প্রায় প্রতি পরিবারেই একজন না একজন থাকেন, যিনি দিনের মধ্যে হাজারবার তাঁচাবির গোছা, মোবাইল ফোন এমনকি নাকের ওপরে লাগানো অবস্থাতেও নিজের চশমাটি খুঁজে খুঁজে হয়রান হন। তিনি আপনার স্ত্রী হতে পারেন, হতে পারেন আপনার বাবা/ স্বামী কিংবা মা, বা কোনও বয়স্ক আপনজন পরিবারের অন্য মানুষজন তাঁর ভুলভ্রান্তি নিয়ে নির্মল হাসিঠাট্টা করেন! ভুলভ্রান্তির মাত্রা একটু বৃদ্ধি পেলে, গল্পচ্ছলে গৃহচিকিৎসককে বলতে গেলে, অনেক ক্ষেত্রে সেই চিকিৎসকও একে ‘বার্ধক্যজনিত  সমস্যা’ বলে উড়িয়ে দেন।
তারপর কোনও এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে রোজকার অভ্যেসমতো প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে সে মানুষটি আর ফিরে আসেন না।
সকলের অগোচরে অজান্তে আপনার প্রিয় মানুষটি কবে যেন তাঁর অতি পরিচিত বাড়ি ফেরার পথটি ভুলে গেছেন।
ভুলে গেছেন নিজের নাম, বাড়ির ঠিকানা।
তিনি ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত, একথা বুঝতে শুধুমাত্র পরিবার পরিজনেরই নয়, চিকিৎসকদেরও অনেক সময় বড় দেরি হয়ে যায়।

ডিমেনশিয়া নামক এই অসুখটিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘মহামারী’র তকমা দিয়েছে। সারা বিশ্বে এখন পাঁচ কোটি মানুষ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। সংখ্যা আরও বাড়ার মুখে। ভারতবর্ষেও এই রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বিপজ্জনক ভাবে বাড়ছে। সময় এসেছে এই রোগ সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় সচেতনতা বৃদ্ধির।

তারপর কোনও এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে রোজকার অভ্যেসমতো প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে সে মানুষটি আর ফিরে আসেন না। সকলের অগোচরে অজান্তে আপনার প্রিয় মানুষটি কবে যেন তাঁর অতি পরিচিত বাড়ি ফেরার পথটি ভুলে গেছেন।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে আমার প্রয়াত স্বামী সাংবাদিক শংকর ঘোষের এক অগ্রজপ্রতিম সহকর্মীর কথা। রাজনৈতিক কলাম-লেখক হিসেবে তাঁর দেশজোড়া খ্যাতি। একদিন এক শীতের রাতে একবস্ত্রে নিজের দিল্লির বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন – আর ফিরে আসেননি। সরকারি সাহায্য নিয়ে তাঁর পরিজনেরাও অনেক চেষ্টা করেছিলেন খোঁজার। কিন্তু লাভ হয়নি। পরে জেনেছিলাম, তিনি ডিমেনশিয়ায় ভুগছিলেন। এ খবরে আমরা দু’জনেই খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন ভাবতেও পারিনি এ রোগ একদিন আমার দরজায়ও এসে হানা দেবে।

***

২০০৭-এর জুলাই মাসের এক দিন।
যে বাংলা সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে আমার স্বামী তাঁর দীর্ঘ সাংবাদিক জীবন থেকে অবসর নিয়েছিলেন, সেদিন সকাল থেকে তিনি ব্যস্ত ছিলেন ওই পত্রিকার রবিবারের সাপ্তাহিক কলাম লেখার কাজে। আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষটি সারাদিনই মগ্ন ছিলেন লেখা নিয়ে। ওঁর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করিনি সেদিন। লেখা শেষ হল। পরের দিন অফিসের পিয়ন এসে নিয়মমতো লেখা নিয়ে গেল। বাইরে থেকে মনে হচ্ছিল সব কিছু ঠিক আছে। 

Alpana Ghosh
শংকরের সঙ্গে সুখের দিনে। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

শংকর ইংরেজি লিখতেন একটি জার্মান টাইপরাইটারে। পৃথিবীর যেখানে যখন কর্মসূত্রে গেছেন, এই ছোট্ট মেশিনটি ছিল তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। বাংলা লিখতেন শেফার্স কলম ও সুলেখা রয়্যাল ব্লু কালি দিয়ে। সন্ধ্যের সময় প্রেস থেকে একটি ফোন এল। ওরা জানাল, প্রুফ দেখতে সমস্যা হচ্ছে। প্রথম দু’পাতায় লেখা ঠিক থাকলেও পরের পাতাগুলিতে লাইনগুলি এমনভাবে মিলেমিশে গেছে যে পাঠোদ্ধার করা মুশকিল হচ্ছে।
শুনে তো আমি অবাক!
শংকরকে সমস্যার কথা বলতে ফোন ধরে লেখার যেখানে যা গরমিল ছিল সব ঠিক করে দিলেন।
পরে আমাকে বললেন,তাঁর নাকি সেদিন চোখে দেখতে সমস্যা হচ্ছিল।
চিরকালই মিতভাষী।
তাই নিজের সামান্য শারীরিক সমস্যা নিয়ে অপরকে ব্যস্ত করতে অনিচ্ছুক মানুষটি সে কথা আমাকে জানাবার প্রয়োজন মনে করেননি।রবি
বার তাঁর কলাম নিয়মমতো প্রকাশিত হয়ে গেল। যে মননশীলতা, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ শংকর ঘোষের কলমের বৈশিষ্ট্য ছিল- সে সব গুণমানের কোনও বিচ্যুতি কিন্তু ঘটেনি সেই লেখাতেও। কোনওভাবেই আমরা কেউ কল্পনা করতে পারিনি, এইটিই ওঁর শেষ লেখা।

দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস ছিল শংকরের নিত্যসঙ্গী!
এই রোগের হাত ধরেই চোখের সমস্যা এসেছিল।
সে কথা মাথায় রেখে উনি যে প্রবীণ চক্ষু বিশেষজ্ঞের চিকিৎসাধীন ছিলেন, তাঁর কাছে নিয়ে গেলাম।
অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে তিনি জানালেন, সমস্যাটা চোখের নয়।
অবিলম্বে ব্রেন স্ক্যানের প্রয়োজন। স্ক্যানের রিপোর্ট নিয়ে স্নায়ু চিকিৎসকদের দরজায় দরজায় ঘুরলাম।
নানা মুনির নানা মত।
অবশেষে এক তরুণ স্নায়ুচিকিৎসক বাড়ি এসে শংকরকে নানাভাবে পরীক্ষা করলেন। স্ক্যানের রিপোর্টও দেখলেন

জানা গেল, অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তির অধিকারী শংকর ঘোষ ‘ভ্যাস্কুলার ডিমেনশিয়া’ রোগে আক্রান্ত।

Alpana Ghosh
পরিচর্যা করতাম, পাশে থাকতাম, সে বড় সুখের স্মৃতি। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ

অনেক পরে বুঝেছিলাম, বেশ কিছুদিন আগেই রোগের সূত্রপাত ঘটেছিল। শুধু আমরা বুঝতে পারিনি।
লেখাপড়ার কাজ স্বাভাবিক ভাবে চালিয়ে গেলেও, ক্রমশঃ তিনি যেন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন।
আমাদের একমাত্র পুত্র বাড়িতে এলে খুব খুশি হতেন। তার সঙ্গে কথা বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারতেন। সাহিত্য, রাজনীতি, ক্রিকেট, ফুটবল, সিনেমা – প্রায় কোনও বিষয়ই বাদ যেত না আলোচনা থেকে।
কিন্তু বিগত কিছুদিন ধরে শংকরের উৎসাহ যেন কমে আসছিল।
মিনিট পাঁচেক ছেলের সঙ্গে কথা বলার পরেই বলতেন, ‘তুমি মা’র সঙ্গে কথা বল।’
টেলিভিশনে খেলা দেখা ওঁর নেশা ছিল। অথচ সেই মানুষ টিভি প্রায় খুলতেনই না

ধীরে ধীরে চোখের সামনে আমার প্রিয় মানুষটি পালটে যাচ্ছিলেন আর আমি ওঁর এই পরিবর্তনের কারণ বয়সোচিত মনে করে নিশ্চিন্ত ছিলাম।
চোখের অস্ত্রোপচার
, কানের যন্ত্র কোনওটাই ওঁকে সাহায্য করছিল না।

রবিবার তাঁর কলাম নিয়মমতো প্রকাশিত হয়ে গেল। যে মননশীলতা, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ শংকর ঘোষের কলমের বৈশিষ্ট্য ছিল- সে সব গুণমানের কোনও বিচ্যুতি কিন্তু ঘটেনি সেই লেখাতেও। কোনওভাবেই আমরা কেউ কল্পনা করতে পারিনি, এইটিই ওঁর শেষ লেখা।

অসুখ ধরা পড়ার পর থেকেই শংকরের মানসিক ও শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে লাগল। ডাক্তারের পরামর্শ মতো ফিজিওথেরাপি শুরু হল। প্রাত্যহিক কাজকর্মেও ওঁর সাহায্যের প্রয়োজন হতে লাগল। লেখালিখি, বই ও খবরের কাগজ পড়া বন্ধ হয়ে গেল। সকালবেলায় একাধিক কাগজ খুঁটিয়ে পড়ার অভ্যেস ছিল বহুদিনের। সে সব কোথায় মিলিয়ে গেল। সারাদিন বইয়ের মাঝখানে থেকেও বই ছুঁতেন না। কথা বলাও বন্ধ করে দিলেন। ঘুমিয়ে পড়ার আগে নিয়ম করে ‘গুড নাইট’ বলতাম! উত্তরে ওঁর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠত মাত্র। কোনও কোনও দিন জেদ চেপে যেত আমার। ওঁর মুখে একবার শুধু ‘গুড নাইট’ সম্ভাষণ শোনার জন্য বারবার এক কথা বলে যেতাম। প্রত্যুত্তরে যেদিন খুব আস্তে আকাঙ্খিত শব্দটি উচ্চারণ করতেন, সেদিন তা হত আমার পরম প্রাপ্তি।   

এ ভাবেই চলছিল দিনগুলি আমাদের। এরই মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানির মত এক এক দিন স্বাভাবিকতা শংকরকে ছুঁয়ে যেত।
এরকমই একদিনের কথা
আমাদের পুত্র, আনন্দরূপ সেদিন ওঁকে ওষুধ খাওয়াবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পারছিল না।
কিছুতেই মুখ খুলছিলেন না। হঠাৎ বিছানা থেকে উঠে বসলেন।
পুত্রের চোখে চোখ রেখে স্পষ্টভাবে বলে উঠলেন, “আমাকে এভাবে বাঁচিয়ে রাখছিস কেন? আমার একেবারে ভাল লাগছে না।”
আনন্দ নিরুত্তর
রইল 

***

শংকরের মূল পরিচিতি ছিল সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে। কিন্তু অনেকেই জানেন না তাঁর কবিতাপ্রেমের কথা। তাঁর ভেতরে কোথাও একটি কবিসত্ত্বা লুকিয়ে ছিল। কবি বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় একবার তাঁর একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। শংকরের বইয়ের তাকে বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সমর সেন থেকে শুরু করে শক্তি চট্টোপাধ্য়ায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্য়ায় প্রমুখের লেখা কবিতার বই স্থান পেয়েছে চিরদিন। অবসরে দেখেছি ওঁকে কবিতা পড়তে। দারুণ আবৃত্তিও করতেন। সুভাষ মখোপাধ্যায়, সমর সেন এবং জীবনানন্দ ওঁর অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। কতবার ওঁর মুখে সুভাষের ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’ বা জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ শুনে মুগ্ধ হয়েছি, বলতে পারি না।

২০০৮ সালে অসুস্থতার মাঝামাঝি সময়ে প্রায় বাক্‌হীন শংকর ঘোষকে ওঁর প্রিয় কবিতা পড়ে শোনাতাম। এরকমই এক সন্ধ্যায় ‘বনলতা সেন’ পাঠ করতে করতে “……গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল” পং‌ক্তিতে এসে একটু থেমে গেছি। দুর্বল শরীর, কণ্ঠস্বর ক্ষীণ। তবু ঠিক তার পর থেকে বলতে শুরু করলেন, “সব পাখি ফিরে আসে, সব নদী……/ ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন,/ থাকে শুধু অন্ধকার,/ মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”
আমি হতবাক!
ততদিনে ডিমেনশিয়া ওঁর স্মৃতির ওপর পর্দা টেনে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও ঠিক ওই মুহূর্তে কী করে তাঁর স্মরণে ওই ছত্র দু’টি এল জানি না।
সেদিন ওঁর সেই স্মিত, পরিতৃপ্ত মুখের ভাব দেখে আমার চোখের জল বাঁধ মানেনি।

২০০৭ থেকে ২০০৯, কত যে ঝড়-ঝাপটা আমাদের জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে, তার হিসেব নেই।
এর মধ্যে আমি নিজে গুরুতর অসুস্থ হয়ে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হলাম।
শংকরকে বললাম দু’একদিনের মধ্যেই ফিরে আসব।
গাড়িতে ওঠার মুখে ওপর দিকে তাকিয়ে দেখি সেবিকার হাত ধরে ম্লান মুখে শংকর দাঁড়িয়ে আছেন জানলার কাছে।
আনন্দর জিম্মায় রেখে নিরূপায় আমি রওনা দিলাম
হাসপাতালের পথে
শুনেছি অস্ত্রোপচারের সময় যখন আমাকে নিয়ে প্রায় যমে-মানুষে টানাটানি চলছে, তখন নাকি বাড়ি থেকে বারবার আনন্দর কাছে সেবিকার ফোন আসছিল, যে শংকরের অবস্থা একেবারেই ভালো নেই। সকাল থেকে অস্থির হয়েছেন।
বারবার আমার নাম ধরে ডেকেছেন। চোখের জল ফেলেছেন।
সেই সময়টাতে আমাদের গৃহচিকিৎসক এসে
অবস্থা অনেকটা সামাল দিয়েছিলেন। 

একমাস পরে যখন ফিরে এলাম, তখন শংকর আমাকে চিনতে পারলেন না।

শুরু হল আমার আর এক লড়াই।
দিনের বেশির ভাগ সময় ওঁকে সঙ্গ দিতাম নানা ভাবে।
কখনও বই পড়ে, কখনও গান শুনিয়ে আবার কখনওবা পুরনো দিনের কথা বলে চেষ্টা করতাম মুখে হাসি ফোটাতে।
কিন্তু কোনও ভাবেই ওঁর চোখে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
শুধু আনন্দ এসে বাবার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ‘বাবা’ বলে ডাক দিলে মুখে হাসি ফুটত।
কোনও কোনও দিন ছেলের দিকে হাত বাড়িয়ে
ওর হাতটি ধরতেন।

Alpana Ghosh
এআরডিএসআই-এর ডে-কেয়ার সেন্টারের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

একদিন আমি শংকরকে আমাদের বিয়ের আগের দিনগুলির কথা বলতে থাকলাম।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার সেই দিনগুলিতে শংকর রবিবারেও অফিস করতেন।
ওই দিনই একটু কাজ হালকা থাকত। শংকর কাজ-পাগল মানুষ।
রবিবার দেখা করার কথা বললে, কাজের অজুহাত দিতেন।
ওঁকে রাজি করানো মোটেই সহজ ব্যাপার ছিল না আমার পক্ষে।
তখন আমিও নিয়মিত সাংবাদিকতার কাজে যুক্ত শিক্ষানবিশ হিসেবে। সপ্তাহের দিনগুলিতে এখানে ওখানে দেখা হলেও কথা তো হত না। মাসে দু’একটা রোববার দেখা হত।
কোনওদিন আমরা গড়ের মাঠে বসে মাটির ভাঁড়ে চা খেতাম।
আবার কোনও কোনও দিন ওঁর অফিসের রাস্তা ধরেই হেঁটে বেড়াতাম। তার মধ্যে আবার পড়াশুনো এবং কাজে অমনোযোগী হওয়ার কারণে কপালে আমার বকুনিও জুটত।
সে সব গল্পই শোনাতে থাকতাম নীরব হয়ে যাওয়া শংকরকে।
রোজ এসব শুনতে শুনতে একদিন শংকর হেসে ফেললেন।
শুধু তাই নয়, আমার বলায় কোথাও সেদিন তথ্যের সামান্য ভুল ছিল, সেটিও সংশোধন করে দিলেন।
বুঝলাম আমাকে চিনতে পেরেছেন! 

Alpana Ghosh
এআরডিএসআই-এর ডে-কেয়ার সেন্টারের আরও এক সদস্য প্রফেসর সেনগুপ্তের সঙ্গে। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ

শংকরের জীবনের এই বিস্মরণের মুহূর্তগুলিতে ওঁর নিজের কী অনুভূতি হয়েছিল, নিজের অক্ষমতা ওঁকে কতটা ব্যথিত করেছিল, আদৌ সে সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন কিনা, আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। যদিও আমরা যাঁরা ওঁর পাশে ছিলাম, তাঁরা পলে পলে লক্ষ্য করেছি, অনুভব করেছি, তিল তিল করে ওঁর মন ও শরীরের পরিবর্তন। যে মানুষটির মেধা ছিল প্রশ্নাতীত, তাঁর এই পরিণতি আমাদের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। এই যন্ত্রণার অনুভূতির কথা সত্যি হলেও, এই অভিজ্ঞতা জীবনের অন্য একটি দিককে আমাদের খুব কাছ থেকে চিনতে শিখিয়েছে। এক এক সময়ে ধৈর্য হারাতাম। মাঝে মাঝে শংকরের অবুঝ জেদ, অসহযোগিতা মানিয়ে চলা আমার পক্ষেও খুব সহজ হয়নি।

***

শংকর ঘোষের চিকিৎসক ডাঃ চক্রবর্তী ওঁর অসুখের সময় পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, অ্যালজ়াইমার্স অ্যান্ড রিলেটেড ডিজ়অর্ডার্স সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার (এআরডিএসআই) কলকাতা সংস্থার মুখ্য আধিকারিক নীলাঞ্জনা মৌলিকের সঙ্গে। মাঝে মাঝে তিনি আসতেন আমাদের বাড়িতে। শংকরের সঙ্গে কথা বলতেন। ওঁর কথা বলার ধরনটি ছিল অতি মোলায়েম। শংকর ওকে পছন্দ করতেন বলে মনে হত। প্রতিবারই লক্ষ্য করেছি নীলাঞ্জনা শংকরের সঙ্গে কথা বলার আগে নতুন করে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন। কথা বলছেন মৃদু গলায়। আমাকে সাহায্য করেছেন পরিচর্যাকারী (caregiver) হিসেবে সঠিক পথে চলতে। বারবার বলেছেন, ধৈর্য হচ্ছে এই ধরনের রোগীর সেবার মূলমন্ত্র। চেষ্টা করেছি। কিন্তু একথা অস্বীকার করে লাভ নেই যে মাঝে মাঝে ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে আমার তরফে। 

Alpana Ghosh
এআরডিএসআই-এর ডে-কেয়ার সেন্টারে ছবি আঁকছেন এক সদস্য। রায়বাবু বলে জানতাম ওঁকে। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ

শংকর চিরদিনই অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির মানুষ।
এই রোগের সময়েও কদাচিৎ ওঁকে স্বভাব-বিরুদ্ধ কোন আচরণ করতে দেখেছি।
সমস্যা ছিল ওষুধ খাওয়ানো এবং সেবিকাদের আচরণ নিয়ে।
জোরে কথা বলা, হঠাৎ করে টানাটানি করে কোনও একটি কাজ করতে বাধ্য করা, এ ধরনের ব্যবহার ওঁর ঘোর অপছন্দের ছিল। কিন্তু সে কথা কে বোঝাবে সেবিকাদের!
অবশ্য সবাই এক রকমের নয়। ঝরনা নামের একজন সেবিকা ছিলেন, যাঁকে আমার স্বামী খুব পছন্দ করতেন। তাঁর ধরনটি ছিল ভারি মায়াময়, দিনের সেবিকার একেবারে বিপরীত চরিত্রের মানুষ ছিলেন ঝরনা!
আজও ওঁদের মতো অনেকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ!   

২০০৯ সালে আমার স্বামী শংকর ঘোষকে হারালাম চিরতরে।
আমার একাকীত্বের কথা কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রায় ৪০ বছরের সঙ্গী তিনি।
বিগত দু’বছর ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন এটা ঠিক, কিন্তু যে কোনও আপনজন হারানোর যন্ত্রণা, ব্যথাবোধ যেমন, আমার ক্ষেত্রেও সেই শোকের তীব্রতা কিছুমাত্র কম বোধ হয়নি।

সেই যন্ত্রণা থেকেই আমার এআরডিএসআই-এর ডে-কেয়ারে যাওয়া শুরু হল।
বাইরের জগতের যোগাযোগের সূত্র ধরে একা একা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা, নিজের হাতে রান্না করে আপনজনদের খাওয়ানো, আর নিজের মতো করে লেখালিখির জগতে ডুবে যাওয়াও শুরু করলাম তার পর থেকেই।
ডে-কেয়ারের অভিজ্ঞতা, ডিমেনশিয়া আক্রান্ত মানুষদের সাহচর্য সেই দিনগুলিতে সম্পূর্ণ ভাবে না হলেও আংশিক ভাবে আমার একাকীত্ব, আমার শোক লাঘব করতে সাহায্য করেছে।

Alpana Ghosh
শংকরের শেষ জন্মদিন ১২ ই জুলাই ২০০৯ – আনন্দরূপের সঙ্গে। ছবি – লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

আমাদের দু’জনের বয়সের পার্থক্য নিয়ে শংকর চিরদিন চিন্তিত থেকেছেন।
সব সময়ে বলেছেন, প্রকৃতির নিয়মে উনি আমার অনেক আগে চলে যাবেন আর আমি যেন সেই সময়ে এই বিচ্ছেদকে দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করি।
আমি ওঁর কথা রেখে তা-ই করেছি।
শংকর চলে গেলেন, কিন্তু আমার জীবন থেমে থাকেনি।
নানা সমস্যা, নানা বাধা বিপত্তি আর পাঁচজনের জীবনে যেমন বারবার আসে, আমার জীবনেও তার অন্যথা ঘটেনি।
তবু আমি তার মুখোমুখি হয়েছি। কখনও হেরেছি, কখনও বা জয়ী হয়েছি।
চলার পথে সঙ্গে পেয়েছি আমার একান্ত আপনজন, আমার পরিবার আর বেশ কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুকে।
আজও আমার গভীর বিশ্বাস ‘চরৈবেতি চরৈবেতি’-এ দুটি সংস্কৃত শব্দে। নিত্য অগ্রসর হওয়ার শাশ্বত মহামন্ত্র। এ শব্দের অর্থ হল জীবনে এগিয়ে যেতে হবে, কারণ জীবন হল বহতা নদীর মতো চলমান! তাই যতই ঘাতপ্রতিঘাত আসুক জীবনে, থেমে গেলে চলবে না!
মাভৈঃ মাভৈঃ রবে, একলাই চলতে হবে আলোর সন্ধানে! 

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।

25 Responses

    1. অদিতি, এই লেখা লিখতে কষ্ট হয়েছে।চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়েছে, তবু লিখেছি।
      সঙ্গে আছি! ফেসবুকে আছ মনে হচ্ছে। ইন বক্সে ফোন নম্বর দিচ্ছি। মন চাইলে ফোন কোর। ‘তুমি’ বললাম বয়সের সুবিধে নিয়ে!

    2. অদিতি, তোমার কমেন্টস পাওয়া মাত্র উত্তর দিয়েছি। কিন্তু মনে হয় না পৌঁছেছে! তোমাকেও মনে হচ্ছে যেন আমার বড় কাছের মানুষ! ইনবক্সে ফোন নম্বর দিচ্ছি। কথা বলতে ইচ্ছে হলে ফোন কোর!
      জেনো সঙ্গে আছি সব সময়ে! নিজেকে ভালো রেখ!

  1. সেদিন ফোনে গল্প করে এর কিছু কিছু বলেছিলেন। কখন অজান্তেই এসে পড়ে রোগটা। এই লেখায় আপনার দৃঢ়তার কথা পড়ে নতুন করে প্রণাম জানাই। লিখতে থাকবেন, যত্ন নেবেন আর আবার যেন দেখা হয়। 🙏💐

    1. খুব দ্বিধায় ছিলাম! শংকরের মতো মানুষ সম্বন্ধে এই রোগ নিয়ে লেখা উচিত হবে কিনা। তোমার ভাবনা স্বস্তি দিল আমাকে। দেখা হবে এই আশা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। সাবধানে থেকো।

    2. সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলাম। যায়নি। এবারে লিখতে কষ্ট হয়েছে! সঙ্কোচ বোধ করেছি যে কারণে ডিমেনশিয়াগ্রস্ত আপনজনকে তার পরিবার লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখে দেন, তার বাবা/ মা/ স্ত্রী রোগের শিকার, তা গোপন রাখতে চান, ঠি ক সেই কারণে! তোমাদের মন্তব্য আমাকে ভরসা দিল! অনেক ভালোবাসা, নিখিলেশ!

  2. দিদি, খুব ভালো লাগল। নিজের লোকের শারীরিক কষ্ট চোখে দেখা দারুণ যন্ত্রণার। আপনি যা করেছেন শঙ্কর দার জন্য, অকল্পনীয়। যাই হোক, ভালো থাকবেন।

    1. দেবাশীষ, একবার আমি দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলাম। পুত্রর বয়স তখন মাত্র পাঁচ। তোমাদের দাদা তখন অমৃতবাজার পত্রিকার জয়েন্ট এডিটর। সব সামলে সারারাত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন, আমার দেখভাল করে।
      এলেখা তোমার ভালো লেগেছে সে আমার পরম প্রাপ্তি। ভালো থেক।

    1. আল্পনা দি, আপনার সাথে, আপনাদের সাথে – এই লেখার মাধ্যমে পরিচয়।
      এই অসুখ টি সম্পর্কে জেনেছি আগেই – আপনার লেখা পড়ে ঋদ্ধ হলাম। দৃষ্টি ঝাপসা হয়েছে কিছু সময়, তবু পড়ে গেছি – আপনাকে কুর্নিশ ।
      ভালো থাকবেন। একাকীত্ব বড় অমোঘ। তবু ভালো থাকার, ভালো রাখার নিরন্তর চেষ্টার মধ্যেই এগিয়ে যাওয়া ।
      লিখবেন। আরো লিখবেন, দিদি। এভাবেও তো এক থেকে অনেকের মাঝে পৌঁছে যাওয়া যায়।

  3. এক কথায় অনবদ্য । ঠিক মনে হলো আপনাদের সবাইকে চোখের সামনে দেখছি । যে এই পরিস্থিতিতে পড়ে সেই একমাত্র বোঝে , কিন্তু আপনার লেখায় সেই যন্ত্রণা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম । আপনার এই পসিটিভ অ্যটিটিউ কে আমি শ্রদ্ধা করি ।

  4. খুব ভালো আন্তরিক এক স্মৃতি চিত্র। লেখাটির সবচেয়ে বড় গুণ, স্মৃতি কথা হয়েও একটা বেশ নির্মোহ দৃষ্টিতে লেখা। গোটা ঘটনাটি লেখিকার স্মৃতিকথা হলেও তিনি যেন অনেকটা উঁচু থেকে ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করছেন।
    শংকরবাবুর চরিত্র, তাঁর ছোটখাটো ভালো লাগা, মন্দ লাগাগুলোকে কি অসাধারণ ছোট ছোট বাক্যে ধরেছেন। এরই মধ্যে পুত্রের প্রতি, স্ত্রীর প্রতি তাঁর টান চমৎকার ধরা পড়েছে।
    আর একটা জিনিস মনে হলো, যাঁরা কাজের মানুষ,বিশেষ করে সাংবাদিকেরা ঘরে বন্দী হয়ে পড়লে, তাঁদের মানসিক যন্ত্রণাটা এই লেখা পড়ে বুঝতে পারলাম।
    আলপনা ঘোষের গদ্যের অনুরাগী আমি,ফলে তাঁর লেখায় আমি বেশ একটা পাঠ্যসুখ পাই।এই লেখাটি পড়ে একই রকম ভাবে মুগ্ধ হলাম।

    1. দেবাশীষ, আমার স্বামী শংকর ঘোষকে নিয়ে এই স্মৃতিকথা লেখা সহজ হয়নি আমার পক্ষে বিশেষ করে সেই মানুষটি যদি হন অসাধারণ মেধা সম্পন্ন এক সাংবাদিক, গ্রন্থকার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক! তবু লিখেছি কারণ আমি দেখেছি কিভাবে এই রোগে আক্রান্ত মানুষকে তাঁর পরিবার লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখে দেন। অসুখটি ডিমেনশিয়া একথা গোপন রাখেন যেন একথা প্রকাশ করার মধ্যে এক সামাজিক লজ্জা জড়িয়ে আছে! এই সব থেকে আমিও সম্পূর্ণ মুক্ত নই। আজও শংকরের ডিমেনশিয়া নিয়ে লিখতে আমি দ্বিধামুক্ত নই। আপনারা আমাকে সাহস জোগালেন! আমি চিরকৃতজ্ঞ!
      অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!

  5. আল্পনা দি, অপূর্ব লেখা। আবার সেই দিনগুলো চোখের সামনে এসে দাঁড়ালো। তোমার এই সংগ্রামের সময়েই তোমাকে প্রথম দেখি। ডে-কেয়ারের ছবি গুলো দেখে চোখের জল বাধা মানছে না। আমার বাবার ক্ষেত্রে তো আমি একাধিক ডাক্তার কে বলার পরে ও একযুগ কোনো সঠিক চিকিৎসা হলো না। সবাই বললেন আমি নাকি over concerned, এই বয়সে এটুকু হতেই পারে। কিন্তু সেই সময় সঠিক চিকিৎসা শুরু হলে আমার বাবা হয়তো শেষের দিনগুলো আর একটু ভালো থাকতে পারতেন।

  6. This is a very resourceful article. Being a Geriatric Social Worker specializing in Dementia I am familiar with the challenges of Caregivers, which you have done very effectively. Nilanjana is very close to me so having her to guide you must have been a good experience. I hope you can be a guide/mentor to others who are going through this. One of my suggestion will be to ask friends to document some special moments in the photographs, often that triggers the memory even if it is short lived, also understanding their likings and passion helps. I am sorry my Bengali font is not working properly so I had to write in English, I commend you Alpona for taking this bold step, it must have been difficult but sharing your experience with others is a mutual benefit. Take care and as you said Choroiboti choroiboti,let that be our mantra

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *