কোরক বসুর কণ্ঠে এই ফিচারটির পডকাস্ট শুনতে হলে ক্লিক করুন

সত্তরের দশক – সে এক উত্তাল সময়। আমি আর আমার স্বামী সাংবাদিক শংকর ঘোষ তখন লেক রোডে একটা ভাড়াবাড়িতে থাকি। নকশালবাড়ি আন্দোলনের ঢেউ তখন তোলপাড় তুলেছে ছাত্র সম্প্রদায়ের মধ্যে। রাজনীতি সম্পর্কে আমার সে রকম জ্ঞানগম্যি না থাকলেও বুঝতাম এই আন্দোলনের প্রতি শংকরের একটা পরোক্ষ সমর্থন আছে। নিয়মিত সাংবাদিকতার পাশাপাশি প্রথমে সমর সেনের ‘Now’ এবং পরে ‘Frontier’ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। এছাড়াও তখন উনি টাইমস অফ ইন্ডিয়া কাগজের কলকাতা প্রতিনিধি। প্রায় প্রতিদিন তখন ঐ কাগজের প্রথম পাতায় খবরের শিরোনামে কলকাতা ও তার আশেপাশের নকশাল আন্দোলনের খবর থাকতো যার সবটাই কলকাতা ব্যুরো থেকে শংকরের পাঠানো।  

আমাদের বিয়ের আগে শংকর থাকতেন পাইকপাড়ায়। ওখানে থাকার সময়ে নকশাল দলে নাম লেখানো জনৈক আত্মীয়কে বেশ কিছুদিন আশ্রয় দিয়েছিলেন শংকর। ছেলেটি প্রেসিডেন্সি কলেজের মেধাবী ছাত্র। ওই কলেজের নকশাল নেতা, ‘কাকা’ নামে পরিচিত অসীম চট্টোপাধ্যায়ের অন্যতম বিশ্বস্ত শাগরেদ ছিল সে। কী ভাবে সে এই আন্দোলনে জড়িয়ে গিয়েছিল, তা অবশ্য আমার জানা নেই। বুদ্ধিমান, মেধাবী এই ছাত্রটিকে শংকর অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাই পুলিশ যখন ছেলেটির পেছনে ফেউ লাগায়, তখন উনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিজের বাড়িতে ওকে কিছুদিন রেখে দেন এই আশায়, যে এক সর্বভারতীয় কাগজের সাংবাদিকের বাড়িতে হয়তো পুলিশ তৎক্ষণাৎ হানা দেওয়ার কথা ভাববে না এবং ওর পক্ষে নিরাপদ হবে। পরে অবশ্য ছেলেটি অন্য জায়গা থেকে গ্রেফতার হয়।

এ দিকে, সেই সব দিনে জেলে আটক নকশাল বন্দিদের উপর অত্যাচার ও সাজানো পুলিশ এনকাউন্টারে একেবারে কাঁচা বয়সের ছেলেপুলেদের মৃত্যু ছিল রোজকার ঘটনা। কাজেই ছেলেটি গ্রেফতার হবার পর তাকে নিয়ে পরিবারের তো বটেই, শংকরের মনেও আশঙ্কা ছিল। পেশার কারণে কলকাতার পুলিশ মহলে শঙ্করের শুধু যে যথেষ্ট পরিচিতি ছিল তাই নয়, কারও কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে সুসম্পর্কও ছিল। সেই সময়ে গোয়েন্দা দফতরের প্রধান ছিলেন বিষ্ণু বাগচি। এই দুঁদে প্রবীণ অফিসার শংকরকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন। অবস্থা বেগতিক দেখে শংকর তাঁর শরণাপন্ন হলেন। ছেলেটি তাঁর আত্মীয় ও বিশেষ স্নেহভাজন, এই কথা বলে আর্জি রাখলেন বিষ্ণুবাবুর কাছে। উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, ছেলেটিকে পুলিশের বড়োকর্তার নজরে আনা… পুলিশি অত্যাচার যদি কোনও ভাবে একটু ঠেকানো যায়! শংকরের কথা শুনে বিষ্ণুবাবু হেসে উঠলেন। বললেন, “ওর বিরুদ্ধে তো সাংঘাতিক অভিযোগ!” সেটা কী? না, আমেরিকার তৎকালীন কুখ্যাত প্রতিরক্ষামন্ত্রী ম্যাকনামারার তখন কলকাতা আসার কথা। শংকরের পরিচিত সেই ছেলেটি ও তার দলবলের নাকি পরিকল্পনা ছিল, বোমা মেরে ম্যাকনামারার গাড়ি উড়িয়ে দেওয়ার। সব শুনে শংকর নিশ্চুপ। কথাপ্রসঙ্গে কৌতুক করে বিষ্ণুবাবু এটাও আভাস দিয়েছিলেন যে শংকরের বাড়িতে ছেলেটির আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাও তাঁর অজানা নয়। এসব খবর সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে আছে কী নেই তা নিয়ে শংকরেরও অবশ্য কোনও মাথা ব্যথা ছিল না। তবে শংকরের এই সুপারিশে কাজ হয়েছিল। ছেলেটির ওপরে সে বার তেমন কোন শারীরিক পীড়ন হয়নি বলেই শুনেছি।      

চারু মজুমদারের বিশ্বস্ত সহযোগী, নকশাল নেতা সরোজ দত্ত সম্পর্কে শংকরের মামা হতেন। সংসারের দায় সামলাতে এম এ ক্লাসে ভর্তি না হয়ে শংকরকে চাকরিতে ঢুকতে হয়েছিল। অমৃতবাজার পত্রিকায় যখন উনি প্রুফরিডার হিসেবে কর্মরত, সরোজমামা তখন ওই পত্রিকারই চিফ সাব এডিটর। কিছু দিন পরে শংকর ওই চাকরি ছেড়ে হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে যোগ দেন। কিন্তু মামা-ভাগ্নের যোগাযোগ অটুট ছিল। ইতিমধ্যে কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক হিসেবে সরোজমামার বেশ খ্যাতি হয়েছে। কলেজ জীবন থেকেই থেকেই ওঁর কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ। ষাটের দশকে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙন ধরলে সরোজমামা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-তে যোগ দেন। কিন্তু দলের অন্তর্বিরোধের কারণে চারু মজুমদার ও আরও কয়েকজনের সঙ্গে তিনিও পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন। পরবর্তীকালে সিপিআই (এমএল) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেই উদ্যোগে চারু মজুমদার, অসিত সেন প্রমুখ নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে অন্যতম নাম ছিলেন সরোজ দত্ত।

এই নতুন গড়ে ওঠা পার্টির খবরাখবর সংক্রান্ত ব্যাপারে সাংবাদিক হিসেবে শংকরের আগ্রহ কিন্তু কিছু কম ছিল না! দু’জনের মধ্যে যোগাযোগ তো ছিলই। পার্টির জন্য টাকা তোলার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝেই সরোজ দত্ত ভাগ্নের কাছে দূত পাঠাতেন। সঙ্গে থাকত ওঁদের কাগজ ‘দেশব্রতী’র কিছু সংখ্যা। শুধু শংকর নন, কলকাতার বাছাই করা কিছু কাগজের লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন ছিল ওঁদের, যাতে দলের বক্তব্য সঠিক ভাবে কাগজে বেরোয়, আন্দোলনের প্রচার হয়।

আমি তখন সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষিকা। এই সময়ে হঠাৎ একদিন সকালে সরোজমামা আমাদের লেক রোডের বাড়িতে হাজির হলেন। সেই আমার প্রথম দেখা ওঁর সঙ্গে। জানলাম উনিই সেই ‘সরোজ মামা’। সেদিন কী কারণে আমার স্কুল ছুটি ছিল। আমার সঙ্গে বিশেষ কথা হল না। মামা-ভাগ্নের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আমি উপস্থিত ছিলাম না। দু’কাপ চা ঘরে দিয়ে এসেছিলাম। বেশিক্ষণ থাকেননি সেদিন।

কিছুদিন বাদে একদিন রাত আটটা নাগাদ দরজার ঘন্টি বেজে উঠল। দরজা খুলতে দেখি সরোজমামা। হাতে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তখনও শংকরের অফিস থেকে ফেরার সময় হয়নি। ইতিমধ্যে টাইমস ছেড়ে, শংকর আবার তাঁর পুরনো কর্মস্থল হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে যোগ দিয়েছেন। সরোজমামা ঘরে ঢুকে বললেন, ‘আজ কিন্তু তোমাদের বাড়িতে রাতটা কাটাব।’ তত দিনে অবশ্য আমার ওঁর ব্যাপারে কথা সব জানা হয়ে গেছে। উনি যে এরকম হঠাৎ এসে থেকে যেতে পারেন, সে কথাও শংকর আমাকে বলে রেখেছিলেন। সরোজমামা বললেন, স্নান করে একটু বিশ্রাম করবেন। রাতের খাওয়া যেন একটু দেরি করে দিই। শংকরের জামাকাপড় ওঁকে পরার জন্য দেব কিনা জানতে চাইলে, আমাকে ব্যস্ত হতে বারণ করলেন।

চানের শেষে দেখলাম গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরেছেন। লম্বা প্যান্টের নিচে লুঙ্গি গুটিয়ে পরে থাকতেন। চা দিলাম। একটু কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ‘হুঁ’ বা ‘না’ ছাড়া আর কোনও সাড়া পেলাম না। টেবিলে যখন খেতে বসলেন, তখনও কেমন অন্যমনস্ক। শুতে যাবার আগে জানিয়ে দিলেন ভোরের আলো ফুটলেই চলে যাবেন। শংকর বাড়ি ফিরে ওঁর ঘরে গিয়ে দেখলেন, তখনও চেয়ারে বসে কী লিখছেন। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি স্নানটান সেরে প্যান্ট বুশশার্ট পরে তৈরি। ঘড়িতে তখনও ছটা বাজেনি। এক কাপ চা, দু’টো বিস্কুট খেয়ে চলে গেলেন। বললেন শংকরকে ঘুম থেকে ডাকার দরকার নেই।

শংকরের কড়া নির্দেশ ছিল সরোজমামার আসা যাওয়া নিয়ে কোনও কথা কারও সঙ্গে, এমনকি আত্মীয়দের সঙ্গেও যেন আলোচনা না করি। এর পর থেকে সকালে আসা বন্ধ হয়ে গেল। রাত আটটা-সাড়ে আটটা নাগাদ আসতেন। পরদিন ভোর না-হতে চলে যেতেন। শংকরের সঙ্গে যে প্রতিবার দেখা হত, তা নয়। এক এক সময়ে ভয় হত, যদি কোনওদিন পুলিশ হানা দেয়! সরোজমামাকে ধরে নিয়ে যায়!

প্রথম প্রথম আট-দশ দিন অন্তর আসতেন। পরে সে ব্যবধান কমে দু’তিন দিনে দাঁড়িয়েছিল। কোনও কোনও দিন শংকরের জন্য অপেক্ষা করতেন। আবার ক্লান্ত থাকলে শুয়ে পড়তেন। ধীরে ধীরে বরফ গলছিল। লেখাপড়ার কাজ না থাকলে আমার সঙ্গে গল্প করতেন। প্রথম দিকের অপরিচয়ের আড়ষ্টতা কিছুদিনের মধ্যেই কেটে গিয়েছিল।আগেই বলেছি প্রথম দিকে সরোজমামার কোনও দিকে নজর থাকতো না। পাতে যা পড়ত, খেয়ে নিতেন। রান্না সম্পর্কে কোনও মন্তব্য নয়। কোনও পদ আর একবার চেয়ে খাওয়া তো নয়ই। ক্রমে এটা কেটে গিয়েছিল। আমার হাতের রান্না পছন্দ হলে তারিয়ে তারিয়ে খেতেন। আর একবার দিতে চাইলে না করতেন না। ওঁকে তৃপ্তি করে খেতে দেখে আমারও খুব ভাল লাগতো।

সন্ধ্যেবেলায় চা খেতে খেতে আমার সঙ্গে যে কথা হত, তাতে রাজনীতি প্রায় থাকতই না। সরোজমামা ওঁর সাংবাদিক জীবনের কথা, বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার গল্প বলতেন। কবে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সুরেশচন্দ্র মজুমদার ওঁকে সেই প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিতে চেয়েছিলেন, একবার কী করে একটি পয়সাও খরচ না করে কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন, এসব নানা গল্প শুনতাম ওঁর মুখে। এসবের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে দু’একটি কথা বলতেন, যাতে তিনি যে রাজনীতি করতেন তার সাফল্য সম্পর্কে, কৃষি বিপ্লবের অনিবার্যতা সম্পর্কে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ পেত।

এর মধ্যে কখনও আমার বাপের বাড়ির কথা, দাদা-দিদির কথা, আমার পড়াশোনা নিয়ে জানতে চাইতেন।আমার বাবা একজন চিকিৎসক শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন কোনওদিন হয়তো তাঁকে ওঁদের প্রয়োজন হবে।আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি ফার্স্ট এড্‌টা শিখে নাও তো! শিগ্‌গির আমাদের মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠবে। সেখানে গণফৌজের আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তোমার ফার্স্ট এড্‌ জানা থাকলে খুব কাজে লাগবে।’ তখন নকশালদের ওপরে অকথ্য পুলিশি অত্যাচার চলছে, নেতারা ধরা পড়ছেন। তবু কী অটুট বিশ্বাস তাঁদের আন্দোলনের সার্থকতা নিয়ে!

রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ভাঙার স্বপক্ষে যতই পার্টির কাগজে কড়া কড়া কথা লিখুন না কেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কে সরোজমামার ভালবাসা কিন্তু মরে যায়নি। মনে পড়ে আমার রেকর্ডের সংগ্রহ থেকে ওঁর পছন্দের গান বাছাই করে দিচ্ছেন আর রেকর্ডপ্লেয়ার বাজিয়ে দু’জনে সে গান শুনছি। কথা প্রসঙ্গে যেদিন জানলেন আমি দক্ষিণীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছি, আমাকে গান গেয়ে শোনাতে বললেন।

২০১৮ সালে কস্তুরী বসু ও মিতালি বিশ্বাস সরোজকে নিয়ে তৈরি করেছিলেন তথ্যচিত্র – S.D – Saroj Dutta and his Time. ভিডিও ট্রেলার সৌজন্যে – youtube.com

অনেক সময়েই বইয়ের তাক থেকে বই টেনে নিয়ে পড়তেন।বার্টান্ড রাসেলের দুই ভল্যুমের আত্মজীবনীটি সরোজমামার খুব প্রিয় ছিল। ধরা পড়ার কয়েকদিন আগে আমার কাছ থেকে বই দু’টি নিয়ে গিয়েছিলেন। এর আগে অন্য বই নিয়ে গিয়ে ফেরত দিয়েছেন। কিন্তু ওদু’টো আর ফেরত দিতে পারেননি। এ বই দু’টো শংকরের  জন্মদিনে আমি উপহার দিয়েছিলাম, তাই বইতে শংকরের নাম লেখা ছিল। সরোজমামা বই নেবার সময়ে পেন দিয়ে নামটা কেটে দিলেন, যাতে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলে আমরা বিপদে না পড়ি। সরোজমামা হয়তো জানতেন না যে ওঁর সব খবরই কলকাতা পুলিশের নখদর্পণে। আর তার প্রমাণও পাওয়া গেল কিছুদিনের মধ্যেই।

পুলিশের এক বড়কর্তা নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলন ডাকলেন। স্বরাষ্ট্র দফতরের তাবড় তাবড় অফিসারেরাও সেখানে উপস্থিত। নেতাদের ধরপাকড় নিয়ে কথা হচ্ছে। হঠাৎই সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে স্বরাষ্ট্রসচিব একটু কৌতুকের সুরে বলে উঠলেন, ‘আমাদের কাছে খবর আছে, কলকাতার বেশ কিছু বাঘা বাঘা সাংবাদিকদের সঙ্গে নকশাল নেতাদের যোগাযোগ আছে। কেউ কেউতো আবার নিজের বাড়িতেই তাঁদের আশ্রয় দিচ্ছেন।’ শংকর ভাবলেশহীন মুখে শুনে গেলেন কোনও প্রতিক্রিয়া না দিয়ে।

এর কিছুদিন পরের ঘটনা। ১৯৭১-এর আগস্টের প্রথম সপ্তাহ। আমি সন্ধ্যের সময় একা বাড়িতে বসে খাতা দেখছি। মনটা সেদিন খুব খারাপ। দিনকয়েক আগে আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্টার রাখাল নাহা হাওড়াতে নকশালদের হাতে খুন হয়েছিলেন। এ নিয়ে কাগজে খুব হৈচৈ হয়। দিল্লি থেকে ইন্দিরা গান্ধী শোকবার্তা পাঠান। সন্ধেবেলা সরোজমামা আসার পর আমি তাঁকে রাখাল নাহার ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করি। সরোজমামা বলেন তিনি ঘটনাটি জানেন না। তবে সব খতমের ঘটনার পরেই পার্টি থেকে তদন্ত হয়। এটিরও হবে। অকারণ খতমের জন্য পার্টি থেকে শাস্তি হয়। আমি তখন ওঁকে নিজের ভয়ের কথা বললাম। বললাম, ‘শংকরকেও তো নকশালরা পুলিশের লোক মনে করে যে কোনও দিন খুন করে দিতে পারে! তারপরে পার্টি যদি তদন্ত করে দেখে, যে খুনটা ভুল করে হয়ে গেছে, তখন হত্যাকারীর নয় শাস্তি হবে। কিন্তু যে চলে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না!’

সরোজমামা আমাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন সেদিন। কিন্তু কোনও ফল হয়নি। আমি ওঁর কথা মানতে চাইনি। শংকর বাড়ি ফিরে আমার কাছে সব শুনে মুখ গম্ভীর করে সরোজমামার ঘরে গিয়ে বললেন, ‘তুমি ওর কথায় কিছু মনে কোরও না মামা। রাখালের ঘটনাটায় ও এত আপসেট হয়ে আছে যে হয়তো অনুচিত কথা বলে ফেলেছে।’ সরোজমামা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘না আমি কিছুই মনে করিনি। পেটি বুর্জোয়া তো, ওরা তো ও রকম ভাববেই।’

ওই দিনটা ছিল আমাদের বাড়িতে ওঁর শেষ দিন। পরদিন সকালে চলে যাওয়ার সময়ে ওঁর ভাগ্নেও উঠে পড়েছিলেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দু’তিনদিন বাদে আসব।’ আর আসেননি। শেষ দিনে ওঁর সঙ্গে ওই ভাবে কথা কাটাকাটি হওয়ার দুঃখটা তাই আজও ভুলিনি।

কয়েকদিন বাদে স্টেটস্‌ম্যান-এর প্রাক্তন সাংবাদিক ও নকশাল নেতা ভবানী চৌধুরী এসে শংকরকে বললেন, ‘আপনার সরোজমামা গ্রেপ্তার হয়েছেন কি না জেনে দিতে পারবেন? আমাদের সন্দেহ পুলিশ ওঁকে মেরে ফেলেছে। কারণ ওঁর গ্রেফতারির খবরটা পুলিশ কিছুতেই স্বীকার করছে না।’

খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল খবর সত্যি। কেন যে সে দিন সরোজমামা আমাদের বাড়ি না-এসে রাজা বসন্তরায় রোডে তাঁর পরিচিত এক অধ্যাপকের বাড়িতে থাকতে গিয়েছিলেন, সে কথা জানতে পারিনি। ৫ আগস্ট ভোররাতে সরোজমামা ও সেই অধ্যাপককে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পরে অধ্যাপককে ছেড়ে দিলেও, ওঁকে ছাড়েনি। গ্রেফতার হওয়ার সময় সরোজমামা নাকি নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন বীরেন চৌধুরী বলে।কিন্তু পুলিশ তাঁকে ঠিকই চিনে নিয়েছিল।

শোনা যায়, উত্তমকুমার নাকি একবার ময়দানে প্রাতঃর্ভ্রমণ করতে গিয়ে দেখেছিলেন, পুলিশ একজনকে গুলি করে খুন করছে। অনিচ্ছাকৃত ভাবে পুলিশের এই কুকর্মের সাক্ষী হয়ে যাওয়ায় তিনি ভয়ে কলকাতা ছেড়ে বেশ কিছু দিনের জন্য মুম্বই চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সম্ভবত সেই ব্যক্তিই ছিলেন সরোজমামা। পরে শংকর এবং বরুণ সেনগুপ্ত ওই অধ্যাপকের বাড়িতে গিয়েছিলেন। হত্যা সম্বন্ধে রিপোর্টও বের করেছিলেন নিজের নিজের কাগজে। কিন্তু এ নিয়ে কোনও তদন্ত হয়নি। আজ পর্যন্ত সরোজমামার মৃত্যুরহস্য যেমন কে তেমনই থেকে গিয়েছে।

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।

5 Responses

  1. অসাধারণ একটি লেখা ! নকশাল আন্দোলন নিয়ে সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে। ৭০ দশক, সরোজ দত্ত, ব্যক্তিগত স্তরে সম্পর্ক ও ভাবনা, সবকিছু মিলেমিশে অথচ স্বাতন্ত্র বজায় রেখেই একাকার যেখানে। লেখাটির আরেকটি গুন – এর সাবলীল গতি ও ঝরঝরে গদ্য। শুভেচ্ছা রইল লেকিকাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *