আমার নাচের হাতেখড়ি এই মানুষটির কাছে। আমরা বলতাম ‘মাসিমা।’ শ্রীমতী অমলাশঙ্কর। আজ প্রয়াত হলেন।
শতায়ু এই নৃত্যশিল্পী বেঁচে থাকবেন তাঁর কাজের মধ্যে, তাঁর শিল্পশৈলির মাধ্যমে।
সেই কোন ছেলেবেলায় আমার মা আমাকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়ান কালচার সেন্টারে। কতই বা বয়স আমার তখন। সাড়ে চার-পাঁচ হবে। তখন এই প্রতিষ্ঠানের ক্লাস হত লেক গার্লস স্কুলের চার তলায়। আমার বাড়ি থেকে হাঁটাপথ। সারা সপ্তাহ তাকিয়ে থাকতাম রোববারের সকালের দিকে। ভরতনাট্যম, কথাকলি, মণিপুরী, ধ্রুপদী নৃত্যশৈলির বিভিন্ন মাধ্যমে তালিম নিতে হত। যে ক্লাসটির জন্য আমি মুখিয়ে থাকতাম, তা হল মাসিমার ক্লাস। মানে অমলাশঙ্করের ক্লাস।

ছেলেবেলা থেকেই আমার একটা বদভ্যাস ছিল। নিজের ক্লাস শেষ হয়ে গেলেও বড়োদের নাচ দেখতাম বসে। তখনই দেখেছিলাম অনেক বড়ো বড়ো দিদিরা গোল করে হাঁটত, মাসিমার ক্লাসে। শুধুই হাঁটা। সঙ্গে মিউজিক। আর অমলাশঙ্কর চেয়ারে বসে তাল দিতেন, প্রয়োজনে মন্তব্য করতেন। মাঝে মাঝে নিজে উঠে দেখিয়ে দিতেন। প্রচলিত অর্থে সুন্দরী হয়তো তাঁকে বলা যাবে না, কিন্তু কী সুঠাম দীর্ঘ চেহারা! দিদিদের যখন মুভমেন্ট দেখাতেন, হাতের ভঙ্গিমায়, পশ্চারে কী যে লাবণ্য! তাল, লয়, ছন্দ পেরিয়ে এ এক ম্যাজিক ফ্যাকটর। প্রথম দিকে দিদিদের গোল করে হাঁটতে দেখে ভাবতাম এ কেমন নাচ! ওঁকে বলতে শুনেছিলাম, “প্রতিটি চলার মুহূর্ত হয়ে ওঠা চাই লীলায়িত, ছন্দোময়, মাধুর্য্যমণ্ডিত। তবেই তা শিল্প হয়ে ওঠে।” এ যে কত দামি কথা, পরে বুঝেছি। আজও কানে বাজে সেই কথা।

আর আমরা যারা ছোটর দল, তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল এক মজার ক্লাস, আমার প্রিয় ক্লাস। আমাদের পুরো গ্রুপকে ছোট ছোট কয়েকটা দলে ভাগ করে ক্লাসের বাইরে যেতে বলতেন। মিউজিক বাজত। হ্যাঁ, ক্লাস হত লাইভ মিউজিকের সঙ্গে। সেতার, বাঁশি, তবলা, পাখোয়াজ সব থাকত। গর্জাস একটা ব্যাপার। আমাদের এক একটা দলের কাজ ছিল মিউজিকের সঙ্গে নাচ বানানো। প্রতিটি দলের নাচ তিনি মন দিয়ে দেখতেন, বিশ্লেষণ করতেন, কী ভেবে করেছি জিজ্ঞেস করতেন, কী ভাবে আরও সুন্দর করা যায় দেখিয়ে দিতেন। নিজের অজান্তেই কোরিওগ্রাফি, মিউজিক, ক্রিয়েটিভিটির একটা দুর্দান্ত বীজ বপণ হয়ে যেত সেই ছোট্ট বয়সেই। খেলতে খেলতে শেখা হয়ে যেত বিরাট এক শৈলির অ-আ-ক-খ। একেই বলে সহজপাঠ।

নাচের মাঝে ব্রেক টাইমে দেশবিদেশের অভিজ্ঞতার গল্প করতেন। চলা-বলা, হাঁটা-দাঁড়ানো সবেতেই তাঁর অসামান্য এক ব্যক্তিত্ব। পাতাকাটা স্টাইলে চুল বাঁধা, পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন পরিধান। সেই ছোটবেলাতেই এখানে শিখেছিলাম হাত জোড় করে সবাইকে নমস্কার করতে। শিখেছিলাম নিয়মানুবর্তিতা, সময়জ্ঞান। আর শিখেছিলাম নাচকে ভালোবাসতে। বড়ো হয়ে বুঝতে পেরেছি, সেই শিশুবয়সে যে বোধের বীজ বপণ করেছিলেন মাসিমা, তা হল Dance should be one’s way of life.
সাংবাদিক, প্রশিক্ষিত নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যসমালোচক। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন সানন্দা পত্রিকা। যদিও কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল দর্শনের অধ্যাপনা দিয়ে। পরে প্রাণের তাগিদে সাংবাদিকতাকেই পাকাপাকি ভাবে বেছে নেন। অবসর নেওয়ার পরও তুমুল ব্যস্ত। রান্নাবান্না, বেড়ানো, সাজগোজ নিয়ে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতেই থাকে। ভালোবাসেন বই পড়তে, ভালো সিনেমা দেখতে আর খাওয়াতে। নিবিড় ভাবে বিশ্বাস করেন ভালো থাকায়, জীবনের রোম্যান্টিকতায়।
Sharmila Basuthakur is an extremely erudite and talented woman.
The passing away of a legend but a legacy which remains immortal.
সুন্দর লাগলো পড়ে