্রতীক্ষা। কনে যে পণের মতোই পণ্য নয়, সেই অনুভূতির প্রতীক্ষা। মাঝরাতেও কবে মেয়েরা নির্ভয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটবে, তার প্রতীক্ষা। এরকম বহু প্রতীক্ষা বছরভর নানা অনুষ্ঠানে, ঘরে-বাইরে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রতীক্ষার অবসান হয় কই?
রবিবার, নারী দিবসে এই সমস্ত প্রশ্ন উঠে এল আরও একবার। তবে তারও আগে, শুক্রবার সন্ধ্যায় এই প্রশ্ন তুললেন শবরী গঙ্গোপাধ্যায়। একুশে এসেও যাঁর পেশা পরিচয় ‘মহিলা পুরোহিত’। বাবার সাহচর্যে বেড়ে উঠতে উঠতে যিনি বাবার মৃত্যুর পর ভালোবেসে বেছে নিয়েছিলেন এই পেশা। সমাজের অনেক চোখরাঙানি সামলে, ঝড়-ঝাপটা পুইয়ে। শবরীর বাবা খুব ভালো শিক্ষা দিয়েছিলেন মেয়েকে। জল মেশানো দুধ থেকে পরমহংসের মতোই দুধটুকু শুষে নেওয়ার। বাবার পরামর্শ ছিল, বিয়ের পৌরোহিত্যে যেন কখনও কন্যাদানের মন্ত্র শবরী উচ্চারণ না করে। কারণ, গো-দান আর কন্যাদান সমাজে চালু থাকলেও এতে পরোক্ষে মেয়েদেরই অপমান করা হয়। মেয়েরা কি দান সামগ্রী! যে বাবার ঘর থেকে স্বামীর ঘরে সম্প্রদান করা হবে তাকে?
সে কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে কোনওদিন কোনও বিয়েতে কন্যাদানের মন্ত্র উচ্চারণ করেননি শবরী। নিজের বিয়েতেও কন্যাদান হয়নি তাঁর। গ্রাম্য পুরোহিত মশাইয়ের সঙ্গে তরজাতে নেমেও না! এবং এই জেদ তিনি বজায় রেখেছেন শেষ পর্যন্ত। পিসতুতো ননদের বিয়ে দেওয়ার সময়েও। একদম ঠিক পড়ছেন, যে শাশুড়ি মা শবরীর কন্যাদান হয়নি বলে কথা শুনিয়েছিলেন, যিনি নিজে মহিলা গ্রামপঞ্চায়েত প্রধান হয়েও মহিলা পুরোহিত এবং শবরীমালা মন্দিরে ঋতুমতীদের প্রবেশে ঘোর বিরোধী, তিনিই শেষপর্যন্ত ছাড়পত্র দিতে বাধ্য হয়েছেন বউমাকে। যদিও বিপাকে পড়ে। যাই হোক, ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও’ প্রবাদটি তো সার্থক হল! মেয়েরা আর শুধুই ভোগের জোগানদার নয়, যোগে যুক্ত হল।
এ ভাবেই গত দু’বছর ধরে উইন্ডোজ প্রোডাকশন তথা নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বছরের এই বিশেষ দিনটি উদযাপন করছেন বড় পর্দায়। ঠুলি পরা সমাজের চোখ থেকে ঠুলি খোলার মতো গল্প বলে। ছবিতে কন্যাদান প্রথা, মহিলা পুরোহিতের পাশাপাশি উঠে এসেছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ঋতুস্রাব। যার জন্য এখনও নারীরা অপবিত্র, অশুচি বলে চিহ্নিত। কোনও মেয়ে প্রথম ঋতুমতী হওয়ার পর এখনও প্রত্যন্ত গ্রামে তাকে গো-চোনা, গোবর খাওয়ানো হয় শুদ্ধ করতে। প্রতি মাসের ওই কটা দিন ঠাঁই হয় গোয়ালঘরে। হিন্দিতে এই ট্যাবু ভাঙতে ছবি হয়েছে প্যাডম্যান। বাংলায় তার অভাব ছিল। সেটাও পূরণ করে দিলেন দুই পরিচালক। শবরী এখানেও পরমহংস ঠাকুর রামকৃষ্ণের পথ মেনে জানিয়েছেন, তিনি মা সারদাকে ছাড়পত্র দিয়েছিলেন ওই অবস্থাতেও রান্না এবং পুজোর ভোগ রাঁধার। সেই পথ মেনে তিনি নিজেও মাসের ওই ক’টা দিন ক্যালেন্ডারে দাগ দেন ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে।
এ ভাবেই নরমে-গরমে, দৃঢ়তার সঙ্গে একসময় শ্বশুরবাড়ির গোঁড়ামি, অন্ধ সংস্কার ভাঙে শবরী। স্বামী, ভাসুর, শ্বশুরের সাহায্যে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, অচলায়তন আর কতদিন থাকবে! প্রশ্ন রাখে, আর কত ন্যাপকিন লাগবে সংস্কার, অশিক্ষার স্রাব শুষে নিতে? শবরী কিন্তু সংসার ভেঙে প্রতিবাদে বিশ্বাসী নয়। সংসারে থেকে আমূল বদলেছে সবাইকে। এটাই তো নারী জাগরণ। আধুনিক নারীর পরিচয়। যে শাঁখা-পলা-সিঁদুর-শাড়িতেও চূড়ান্ত আধুনিক। যে নিজের সিঁদুর স্বামীর কপালে পরিয়ে বলে, “তুমি-আমি সমান ভাবে ভালোবাসার দাগে দাগী!”
ছবির মুখ্য চরিত্র অর্থাৎ ঋতাভরী চক্রবর্তী একটুও অভিনয় করেননি। কারণ, তিনিও ভীষণ ভাবেই স্বাধীনচেতা, দৃঢ়চেতা। তাই তাঁর প্রতিটি সংলাপ যেন মনের গভীর থেকে উচ্চারিত। শবরীর স্বামী বিক্রমাদিত্য চক্রবর্তী ওরফে সোহম মজুমদার সেই স্বামীর প্রতিনিধি যাঁরা নেপথ্যে থেকে নীরবে এগিয়ে দেন স্ত্রীকে। শাশুড়ির ভূমিকায় সোমা চক্রবর্তী, পিসিশাশুড়ি মানসী সিংহ, ভাসুর অম্বরীশ ভট্টাচার্য– প্রত্যেকে এই ছবির পোক্ত খুঁটি।
তবে বাড়তি বাহবা অবশ্যই প্রাপ্য পরিচালক অরিত্র মুখোপাধ্যায় এবং সঙ্গীতকার অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের। একজন পুরুষ তাঁর প্রথম ছবিতেই কী সাবলীল ভাবে বললেন মেয়েদের যন্ত্রণার কথা। অনিন্দ্য তাতে দিলেন মনকাড়া সুর। এভাবে নারী-পুরুষ কাঁধ মিলিয়ে চললে তবেই তো প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে শবরীর। সব বয়সী নারীর জন্য অনর্গল হবে শবরীমালার দরজা।
একযুগ সাংবাদিকতায় কাটিয়েছেন। কলম তাঁর হাতিয়ার। বই তাঁর বন্ধু। তাই সাদা পাতায় কলমের আঁচড় কেটে মনের কথা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন মুখে না বলে। ভালো লাগে গান, আবৃত্তি-সহ সমস্ত শিল্পকলা। বোধহয় নিজে ষোলকলায় পূর্ণ নন বলেই...।