-বিতনুদা, হ্যালো, হ্যালো, শুনছেন?
-হ্যাঁ হ্যাঁ… হ্যালো
– ওহ, এই ভোডাফোন নেটওয়ার্ক এত বিরক্তিকর হয়ে উঠছে দিন-কে-দিন! বিএসএনএল-টায় করব?
-বলো, আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না তোমার কথা…
-বলছি, এখন বাড়িতে?
-…
-হ্যালো… দুচ্ছাই!

লাইন কেটে যায়। গরমের দুপুরে তিনটের সময় কোথায়ই বা যাবেন আজ। একটা মেসেজ ছেড়ে দেয় দ্যুতিদীপা, ‘এখন কি ঘরে? না মিটিংয়ে আছেন? অফিস থেকে বেরোচ্ছি। একবার দেখা হয়?’ দু’শব্দে উত্তর আসে মিনিট তিনেকে, ‘ঘরেই। এসো।’

গত ছ’মাসে অন্তত আঠেরোবার বিতনু সান্যালের বাড়ি গিয়েছে দ্যুতিদীপা। তবে প্রত্যেকবারই সন্ধেয়, আটটার পর। বিতনু দীর্ঘদিনের সাংবাদিক। আর এ পেশায় যেহেতু তথাকথিত অবসর হয় না, তাই বিতনু এখনও একটি বাংলা খবরের চ্যানেলে অ্যাডভাইজারি কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। তবে বিতনু সপ্তাহে তিনদিনের বেশি দফতরে যান না। সাধারণত মঙ্গল-বৃহস্পতি-শনি। বয়স বাষট্টি হলেও বছর চার আগের অ্যাকিউট প্যাংক্রিয়াটাইটিস বেশ কিছুটা দমিয়ে দিয়েছে একদা টানটান মেরুদণ্ডের এই নিউজপার্সন-কে। অফিসের দিনগুলোয় মোটামুটিভাবে সন্ধে সাতটার মধ্যে ফিরে আসেন বিতনু। তাই দ্যুতিদীপা পৌঁছে যায় ওই আটটা নাগাদ। দু’বার অটোরিক্সা বদলে পঁচিশ থেকে ত্রিশ মিনিটে এক-কামরার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বিতনুদার বারোশো স্কোয়ারফিটের বাড়িতে। মাঝে মাঝে সাড়ে আটটা, এমনকি নটাতেও ঢুকেছে সে। প্রাজ্ঞের বাড়িতে দশটা পর্যন্ত মানুষের জন্য অবারিত দ্বার। পঞ্চাশোর্ধ সাংবাদিকরা প্রেস ক্লাবে যাওয়ার আগে-পরে আড্ডা দিতে আসেন। তরুণরাও আসে মাঝেমধ্যে। একজন স্বল্পভাষী মানুষ কী ভাবে একইসঙ্গে সুবক্তা ও ভালো শ্রোতা হয়ে উঠতে পারে, বিতনুকে না দেখলে জানা যায় না।

উবর-পুল উননব্বই টাকায় প্রায় গোটা দক্ষিণ কলকাতা চক্কর দিইয়ে বিতনুর বাড়ির গলিতে এসে নামায়। পাঁচটা বাজতে তখনও বারো মিনিট বাকি। কলিং বেল বাজানো সমীচীন হবে না। ঠাম্মা ঘুমোচ্ছেন। ঠাম্মা, অর্থাৎ বিতনুর ছোটোমাসি। নিঃসন্তান এই রমণী জীবনসঙ্গীর মৃত্যুর পর থেকে বিতনুর বাড়িতেই থাকেন। বিতনুর ছেলে ওঁকে ছোটঠাম্মা বলে ডাকে। এখন দ্যুতিদীপাও ঠাম্মা পাতিয়ে ফেলেছে তাঁকে। বিতনুর ছেলে অদ্বয় বয়সে দ্যুতিদীপার চেয়ে তিন বছরের ছোটো। ধীমান হাসতে হাসতে দু’একবার বলেছে, “আসলে তো অদ্বয়ের সঙ্গেই তোর প্রেম করা উচিত ছিল।” এসব অর্বাচীনের বাক্যবিলাপে নিরুত্তর থাকে দ্যুতিদীপা। তার জীবন উচিত-অনুচিতের বেড়াজালে কবেই বা আটকে পড়েছে আর! ফুলফুল স্লিং ব্যাগ থেকে সেলফোন বার করে বিতনুর বিএসএনএল-টায় রিং করে। আনঅ্যাভেলেবল। ছোটো গেট পার হয়ে ঢুকে কোল্যাপসিবলের বাইরে দাঁড়িয়ে আবার এসএমএস- ‘এসেছি, খুলবেন?’ ডেলিভারি হয় তৎক্ষণাৎ।

কয়েক মুহূর্তে একপাল্লার সদর দরজা খুলে বিতনু দাঁড়ান, তারপর কোল্যাপসিবল গেট সরাতে সরাতে বলেন- “বেল বাজাবে তো!” দ্যুতিদীপা তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে। খাটো ঝুল আকাশি পাঞ্জাবি, গোল গলা। আর একটা ঢলঢলে পায়জামা, একদম রাজেশ খান্না স্টাইল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে দ্যুতিদীপা। ছটফটে মেয়ের পায়ের গতি শ্লথ হয়, তারপর দ্বিতীয় বাক্যে “এসো” শুনে নিজেকে সামলে ঘরে ঢোকে। দ্যুতিদীপার ক্লাস ফাইভ, নতুন বাড়ির বাগানে সূর্যমুখী গাছের পাশে বাবার একটা ছবি তুলে দিয়েছিল মা। সেই আকাশি-রং পাঞ্জাবির ওপরদিকের দুটো বোতাম খোলা ছিল ছবিতে। বাবা লেন্সের দিকে নয়, সম্ভবত আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। সে সময় ছবিটবি সুদৃশ্য অ্যালবামে সাজিয়ে রাখা হত।

মার্চের প্রথম সপ্তাহ, অথচ ঘরে ফ্যান ঘুরছে না। দ্যুতিদীপা সিঙ্গল সিটার সোফায় বসতে বসতেই বলে- “ঠাম্মা ঘুমোচ্ছেন তাই কলিং বেল বাজালাম না।” সাধারণত এইটাই তার বসার জায়গা। আর নব্বই ডিগ্রি কোণ করে ডাবল সিটার সোফাটায় বসেন বিতনু। তবে সন্ধেয় অন্যান্য লোকের সমাগম থাকলে এই সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্টটা বদলে যায়। তখন দ্যুতিদীপা ঢুকে যায় ঠাম্মার ঘরে। ওখানে বয়েজকাট চুলের আটাত্তর বছর বয়সী এক কোমল বৃদ্ধা বসে বসে টিভি সিরিয়াল দেখেন, কিংবা ভগবদগীতা, কথামৃত পড়েন। দ্যুতিদীপা মাইনে পাওয়ার পর ও-বাড়ি গেলেই ঠাম্মার জন্য মিল্ক চকোলেট নিয়ে যায়। বুড়ি মানুষটার মুখ নিমেষে দশ বছরের বালিকার মতো হয়ে যায় তখন। বিতনু আর দ্যুতিদীপা কিন্তু ড্রয়িংরুমে কখনওই মুখোমুখি বসে না – কখনওই না। সিঙ্গল সিটার সোফায় বসলে সোজাসুজি বিতনুর ঘরের একটা জানলা দেখা যায়। শেষ-সন্ধেয় সে জানলার কাচের ভেতর দিয়ে স্ট্রিট লাইটের আলো এসে পড়ে বেডরুমে। গত শরতে দেখেছে, একবার খুব ঝড়বৃষ্টির রাতে পেয়ারা গাছটা জানলার কাচে আছাড়িপিছাড়ি করে কী হুলস্থূল কাণ্ডটাই না বাধাচ্ছিল। দ্যুতিদীপার মনে হচ্ছিল এক্ষুনি গিয়ে জানলাটা খুলে দেয়। বাতাসকে বন্দি করে রেখে কার কী লাভ! ভয়ে ঘরে যেতে পারেনি। এ বাড়িতে এক্কেবারে নতুন ছিল যে!

-মাসিমা নেই আজ। গায়ত্রী ওঁকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে।
-ওমা সেকি! কী হয়েছে? সিরিয়াস কিছু?
-না ওই কানের সমস্যা, বোধ হয় আজ হিয়ারিং এইড দেবেন ডাক্তার।
-ফিরবেন কখন ওঁরা? দেখা করেই যাব তবে।
-আজ ফিরবে না কেউ। গায়ত্রীর ফ্ল্যাটে থেকে যাবেন মাসিমা। আজ তো শুক্রবার, মেঘও বাড়ি আসবে রাতে।

অদ্বয়ের ডাকনাম মেঘ। সদ্য পিএইচডি সাঙ্গ করে আপাতত মেদিনীপুরের কলেজে অর্থনীতি পড়াচ্ছে। বিতনুর সঙ্গে গায়ত্রীর আইনি বিচ্ছেদ হয়নি কখনওই। তবে অসম-চেতনার দু’টি মানুষ যে একছাদের নিচে স্রেফ সমঝোতা করে কাটাতে পারে না এ কথা বুঝেছিলেন উভয়েই। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারি গায়ত্রী অদ্বয়কে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে এক বছর ভাড়া বাড়িতে থাকেন। তারপর লোন নিয়ে এক্সটেনডেড নর্থ কলকাতায় একটা টু-বিএইচকে ফ্ল্যাটে। অদ্বয়ের তখন ক্লাস এইট। শহরের উপকণ্ঠে ক্রমশ গড়ে উঠতে শুরু করছে বহুতল আবাসন।

সন্ধেয় লোকজনের আনাগোনা থাকে বলে বিতনুকে পরে থাকতে দেখা যায় সুতির ট্রাউজার আর সাদা শার্ট। হাফ কিংবা ফুল স্লিভ। শীতে কাহিল হয়ে পড়েন একটুতেই। তাই অক্টোবর পড়তে না পড়তেই শার্টের নিচে ঢুকতে থাকে কটসউল, ওয়ার্মার। গত ছ’মাসে শার্টের রঙের ব্যত্যয় ঘটেনি। আজ আচমকাই আকাশি পাঞ্জাবি দেখে সামান্য গোল পাকিয়ে গেছে দ্যুতিদীপার মগজে। এত অপূর্ব এক পুরুষ। লম্বা, ছিপছিপে চেহারা, ধীর, শান্ত, বিনম্র, বিচক্ষণ।

কী যেন ছিল মন্দাক্রান্তার ওই কবিতাখানা?
ধূসর পাঞ্জাবি, মেঘলা পাঞ্জাবি, তোমার পাঞ্জাবি মেঘ নামায়/
এখনই রোদ ছিল, লজ্জাবোধ ছিল, হঠাৎ ঝড় এল আকাঙ্ক্ষায়…
ঝড়ের সময় এখনও আসেনি। সবে তো ফাল্গুন। দমকা হাওয়ার ধাক্কা লেগে দু’চার ফোঁটা জল নামতে পারে বড়জোর।

-ফ্যানটা চালাও। ঘামছো তুমি।
-ও ঠিক আছে। আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে তো।
-লাগবে না। চালাও, একটু কমিয়ে দাও খালি।

মেঝের ওপর সোজা হয়ে পড়া বসন্তের আলো ফিকে হয়ে আসছে। ঘরের আলো জ্বালায়নি কেউ। প্রায়ান্ধকার বড় বাঙ্ময়। সেই অনিকেত ম্লানমুখ অন্ধকারের চৌহদ্দির ভেতরে কোনও অবাঞ্চিতের অনুপ্রবেশ ওরা চায় না। দ্যুতিদীপা চোখ কুঁচকে হারারির অক্ষর দেখতে থাকে। এ সময় আদি ও অকৃত্রিম ক্রিং ক্রিং রিংটোনে বিতনুর সেলফোন বেজে ওঠে।

সোফা থেকে হাত বাড়িয়ে সুইচ অন করার চেষ্টা চালানোয় ব্যর্থ হয় দ্যুতিদীপা। ঝটিতি বিতনু উঠে ফ্যান চালান। অভিজ্ঞতাক্লিষ্ট বিতনু সান্যাল একত্রিশের এই যুবতীকে দেখলে বাষট্টির তরুণ হয়ে যান। সে কথা যে দ্যুতিদীপা বোঝে না, এমন নয়। আরও কেউ কেউ বোঝে। ধীমান, পার্থজিৎ। শুধু দ্যুতিদীপা চায় না এসব গায়ত্রীদি কখনও বুঝুন। গায়ত্রী তাকে চেনেন। মাসে দু’একবার গায়ত্রী আর বিতনুর দেখা হয়। অদ্বয়ের কলেজজীবন শুরু হওয়া পর্যন্ত সাক্ষাৎ হত প্রতি সপ্তাহান্তেই। অদ্বয়ের ভাষাশিক্ষা তার পিতার কাছে। এ সমস্ত গল্প তাকে বিতনু নিজেই বলেছেন। রোজ, অল্প অল্প করে। পাশে বসে, টেলিফোনে, এসএমএস-এ। একটা ছাইরঙা বেসিক ফোন বিতনুর। ইন্টারনেট-ফেট কিচ্ছু নেই।

-এটা বদলাবেন না?
-কী দরকার! আমার তো চলে যাচ্ছে বেশ।
-নিউজ আপডেট পেতে অসুবিধে হয়না?
-আমাদের কৈশোর যৌবনে সাংবাদিকতা আন্তর্জাল ছাড়াই চলত।
অদ্ভুত সব রিজিডিটি। দ্যুতিদীপা কথা বাড়ায় না। সকাল হলেই দ্যুতিদীপার ফোনে একগাদা গুডমর্নিং আসতে থাকে। দু’একটা ঝলমলে সকালে, নিভৃত সকালে, দ্যুতিদীপার ইচ্ছে করে বিতনুকে হোয়াটসঅ্যাপে শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখে পাঠায়। অথবা গীতা ঘটকের গানের লিংক। সুযোগ ঘটে না।

গোল সেন্টার টেবিলে একটা ‘স্যাপিয়েন্স: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব হিউম্যানকাইন্ড’ উল্টো করে রাখা। বিতনু পড়ছিলেন বোধ হয়। হারারির এই বইটি খুবই ক্রিটিকালি অ্যাক্লেমড।

-পড়া শেষ হলে দেবেন তো।
-আচ্ছা। চেয়ে নিও মনে করে পরশু নাগাদ। নাহলে কোথায় কোন স্তূপের মধ্যে ঢুকে যায় খেয়াল থাকে না।
পরশু কি দেখা হবে বিতনুদার সঙ্গে? অফিস থেকে বেরিয়ে একবার কুরিয়ার সার্ভিসে যেতে হবে। আর পিরিয়ডের ডেট ওইদিনই। ন্যাপকিন যতই উন্নততর হোক, প্রথম দু’দিনের পীড়ার সঙ্গে যুঝে নেওয়া সহজ হয় না। দ্যুতিদীপা ভাবতে থাকে এইসব। বিতনু ডাবল সিটার সোফার এককোণে বসে ছাইরঙা ফোনে খুটখুট করতে থাকেন। পা দু’টি সামনের দিকে লম্বা করে ছড়ানো। ঢোলা পায়জামার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আছে দুটি ফর্সা, রোগা পায়ের পাতা, একটি অন্যটিতে এলিয়ে রাখা। ঘরের মধ্যেকার অপার নিস্তব্ধতা সঙ্গে নিয়ে বাইরে সন্ধে নামছে। পেন্ডুলাম দেওয়া বড় দেওয়াল ঘড়ির ছন্দোবদ্ধ শব্দে, নৈঃশব্দ উতরোল। পাঁচটা চল্লিশ। উল্টোদিকের ঘরের কাচের জানলা ভেদ করে আলো এসে পড়ছে বিতনুর পায়ের অনতিদূরে। মুহূর্তের জন্য দ্যুতিদীপার মনে হয়, ডান পায়ের যে বুড়ো আঙুল অনবধানে দু’একবার নড়ে উঠছে, ওখানে হাত বোলায়। হঠাৎ আত্মমগ্ন হয়ে যাওয়া এই মানুষটির পায়ের কাছে ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত ক্ষিতি-অপ-ত্যেজ-মরুত-ব্যোমের সন্ধান রয়েছে কি?

মেঝের ওপর সোজা হয়ে পড়া বসন্তের আলো ফিকে হয়ে আসছে। ঘরের আলো জ্বালায়নি কেউ। প্রায়ান্ধকার বড় বাঙ্ময়। সেই অনিকেত ম্লানমুখ অন্ধকারের চৌহদ্দির ভেতরে কোনও অবাঞ্চিতের অনুপ্রবেশ ওরা চায় না। দ্যুতিদীপা চোখ কুঁচকে হারারির অক্ষর দেখতে থাকে। এ সময় আদি ও অকৃত্রিম ক্রিং ক্রিং রিংটোনে বিতনুর সেলফোন বেজে ওঠে। একবার রিং হতেই ফোন ধরে নেয় বিতনু। “হ্যাঁ, আছি… আসবে? আচ্ছা… হ্যাঁ এইবারের এপিসোডটা লেখা হয়ে গেছে কাল রাতে।… আগের প্রুফটা পারলে নিয়ে এসো কেমন? আচ্ছা, রাখো।” ধীমান, নিশ্চিতভাবেই। পেন্ডুলাম ঘড়িতে ছটা বাজতে মিনিট দুই বাকি।

দ্যুতিদীপা সোফা ছেড়ে উঠে প্রথমে জোড়া টিউবলাইট জ্বালায়। ঘরে ঝকমক করছে আলো। ডিনার টেবিলে রাখা বড় জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খায়। আর পরক্ষণেই অনুভব করে, তার বেশ খিদে পেয়েছে। সাড়ে দশটায় অফিস পৌঁছে হেভি-ব্রেকফাস্ট করেছিল। দুটো চিকেন গ্রিল্ড স্যান্ডউইচ আর একটা ওমলেট। মাঝে বার দুই চা বিস্কুট। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে জিগ্গেস করে,
-ফ্রিজে কিছু আছে?
-না বোধ হয়। সামান্য অপ্রস্তুতে পড়ে যান বিতনু। “রহিমা চলে আসবে সাতটায়, কিছু বানিয়ে দেবে তোমায়। এখন বিস্কুট খাও? বিস্কুট?”
-ব্যস্ত হচ্ছেন কেন! চুপ করে বসুন না!
-না না। আমারই বোঝা উচিত ছিল কাজ থেকে এসে তোমার খিদে পেতে পারে। বিচলিত বিতনুর দিয়ে তাকিয়ে স্মিত হেসে দ্যুতিদীপা রান্নাঘর থেকে ক্রিমক্র্যাকার বিস্কুটের কৌটো নিয়ে আসে।
-দু’টো কেন! ছ’টা নাও! দু’টো খেয়ে কী হয়?
দ্যুতিদীপা হাসে- “দুটোই যথেষ্ট।” ক্রিমক্র্যাকার খেতে আদতেই তার বেশ খারাপ লাগে। অ্যাকিউট প্যাংক্রিয়াটাইটিসের পর থেকে এ বাড়িতে ক্রিমক্র্যাকার ছাড়া কিছু আসে না। অদ্বয়ের বান্ধবী পেশায় ডায়েটিশিয়ান। তার কাছ থেকেই একটা ডায়েট চার্ট তৈরি করে অদ্বয় লিখে রেখে গেছে বিতনুর রোজকার ডায়েরির পাতায়। এ বাড়ির রান্নাঘরের দায়িত্ব সামলায় রহিমা বিবি। সে ক্লাস সেভেন অবধি পড়াশোনা করেছে। দাদার দেওয়া তালিকা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। দু’জনের হাতেই এখন দু’টো করে বিস্কুট।
-জানো দ্যুতিদীপা, আমি ছোটোবেলায় খুব চুরি করে মিষ্টি বিস্কুট খেতাম। ওপরে গুঁড়ো গুঁড়ো চিনি দেওয়া, বেকারি বিস্কুট। তখন তো এত রকমারি বিস্কুটের চল ছিল না। আমার জন্য দু’দিন অন্তর বাড়িতে বিস্কুটের প্যাকেট আনতে হত। এখন তাই এমন শাস্তি পাচ্ছি।”
তাদের ছলচ্ছল হাসিশব্দে ডোরবেলের পাখির আওয়াজ মিশে যায়।

ওই জানলায় কি পাখি আসে? ওই জানলায়, কী পাখি আসে?


***

ধীমানকে দরজা খুলে দেন বিতনু। তারপর ভেতরে গিয়ে সোজাসুজি ওঁর শোওয়ার ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে কয়েকটি কাগজ নিয়ে আসেন। ধীমান ঝোলার মধ্যে থেকে চার পৃষ্ঠার প্রুফ বার করে। ধীমান আর ওর পাঞ্জাবি স্ত্রী সোনম মাঝারি মাপের একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালাচ্ছে প্রায় বারো বছর হল। মূলত রাজ্যের মধ্যেই, এবং রাজ্যের বাইরের কয়েকটি শহরেও ওদের ট্যুর চলে। ধীমান কোম্পানির পক্ষ থেকে একটা ট্রাভেল ম্যাগাজিন চালায়। নাম- দূরপাল্লা। সেখানেই গত তিন মাস ধরে ধারাবাহিক লিখছেন বিতনু। লিখছেন তাঁর ব্যক্তিগত ভ্রমণকাহিনী। দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরের সাংবাদিকজীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় মুখর। সে সব কোথাও না কোথাও লিপিবদ্ধ করে রাখতেই হত, আজ না হোক কাল। এ পরিকল্পনা প্রাথমিকভাবে দ্যুতিদীপার। বিতনুর সঙ্গে আলাপের মাস দুই বাদে ধীমানকে সে-ই বলেছিল, “তোমাদের ম্যাগাজিনে বিতনুদাকে লিখতে বলছ না কেন?”
-আমরা পয়সা দিতে পারব না। এত সিনিয়র মানুষকে সাম্মানিক ছাড়া লিখতে বলা কি উচিত হবে?
-আমি বলে দেখব?
বলা বাহুল্য, ধীমান যথেষ্ট আগ্রহীই হয়। কেননা বিতনু সান্যালের নাম দেখে মাসিক বাণিজ্যিক পত্রিকার সার্কুলেশন কিছুটা হলেও বাড়তে পারে। দ্যুতিদীপার প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যান বিতনু।

ধীমানকে বিতনু প্রায় বছর দশেক হল চেনেন। এজেন্সির শুরুর দিকে ওরা বিতনুর তৎকালীন টিভি চ্যানেলে আধ ঘণ্টার স্লটে একটি অনুষ্ঠান করত। সেখানে ভারতের নানা প্রান্তের চেনা-অচেনা জায়গার হদিশ দিতেন একজন সুবেশা নারী ও একজন পুরুষ অ্যাঙ্কার। ধীমানদের কোম্পানির সঙ্গে গায়ত্রী ওঁর কলিগদের নিয়ে দু’বার ট্যুর-ও করেছেন। ফলত, পৃথক পৃথকভাবেই ধীমান, বিতনু ও গায়ত্রীর স্নেহধন্য বলা যায়। ডাবল সিটার সোফার দু’পাশে বিতনু ও ধীমান। বিতনু প্রুফের কাগজগুলো ক্যাজুয়ালি ওল্টাতে থাকেন। ধীমান দ্যুতিদীপার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “কখন এলি?”
-এই তো কিছুক্ষণ। ঘণ্টা-মিনিটের হিসেব করতে ইচ্ছে করছে না। সোজাসুজি জানলায় আর কোনও দৃশ্যকল্প তৈরি হচ্ছে না এ মুহূর্তে।
-এবার কোথাকার গল্প লিখলেন বিতনুদা? ধীমান প্রশ্ন করে। “
-হ্যাঁ?
-বলছি এই এপিসোডে কোথায় বেড়াতে যাওয়া?
-ও হ্যাঁ। বীরসিংহ গ্রাম।
-আরে! অসামান্য! মানে পশ্চিম মেদিনীপুর! বীরসিংহকে সেন্টার করে দু’রাত তিনদিনের চমৎকার উইকএন্ড ট্যুর হতে পারে কিন্তু, কী বলিস দীপু?
-হুম, তা তো পারেই। প্রচারের আড়ালে থাকা এইসব ছোটো ছোটো জায়গা হাইলাইট করা তো তোমাদেরই কাজ।
এরপর বিতনুর দিকে তাকিয়ে দ্যুতিদীপা জিগ্গেস করে,
-ওখানে কবে গিয়েছিলেন?
-বছর আষ্টেক আগে। বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে আমাদের খবরের কাগজ একটা চার পৃষ্ঠার ক্রোড়পত্র করেছিল সে বার।
ধীমান বলে, “ঠিক ঠিক! তখন তো আপনি চ্যানেল ছেড়ে সদ্য কাগজে ঢুকেছেন। বিতনু বলেন, “মনে আছে তোমার? ক্রোড়পত্রটাও রাখা আছে কোথাও। খুঁজলে পেয়ে যাব।” তৃপ্তির হাসি হাসেন। নিবিষ্ট পাঠক সর্বকালেই বিরল, কিন্তু একবারে নেই এমনটা নয়।

ড্রয়িংরুম লাগোয়া সদর দরজায় বাইরে থেকে ডুপ্লিকেট চাবি ঘুরিয়ে রহিমা ঢুকে পড়ে। দ্যুতিদীপার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসে।
-দিদি ভালো আছ? তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
-সবাই চা খাবে তো?
বিতনু কিন্তু চল্লিশ মিনিটে সাফল্যের সঙ্গে ভুলে গেছেন যে দ্যুতিদীপার খিদে পেয়েছিল। প্রথম প্রথম এইসব খামখেয়ালিপনায় অনভ্যস্ত ছিল দ্যুতিদীপা। মাস দেড়েক যেতে না যেতেই সে বুঝতে পারে, এ বাড়িকে নিজের বাড়ি হিসেবে ভেবে নিলে গতায়াত সহজতর হবে। আর, বাড়ির চারটি প্রাণী অর্থাৎ বিতনু, ঠাম্মা, রহিমা কিংবা ঠাম্মার রাতের আয়া মিতালি – কারওরই এতে বিশেষ সমস্যা তো হলই না, বরং সুবিধে হল। দ্যুতিদীপা যে বাড়ির হাল ধরেছে এমন নয়। কিন্তু সপ্তাহে একবার এখানে আসার আগে একটা ফোন করে বিতনুর সব ওষুধ আছে নাকি ফুরিয়ে গেছে, এ খবরটুকু নেওয়ায়, স্বস্তি পেয়েছে সকলেই। দ্বিতীয়বার দেখার পর ঠাম্মা দ্যুতিদীপার চিবুকে হাত রেখে বলেছিলেন, “আহা, দেখতে যেন একেবারে গায়ত্রীরই মতো।” যাতে ঠাম্মার কর্ণগোচর হয়, তাই বিতনু পাশ থেকে জোরে জোরে বলেছিলেন, “ও কত ছোটো তুমি জানো ছোটোমাসি?”
-তা হোক না, যেন লক্ষ্মীঠাকুর। বলে, চিবুক থেকে আঙুল নামিয়ে নিজের ঠোঁটে চুমুর শব্দ করেছিলেন। এ বাড়িটি বিতনুর পৈতৃক বাসভূমি। ড্রয়িংরুমের সোজাসুজি যে ঘর, ওটাই বিতনুর বেডরুম, আর লেখার ঘরও। এখানে একদা বিতনু আর গায়ত্রীর যৌথযাপন ছিল। মাঝের ঘরটি ছিল অদ্বয়ের। আর একেবারে ডানহাতে একটু ভেতরের দিকে অ্যাটাচড বাথরুমওয়ালা ঘরটি বিতনুর বাবা-মায়ের। অদ্বয়ের শৈশবে তাঁরা দু’জনেই গত হয়েছিলেন একে একে। সে ঘরেই এখন বিতনুর ছোটোমাসি থাকেন। গায়ত্রীরা চলে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন ঘর দু’টো ফাঁকা পড়ে থাকত। আর বিতনু অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন যত্রতত্র। বোহেমিয়ানিজম বিতনুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল। সেই মানুষ হঠাৎ অ্যাকিউট প্যাংক্রিয়াটাইটিসে বড্ড বেশি দমে গেলেন যেন। এখন অনেকটা সময় ঘরে কাটান। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, বই পড়ে, লিখে, আর অবশ্যই দেশি-বিদেশি গান শুনে। প্রেস ক্লাবেও বলতে গেলে কদাচিৎ যান।

ধীমানের তিনতলায় ফ্ল্যাট, আর ফ্ল্যাটের একতলায় গ্যারাজের বড় অংশে পাকাপাকি অফিস। বিতনুর বাড়ি থেকে এসবের দূরত্ব মেরেকেটে চার কিলোমিটার। প্রায়শই রাতে ধীমান দ্যুতিদীপাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। অফিস থেকে বেরোতে দেরি হলে কিংবা গিরিশ মঞ্চে নাটক দেখে ফেরার পথে। সর্বত্র যে ধীমান সঙ্গে যায় এমন নয়, কিন্তু নটা বাজলেই ধীমান একবার ফোন করে জেনে নেয়, দ্যুতিদীপা কোথায় আছে, ঠিকমতো ফিরেছে কিনা। এই কনসার্ন দ্যুতিদীপার ভালো লাগে। কিন্তু তফাৎ এই যে, বিতনুর কনসার্ন যতটা প্রত্যাশাহীন, ধীমানের তা নয়। বিতনু ধীমানের মনোভাব বুঝতে পারেন। এইসব বাড়ি পৌঁছে দেওয়া যে উদ্দেশ্যহীন হতে পারে না, বিতনু তা বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু এই মেয়েটিকে বিতনু স্পষ্ট করে বুঝতে পারেন না। বোধ হয় এই প্রজন্মটাই একটু খাপছাড়া। কমিটমেন্টে এরা কি ভয় পায়? বাঁধা পড়তে চায় না কেন কিছুতেই? কলেজ থেকে অধ্যাপনা-জীবনে মেঘ তিনটি আলাদা আলাদা বান্ধবী নিয়ে বাবাকে দেখাতে এল। তাদের একজন আবার বয়সে অনেকটাই বড় ছিল। আপাতত এই তৃতীয় মেয়েটি, যে ডায়েটিশিয়ান, তার সঙ্গে প্রেমটা তিন বছর হল টিকে আছে। তবে মেঘ একেই বিয়ে করবে কিনা সে বিষয়ে ওর ঘনিষ্ঠতম মানুষ ওর মা-ও তেমন সুনিশ্চিত নন।

দ্যুতিদীপা রহিমাকে বাগানের গাছ থেকে দুটো কারিপাতার ডাল ছিঁড়ে আনতে বলে। তারপর মিটসেফ থেকে নিজেই একমুঠো বাদাম নিয়ে শুকনো কড়াইয়ে ছেড়ে এসে আবার সোফায় বসে। দশ মিনিটে রহিমা তিনজনের জন্যই চিঁড়ের পোলাও বানিয়ে নিয়ে আসে। দ্যুতিদীপা বিতনুর প্লেটের দিকে তাকায়।
-বাদামগুলো বেছে তুলে দিন ধীমানদাকে।
বাধ্য বালকের মতো বিতনু তাই করেন। দ্যুতিদীপা গলা উঁচু করে বলে,
-তুমিও নাও রহিমাদি।
যে গুটিকয় সন্ধেয় গায়ত্রীর সঙ্গে দ্যুতিদীপার দেখা হয়েছে, তা পরস্পরকে বোঝার পক্ষে যথেষ্ট নয়। রহিমা একবার গায়ত্রীকে বলেছিলেন, “জানো কাকী, দিদিটা খুব ভালো। মানুষের জন্য ওর প্রাণ কাঁদে।” গায়ত্রী মোটা সেলুলয়েডের চশমার ওপর দিয়ে দ্যুতিদীপার দিকে তাকিয়েছিলেন সাত-আট সেকেন্ড।

এ বাড়িটি বিতনুর পৈতৃক বাসভূমি। ড্রয়িংরুমের সোজাসুজি যে ঘর, ওটাই বিতনুর বেডরুম, আর লেখার ঘরও। এখানে একদা বিতনু আর গায়ত্রীর যৌথযাপন ছিল। মাঝের ঘরটি ছিল অদ্বয়ের। আর একেবারে ডানহাতে একটু ভেতরের দিকে অ্যাটাচড বাথরুমওয়ালা ঘরটি বিতনুর বাবা-মায়ের। অদ্বয়ের শৈশবে তাঁরা দু’জনেই গত হয়েছিলেন একে একে। সে ঘরেই এখন বিতনুর ছোটোমাসি থাকেন।

দ্যুতিদীপা খাবারের প্লেট হাতে করে সমস্ত ড্রয়িং আর ডাইনিং রুমে পায়চারি করতে থাকে। একটু যেন বিক্ষিপ্ত লাগছে তার। পড়ন্ত বিকেলের আলো মনে পড়ছে। এ আলো সে এই বাড়িতে আগে কক্ষনও দেখেনি। এ বাড়িতে সে কি ভোরের আলোও দেখেছে কখনও? গায়ত্রীর বসানো গাছপালাগুলোয় সকালের নরম আলো এসে পড়ে। রহিমার বর পেশায় ফুল বিক্রেতা। এখন এ বাগানে মালির কাজ করে সে-ই। গায়ত্রী যখন আসেন, সার-টার কিনে রহিমার কাছে রেখে যান। সেদ্ধভাত রেঁধে বাসন ধুয়ে রহিমা আর কুড়ি-পঁচিশ মিনিটে চলে যাবে। ধীমান না থাকলে কথাটা অনায়াসে বলা যেত বিতনুকে। দ্যুতিদীপার এ বাড়িতে সকাল দেখতে ইচ্ছে করছে আজ। কিন্তু খুব অনায়াস হত কি? বিতনু কী ভাবতেন?

-বুঝলে ধীমান, দ্যুতিদীপাকে কিন্তু সমস্ত পোশাকের মধ্যে শাড়িতেই সবচেয়ে সুন্দর লাগে।
একটা স্লিম ফিট নীল জিন্স আর ব্যাগি হলুদ টপ পরে দ্যুতিদীপা ঘরের মধ্যে ঘুরছে। পোহা খাচ্ছে, বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, ডিনার টেবিলে বড় একটা ফুলদানিতে কিছু গ্ল্যাডিওলি রাখা ছিল, সেখান থেকে অল্প শুকিয়ে যাওয়া দুটো ফুল তুলে ফেলে দিচ্ছে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে।
– আজ সুন্দর লাগছে না? দ্যুতিদীপা আহ্লাদে গলায় জানতে চায়।
-রোজই লাগে। শাড়ি পরলে আরও বেশি লাগে, তাই না ধীমান?
-ধীমানদা জানো, আজ বিতনুদাকে প্রথম পাঞ্জাবি পরতে দেখলাম। এই পাঞ্জাবিটা কার দেওয়া?
-ওমা, তুমি প্রথম দেখলে! ধীমান তুমি তো কতবার দেখেছ তাই না? এটা কত পুরনো পাঞ্জাবি!
ধীমান জানে, এর একটি কথাও আসলে তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে না। গত ছ’মাস যাবৎ চলতে থাকা এই বিচিত্র লীলায় সে যতটা নট, ততটাই দর্শক-শ্রোতা। রাতবিরেতে বউ আর মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে এসবের কিছু কিছু তার মনে পড়ে। বুকের একপাশে প্রথম-চল্লিশের যুবকের একটা হালকা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়। কিন্তু মাথার মধ্যে পাহাড়প্রমাণ দায়িত্বের ভিড়ে এসব ব্যথাবেদনাকে আমল দিলে চলে না। দ্যুতিদীপা আপ্রাণ চাইছে ধীমান উঠে যাক। বিতনুর আকাশি পাঞ্জাবির একটা বোতাম খোলা। খুব সামান্য রোম দেখা যাচ্ছে বুকে। মাথার চুল যতটা ধূসর, শরীরেরগুলো ততটা নয়।

বিশ্বের যাবতীয় মুগ্ধতার ঘোর নিমেষে ভেঙে দিতেই বোধ হয় মোবাইল ফোনের জন্ম হয়েছিল। বিতনুর ফোনে গায়ত্রীর ফোন আসে। ডাক্তারখানা থেকে নিরাপদে ফ্ল্যাটে ফেরার পৌঁছসংবাদ। চকিতে সেলফোন হাতে নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে যায় দ্যুতিদীপা। ওলা আর উবরে ভাড়া কম্পেয়ার করতে থাকে। থেকে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে সে প্রিমেন্সট্রুয়াল মুডসুইং হিসাবে ঝেড়ে ফেলতে চায়।

-চ, তোকে কিছুটা এগিয়ে দিই অটোয়।
-ক্যাব নিচ্ছি। খুব টায়ার্ড। চাপ নিও না ধীমানদা।
কোনাকুনি স্লিং ব্যাগ চাপিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে দ্যুতিদীপা। তার পিছন পিছন ধীমানও। সামান্য হতচকিত হয়ে বিতনু কেবল বলে উঠতে পারেন,
-সাবধানে যাও। আসলে তো ‘যেও না’ বলাই উচিত ছিল আজ। পারলেন কই? আজ থেকে পনেরো বছর আগেও পেরেছিলেন কি?
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

অবন্তিকা পাল। জন্ম ১৭ জুন ১৯৮৬, হাওড়া। কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জে.বি.রায়. স্টেট আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হসপিটাল থেকে আয়ুর্বেদ চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক। স্নাতকোত্তর স্তরে মনস্তত্ত্বের পাঠ দ্বিতীয় বর্ষে অসমাপ্ত থেকে গেছে। তবে লেখার পরিসরে সমাজবিজ্ঞান ও মানবাধিকার চর্চা অব্যাহত। কবিতার সঙ্গে নৈকট্য আশৈশব। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ২০১৩-তে। ২০১৭-এ প্রথম প্রবন্ধের বই। প্রথম সারির বাংলা দৈনিক, একাধিক জনপ্রিয় পত্রিকা ও ওয়েবম্যাগাজিনে তাঁর নিবন্ধ প্রকাশিত হয় নিয়মিতভাবে। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সময়ে কবি ফৈজ আহমেদ ফৈজ-এর সর্বজনবিদিত 'হম দেখেঙ্গে' (দেখে নেবো আমরাই) কবিতাটির বাংলা অনুবাদ করে অবন্তিকা জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যমেও জায়গা করে নিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *