মহারাজ স্নান সেরেছেন সকাল-সকাল।
শুভ্র বসনে আতর ছড়িয়ে দিয়েছে পারিষদেরা।
ক্রীড়াভূমিতে শান্ত বসলেন রাজন।

রাজ‌্য-সম্পদ বাজি ধরলে নিজেরই ক্ষতি,
ঘরের মানুষকে বাজি ধরলে নিন্দিত হতে হয়—
এ সব ইতিহাস বলেছে।
মহারাজ ইতিহাস মেনে চলেন।
ভূগোলও বোঝেন।
যতটুকু বুঝলে সীমানা-কাঁটাতার স্পষ্ট হয়।
ভূগোলের চেয়ে আরও ভাল বোঝেন অঙ্ক।
বিশেষ করে সমীকরণ।
প্রথম দান ফেলছেন রাজা।

বাজি ধরলেন— ‘মনুষ‌্যত্ব’।

ঘুঁটির ভেতর পোকা ভরে নিলে
খেলা সহজ হয়।
রাজন সে গল্প জানেন।
কিন্তু পোকারাও আজকাল বিশ্বাস ভাঙে।
হয়তো দেখা গেল, সময় মতো
ঠিক জায়গায় শরীর ওল্টালো না। তখন?
রাজা তাই পোকা ভরেন না।

তার চেয়ে বিরোধী অন্ধ হলে জিত নিশ্চিত।

জল্লাদ ডাকলেন মহারাজ।

‘চার’ হলেই কেল্লা ফতে!
কিন্তু ঘুঁটিরা বরাবর বেয়াদপ।
শরীর নেড়েচেড়ে তিন-এ গিয়ে আটকাল।
একটা ঘরের হিসেবে যে কত কী লণ্ডভণ্ড
রাজা তা জানেন বৈকি!
ক্রীড়াস্থল থেকে চোখ তুললেন নৃপতি।
অমাত‌্যরা অধোবদন।
বাজি-হারা ইতিহাস রেয়াত করেনি কখনও।
প্রজারা ভীত। মুদিত চোখ।
ইষ্টদেবতা স্মরণ করছে মনে-মনে।
শুধু রাজন অবিচল। স্মিত হাসি মুখে।

রাজা জ্ঞানী।
বোঝেন,
মনুষ‌্যত্ব দিলেও বাঁচে স্থাবর-অস্থাবরেরা
রাজকোষে টান পড়ে না।

আজ সকাল থেকই নৃপতির খেলায় মোটে মন নেই
বাজি হারার চোঁয়া ঢেকুর মাঝেমাঝেই জ্বালাচ্ছে।
রাজা ঠিক করলেন, হাওয়া বদলাবেন।
রাজধর্মে মৃগয়া অতি উত্তম ব‌্যায়াম।

নৃপতি নির্দেশে তৈরি হল দল।
রথ সাজল নিপুণ। ছক নির্ভুল।
রাজানুচরেরা অস্ত্র-বর্মে প্রস্তুত।
তামাদি মন খারাপ ঝেড়ে রথে উঠলেন রাজন।

ধুলো উড়িয়ে বনাঞ্চল—
সে অতি দীর্ঘ পথ। পৌঁছতে দিন কাবার।
বনাঞ্চল এত দূরে কেন? কার পরামর্শে?
মৃগয়ার পশুরাই-বা আজ এগিয়ে আসেনি কেন?
বিরোধী ষড়যন্ত্র নয় তো?
ফিরে গিয়ে খোঁজ নেবেন রাজন।
ক্রমে ধৈর্য‌্য হারাচ্ছেন তিনি।
(ধৈর্য‌্যচ‌্যুতি স্বাস্থ‌্যের জন‌্য ভাল নয়।)

অস্ত্র ওঠালেন মহারাজ।

জনপথ থেকেই তবে শিকার শুরু হোক।

রাজার শিকারের খবর ছড়িয়েছে চারপাশে।
হাড় গিলগিলে মরা প্রিয়জন নিয়ে
আজ রাজসভায় আসবে কেউ কেউ।
কারও মনে ভয়। কেউ সরাসরি প্রতিবাদী।
বিহিত করবেন নৃপতি নিজ কৃতকর্মের।

সংঘবদ্ধ জনতার কাছে সব রাজশক্তিই দুমড়ে যায়।
ইতিহাস এ কথা বলে।
রাজ‌্যবাসীও রাজার মতোই। ইতিহাস মানে।

মৃতের মিছিল পৌঁছল রাজদরবারে।
প্রবেশদ্বার আটকাল রক্ষী।

‘‘অন্ত‌্যেষ্টির জন‌্য যা প্রয়োজন
তা দেবেন রাজন,
সঙ্গে ক্ষতিপূরণ।
আর কী চাই?’’

‘‘বিচার।’’
উদ্ভ্রান্ত জনতার একজন আওয়াজ তুলল।
রক্ষী রাগত, তবু গোপন করল ক্রোধ
স্বজনহারাদের প্রতি দুর্ব‌্যবহার রাজা মোটে পছন্দ করেন না
শান্ত কণ্ঠে পাঠ করল রাজনির্দেশ: 

বিচার মিলবে,
যদি পরের বাজিতে যদি ‘বিচার’ সুরক্ষিত থাকে।

প্রজাদের ফিরে যাওয়া রাজা দেখেছেন বাতায়ন থেকে।
ক্ষতিপূরণের পরও বিচার কিসের!
এই ভাবনাই অশান্ত রেখেছে তাঁকে।
প্রাজ্ঞ রাজা বোঝেন,
প্রজাদের এসব নির্বোধ-দাবিই আদতে রাজকার্যে বাধা।

তবে তিনি প্রজাবৎসল, তাই বিষয়টা এড়িয়ে গেলেন না।
মন দিলেন ছকে। এবার বাজি জিততেই হবে।
‘বিচার’ রক্ষা পেলে, ‘বিচার’ হবে।

প্রজাদের।

রাজন শেষ চাল দিয়েছেন।
এবারে খুব মেপে।
যত রকম কৌশল হাতের তালু জানে
সে সবই প্রয়োগ হয়েছে।
ঘুঁটিও বিট্রে করেনি।
পারিষদেরা খুশি। আহ্লাদিত অমাত‌্যগণ।
মহারাজ কেবল স্থিতধী।
পুরান-পুরুষের মতো অবিচল তাঁর মেধা।
আসলে, রাজন জানেন,

‘শ্রীকৃষ্ণ’ হাতে এলে ‘অক্ষৌহিণী’-র জন‌্য রণনীতি সাজায় নাবালকে।

পেশায় সাংবাদিক ও বাচিক শিল্পী। লেখালেখি করেন একাধিক বাংলা পত্র পত্রিকায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'জলপাই অরণ্যের পারে'।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *