নেশা
ছায়া ছায়া অন্ধকারে হালকা সুগন্ধ গায়ে মেখে দোলে ধূপছায়া, গোধূলি, মরুমায়া, সবুজকলিরা। দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার অন্ধকারটা ভেদ করে আলো এসে পড়ে তাদের গায়ে। তখনই তারা বুঝতে পারে বাইরে আলো না মেঘলা। ঠান্ডা না গরম। মন খারাপ করা বিকেল না চনমনে ছুটির সকাল। তারা একসঙ্গে হাসে, কাঁদে, ঝগড়া করে আর উদ্বিগ্ন হয়। উদ্বেগের প্রধান কারণ তাদের কার ভাগ্যে আজ সূর্য ওঠা সফল হবে। কে আজ অমল ধবল পালে হাওয়া লাগিয়ে খানিকক্ষণের জন্য অন্তত মুক্তি পাবে এই বন্ধ ঘরটা থেকে। অপেক্ষা করতে করতে তাদের রূপের চটা উঠতে থাকে। টান টান অহঙ্কারি যৌবন ফণা নামায় আস্তে আস্তে। এর মধ্যেই আসতে থাকে নবীনরা। পুরনোরা সরে যায় পেছন দিকে।
দরজাটা খুলে তাদের ভাগ্যবিধাতা যখন গভীর মনোযোগ দিয়ে নির্বাচনের কাজটা করেন, তখন ঘরের অন্য দিক থেকে মাঝে মাঝে একটা দয়ালু গলা বলে, “মুক্তি দাও না এদের।”
– কখনও না। এরা আমার। যতদিন বাঁচব এরা থাকবে আমার সঙ্গে।
– তারপর?
– এরাও সহমরণে যাবে।
– তুমি বড় নিষ্ঠুর।
হঠাৎ একদিন এল মোহিনী। কারও মত নয় সে। কবেকার অম্বুরী তামাকের গন্ধ ওর গায়ে। কেউ ভাব করল না ওর সঙ্গে। ও-ও অহঙ্কার কিম্বা দীনতা নিয়ে রয়ে গেল একপাশে।
ধূপছায়া, মরুমায়া, গোধূলিরা বুঝতে পারে না কেন ভাগ্যবিধাতার আলোমাখা হাতটা বারে বারে মোহিনীকে ছুঁয়ে যায়।
এরমধ্যে হইহই কাণ্ড। কী যেন ঘটছে দরজার ওপাশে। হাসি ঠাট্টা চলছে। খানাপিনার দেদার আয়োজন। সেই হুল্লোড়ের ধাক্কা এসে লাগল এখানেও। শ্যামছায়া, স্বর্ণময়ী, সবুজকলিরা পালা করে ঘুরে এল বাইরে।
আজ সেই বিশেষ দিন, যার জন্য গত ক’দিনের উৎসব। দরজা খোলামাত্র আলোর ঢেউ আছড়ে পড়ল সবার গায়ে মনে। ভিড়ের মাঝখান থেকে হাতটা আদর করে তুলে নিল মোহিনীকে একেবারে বুকের কাছে। দরজার আড়ালে থাকা গলাকে বলল, “ও আমার কবেকার সঙ্গী!কোথায় হারিয়ে গেছিল। হঠাৎ খুঁজে পেলাম। ও বড্ড পয়া। প্রথম যেদিন “তরুণপ্রতিভা” পুরস্কার পেয়েছিলাম, ও-ই ছিল সঙ্গে। আজ দেশের সেরা হয়ে ওকে ভুলি কী করে? পুরনো, তবু কী সুন্দর! আজ এটাই পরব।”
বিশাল শাড়িঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন সঙ্গীত শিল্পী মৃত্তিকা।
সংস্কার
রিমা ব্যাঙ্গালোর থেকে আসা চিঠিটা বুকে চেপে বলল, “মুক্তি! মুক্তি! এখন চার বছর স্কলারশিপ। তারপর চাকরি। হাফ থেকে ফুল স্বাধীনতা- সব দিক থেকেই।”
রিমার সদ্য-ডাক্তার হওয়া দাদা অবাক হয়ে বলল, “এখানেই বা কী কম স্বাধীনতা? আর তোর যে রকম মেরিট, ব্যাঙ্গালোরের প্রাইম ইন্সটিটিউশনের স্কলারশিপটা যে পাবি এটা তো জানাই ছিল। তোর উচ্ছ্বাসটা অতিরিক্ত মনে হচ্ছে। ভেতরে কি অন্য কোনও গল্প আছে?”
রিমা চারদিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “তোকে বলি? খুব বলতে ইচ্ছে করছে আপন কারওকে।”
– বল না! এত ভনিতা করছিস কেন?
– বলাই যায়। সুপ্রিম কোর্টও যেখানে অ্যাপ্রুভ করেছে। পর্ণাকে তো তোরা সবাই জানিস। এত ঘন ঘন আমাদের বাড়ি আসে বলে মার খুব সন্দেহ। তোকে সেই সময়ে একটু গার্ড দিয়ে রাখে। জাতপাত নিয়ে মা কী রকম বাড়াবাড়ি করে জানিসই তো। পর্ণা আসে কিন্তু আমার জন্য। আমি আর পর্ণা অনেকদিন ধরেই পার্টনার। ব্যাঙ্গালোরে ও-ও যাবে চাকরি নিয়ে। আমরা একসঙ্গে থাকব, যেটা এখানে কিছুতেই সম্ভব নয়।
ঋজুর হাত থেকে স্টেথোস্কোপটা ছিটকে মাটিতে পড়ল। পড়েই রইল নিথর হয়ে… যেন সাপুড়ের ঝাঁপি থেকে আচমকা বেরিয়ে আসা একটা সাপ।
ঋজু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমাকে বলেছিস ভাল কথা। আর কারওকে বলতে যাস না। কদিন বাদে তোর সিক্রেট সঙ্গে করে আমিও বাইরে চলে যাব। যে কদিন বাঁচবে, মা বাবাকে শান্তিতে থাকতে দিস। ঝুলি থেকে বেড়াল না বেরনোই ভাল।
- রিয়্যাকশন এরকমই হবে জানতাম, তবু একটু আশা ছিল। তুই এ যুগের ছেলে যদি অন্যরকম ভাবিস।
- এ যুগের ছেলে হলেই যত বিটকেল জিনিসকে প্রশ্রয় দিতে হবে, তার কোন মানে নেই। ট্র্যাডিশন ভাঙার মধ্যে কোন বীরত্ব নেই।
- তুই যাকে ট্র্যাডিশন বলিস আমার ট্র্যাডিশনও কিন্তু ততটাই পুরনো।
- আমি তোর সঙ্গে তর্ক করতে চাই না। আমার হাতে আইন থাকলে এইসব বিকট জিনিস ঝেঁটিয়ে বিদায় করতাম।
- ভাগ্যিস।
এইসব কথাবার্তার পর কেটে গেছে বেশ কিছু সময়। রামধনুর রঙ আরও গাঢ় হয়েছে। সূর্যের সাত ঘোড়ার দাপাদাপি ঋজুর অগোচরেই ঘটেছে কারণ সে বহুদিন বিদেশবাসী। ব্যস্ততার কারণে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হতে হতে ক্ষীণতর। পারিবারিক গুহ্য তথ্যটিও প্রবাস ছেড়ে দেশে আসার সুযোগ পায়নি।
রিমা একটি বিদেশি সংস্থায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছে বছর দুয়েক হল। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনের কাছে সে অনুসরনযোগ্য উদাহরন। আর মা-বাবার কাছে সোনার টুকরো, হিরের টুকরো মেয়ে। রিমা মাঝে মাঝেই ছুটি নিয়ে মা-বার সংসারে এসে ঢিলে হয়ে যাওয়া কলকব্জা মেরামত করে দেয়। আর ব্যাঙ্গালোরের জীবন চলে তার নিজের মত। থেকে থেকেই হড়পা বানের মত প্রেম আসে তার জীবনে। সে প্রবল সাড়ম্বরে সেই প্রেমের ধ্বজা উড়িয়ে চলে।
মেয়ে বিয়ে করছে না, এটা যেমন মা বাবার দুঃখ, আবার কোনও ছেলের সঙ্গে মিছিমিছি গলাগলি করে না, এই নিয়ে গর্বও কম নয়! বৈধ ছাপ ছাড়া বিপরীত লিঙ্গের থেকে দূরে থাকাই তাঁদের কাছে সৎ চরিত্রের চরম লক্ষন।
এই সময়ে রিমার বাবা মারা গিয়ে মা একা হয়ে গেলেন।রিমা বেশ কিছুদিন ছুটি নিয়ে ডাক্তার আয়া আরও নানারকম সাংসারিক সুবিধের ব্যবস্থা করে যাবার আগে মাকে বলে গেল, “আমার কাছে থাকতে তোমার অসুবিধে হবে। এখানে চেনা জায়গা। নিজের মতো থাকতে পারবে।দরকার হলেই ফোনের বোতাম টিপবে। আমি চলে আসব।”
এতকিছু সত্ত্বেও মায়ের শরীর-মন দু’টোই থেকে থেকেই বিগড়ে যেতে লাগল। তখন শুভাকাঙ্খীদের সকলের পরামর্শে ব্যাঙ্গালোরে মেয়ের কাছে গিয়ে থাকাটাই একমাত্র সমাধান বলে রিমার আপত্তি সত্ত্বেও তিনি একরকম জোর করেই ব্যাঙ্গালোরে যাবার দিনক্ষণ ঠিক করে ফেললেন।
রিমা বন্ধুদের বলল, “মা আসছেন ভাল কথা। তবে ভান করে থাকতে পারব না। মেনে নিলে ভাল। নয়তো কী হবে জানি না।”
বিপর্যয় আটকাবার জন্য রিমার অন্তরঙ্গ মহল আপৎকালীন তৎপরতায় মাসিমার প্রাথমিক শিক্ষার ভার নিল। এয়ারপোর্ট থেকেই শুরু হয়ে গেল। সুনেত্রা বলল, “মাসিমা, এটা সকলেই জানে আপনার মেয়ের মত মেয়ে হয় না।”
– ও আমার একসঙ্গে ছেলে আর মেয়ে ।
– সেইজন্যই সেই অর্থে যাকে বলে জামাই, সেটা আপনার না হলেও চলবে।
সরিতা বলল, “জামাইদের অবস্থা তো দেখেছেন! কেবল ডিমান্ড। না পেলেই বৌ পেটায়।”
– মদ খায় আর মেয়েবাজি করে।
– দূর দূর! পুরুষমানুষকে কেউ বিয়ে করে? কোনও গুণ নাই তার কপালে আগুন।
মাসিমা আচমকা এত পুরুষবিদ্বেষে দিশেহারা। সুনেত্রাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তা তোমরা তো স্বামীর ঘরই করছ, নাকি?”
– করছি বলেই জ্বলছি মাসিমা। সবাইকে বলি, কেউ যেন ভুলেও এপথ না মাড়ায়। আমরা মেয়েরা মেয়েরা একসঙ্গে কত ভাল থাকি বলুন তো?
– আর সরিতা? তারও তো স্বামী আছে শুনেছি!
– আমার সুবিধে কী জানেন মাসিমা, আমি স্বামীর ঘর করি না। স্বামীই আমার ঘর করে। রাঁধে বাড়ে। ছেলেমেয়েদের দেখেশুনে রাখে। আমি অফিস করি।
দুই ক্ষুরধার মেয়ের ধারালো যুক্তিতে মাসিমার এত দিনের জ্ঞান যেন ঘাসের আগায় বেলা নটার শিশিরবিন্দু। সে যে ছিল, তার স্মৃতিটুকু শুধু আছে।
ভগ্নতরী বেয়ে নয়, উড়োজাহাজে চড়ে সত্যি সত্যি তিনি চলে এসেছেন এক নতুন দেশে! সুনেত্রা আর সরিতা দু’জন দু’পাশ থেকে সেই নতুন দেশের নানা কথা মগজে তাঁর গজাল মেরে গুঁজে দিচ্ছে। কথাসরিৎসাগর থেকে ছাঁকনিতে ছেঁকে মাসিমা সার কথাটি যা বুঝলেন, তা হল জামাই হিসেবে তাঁকে পুরুষ নয়, কোনও একজন মেয়েকেই বরণ করে নিতে হবে!
একেবারে সারেন্ডার করার আগে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মত শেষ প্রশ্নটা তিনি করলেন, “সবই তো বুঝলাম… কিন্তু সৃষ্টি বজায় থাকবে কি করে?”
দুই মেয়ে কুলকুল করে হেসেই অস্থির। “সৃষ্টির জন্য একদম ভাববেন না মাসিমা। কত ব্যবস্থা আছে জানেন? একটি ক্যাবলাকান্ত জামাইয়ের বদলে অনন্ত চয়েস। সব ঠিকঠাক থাকলে ঘর আলো করা নাতি নাতনি পাবেন শিগগিরই। জ্ঞান বুদ্ধি গান বাজনা খেলাধুলো যে ফিল্ডের চান পেয়ে যাবেন।”
মাসিমার ভুরু আর সোজা হয় না! এদিকে পথ প্রায় শেষের দিকে। দূতিয়ালি সফল করতে মরিয়া সরিতা বলল, “ছেলের বউয়ের সঙ্গে জীবনেও থাকা হবে না সেটা তো আপনি জানেন। এ একাধারে বউমা আর জামাই। এরকম ইউনিক কম্বিনেশন খুব ভাগ্য করলে পাওয়া যায়।”
মাসিমা মচকান তবু ভাঙেন না। অনেক ভেবেচিন্তে শেষে বললেন, “বেশ তোমাদের সব কথা মেনে নিলাম। তবে তোমরাও দেখো, পাত্র যেন বামুনের মেয়ে হয়!”
বাংলা সাহিত্য নিয়ে শান্তিনিকেতন ও প্রেসিডেন্সিতে পড়াশোনা। পরে শিক্ষাঙ্গনকেই বেছে নিয়েছেন কর্মজগত্ হিসেবে। তবে লেখালিখিই প্রথম ভালবাসা। ছোটদের ও বড়দের –-- দু'রকম লেখাতেই সমান স্বচ্ছন্দ। ছোটদের ও বড়দের গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি শান্তিনিকেতনের মেয়েদের হস্টেল জীবন নিয়ে তাঁর লেখা 'শ্রীসদনের শ্রীমতীরা' পাঠকসমাজে সমাদৃত। প্রিয় বিষয় সিনেমা, নাটক, রহস্য ও ইতিহাস।
প্রথম অনু গল্প শাড়ীর আত্ম্য কথায় বেশ চমক আছে, দ্বিতীয় গল্পে জাতপাত যে আমাদের মজ্জায় আছে বেশ মুন্সীয়ানার সঙ্গে lesbianism কে ছাপিয়ে গেছে।
Valo hoyeche, bises kore prothom golper suru ta, sundor vasa