ছোটবেলা থেকেই জানতুম আমি কিচ্ছু পারি না। দেখতে খারাপ। রুগ্ণ। নাকের ডগায় ইয়াব্বড় চশমার আড়ালে চোখদুটো ঢাকা পড়ে থাকে। পড়াশুনো করিনে ভাল করে। ফার্স্ট সেকেন্ড হতে পারিনে। দৌড়ে গিয়ে গোল্লাছুটের বুড়ি ছুঁতে পারিনে। নাটক করতে পারিনে। গানটা পারি, কিন্তু স্টেজে উঠলেই হাত পা এলিয়ে পড়ে যাবার দাখিল। শুধু একলা ঘরে বসে বই পড়তে পারি ভারি তাড়াতাড়ি। সেখানেই, হেমন্তের এক মনখারাপের বিকেলে, তাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ। মায়ারাজ্যের বুড়োবুড়ি হাতে পেয়েছে সোনা হলুদ রঙের এক ডিম, তার গায়ে সবুজ আর সাদা রঙের আলপনা। বুড়োবুড়ির কানা নাতি ডিমের ছোঁয়ায় হল চক্ষুষ্মান। আর শেষমেশ ডিম ফুটে বেরুলেন ডিম্ববতী। টুকটুকে পুতুলের মতো মেয়ে। দুই ভাইবোন মিলে মনমরা একলা মেয়ের সব আশ মিটিয়ে দিলে। দুষ্টু লোকেদের বেশি সাজা হল না। সবাই ভারি আনন্দে থাকতে লাগল। মেয়ের বরাবরের অভ্যেস, গপ্পো শেষ করে ভালো লাগলে তবে তার নাম দেখা। পাতা উলটে দেখলুম গপ্পের নাম ডিম্ববতী। কে লিখেছেন? উহহ কী বড় নাম। ন-ব-নী-তা-দে-ব-সে-ন। ভুলে গেলুম বেমালুম। 

বেশ কদিন পরে আরেক একলাটির গল্প হাতে এল। তাতাই। তাতাইয়ের জ্বর হয়েছে। তাকে কেউ কিচ্ছু খেতে দিচ্ছে না। শুয়ে শুয়ে তার কেবলই ডালমুট, ফুচকা আর তেঁতুলমাখা খেতে ইচ্ছে করছে। ইশকুল যাওয়া বন্ধ। বাবুই অবশ্য ইশকুল যায় না। তার বাবা ঝাড়ুদার। তাই তাতাইকে সে গল্প শোনায়। বাবুই আমার বন্ধু হল। তাতাই হলুম আমি। এবারে লেখকের নামটা দেখে মনে হল, শোনা শোনা। 

তারপর কবে যেন সূচিপত্র দেখতে শিখলুম। সেই বড়োওওওও নামটা চেনা হয়ে গেল। আমি তো ওঁকে চোখে দেখিনি। কে যেন বলেছিল আমার মাকে নাকি ওঁর মতো দেখতে। তাই মনে মনে ওঁর ডাকনাম দিলুম নবনীতামাসি। কাউকে বলা বারণ! এসব ডায়রিতেও লেখা চলে না। শুধু নবনীতামাসি আমাকে মাঝে মাঝেই গপ্পো শোনান। পদিপিসির বর্মিবাক্স, হলদে পাখির পালক, টুনটুনির বই, হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রি, সুজন হরবোলা, লালকমল নীলকমল পড়ার মাঝেই আচমকা হাতে এসে যেত রুবাইয়ের বনপাহাড়ি কিম্বা টুলটুল আর ফুলফুলের গল্প, যাদের কুকুরের নাম কিনা কৃষ্ণচন্দ্র আর বেড়ালের নাম কমলিকা! একনিঃশ্বাসে গপ্পো শেষ করে ফিশফিশিয়ে আবদার করতুম, “নবনীতামাসি আরেকটা প্লিজ।“ কিন্তু কেউ শুনতে পেত না। 

আমাদের বাড়িতে বড়দের বই, ছোটদের বই বলে কোনও ভাগ ছিল না কোনওদিন। তাই বুঝতে না-পারলেও বড়দের বই পড়ে ফেলায় কেউ বিশেষ বাধা দিত না। পাত্তাও দিত না। ক্লাস সিক্সে পড়বার সময় একবার কাগজে একটা ভারি শক্ত লেখা পড়ে ফেললুম। স্রেফ নবনীতামাসি লিখেছেন বলে। লেখার নাম, ’আমার কোনও তাড়া নেই।‘ প্রায় কিছুই বুঝলুম না যথারীতি। শুধু দুটো লাইন মাথার মধ্যে ঢুকে গেল কী করে যেন। আজও না দেখে লিখে দিতে পারি – 

“আমাকে কেমন দেখছ মা? মন্দ না থাকার নামই কি ভালো থাকা?” 

ক্রমে বয়স বাড়তে লাগল। মন ডানা মেলতে থাকল। অনুভব আকার নিতে লাগল। কেবল নবনীতামাসি আমার হাতটা আর ছাড়লেন না। আমার একান্ত গোপন সব মন্দ থাকা, ঘুসঘুসে মনখারাপ, অব্যক্ত প্রেম, না-পাওয়ার অতৃপ্তি, বিচ্ছেদের কালিমা যত ঘনীভূত হতে থাকল, আমার ঘরদোর ভেঙে ঢুকে পড়তে থাকল এক শহুরে চির-কিশোরীর বেড়ে ওঠার গল্প, যে আসলে কখনও বেড়ে ওঠে না, যার বয়স পঞ্চাশ হতেই পারে না কভু। 

১৯৯৮ সালে নোবেল পেলেন অমর্ত্য সেন। পত্রপত্রিকায় একের পর এক প্রকাশিত হতে লাগল নবনীতামাসির লেখা। অচেনা ষোড়শী বালিকার মনে মনে খুব কষ্ট হত। মনে হত, কেন এরা ওঁকে এত বিরক্ত করে? হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়ে এ কী রকম পাতা ভরানোর খেলা? লেখাগুলো গোগ্রাসে গিলতে গিলতে খুঁজতুম, কোথায় আছে সেই বুক মোচড়ানো কষ্টের বিন্দুটি? ভালোবেসেও ছেড়ে আসতে বাধ্য হওয়া প্রাণের মানুষটির অভাবিত সাফল্যে ‘প্রাক্তন’-এর ভূমিকায় সসম্মানে অধিষ্ঠিত থেকে এ ভাবে নিজের প্রেমের আখ্যান শোনানো তামাম দুনিয়াকে… এ কি কোনও মানবীর পক্ষে সম্ভব? কৈশোরের স্বাভাবিক কৌতূহলে প্রাণপনে খুঁজতুম সেই গোপনতম ক্ষরণবিন্দুটিকে, যা হয়তো আমাকে আশ্বস্ত করতে পারত তখনকার মতো! বলত, আসলে ওঁর খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু খুঁজে পাইনি। নবনীতামাসি আমাকে শিখিয়ে ছাড়লেন, “ভালোবাসা কারে কয়।“ পরম রমণীয়, কৌতুকোজ্জ্বল, হাস্যরসে টইটুম্বুর সেসব লেখা পড়তে পড়তে আমার কেবলই ছুটে যেতে ইচ্ছে করত ওঁর কাছে। কোলে মাথা রেখে শুধোতে ইচ্ছে করত, কেমন করে লিখছ? কেমন করে হাসছ? আমাকে বলো। 

তার আর সুযোগ হয়নি। অনেক বছর পরে একটি পত্রিকায় পড়েছিলুম তাঁর বিচ্ছেদপর্বের অন্ধকারের একটুখানি বিবরণ। দুই শিশুসন্তান এবং একটি গুঁড়ো হয়ে যাওয়া হৃদয় নিয়ে বিভুঁইয়ের মাটিতে তাঁর ভেসে থাকার লড়াইয়ের আখ্যান। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কাছে হঠাৎ অকপট হয়ে যাওয়া আর তাঁর কথা থেকেই শুষে নেওয়া ফের উঠে দাঁড়ানোর জোর, রবি ঠাকুরের গান সম্বল করে। তাঁর একটিমাত্র লেখায় পড়েছিলাম সেই থেমে যেতে যেতে একবার কোনওমতে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ছুট দেবার কথা। ততদিনে ষোড়শী অষ্টাদশী হয়েছে। জেনে গেছে তার বংশগতিতে প্রবাহিত ‘ডিপ্রেশন’ নামক আঁধারকণার উপস্থিতি। শুরু হয়েছে কড়া কড়া ওষুধের পালা। তখন থেকেই নবনীতামাসির অদৃশ্য হাতটি ধরে সাবধানে পা ফেলে ফেলে সে পেরোতে শুরু করে তার মানসলোকের কালো পথের বাঁকগুলি। সে শিখে নেয় দীঘল একবুক শ্বাস টেনে নিয়ে সহাস্যে রম্যবীণা বাজানোর গোপন কৌশল। সে হাসতে শুরু করে। সে উদ্দীপনার প্রতিমূর্তি হয়ে উঠতে থাকে। তাকে সবাই জেনে নেয় হাসিখুশি রৌদ্রোজ্জ্বল উচ্চকিত এক মানবী বলে। শুধু নবনীতামাসি তাকে চেনেন। তাই হঠাৎ একদিন তাঁর লেখায় সে নিজের কথা দেখতে পেয়ে চমকে ওঠে – “জানি লোকে বললে বিশ্বাস করবে না, কিন্তু সত্যি সত্যিই আমার দু’চোখ দু’রকমের। ডান চোখটা সর্বদা মিটিমিটি হাসে… আর বাঁ চোখটা একদম হাসে না। আমি হেসে কুটিপাটি হলেও বাঁ চোখ আপনমনে দুঃখী হয়ে থাকে।“ 

কুড়িতে পড়ে সে। লিখতে থাকে। পড়তে থাকে। নবনীতামাসির সঙ্গে এক নীরব অদৃশ্য সহাবস্থান হয়ে যায় তার। কুম্ভজয়ের অবিশ্বাস্য অকল্পনীয় আখ্যান পড়ে নিদ্রাহীন রাত কাটাতে কাটাতেই কখন যেন তাঁর সঙ্গে চারধাম ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। কালের হিসেব করতে পারে না সে। যেখানে যা পায় ছাপার অক্ষরে, রস নিংড়ে নিয়ে ছিবড়েটুকুও জল দিয়ে গিলে নেয়। জীবন এগিয়ে চলে। আর লকগেট খুলে গিয়ে গলগল করে শিরাকাটা রক্তস্রোতের মতো তার অস্থিমজ্জায় প্রবেশ করতে থাকে অনুপম, বিপাশা, ইয়োহান, বৃন্দা, ঝিল্লি, তিতলি, অংশুমালারা। নবনীতামাসির অঘটনের যষ্টি বেয়ে সে চোখ বুজে পৌঁছে যেতে থাকে জেরুজালেম থেকে মাচুপিচু, জোহানেসবার্গ থেকে ভাইমার, নিউ ইয়র্ক থেকে সঁজে লিজেঁ। 

পত্রিকার নিয়মিত কলাম পড়ে সে কখনও সখনও জানতে পারে নবনীতামাসির হাঁপের টান তাঁকে শয্যাশায়ী করে রেখেছে। আপিস যাতায়াতের পথে “ভালোবাসা” বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সে। মাসি ঘুমোচ্ছ? জ্বর আসেনি তো? সেরে ওঠো জলদি। মুখ তুলে তাকিয়ে থাকে বারান্দার দিকে। ওটাই তো “ভালোবাসার বারান্দা।” ও শিবুদা, কানাইদা, রঞ্জুমামা, শ্রাবস্তীদি, একবার ডেকে দেবে? না। ‘এমন করে বাইরে থেকে ডাকব না! পারি যদি, অন্তরে তার ডাক পাঠাব আনব ডেকে!’ সে ডাক আর পৌঁছল না। ডাক হরকরা চিঠি নিয়ে মাঝপথেই দাঁড়িয়ে রইল। অমল সে চিঠি পেল না। আমার যে ফুলের সাজি নেই নবনীতামাসি। নয়তো এক সাজি ফুল আজ তোমার বারান্দার নিচে রেখে আসতুম। চিরকুটে লিখতুম, সুধা তোমাকে ভোলেনি। সুধা তোমাকে ভুলবে না। 

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *