বেশ কয়েকটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে — সালটা খুব সম্ভবত ২০১৬।

এই ক’বছরের মধ্যে পৃথিবীর বড় শহরগুলোর পরিবহন ব্যবস্থায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। চালু হয়েছে অ্যাপ ক্যাব। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ধবধবে পরিষ্কার ট্যাক্সি জায়গা মতো চলে আসছে, ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে। জিপিএস আসার ফলে গন্তব্য খুঁজে পাওয়া খুব সহজ হয়ে গিয়েছে। অবশ্যই নিজের সুবিধার জন্য ভুলে যাচ্ছি, আমাদের শহরের ট্রাফিকে আরও অতিরিক্ত গাড়ি যোগ হলে এরপর আর কোথাও যাতায়াত করাই মুশকিল হয়ে যাবেএমনিতেই বেশির ভাগ সময় ট্রাফিকে কাটে। এই সব কথা ভাবি না, বুঝি না এমন নয়। কিন্তু চামড়া ঝলসানো গরমে একটা এসি-যুক্ত পরিষ্কার ট্যাক্সি… শারীরিক স্বস্তির কাছে হার মেনে যায় আইডিয়ালিজম। সে যাই হোক, এই ট্যাক্সিচালকদের অনেকেই প্রথম গাড়ি চালাচ্ছে। কারওর সেটাই প্রথম মাস, কারও সঞ্চয় করা টাকা বা ধার নিয়ে কেনা নিজের গাড়িকী মমতা গাড়িটার ওপর! প্রাণপাত পরিশ্রম করা মানুষের গল্প শুনতে শুনতে কেটে যায় রাস্তা। 

আমার মায়ের এখন হাঁটাচলা করতে অসুবিধা হয়। ব্যাংকে নিয়ে গিয়েছি, মায়ের হাতে লাঠি। রাস্তা পার হয়ে ট্যাক্সিতে উঠতে সময় লাগল। ড্রাইভার বাইরে বেরিয়ে এসে রাস্তার দিকে একটু আড়াল করে দাঁড়ালেন যাতে মা যথেষ্ট সময় পায়। আমি ট্যাক্সিতে বসে বললাম,  “মা দেখেছ তো লাঠি নিয়ে বেরলে কত সুবিধা হয়, লোকজন কিন্তু খেয়াল করেআশপাশ দিয়ে হাঁটার সময় সাবধানে স্পিড কমিয়ে নেয়।লাঠির উপযোগিতার সেই কথোপকথনে খুব অনায়াসে ঢুকে গেলেন আমাদের ওলাচালক। তিনি জীবনের অনেকটা সময় বাস চালিয়েছেন, তার গল্প শুরু করলেন। 

জানেন দিদি, দূর থেকে দেখে মালুম হয়ে যেত বাসস্টপে যারা দাঁড়িয়ে আছেন, তাদের কার কতটা সময় লাগবে বাসে উঠতে। কেউ দৌড়ে ধরে নেবে। কেউ কিছুক্ষণ না দাঁড়ালে পারবে না… আরে দিদি সামনে লোক রাস্তা পার হলে সেও আন্দাজ করে নিতে হয়, কত সময় নিতে পারে — সেই বুঝে স্পিড কমিয়ে বাড়িয়ে নিতাম। আর মানুষটা যদি প্রতিবন্ধী হয় তাহলে তো অবশ্যই! যদি দেখি ক্রাচ নিয়ে কি লাঠি নিয়ে হাঁটছে…” 

এবার মা আর আমি দু’জনেই মানুষটার দিকে মনোযোগ দিলাম।

আপনি কি কলকাতার না অন্য কোনও জায়গা থেকে?”

বিহার থেকে আসা মিথিলেশ পান্ডে বলতে লাগলেন নিজের পরিবারের কথা…। দুই ছেলেমেয়ে বি.কম পাশ করে গেছে। মেয়ে এম.কম পড়ছে। ছেলে চাকরি পেয়েছে। ছোট ছেলে, তার কোনও এক অজ্ঞাত নার্ভের অসুখ, পায়ে কোনও জোর নেই। ছোটবেলা থেকে নানা জায়গায় চিকিৎসা, সুদীর্ঘ ফিজিওথেরাপি করেও তেমন কোনও ফল হয়নি|খুব কষ্ট হয় কিন্তু তাও সেই ছেলে হাঁটে এবং এখন হাইস্কুলে যায়। তবে বড় হয়ে যাচ্ছে, এখন সে আর চায় না মা-বাবা তার সঙ্গে স্কুলে যাক। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন উনি। তারপর বললেন, মা জি, কী জানেন বড্ড কষ্ট হয় যখন লেংচাতে লেংচাতে স্কুলে যায়। নিচু ক্লাসে অন্য বাচ্চারা খুব পেছনে লাগত।

মনে হল আমাদের দু’জনেরই মুখে কিছু বলার আগেই, ভেতর থেকে উঠে আসা শুভ ইচ্ছেরা ঠেলাঠেলি করে বলে উঠল দু’রকম ভাবে, একই কথা — ও পান্ডেজি, কিছু চিন্তা করবেন না, দেখবেন ছেলে আপনার কলেজে যাবে, চাকরি পাবে। খুব ভালো হবে।

এখন তো শুনেছি গভর্নমেন্ট থেকে অনেক সুবিধা দেয়।মা বলল।

হামি তো কিছু সুবিধেই পেলাম না মা জি…ওদের মধ্যে কথা হতে থাকল। ছেলের ভবিষ্যতে কী করার ইচ্ছেকলকাতার রাস্তায় ক্রাচ নিয়ে চলাফেরা কত অসুবিধে। কিন্তু ছেলে এখন সাহায্য করতে চাইলে রেগে যায়… ইত্যাদি ইত্যাদি। 

আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। গলার ঠিক নিচে আটকে যাওয়া জায়গাটাতে জমতে থাকল কথাগুলো,  “কী করে বলুন তো পান্ডেজি, সন্তানদের কিছু না থাকাটা আমাদের বাবা মাদের  চোখগুলোকেই এ ভাবে বদলে দেয়? একজোড়া চোখ দশজোড়া হয়ে নিমেষে স্ক্যান করে বের করে ফেলতে পারে কোন বাচ্চাটা কষ্টে আছে?”

আবার একদিন, চলেছি এক আত্মীয়ের বাড়িএদিনেরটা হলুদ-কালো ট্যাক্সি। ড্রাইভারের সঙ্গে তেমন কোনও বাক্যবিনিময় হয়নি, কারণ উনি মাঝরাস্তায় রাস্তা আটকে অন্য ট্যাক্সি ড্রাইভারকে প্যাসেঞ্জার তুলতে দেখে বেশ বিরক্ত এবং গজগজ করে চলেছেন স্ট্যান্ড থেকে তোলার নিয়ম, তাও সমানে মাঝরাস্তায় লোক তুলছে। কী করা যাবে? যার বিবেকে যা আছে সে তো সেটাই করবে!” এঁকে মনে হল বেশ আদর্শবাদী। পেছন থেকে দেখছি… স্টিয়ারিংয়ে রাখা হাত, পরিশ্রমী একজন বেশ শক্তসমর্থ বয়স্ক মানুষের। কিছুক্ষণ বাদে আমার মোবাইলে একটা ফোন এল। এক দাদার। তার সঙ্গে অনেকদিন বাদে কথা হল। তার সংসার, মেয়ে, কাজ, সমস্যা এই সমস্ত কিছু আপডেট করতে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই ফোনালাপ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হল। তার কিছুক্ষণ বাদে প্রশ্নটা এল,দিদি আপনি বাইরে থাকেন, তাই না?”

আগে হলে এই কলকাতায় না থাকার প্রশ্নটা একটু বিব্রত করত। কিন্তু এখন নিয়মিত একা যাতায়াত করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। তাই বললাম,হ্যাঁ।

কোথায়?”

আমেরিকা।” 

পরের প্রশ্নটাতে বেশ কৌতূহল ফুটে উঠল — সেটা কত দূর?”

কিলোমিটার মাইল ইত্যাদি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। হল কিনা জানি না। পরের প্রশ্ন।  “তো দাদা আর বাচ্চারা সঙ্গে আসেননি?” বুঝলাম আমার সাম্প্রতিক ফোনালাপটা উনি যথেষ্ট মন দিয়ে শুনেছেন এবং সেটা গোপন করার কোনও ইচ্ছেও নেই। প্রাইভেসি, স্পেস, আর সচেতন উদাসীনতা ভরা জগতে অভ্যস্ত আমার মিইয়ে থাকা মনটাতে একটা ঝরঝরে খোলা হাওয়া পাঠিয়ে দিল কেউ। 

না দাদা। এই বাবা-মা, শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে দেখতে এসেছি, সবাই মিলে আসতে পারি না সবসময়, অনেক দূর। প্লেন ভাড়া অনেক।” 

কতক্ষণ লাগে?” চিন্তিত প্রশ্ন। 

তা ধরুন আঠেরো থেকে চব্বিশ ঘন্টা।

একটু স্তব্ধতা। 

ঠিক আছেএই ম্যায়কা ,সুসুরাল এখানেও তো আসতে হবে দিদি। সবদিকেই তো দেখতে হবে…যেন নিজেকেই বোঝাচ্ছেন মনে হল। তো বাচ্চেলোগ আর দাদা কি খাচ্ছেন? রসোই করতে পারেন দাদা?”

আমার মনে এবার ঘনিয়ে আসছে হাসি। বোঝার চেষ্টা করছি কোনদিকে যাচ্ছে এই কনভার্সেশন।

ওই একটু আধটু পারে। আমরা যারা ওখান থেকে আসি, অনেক সময় পারলে রান্না করে ডিপ ফ্রিজে রেখে আসি।একটু থেমে বললাম ওখানকার ডিপ ফ্রিজ খুব ভালো দাদাছোট ছোট বাক্সে খাবার রেখে এলে বার করে শুধু গরম করে নিলে, একদম ঠিক থাকে।” 

এইবার গাড়ির ভেতরটা একদম নিস্তব্ধ। এতটাই, যে বাইরের ব্যস্ত ট্রাফিকের আওয়াজ হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। আচমকা গাড়ির জানলা খুলে দিলে যেমন হয়। আমি সামান্য উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওঁর মাথার পিছন দিকে। কী হল ব্যাপারটাচিন্তা দানা বাঁধার আগেই খুব সিরিয়াস গলায় ভেসে এল,  “দিদি আপনাকে না একটা বাত বলছি, খুব ধেয়ান করুন। আপনি না দাদাকে বাসি খানা খাওয়াবেন না!” ওঁর গলায় পরিষ্কার আশঙ্কা বাসি খানা সেহত কে লিয়ে বহোত হানিকারক হোতা হ্যায়!”

আমি খাবার ফ্রিজ করার নিয়মকানুন নিয়ে কোনও কথা বলার আগেই আবার ধেয়ে এল বাক্যবাণ — না না দিদি, দাদাকে সিদাসাদা খানা দিতে হবে, কিন্তু ডেলি পকাতে হবে।

আমার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। আধঘণ্টার পরিচয়ে কয়েক হাজার মাইল দূরে থাকা, আমার না দেখা পরিবারের জন্য এরকম চিন্তা প্রকাশ করা, আমার দীর্ঘদিনের তথাকথিত ভদ্র সুপারফিশিয়াল ঠান্ডা নাগরিক সৌজন্যবোধের ওপর সমুদ্রের খোলা, নোনতা, খরখরে তাজা হাওয়া বইয়ে দিল।  

না। জানি গল্পগুলো মোটেই গোলাপি বা আকাশি নয়। প্রচণ্ড তাড়া বা ক্লান্তিকর দিনের শেষে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের অকারণ রিফিউজাল সহ্য করেছি হাজারবাররাত হয়ে যাবার বা অন্য অজুহাতে অতিরিক্ত টাকার আবদারও। তাই আমি জানি এই পুরো ছবিটা আমাদের সকলের বাকি জীবনের মতোই ধূসর। সেই ধূসরের মধ্যে মিশে থাকে হাজার রং। মানুষই তো মেশায় রং… সবসময়ই। রাগ, আশাভঙ্গ, সাহায্য, সহৃদয়তা, ঘৃণার লাল নীল হলুদরা মিশে যায় ওই ধূসরে। প্রত্যেকদিন। 

সেই রকম ধূসর শীতের ক্লান্ত বিকেলবেলা… কখনও কখনও বাড়ি ফেরার পথে, আমার প্রায় ঘুম নেমে আসা চেতনায় গুলিয়ে যায় স্থান, কালহঠাৎ ভেসে ওঠে একটা সহাস্য মুখ… স্টিয়ারিং থেকে পিছন ফিরে ড্রাইভার তার চার মাসের মেয়ের ছবি দেখাচ্ছে মোবাইলে, আমি না চাইতেই। বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে শহর, তার মধ্যে চায়না টাউনে চাইনিজ চামড়ার ব্যবসায়ী পরিবারের ড্রাইভার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা আমার উবরচালক শোনাচ্ছেন কলকাতার লেদার ইন্ডাস্ট্রির, এই শহরে থাকা  একটা প্রায় অচেনা কমিউনিটির জীবনযাত্রা, উত্থানের গল্প। খুলে যাচ্ছে আমার শহরের মাঝখানে একটা অন্য অচেনা পৃথিবীআমি হাজার হাজার মাইল দূরে বরফ মেশানো বৃষ্টির পর্দায় ঢেকে যেতে যেতে যেন শুনতে পাই গল্পের গুনগুনানি। 

সামনে দীর্ঘ লাল টেল লাইটের মিছিল। ধূসর মিশে যায় প্রায় আবছা অন্ধকারে। আমার খুব খিদে পায়, মনে হয় এই পথটার  শেষে মা যদি বসে থাকত খাবার নিয়ে।

আধো-স্বচ্ছ জলের ফোঁটাওলা উইন্ডস্ক্রিনে ওয়াইপার চলে। একবার ঝাপসা, একবার রাস্তা, আবার ঝাপসা! আমার মনে হতে থাকে, আচ্ছা কেমন হয়, হঠাৎ যদি দূরে ছোটবেলায় বাইরে থেকে কলকাতা ফেরার সময় ওই দৈত্যাকার ব্রিজটা দেখতে পাই?

জন্ম, বড় হয়ে ওঠা কলকাতায়। গত একুশ বছর ম্যাসাচুসেটস,আমেরিকা প্রবাসী। বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক। এখন পর্যন্ত লেখা বেরিয়েছে ওয়েব ম্যাগাজিন পরবাসে এবং আনন্দবাজারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *