“খেয়েছি ছাতু, দেখেছি রাঁচি, থেকেছি বিহারে নিঃসন্দেশ মৎস্যহীন সুদীর্ঘ তিন বছর। পড়োশি ছিল পিঁজরাপোলের হাড় জিরজিরে ষাঁড়। জায়গাটি ছিল স্বাস্থ্যকর, দৃশ্যও ছিল মনোজ্ঞ, ভাষা ছিল রাষ্ট্রভাষা। পালিয়েছি, ফিরেছি কলকাতায়, পাঠানকোট-এক্সপ্রেসে; নেমেছি হাওড়ায়, ঠেলতে ঠেলতে খুঁজেছি পথ, দুর্গোপুজোর ভিড়ের গোলকধাঁধার মধ্যে, কুলিদের অবাঞ্ছিত সাহায্যে।”
এমন সাবলীল, রসে ভরপুর বাংলা অনায়াসে পাতার পর পাতা লিখে বাঙালির অন্দরমহলে অক্লেশে ঢুকে পড়েছিলেন যে বিদেশি, তিনি জন্মসূত্রে বেলজিয়ান এবং ভাষাসূত্রে ফরাসি এক জেসুইট ধর্মযাজক পল দ্যতিয়েন। সাহিত্যপ্রেমী বাঙালির কাছে ইনি একজন আদ্যোপান্ত বাঙালি যাঁর পরিচয় ‘ডায়েরির ছেঁড়াপাতা’, ‘রোজনামচা’ প্রমুখ গ্রন্থাবলি ও অসংখ্য প্রবন্ধের লেখক হিসেবে।
১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৭৮ — প্রায় ২৮ বছরের বাস তাঁর এই বঙ্গে। এসেছিলেন ধর্মপ্রচারক হিসেবে। বাংলা ভাষার প্রতি একনিষ্ঠ প্রেম তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। তিনি মানুষটি কতখানি সন্ন্যাসী আর কতখানি বাংলাভাষার একনিষ্ঠ পূজারী এক কৃতী সাহিত্যিক – দাঁড়িপাল্লায় তার হিসেব করা যথেষ্ট কঠিন। স্বদেশে ভারততত্ত্ব পড়াশুনো করার সময় তাঁর গুরু জোহানস্ তাঁকে পরিচয় করিয়েছিলেন সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে। সেই সময়ে জে ডি হ্যান্ডারসনের লেখা বাংলা ব্যাকরণ তাঁর হাতে এসে পড়ে আর সেই বইয়ের মধ্যেই পড়ে ফেলেন রোমান হরফে লেখা ‘মেজদিদি’, ‘নৌকাডুবি’, এমনকি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র উদ্ধৃতি।
কেরি সাহেবের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি কলকাতা থেকে চলে যান শ্রীরামপুরে। শুরু হয় বাংলা ভাষার চর্চা। পড়ে ফেলেন পরশুরামের ‘গড্ডলিকা’ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের ‘লিপিকা’, অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’, সতীনাথ ভাদুড়ির ‘জাগরী’ এবং আধুনিক সাহিত্যিকদের লেখা একাধিক বই। সাধারণ মানুষের কথা বুঝতে ও শিখতে চলে যান সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। মাঝে দু’বছর ছাত্র হিসেবে কাটান শান্তিনিকেতনে।
বাঙালি মানুষজনদের সঙ্গে পাতালেন নিবিড় বন্ধুতা। কুঁজো-কলসির তফাত যেমন শিখেছেন, তেমনি ঘটি-বাঙাল নিয়েও চর্চা করেছেন। বাঙালির স্বভাব, তার সংস্কৃতি, জীবনধারাকে আত্মস্থ করেছেন। বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় মাতৃভাষা জ্ঞানে পরম স্নেহে নিজের জীবনে গ্রহণ করেছেন, লালন করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে।
১৯৫৯ সাল। ফাদার দ্যতিয়েন তখন নিয়মিত লিখছেন ‘দেশ’ পত্রিকায়। তাঁর ‘ডায়েরির ছেঁড়াপাতা’ পড়ে বাঙালি পাঠক মুগ্ধ। সে সময়ে নিয়মিত ‘দেশ’ আসত আমাদের বাড়িতে। ভাইবোনদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত কে প্রথমে ফাদারের ডায়েরি পড়বে। সেই ছোট বয়সে অবাক লাগতো এই ভেবে যে কে এই বিদেশি, যিনি এমন চমৎকার বাংলা লেখেন। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো অনেক বিদগ্ধ পাঠক বিশ্বাস পর্যন্ত করতে পারেননি যে এ এক বিদেশির লেখা। ভেবেছিলেন ছদ্মনামে কোন নামী বাঙালি সাহিত্যিক লিখছেন। এই মর্মে পত্রিকার দপ্তরে নাকি অনেক চিঠিও এসেছিল সে সময়ে।
সত্যিই ফাদার দ্যতিয়েন বাঙালিকে আপন করেছিলেন। নিজেকে বাঙালি করতে যে সব কান্ডকারখানা তিনি করেছিলেন তা নিজেই কবুল করে লিখেছেন, “যে চা–কে দু’চোখে দেখতে পারতাম না, তা গ্যালন গ্যালন গলাধঃকরণ করেছি, চারটের সভায় ছ’টায় আসতে শিখেছি, খোলা মুখে স্বীকার করেছি যে রসগোল্লা শ্রেষ্ঠ মিষ্টি (আমার মতে একটু বেশি মিষ্টি) আর ইলিশকে বলেছি মৎস্যের সম্রাট (আমার মতে কিন্তু কাঁটা কম থাকলে চলত)।”
আর কী করেছেন? কলকাতার রাজপথের ধারে এক সাধারণ দোকানে বসে গোগ্রাসে খেয়েছেন রুটি আর শুয়োরের মাংস। তেলিপাড়া লেনে, পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে ‘ফাদার দাদা’ খেলেছেন ডাংগুলি।
এই ফাদারের সঙ্গে আমার চাক্ষুস পরিচয় ষাটের দশকের মাঝামাঝি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের কৃতী ছাত্র, বন্ধু অমলকান্তির মাধ্যমে। আমি নিজেও তখন কলেজের ছাত্রী। এখনও মনে পড়ে মধ্য চল্লিশের ফাদারের মাথা-ভর্তি তখন কোঁকড়ানো চুল। সন্ন্যাসীর সাদা জোব্বা পরে কলকাতার একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়ে সাহিত্য পড়তে চেয়েছিল বলে গৃহত্যাগ করতে হয়েছিল অমলকান্তিকে। বুদ্ধদেব বসুর অনুরোধে ফাদার তাকে আশ্রয় দিলেন ওঁর পক্ষপুটে। পুত্রতুল্য অমলকে তিনি ডাকতেন ‘কান্তি আমার’ বলে। নিজের লেখার ব্যাপারে অসম্ভব নির্ভরতা ছিল এই তরুণ কবিটির ওপরে। আক্ষরিক অর্থে অমল হয়ে উঠেছিল ফাদারের ‘মুনশি’। ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রতিটি লেখা প্রকাশের আগে অমলকে তা খুঁটিয়ে পড়ে অনুমোদন করতে হত। দীর্ঘ কুড়ি বছর, একনিষ্ঠ ভাবে অমল এই কাজ করে গেছে। আমৃত্যু ফাদার কৃতজ্ঞ থেকেছেন এই তরুণ মুনশির প্রতি। অমলের অকাল মৃত্যুর শোক তাঁর বড়ো বেজেছিল।
আমি তখন সবে কলেজের পাঠ শেষ করার মুখে। লেখাপড়ার পাশাপাশি দু’তিনটি ছোট পত্রিকায় লেখালিখি করছি। ইংরেজিতে এমএ না-পড়ে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ার ইচ্ছে। অমল আমাকে হাজির করল ফাদারের কাছে। সঙ্গে আমার দু’একটি রম্যরচনামূলক লেখার নমুনা। অমলের উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে মহৎ ছিল, কিন্তু আমার মন্দ কপাল। ফাদার আমার লেখা পড়েই এক হুঙ্কার ছাড়লেন। পাচন-গেলার মতো মুখ বিকৃত করে বললেন, “কিসস্যু হয়নি। অনেক ঘষামাজার প্রয়োজন।” ওঁর কথা শুনে বেশ রাগ হয়েছিল সেদিন। ফাদারের ঘর থেকে বেরিয়ে অমল আমাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল। বলল, ওঁর কথায় আমি যেন কিছু মনে না করি। আমার লেখা পড়ে ওঁর ভালো লেগেছে বলেই উনি লেখার সম্মার্জনের প্রস্তাব দিয়েছেন। উত্তরে মুখে কিছু না বললেও, মনে মনে বিলক্ষণ জানি আর আমি জীবনে সাহেবের মুখ দর্শন করছি না। এই ঘটনার পরে প্রায় সপ্তাহ দু’য়েক কেটে গেছে। মাঝে মাঝে অমল আমাকে ফাদারের কাছে যাওয়ার কথা স্মরণ করিয়েও দিয়েছে। আমি নানা অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে গেছি।
একদিন কলেজের পরে বাড়ি ফিরেছি। আমার বাবা ডাক্তার। বাড়ির সামনের ঘরে বাবার চেম্বার। রোগিদের ভিড় না থাকলে সেখানে বসে বাবা ও তাঁর বন্ধুদের জমজমাট আড্ডার আসর। কিন্তু সেদিন বাড়ি ফিরে আমার চমকে যাওয়ার পালা। বসার ঘরের দরজা হাট করে খোলা আর সেখানে মধ্যমণি হয়ে আসর আলো করে বসে আছেন ফাদার দ্যতিয়েন। চায়ের কাপে সশব্দে চুমুক দিতে দিতে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন! বাঙালির কাছ থেকে সশব্দে চা-পানের এই অভ্যেসটিও ততদিনে রপ্ত করেছেন। তাঁকে ঘিরে বসে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ফাদারের মুখনিসৃত বাণী শুনছেন আমার সদা কর্মব্যস্ত বাবা। সঙ্গে মা, দিদি। এ দৃশ্য দেখে আমি তো হতবাক। আমাকে দেখে হাত ধরে টেনে বসালেন। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই জানালেন কী ভাবে খুঁজেপেতে তিনি আমার বাড়িতে এসে হাজির হয়েছেন। এমন মানুষের ওপরে কী রাগ করে থাকা যায়? সেদিন থেকে ফাদার হয়ে উঠলেন বাড়ির লোক আর আমার একান্ত আপনজন।
যখন যে লেখাতে আটকে গেছি, আমার মুস্কিল-আসান ফাদার নানাবিধ সুপরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন। সেই অর্থে আজও যেটুকু লেখালেখি করার চেষ্টা করি, বলতে পারি তার প্রথম পাঠ নিয়েছি আমি আমার গুরু ফাদার দ্যতিয়েনের কাছ থেকে।
সাংবাদিকতা ক্লাসে ভর্তির তালিকায় প্রথম নামটি নিজের দেখে খুশিতে আমি ডগমগ। সুসংবাদ দিতে ছুটে গেলাম ফাদারের কাছে। কিন্তু সত্যিই এবারও কপাল মন্দ! অভিনন্দন দূরের কথা, তার পরিবর্তে যে ভাষণ দিলেন তা আমার মাথা গরম করার পক্ষে যথেষ্ট। আমিও ছেড়ে দেবার পাত্রী নই। কড়া কড়া সব উত্তর দিয়ে স্থান ত্যাগ করলাম। কিছুদিন বাদে দেখি ‘দেশ’ পত্রিকার ‘ডায়েরির ছেঁড়া পাতা’ কলমে সেদিনের ঘটনার সবিস্তার বিবরণী। শুধু আমার এই চালু নামের বদলে ব্যবহার করেছেন আমার ডাক নাম ‘গোপা’। লেখাটির শিরোনাম “পক্ষপাতের আলোকে।” এই লেখার অংশবিশেষ- ‘ গোপার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। হায় রে কপাল! মেয়েটি এসেছিল এই বুড়োর কাছে জার্নালিজম ক্লাসে ভর্তি হওয়ার শুভসংবাদ জানাতে; আর আমি কী জানি কোন দুর্বাসার অভিশাপে অভিশপ্ত হয়ে তাকে অভিনন্দন না জানিয়ে ঠাট্টা করে বলেছিলাম, “জার্নালিজম?…মেয়েরা কি তা পারে? ওতে যে নিরাসক্ত দৃষ্টিভঙ্গী চাই!” গোপা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিল, “তা হলে আপনি বলতে চান সত্যদৃষ্টিতে একা পুরুষদেরই মনোপলি?” কিংবা ওই ধরনের খোঁচা-দেওয়া আরও কিছু।’ এখানেই শেষ করেননি ফাদার। লিখেছেন, ‘গোপা গোঁসা করে চলে গেল। আমার মন্তব্য না শুনে সে কিন্তু মূল্যবান কিছু শেখার সুযোগ মিস করেছে।’
সত্যি সেদিন আমার অপরিণত বুদ্ধিতে ওঁর বক্তব্যের আসল সত্যতা বুঝতে পারিনি। তিনি আমাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, ‘……নিরাসক্ত দৃষ্টিভঙ্গী এবং সত্য দৃষ্টিভঙ্গী এক জিনিস নয়। সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য অবশ্য হিম ও নির্লিপ্ত তথ্যনিষ্ঠা। সবক্ষেত্রে কিন্তু সত্যে পৌঁছোবার পন্থা ওটা নয়। আমি বরং বলি অনেক ক্ষেত্রে আবেগের উত্তাপেই সত্যের আগুন জ্বলে।”
১৯৭৮ সালে সকলের অজ্ঞাতে কলকাতা ছেড়ে স্বভূমি ব্রাসেলসে প্রত্যাবর্তন করলেন। মনে হল আমাদের জীবন থেকে যেন একেবারে উবে গেলেন ফাদার। কোন অজ্ঞাত কারণে, কার প্রতি অভিমানে তাঁর প্রিয় শহর, প্রিয় মানুষজন ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে গিয়েছিলেন তা অজ্ঞাতই থেকে গেল চিরদিন। তাঁর এই হঠাৎ করে চলে যাওয়াতে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম আমি এবং আমার মত ওঁর অজস্র অনুরাগী বন্ধু।
শুনেছি এই দীর্ঘ সময় ফাদার বাংলা গান শোনেননি, বাংলা বই পড়েননি আর অবশ্যই লেখেননি এক ছত্র বাংলা। তাই ২০০৬ সালে কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদকের পক্ষ থেকে যখন ফোন গেল লেখার জন্য, তিনি ইতস্তত করেছিলেন রাজি হতে। কিন্তু পত্রিকার সম্পাদক, স্নেহভাজনদের একান্ত আবেদন এড়ানো গেল না। সেদিন, সারা প্রহর জুড়ে, ছন্দে ফিরে আসতে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলেন। ‘চলন্তিকা’ আর ‘গীতবিতান’ নিয়ে সারাদিন কাটালেন। তিন দশক বাদে নতুন করে শুরু হল বাংলা লেখা।
২০১০-এ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে খবরের কাগজের পাতায় পড়লাম রবীন্দ্র পুরস্কার নিতে ফাদারের কলকাতায় আসার কথা। মনের মধ্যের পুঞ্জীভূত অভিমান কোথায় ভেসে গেল এক নিমেষে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদকের কাছ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে চিঠি পাঠালাম। এতদিনের অদর্শন, আমাকে উনি চিনতে পারবেন কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিল। তাই আমার পুরো ইতিহাস দিয়ে চিঠি লিখেছিলাম। উত্তর পেলাম। ইংরেজিতে টাইপ করা চিঠি। সঙ্গে সাদাকালো তাঁর সাম্প্রতিক একটি ছবি। লিখেছেন,ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় এলে আমি যেন অবশ্যই রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডে, প্রভু যিশুর গির্জাতে গিয়ে দেখা করি।
অবশেষে দেখা হল। গির্জার উঠোন পেরিয়ে হাসিমুখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন আমার প্রিয় ফাদার। পায়ে ভারি চপ্পল। পরনে গেরুয়া পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা। চুলে বেশ পাক ধরেছে। পার্থক্য শুধু এটুকুই। প্রণাম করতেই সেই সস্নেহ আলিঙ্গন। চিনতে কি পেরেছেন আমাকে? বললেন ‘ স—ব ভুলে গেছি।’ ভাব দেখে বুঝলাম পূর্বের মনোমালিন্য সম্পর্কে আলোচনা ওঁর একেবারেই পছন্দের নয়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব খবর নিলেন আমার। এক বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছি শুনে দুঃখিত হলেন।
নির্দিষ্ট দিনে আমার দেওয়া ঠিকানা ও নির্দেশিকা মেনে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলেন আমার সপ্তপর্ণীর বাড়িতে। বলেছিলেন চিংড়িমাছ খাবেন। কিন্তু শেষ পাতে দই রসগোল্লা নয়। তাই সেদিন আমি রেঁধেছিলাম মুগের ডাল, ভেটকি মাছের ফ্রাই, আর ওঁর ফরমাশ মতো ফুলকপি দিয়ে চিংড়িমাছ। শেষপাতে নলেনগুড়ের এক মস্ত জলভরা সন্দেশ। কাঁটাচামচ সরিয়ে সেই আগেকার মতো হাত দিয়ে চেটেপুটে তৃপ্তি করে খেলেন। সেদিন আমি একটি সবুজ শাড়ি পরেছিলাম। তা দেখে খুশি হয়ে বললেন, ‘তুমি জানো আমি সবুজ রং পছন্দ করি আর তাই তুমি সবুজ শাড়ি পরেছ। তাই না আলপনা?’ আমি তো অবাক। ব্যাপারটা যে একেবারেই কাকতালীয় সে কথা ব্যাখ্যা করে বললাম । এ ব্যাখ্যাতে ফাদার যে খুব সন্তুষ্ট হলেন না, তা বুঝতে অসুবিধে হল না আমার। এই ছিলেন আমার সন্ন্যাসী ফাদার।
আমার সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখলেন। কাচের আলমারিতে রাখা গণেশের সংগ্রহ দেখে অজস্র প্রশ্নবাণে আমাকে জর্জরিত করলেন। কেন একটি গণেশের শুঁড় বাঁ দিকে, আর কেনই বা অন্যটির শুঁড় ডান দিকে, কেন গণেশ নৃত্যের ভঙ্গিমায়, কেন বা তিনি অনন্ত শয়ানে, এ রকম নানা প্রশ্ন। বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় মৃদু তিরষ্কৃত পর্যন্ত হলাম। কথা দিতে হল পরের বার যখন আসবেন, আমি যেন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি। মাঝে মাঝে লক্ষ্য করছিলাম, পকেট থেকে একটি ছোট ডায়েরি বের করে খস্খস্ করে কি যেন লিখছেন। পরে দেখি ওঁর সদ্য প্রকাশিত ‘আটপৌরে দিনপঞ্জী’ গ্রন্থে আমার নাম পালটে সেদিনের এসব ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
এর পরে যতবার কলকাতায় এসেছেন, আমার বাড়িতে আসা নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমি মনে করে প্রতিবারই সবুজ শাড়ি পরতাম আর আমার শিশু ভোলানাথ ফাদারের খুশি দেখে আমিও খুশি হতাম।

সবই ঠিক চলছিল। এর মধ্যে ২০১৫-তে কলকাতায় এলেন বাংলাদেশ হয়ে। ফোনে বললেন এবারে যেন ওঁকে আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসি। লজ্জা পেলাম কথা শুনে। সত্যি তো, এ ব্যাপারটা আমারই আগে খেয়াল হওয়া উচিত ছিল। নির্দিষ্ট দিনে ফাদারকে নিতে গেলাম। খবর পেয়ে নেমে এলেন। পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই মাথায় হাত রাখলেন আর হাতে তুলে দিলেন, ‘আমাদের জীবন’ পত্রিকা থেকে সংকলিত রচনাবলি ‘লালপেড়ে গল্পাবলী।’ অবাক হলাম আর আনন্দিতও হলাম এই অপ্রত্যাশিত উপহার লাভে। এ পর্যন্ত ফাদারের সব বই আমি কিনে রেখে দিতাম। ফাদার এলে বইতে ওঁর স্বাক্ষর আদায় করে নিতাম শুধু। এই প্রথম ফাদার আমাকে তাঁর লেখা বই উপহার দিলেন। আপ্লুত হলাম যখন দেখলাম বইয়ের পাতায় লেখা আছে , ‘আমার “বান্ধবী” আলপনাকে প্রীতি ও ভালোবাসা সহ – ফাদার দ্যতিয়েন ১৬.২.১৫।’
বাড়িতে পৌঁছে প্রচুর আড্ডা হল। মনে হল আমার চিরনবীন ফাদার যেন একটু ন্যুব্জ, একটু দুর্বল। চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে দু’বার দেখলাম কেমন যেন টলে গেলেন। এনিয়ে কিছু বলার স্পর্ধা ছিল না আমার, তাই নীরবই থেকে গেলাম। এবারে ফরমাশ ছিল লুচি আর মাংসের ঝো—-ল। ওঁর পছন্দের ফুলকপি দিয়ে চিংড়ি মাছের কথা মনে করাতে এক গাল হেসে বললেন ‘ওটাও রেখো।’
সদ্য প্রকাশিত আমার বই ‘মছলিশ’ ফাদারের হাতে দিয়ে আমি রান্নাঘরে ঢুকলাম, লুচি ভাজতে। বই হাতে পেয়ে শিশুর মতো খুশি হলেন ফাদার। বললেন, দেশে গিয়ে পড়বেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমি তো বিলক্ষণ চিনি ওঁকে! লেখা পছন্দ না হলে, সেই রূঢ় সত্যটি মুখের ওপরে বলে দিতে ওঁর যে একটুও সময় লাগবে না, তা আমার থেকে ভালো আর কে জানে! দেশে ফেরত গিয়ে, ‘মছলিশ’ পড়ে আমাকে চিঠি দিলেন ফাদার। লিখলেন, তিনি মছলিশ পড়েছেন সানন্দে ও আগ্রহের সঙ্গে।
এর কিছুদিনের মধ্যে ওঁর চিঠিতেই জানতে পারলাম, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। ই-মেলের মাধ্যমে চিঠি পত্র কিন্তু চলতে থাকল। কোনও অনুযোগ, কোনও শঙ্কা, রোগ-যন্ত্রনা ভোগের বিন্দুমাত্র আভাস নেই সেসব চিঠিতে। শুধু কৃতজ্ঞতা স্বীকার আর এ জীবন ছেড়ে চলে যাবার জন্য তাঁর ঈশ্বরের কাছে তাঁর নিশিভোর আকুতি।
ওই বছরের মাঝামাঝি ভ্রাতৃপ্রতিম ফিলিপ বেনোয়ার আমন্ত্রনে একমাস প্যারিসবাসের সু্যোগ এল। ফিলিপের সহায়তায় ব্রাসেলস-এ সন্ন্যাসীদের আশ্রমে দেখা হল ফাদারের সঙ্গে। খুশি হলেন। ‘আটপৌরে দিনপঞ্জী’ থেকে অংশবিশেষ পাঠ করে শোনালেন। নতুন বাংলা বই কী কী বেরিয়েছে জানতে চাইলেন। সবই যেন আগের মতো চলছে এমন একটা ভাব। কিন্তু তাই কী? একবারও সেদিন খোলা গলায় ওঁর সেই অতি পরিচিত উদাত্ত হাসি শুনতে পেলাম না। একটু কৃশ, চোখেমুখে একটা ক্লান্তি, অবসাদের ছাপ।
সেদিনও আমার কোন আপত্তি শুনলেন না। আমাদের বিদায় দিতে লিফটে করে নিচে নেমে এলেন। আমি এবং ফাদার দুজনেই তখন জানি এই আমাদের শেষ দেখা। আমার চোখে জল দেখে সন্ন্যাসীর চোখও যেন সজল হল। প্রণাম করলাম। আমার দু’টি হাত সজোরে চেপে ধরে ছেড়ে দিলেন। সেই অতি পরিচিত ভঙ্গিতে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন। একবারের জন্যও আর পিছন ফিরে তাকালেন না।
[ ফাদার দ্যতিয়েন ১৯২৪- ২০১৬]
পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি বই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।